ফিরোজ মান্না : নির্দোষ হয়েও ব্রিটেনে বাংলাদেশী এক পাচক বা শেফ ১৬ বছর ধরে মামলা লড়ে যাচ্ছেন। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে সাইফুল ইসলাম ব্রিটেনের কার্ডিফে গিয়েছেন এক রেস্তরাঁয় কাজ করতে। বাংলাদেশের পটুয়াখালীর বাসিন্দা ৪৪ বছর বয়স্ক সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের পুলিশ ভুলে যৌন অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করে। এই অভিযোগে তাকে ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করার নিদের্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সাইফুল ইসলাম এই আদেশের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই শুরু করেন। এখন পর্যন্ত এই মামলার কোন সুরাহা হয়নি। তবে হোম অফিস তার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে। তার পক্ষে দেশটির কয়েক আইনজীবী সহযোগিতা দিচ্ছেন। ব্রিটেনে এটা নজিরবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন আইনজীবীরা।
ব্রিটেন থেকে সাইফুল ইসলাম টেলিফোনে জানান, পুলিশ যে ভুল করেছে ব্রিটেনের প্রসিকিউশন তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এর পর মামলাটি চলমান রেখেছে কর্তৃপক্ষ। সরকারী দফতরে থাকা তার কাগজপত্র কোনভাবে মিশে গিয়েছিল অন্য তিনজন লোকের সঙ্গে। তার ফলে কোন দোষ না করেও আমাকে অপরাধী করা হয়। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা ‘হোম অফিস’ ইতোমধ্যেই এ ভুলের জন্য আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর পরও তাকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার অধিকার দেয়া হচ্ছে না। আমি যুক্তরাজ্যে থাকার জন্য ১৬ বছর ধরে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। এ সমস্যার শুরু ২০০৫ সালে। তখনকার কর্মস্থল ছিল যে রেস্তরাঁয় তার পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। পরে পুলিশ এবং হোম অফিস বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে বছরই তার পারমিটের মেয়াদ কমিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাকে কোন নোটিস দেয়া হয়নি।
সম্প্রতি সাইফুল ইসলামকে নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী ফিজা কুরেশি বলেন, সাইফুল যদি ১৬ বছর ধরে মামলা লড়ে না যেতেন তাহলে তার জানাই হতো না যে হোম অফিস তার কাগজপত্র গুলিয়ে ফেলেছে এবং তাকে ভুলভাবে একজন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ সাইফুল যেভাবে তার নিয়োগদাতার শোষণ সম্পর্কে খবর দিয়েছে তার প্রশংসা করতেও ব্যর্থ হয়েছে। তা না করে উল্টো তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে ও তাকে বহিষ্কার করতে চাইছে। যদিও সে সাহসী ও নির্দোষ।
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সাইফুলের বিষয়ে তথ্য কমিশনারের মাধ্যমে তার ফাইল দেখার সুযোগ পান এবং তাতে ভুলও ধরা পড়ে। ২০১৯ সালে তার কাছে এজন্য পূর্ণভাবে দুঃখপ্রকাশ করা হয়। হোম অফিস আমাকে মানুষ বলে মনে করেনি। তারা এমন আচরণ করেছে যেন আমি একজন অপরাধী। আমি এ জন্য অনেক বছর হারিয়েছি, আমার স্বাস্থ্য ও অর্থ হারিয়েছি। এ জন্য তিনি মানসিক বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এ সংক্রান্ত এক বিচারবিভাগীয় পুনর্বিবেচনার রায়ে বলা হয় ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য সাইফুল ইসলামের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে ভিত্তি ছিল ২০০৮ সালের একটি প্রত্যাখ্যাত আবেদন। কারণ, সে সময় তার কোন ওয়ার্ক পারমিট ছিল না। হোম অফিসের ভুলের ওপর কোন প্রভাব ফেলেনি।
সাইফুল ইসলাম বলছেন, ২০০৮ সালে তার কোন ওয়ার্ক পারমিট না থাকার কয়েকটি কারণ ছিল। একটি হচ্ছে তাকে ভুলভাবে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা। তা ছাড়া তার ফাইলের কিছু অংশ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে এবং অন্য একটি মামলায় তা আদালতে উত্থাপন করা হয়নি। তিনি যে আইনসঙ্গতভাবে ব্রিটেনে প্রবেশ করেছিলেন তার প্রমাণ হিসেবে তার পাসপোর্টের প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠাগুলোও আদালতকে দেয়া হয়নি। এরপর বিচারপতি জ্যাকসন রুলিং দেন যে, সাইফুল ইসলামের আবেদনের ক্ষেত্রে অতীতে কিছু ভুল ও অবিচার করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোই তার বর্তমান অবস্থার কারণ বলে সাইফুল ইসলাম যে দাবি করছেন তা দলিলপত্রে প্রমাণ হয় না। রুলিংয়ে আরও বলা হয়, এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই যে তাকে কোন একটি বিশেষ পদে নিযুক্ত রাখা এখনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সাইফুল ইসলাম জনান, তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ের পরিকল্পনা করছেন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১৮টি মামলা এবং হোম অফিসের বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে। হোম অফিস বলছে, তারা কোন চলমান আইনী প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করবে না। তবে তারা এটা নিশ্চিত করেছে যে সাইফুল ইসলামের বিবরণের সঙ্গে অন্য তিনজন লোকের বিবরণ ‘ভুলক্রমে’ যুক্ত হয়ে গেছে। হোম অফিস আরও বলেছে যে, ব্রিটেনে বসবাসের প্রতিটি আবেদনই স্বতন্ত্রভাবে অভিবাসন আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা হয়, এবং কারো এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি না থাকলে এটাই আশা করা হয় তিনি স্বেচ্ছায় চলে যাবেন। যদি তা না করেন তাহলে এদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে। এমন এক পরিস্থিতিতে এই বাংলাদেশী নাগরিক দেশটিতে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।