আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য : ব্রিটেনে বাংলাদেশি এক শেফ (রাঁধুনি) সাইফুল ইসলামের জীবন সংগ্রামের কাহিনি সিনেমাকেও হার মানায়! এই সংগ্রামের কাহিনি ব্রিটেনের বিবিসি, গার্ডিয়ান ইত্যাদি মূলধারার পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। নির্দোষ হয়েও ১৭ বছর ধরে মামলা লড়ে যাচ্ছেন ব্রিটেনের হোম অফিসের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ আইন প্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রায় প্রতিদিনই পার্লামেন্টের সামনে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে মাইক নিয়ে নিজের প্রতি সুবিচারের জন্য চিৎকার করে যাচ্ছেন! হোম অফিস তাদের ভুল স্বীকার করেছে, সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছে এবং ৬ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছে। সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি এই দেশে এসেছিলাম পূর্ণ যৌবনে, আমার জীবন থেকে যৌবনের সোনালি এক অধ্যায় ১৭ বছর হারিয়েছে হোম অফিসের ভুলের কারণে, ৬ হাজার পাউন্ড দিয়ে কি সেই ১৭ বছরের হারানো জীবনের তুলনা হয়? বাংলাদেশের পটুয়াখালীর বাসিন্দা ৪৪ বছর বয়সী সাইফুল ইসলামকে পুলিশ ভুলে যৌন অপরাধের জন্য অপরাধী বলায় ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সাইফুল ইসলাম এই আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেন। এখন পর্যন্ত এই মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। তবে হোম অফিস তার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে। তার পক্ষে দেশটির কয়েক আইনজীবী সহযোগিতা দিচ্ছেন। ব্রিটেনে এটা নজিরবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন আইনজীবীরা। ২০০২ সালের নভেম্বরে তিনি স্ট্রাফোর্ডশায়ারে একটি থাই-ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় আসেন ওয়ার্ক পারমিটে। ২০০৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ওয়ার্ক পারমিট পান। ২০০৫ সালেই এই রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে আধুনিক দাসত্ব আরোপের অভিযোগ করেন হোম অফিসে। সাইফুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হোম অফিস এনফোর্সমেন্ট ওই রেস্তোরাঁয় হানা দেয় কিন্তু রেস্তোরাঁ মালিকের ওপর কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে দেয়! কিন্তু সেই নোটিস তিনি পাননি। এরপর থেকেই শুরু হয় নানা বিড়ম্বনার! হোম অফিসের পরামর্শেই তিনি নতুন আরেক রেস্টুরেন্ট থেকে ওয়ার্ক পারমিট নেন। আবেদন করেন, সেটি মঞ্জুরও হয়। বিপত্তি বাধে যখন তিনি ইন্ডিফিনিট লিভ টু রিমেইনের জন্য আবেদন করেন তখন! সে সময় হোম অফিস তাকে একজন ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গকারী হিসেবে দায়ী করে। এই আইনি লড়াইয়ের মধ্যেই ঘটে আরেক বিপত্তি। সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকারি দফতরে থাকা তার কাগজপত্র কোনোভাবে মিশে গিয়েছিল অন্য তিনজন লোকের সঙ্গে। যাদের একজন ছিলেন সেক্স অফেন্ডার। তার ফলে কোনো দোষ না করেও আমাকে সেক্স অফেন্ডার হিসেবে অপরাধী করা হয়। পুলিশ যে ভুল করেছে ব্রিটেনের প্রসিকিউশন তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এরপর মামলাটি চলমান রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা ‘হোম অফিস’ ইতিমধ্যেই এ ভুলের জন্য আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর পরও তাকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। আমি যুক্তরাজ্যে থাকার জন্য ১৭ বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি সাইফুল ইসলামকে নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিবাসীদের অধিকার-সংক্রান্ত নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী ফিজা কুরেশি বলেন, সাইফুল যদি ১৭ বছর ধরে মামলা লড়ে না যেতেন তাহলে তার জানাই হতো না যে হোম অফিস তার কাগজপত্র গুলিয়ে ফেলেছে এবং তাকে ভুলভাবে একজন অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ সাইফুল যেভাবে তার নিয়োগদাতার শোষণ সম্পর্কে খবর দিয়েছে তার প্রশংসা করতেও ব্যর্থ হয়েছে। তা না করে উল্টো তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে ও তাকে বহিষ্কার করতে চাইছে। যদিও সে সাহসী ও নির্দোষ। বিবিসির ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সাইফুলের বিষয়ে তথ্য কমিশনারের মাধ্যমে তার ফাইল দেখার সুযোগ পান এবং তাতে ভুলও ধরা পড়ে। ২০১৯ সালে তার কাছে এজন্য পূর্ণভাবে দুঃখ প্রকাশ করা হয়।

সাইফুল ইসলাম বলেন, হোম অফিস আমাকে মানুষ বলে মনে করেনি। তারা এমন আচরণ করেছে যেন আমি একজন অপরাধী। আমি এ জন্য অনেক বছর হারিয়েছি, আমার স্বাস্থ্য ও অর্থ হারিয়েছি। এ জন্য তিনি মানসিক বিষণœতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এ-সংক্রান্ত এক বিচার বিভাগীয় পুনর্বিবেচনার রায়ে বলা হয়, ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য সাইফুল ইসলামের আবেদন প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে ভিত্তি ছিল ২০০৮ সালের একটি প্রত্যাখ্যাত আবেদন। কারণ, সে সময় তার কোনো ওয়ার্ক পারমিট ছিল না। হোম অফিসের ভুল তার সিদ্ধান্তের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। সাইফুল ইসলাম বলছেন, ২০০৮ সালে তার কোনো ওয়ার্ক পারমিট না থাকার কয়েকটি কারণ ছিল। একটি হচ্ছে তাকে ভুলভাবে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা। তা ছাড়া তার ফাইলের কিছু অংশ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে এবং অন্য একটি মামলায় তা আদালতে উত্থাপন করা হয়নি। তিনি যে আইনসঙ্গতভাবে ব্রিটেনে প্রবেশ করেছিলেন তার প্রমাণ হিসেবে তার পাসপোর্টের প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠাগুলোও আদালতকে দেওয়া হয়নি। এরপর বিচারপতি জ্যাকসন রুলিং দেন যে, সাইফুল ইসলামের আবেদনের ক্ষেত্রে অতীতে কিছু ভুল ও অবিচার করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোই তার বর্তমান অবস্থার কারণ বলে সাইফুল ইসলাম যে দাবি করছেন তা দলিলপত্রে প্রমাণ হয় না। রুলিংয়ে আরও বলা হয়, এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই যে তাকে কোনো একটি বিশেষ পদে নিযুক্ত রাখার এখনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধ আইনি লড়াইয়ের পরিকল্পনা করছেন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১৮টি মামলা এবং হোম অফিসের বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে। হোম অফিস বলছে, তারা কোনো চলমান আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করবে না। তবে তারা এটা নিশ্চিত করেছে যে, সাইফুল ইসলামের বিবরণের সঙ্গে অন্য তিনজন লোকের বিবরণ ‘ভুলক্রমে’ যুক্ত হয়ে গেছে। হোম অফিস আরও বলেছে যে, ব্রিটেনে বসবাসের প্রতিটি আবেদনই স্বতন্ত্রভাবে অভিবাসন আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা হয় এবং কারও এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি না থাকলে এটাই আশা করা হয় তিনি স্বেচ্ছায় চলে যাবেন। যদি তা না করেন তাহলে এ দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে। এমন এক পরিস্থিতিতে এই বাংলাদেশি নাগরিক দেশটিতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।