কামাল কাদের : আগামীকাল ফরহাদের চাটার্ড একাউন্টেন্সির ফাইনাল পরীক্ষা। এটা তার শেষ সুযোগ। এবার পাস্ না করতে পারলে সে “অটোমোশনে” পড়ে যাবে, অর্থাৎ পুনরায় আর পরীক্ষা দিতে পারবে না। আগের যে দুটো পার্ট পাস করেছে সে গুলি ভেস্তে যাবে, ওই পাস্ করা সমস্ত সাব্জেক্টগুলির কোনো মূল্য থাকবে না। ফরহাদ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র নয়, আবার খারাপ ছাত্রও নয়। জীবনে ফেল করে নাই। ওর কাল হয়েছে ওই ফাইনাল পার্ট পরীক্ষাটা নিয়ে। পর পর তিনবার ফেল করার পর এটাই ওর “লাস্ট চান্স”। পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালোই হয়, কিন্তু পরীক্ষা আরম্ভ হবার দু-তিনদিন আগে থেকে সে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে পড়ে। বিলেতের প্রবাস জীবনে অফিসের হাড়-ভাঙা খেটে পড়াশুনা করা সহজ কাজ নয়। তবুও এই প্রবাসে জানা শুনা সবাই এ ভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছে এবং পাস্ ও করছে। ফরহাদ কেন পারবে না? এ প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই তার মনে সারা জাগায়। ম্যানচেস্টার থেকে ফাইনাল সাবজেক্টের (পার্ট থ্রি) উপর চার সপ্তাহের একটা “ইনটেনসিভ কোর্স” করে এসেছে। এতে একটা মোটা অংকের পাউন্ড খরচা হয়েছে। সে ভাবে এবার পরীক্ষার বেড়াজাল পার হয়ে যেতে পারলে এ ত্যাগ কিছুই না।

ফরহাদের আজও মনে পরে তার ঢাকার ছাত্র জীবনের কথা। বিলেতে যাবে, ডিগ্রী নেবে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে নিজের ফার্ম খুলে প্রাকটিস শুরু করবে। কত আশা, কত রঙিন কল্পনা ছিল, এখন যা অবস্থা, তাতে মনে হয়, এ যেন গুড়েবালি হতে চলেছে। এবার যে করে হোক তাকে পরীক্ষায় পাস করতেই হবে।

ফরহাদের বউ রোকেয়া এ বছর দেশে যেতে চেয়েছিলো, ওর বাবা মা, আত্মীয় স্বজনদের দেখবে বলে। প্রায় সাত বছর দেশ ছাড়া টাকার অভাবে দেশে যাওয়া হলো না। অবশ্য ফরহাদের কোর্সের জন্য যে মোটা অংকের ফিস দিয়েছে, তা থেকে অনায়াসে রোকেয়া ঢাকা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারতো। ফরহাদ অনেক বার রোকেয়াকে বলেছে, “না, আমি কোনো কোর্স করতে যাবো না, তুমি বরং দেশ থেকে ঘুরে আসো। আত্মীয় স্বজনদের কাছে পেলে আনন্দ পাবে, তার সাথে মনটাও ভালো লাগবে। তাছাড়া এমন কি গ্যারান্টি আছে যে, আমি কোর্সটি করলে পাস্ করে যাবো। সব বার প্রস্তুতি তো ভালোই হয়, কিন্তু কি জানি পরীক্ষার হলে গিয়ে মাথা মুন্ডু সব গুলিয়ে ফেলি। হয়তো অজানা আশংকায় নার্ভাস হয়ে পড়ি”।

ফরহাদের এ সমস্ত কথা রোকেয়া মোটেই শুনতে রাজী নয়, বলে, “সারাদিন অফিসের কাজ করে আর কি মনোযোগ দিয়ে ভালোভাবে লেখাপড়া করা যায়! তুমি ইনটেনসিভ কোর্সটিতে যোগ দিলে কিছুটা ফুল টাইম স্টাডির সুযোগ পাবে এবং অন্যান্য সহপাঠীদের সাথে মিলে মিশে পরীক্ষার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারবে, মানে “নেট ওয়ার্কিং” করতে পারবে। ঐ তো তোমার বন্ধু শরীফ, মাহমুদ, মনসুর, সালাম ওরা সবাই তো কোর্সে যোগ দিয়েছিলো। আবার পাসও করে গেছে। তুমি কেন পারবে না। ও সমস্ত বাজে চিন্তা মন থেকে দূর করে দিয়ে কোর্সটিতে জয়েন করে ফেলো”। একটু দম নিয়ে রোকেয়া আবার বলে, “তুমি পাস্ করে গেলে আমি দেশে প্রতি বছরই হলিডে করতে যেতে পারবো”। এ কথায় ফরহাদের আর কিছুই বলার থাকে না।

পরীক্ষার দিন সকাল বেলায় ফরহাদ হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করার জন্য টেবিলে বসলো। নাস্তা খেতে খেতে সে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে, হয়তো আসন্ন পরীক্ষার আশঙ্কায়। আনমনে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই ফরহাদ দেখলো আকাশটা মেঘে ভীষণ কালো হয়ে উঠেছে, যে কোনো সময়ে বৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। রাস্তায় এক ঝাঁক পায়রা একটা “গ্রোসারি” দোকানের আশে পাশে ঘুর ঘুর করছে, খাবারের খোঁজে। ফরহাদের চোখে পড়লো ওই ঝাঁকের মাঝে একটা পায়রা খোঁড়া। খুব কষ্ট করে খোঁড়া পা-টাকে মাটির সাথে টেনে টেনে হাটছে, আর ওদের সাথে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। পথচারীরা সামনে এসে পড়লে অন্যান্য পায়রাগুলো উড়ে চলে যায়, আবার ফিরে আসে। কিন্তু সেই খোঁড়া পায়রাটি যেখানে ছিল সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, সে উড়ে যায় না। হয়তো পায়রাটি ভাবে এমন করে বেঁচে থাকার চাইতে কোথাও উড়ে পালিয়ে না যাওয়াই ভালো। বিকট শব্দ করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে সব পায়রাগুলো উড়ে চলে গেলো সামনের দোতালা বাড়ির ছাদের আঙিনায়, আর ঐ খোঁড়া পায়রাটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে সামনের দিকে এগুচ্ছে, কোথায় যাবে হয়তো সে নিজেই জানে না।

“কি গো, তুমি এখনো তোমার ব্রেকফাস্ট শেষ করোনি আটটা যে বাজে” রোকেয়ার ডাকে ফরহাদের ঐ করুণ দৃশ্য দেখার ছেদ পড়ল। ফরহাদ কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। তারপর কফির কাপ থেকে শেষ চুমুক দিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো।

পরীক্ষার “সিট্” পড়েছে উডগ্রীন টিউব স্টেশনের পাশে “আলেকজান্ডার প্যালেস” নামে এক হলে। সাহেবরা হলটিকে আদর করে বলে “এলে-পেলে”। ফরহাদের বাসা থেকে ডাবল ডেকার বাসে করে সোজা আলেকজান্ডার প্যালেসে যাওয়া যায়। আন্ডার গ্রাউন্ড টিউব হয়ে গেলে অনেক ঘুরে-ফিরে যেতে হবে। তাই ফরহাদ বাসে যাওয়ায় মনস্থির করলো।

এই দুর্যোগ এবং প্রতিক‚ল আবহাওয়ার মাঝে ও বাসটি সময় মতো এলো। ডাবল ডেকের বাস, ফরহাদ দোতলার উপর এসে বসলো। আলতো চোখে বাসের ভিতরে চারিদিকে চেয়ে দেখলো তার মতো আরো কয়েকজন পরীক্ষার্থী বাসটিতে রয়েছে। কেউ কেউ শেষবারের মতো নোট বইয়ের মধ্যে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। বাসটি নির্ধারিত জায়গায় আধঘন্টার ভিতর পৌঁছার কথা। হঠাৎ বাসটি ঘটাং করে এক অস্বাভাবিক শব্দ করে থেমে গেলো, আর সবাই একে অপরের গায়ে হুর মুড়িয়ে পড়লো। তারপর বাসটি প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলো সামনের এক বাড়ির দেয়ালে। ফরহাদ নিজেকে সামলে নিয়ে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো একজন মোটর সাইকেল আরোহী তার সাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে ব্যথায় মাটিতে ছটফট করছে, আর তার সাথে রক্তের বন্যায় পিচ ঢালা রাস্তাখানি ভিজে যাচ্ছে। ক্ষনিকের মধ্যে পুলিশ, এম্বুলেন্স এবং ফায়ার ব্রিগেডের লোক এসে হাজির। পুলিশ বাসের ভিতরে ঢুকে যাত্রীদের খবরাখবর নিচ্ছে, কারো কোনো আঘাত বা অন্য কোনো অসুবিধা হলো কিনা তা দেখার জন্য! কিন্তু, আশ্চর্য, কারো কোনো বিরাট রকমের আঘাত লাগেনি। এভাবে প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেলো। পরে পুলিশ বাসের সব যাত্রীকে অন্য একটা উডগ্রীনগামী বাসে চড়িয়ে দিলো। ভাগ্যিস, কিছুটা সময় নিয়ে আগেই বেরিয়েছিল ফরহাদ। তাই পরীক্ষা শুরু হবার আগেই পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে পারলো।

ঢং ঢং করে পরীক্ষার হল ঘরের দেয়াল ঘড়িটা দশটা বাজার সংকেত ঘোষণা করলো। পরীক্ষার পরিদর্শক প্রশ্ন পত্র দিয়ে গেলো। দুরু দুরু বুকে ফরহাদ প্রশ্ন পত্রের উপর চোখ বুলালো। মোট প্রশ্ন সংখ্যা নয়টি। পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ফরহাদের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো, কারণ সবগুলি প্রশ্নের উত্তর তার জানা। কোন প্রশ্নের উত্তর আগে দেবে সেটা ভাবছে, এমন সময় তার মাথার পিছন দিকটা ব্যথায় কন কন করে উঠলো, হাত দিয়ে অনুভব করলো জায়গাটায় আলুর মতো ফুলে উঠেছে, মনে হলো তুল তুলে এক পাকা আম। পথের দুর্ঘটনার সময়ে ফরহাদের মাথায় বাসের এক রডের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো তখন সে কোনো খেয়াল করে নাই। এখন সে ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ব্যাথাটা আস্তে আস্তে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো, আরো আরো, তারপর ফরহাদের কোনো হুশ রইলোনা। যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো, তখন সে দেখতে পেলো এক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে।

দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্ণ হয়েছে। বেডের সামনে বসে রোকেয়া এবং তার প্রাণ-প্রিয় বন্ধু নবী ব্যাকুল চিত্তে তার দিকে চেয়ে আছে।

ফরহাদ ভাবছে আজ সকাল বেলার দেখা ঐ পা ভাংগা পায়রাটির মত বেঁচে থেকে লাভ কি? রোকেয়া, নবী আরো ওদের মত প্রিয় লোকজন তাকে মরতে দিতে চায় না। নবী, ফরহাদের হাতে হাত রেখে বললো, “বন্ধু, পৃথিবীটা এখানেই শেষ নয়, এখনো তোমাকে অনেক কিছু করার আর দেবার আছে এই পৃথিবীতে। সুখ, দুঃখ নিয়েই তো জীবন”। বন্ধুর কথাগুলি শুনার পর ফরহাদের দু চোখ বেয়ে অশ্রæ ঝরতে লাগলো, ভাবছে তার এ দুঃখের শেষ কোথায়? শেষ
ই-মেইল : quadersheikh@gmail.com