জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।
ঊনিশ.
বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবর্দি উপজেলা; ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলা, নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুর ও কমলাকান্দা উপজেলা এবং সুনামগঞ্জ জেলার সদর উপজেলা, ধরমপাশা, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও দোয়ারা উপজেলায় অধিকাংশ হাজংরা বসবাস করেন। তাছাড়াও গাজীপুর, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, মির্জাপুর, সখিপুর ও ভালুকা উপজেলায় বেশ কিছু সংখ্যক হাজং বসবাস করছেন।
১৯৯১ সালে আদমশুমারীর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে হাজংদের সংখ্যা ছিল ১১,৪৭৭ জন। কারো কারো মতে এ দেশে হাজংদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। তবে হাজং নেতৃবৃন্দ মনে করেন, বাংলাদেশে হাজংদের বর্তমান সংখ্যা প্রায় ১৩,৫০০ জন। আদিবাসী প্রতিনিধিদের বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, চারটি হাজং জেলায় ১০৪ টি গ্রামে প্রায় ১৫,০০০ হাজংয়ের বসবাস। তবে অবাক করার মত বিষয় হল: হাজং অধ্যুষিত ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার একটি গ্রামেও আর হাজংদের বসবাস নেই। বেশির ভাগ হাজং গ্রামে ২০-৩০টি করে হাজং পরিবার রয়েছে। বেলতৈল, নয়নকান্দি ও ঘিলাগড়া গ্রামের প্রত্যেকটিতে ৬০ টির অধিক করে হাজং পরিবার রয়েছে। শিক্ষার অভাব, অর্থের অভাব এবং ব্যবসাবাণিজ্যে অমনোযোগিতা ইত্যাদি কারণে শহরে হাজংদের বসবাস কম লক্ষ করা যায়। প্রায় ৩০০ হাজং ঢাকা শহরে লেখাপড়া ও কর্মরত রয়েছে।
ভাষা: হাজংদের নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের নিজেদের কোন বর্ণমালা নেই। আসামের অহমিয়া ভাষার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। হাজংরা তাদের ভাষা বাংলা হরফের মাধ্যমেই প্রকাশ করেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলের হাজংদের কাছ থেকে জানা যায়, হাজং ভাষা তিব্বতি বর্মী ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরবর্তীকালে তা মূলরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
পরিবার: পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা বিদ্যমান। পিতার অবর্তমানে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য সংসারের দায়ভার গ্রহণ করেন। বর্তমানে একক পরিবার বেশি গড়ে উঠছে এখন।
উত্তরাধিকার: পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে হাজং সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্র সন্তানই বিবেচিত হন। পুত্র সন্তানরা সবাই সমানভাবে সম্পত্তির মালিক হন। হাজং সমাজে দত্তক ব্যবস্থা রয়েছে, দত্তককে বলা হয় ‘পুঙা’। নিয়মানুযায়ী দত্তক সন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন ।
বাসস্থান: হাজংরা তাদের নিজেদের বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে গুছিয়ে রাখেন। প্রত্যেক হাজং পরিবারে সাধারণত ৪টি ঘর থাকে। তাছাড়া দেব দেবীর পূজা আর্চণা করার জন্য একটি ছোট ঘরও থাকে। ডাঙ্গর ঘরে বা বড় ঘরে বাড়ির প্রধান কর্তা বাস করেন। এ ঘরে অন্য কারো প্রবেশের পূর্বে অনুমতির প্রয়োজন হয়। গোয়াল ঘরে গরু থাকে। কাছারি ঘরে ছেলে-মেয়েরা খেলাধূলা করে। এককালে বাঁশ-বেত, শন, খড়, ইত্যাদি দিয়ে ঘর নির্মাণ করলেও বর্তমানে হাজংরা টিন, কাঠ ব্যবহার করে আবাসগৃহ তৈরি করছেন।
খাদ্য: হাজংদের প্রধান খাদ্য হল ভাত। তারা ভাত এবং তরিতরকারী রান্না করতে অভ্যস্ত। নদী-নালা, খাল-বিল থেকে প্রচুর মাছ ধরে সেগুলো রোদে শুকিয়ে চমৎকারভাবে শুঁটকি তৈরি করেন। বিন্নি চালের ভাত খেতে তারা পছন্দ করেন। হিদিল ও কাছিমের মাংস দিয়ে বিশি ভাত খেতে তারা ভালবাসেন। আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ যে অম্বুবাচি অনুষ্ঠান হয় তাকে হাজংরা সাতাযুগ বলেন।
ধর্ম: হাজংরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। তবে তাদের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে এবং কালের পরিক্রমায় হাজংরা বাঙ্গালি হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিই পালন করেন। হাজংদের প্রতি বাড়িতে ঠাকুরঘর ও তুলসী গাছ থাকে। হাজংদের বাড়িতে যে ঠাকুরঘর থাকে তাকে ‘দেওঘর’ বলে। দেওঘরে মাটির তৈরি দেবীকে প্রতি সন্ধ্যায় ধুপ ও প্রদীপ জ¦ালিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে উপাসনা করা হয়। কাঁসার ঘণ্টা ও শঙ্খ বাজিয়ে নিত্য পূজা অর্চণা করা হয়। ১৯২৫ সালে হাজংরা সিলেটের হারান বাগচী নামক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে পূজা অর্চণার পৌরোহিত্য পান। হাজংদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে: দোল উৎসব, মাল উৎসব, দেউলী উৎসব।
সামাজিক উৎসব : হাজং জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সামাজিক উৎসবগুলি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করেন। এ উৎসবগুলি বাংলা সনের পঞ্জিকাভিত্তিক হয়ে থাকে। উৎসবগুলো হল: নয়া খাওয়া, হঙআরানী, শেষরোয়া খান, আমাতি, পুষণি, আশ্বিন ব্রত, কার্তিক গাছা ইত্যাদি। হঙআরানির দিনে প্রত্যেক ঘরের দরজায় শন ও বেত দিয়ে টিপা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এ দিনে হাজংরা ¯œান শেষে মন্দির গিয়ে পরবর্তী বছরের শান্তির জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন। বাড়িতে বাড়িতে পিঠা ও পায়েস রান্না হয়। সন্ধ্যায় মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো হয়। নবান্ন উৎসবকে নয়া খাওয়া উৎসব বলে। ঐ দিন প্রতি ঘরে ঘরে চিড়া, মুড়ি, খৈ ও পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আতœীয়স্বজনকে এ দিন নিমন্ত্রণ জানানো হয়। কাঁচি ধোয়া ও ধানদুকা উৎসব সাধারণত ধান কাটা শেষ হলেই হয়ে থাকে। এছাড়াও মইসব, পুষণি, ফলানি দেয়া, আমাতি, আশ্বিন ব্রত, কার্তিক গাছা, দেউলী ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় হাজংদের সমাজব্যবস্থায়।
বিবাহ : হাজং সমাজে একই নিকনির মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। কারণ একই নিকনির ছেলেমেয়ে সমাজে ভাইবোন হিসেবে পরিচিত। হাজংদের বিয়ের অনুষ্ঠানকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন: গোয়া খাওয়া, অধিবাস, বিয়া অনুষ্ঠান ও পাক পরশ বা জ্ঞাতি ভোজন।
মৃত্যু: মৃত্যু হলে ১০-১৩ দিনের মধ্যে ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে শ্রাদ্ধ কার্য সম্পন্ন করতে হয়। ঐ সময় পুত্রকে খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা প্রচলিত নিয়ম মেনে চলতে হয়। আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভোজের আয়োজন করা হয়। পালাকীর্তন গীত হয়। তবে গরিব হাজংরা তা করতে পারেন না। তবে যারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী তাদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানটি ধুমধামের সাথে হয়।
তথ্যসূত্র:
সোহেল হাজং ‘হাজং’ প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফীয় গবেষণা (দ্বিতীয় খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।