জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

আঠারো.

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী গারো একটি প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম। গারোরা নিজেদেরকে ‘মান্দি’ বলে পরিচয় দেন। আচিক মান্দি বলেও তাদের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। ‘আচিক’ শব্দের অর্থ পাহাড় আর ‘মান্দি’ শব্দের অর্থ মানুষ। তাই গারো বলতে পাহাড়ের মানুষদের বোঝানো হয়। তবে হিন্দু জমিদারগণ গারোদেরকে দুর্বিনীত, জেদী, একরোখা ইত্যাদি অর্থে ‘ঘারুয়া’ জাত নামে অভিহিত করেন। কারণ ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু জমিদারগণ গারোদের কাছ থেকে আনুগত্য পাওয়ার চেষ্টায় সীমান্তবর্তী এলাকায় সাপ্তাহিক হাটগুলোতে গারোদের প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করতেন, এমনকি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতেন। কাজেই গারোরা সীমান্তে সমতলে হামলা চালিয়ে পালিয়ে যেতেন। এ ভাবে তারা জমিদারদের বিভিন্নভাবে ব্যস্ত রাখতেন। যার ফলে জমিদাররা তাদেরকে ‘ঘারুয়া’ বলতেন, পরবর্তীতে যেটি গারোতে রূপান্তরিত হয়।

বাসভূমি: বাংলাদেশে বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ নেত্রকোনা, বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সহ গাজীপুর জেলার শ্রীপুর ও কাকরাইদ এলাকাতে এবং রংপুর জেলার রৌমারীতেও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সংখ্যক গারো পরিবার বসবাস করে। বাংলাদেশে গারোরা মনে করেন, বর্তমানে তাদের লোকসংখ্যা আনুমানিক ১ লক্ষ ২০ হাজারের মত। ২০০১ সালের আদমশুমারীতে জাতভিত্তিক জনসংখ্যার হিসাব না থাকায় গারো সম্প্রদায়ের লোকজন কত তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। অথচ ১৯৯১ সালের সরকারী পরিসংখানে দেখানো হয় গারো জনসংখ্যা মাত্র ৬৮,২১০ জন।

ভাষা: গারোরা নিজেদের ভাষাকে ‘আচিক কুসিক’ অথবা পাহাড়ী ভাষা বলেন। তাদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই। আচিক ভাষা বড় তিব্বতীয় ভাষাভাষীর অন্তর্ভুক্ত। মূল ভাষা হল তিব্বতি চীন। সিনে তিব্বতীয় ভাষা, যার মাধ্যমে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগণ কথা বলে, গারো ভাষা ঐ ভাষা থেকে উদ্ভূত। ভারতের মেঘালয়ে সরকারীভাবে রোমান অক্ষর দিয়ে গারো ভাষায় লেখাপড়া করার সুযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে গারো ভাষায় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কাজ চলছে। উল্লেখ্য ময়মনসিংহে অবস্থানরত তেইজে ব্রাদার্সগণের মধ্যে ব্রাদার গিউমের ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং গারোদের বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জনের প্রবণতা লক্ষ করে ৯০ এর দশক থেকে গারো অধ্যুষিত এলাকায় সীমিত পরিসরে ছেলেমেয়েদের নিজ মাতৃভাষায় গারো ভাষা শিক্ষাদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা এখনো চলমান রয়েছে। গারোভাষায় কয়েকটি শব্দ হল: চা.আ=খাওয়া, রি.ংআ=পান করা, খাললা=খেলা করা, থুয়া=ঘুমানো, খাৎতা=দৌড়নো এবং আৎচংআ=বসা ইত্যাদি। আচিক, আবেং, মেগাম এবং আত্তং এই চারটি প্রধান ভাষা ছাড়াও গারোদের মধ্যে কথ্য ভাষা হিসেবে দোয়াল ও চিবক ভাষার প্রচলন রয়েছে।

পরিবার ব্যবস্থা: মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গারো সমাজে বিদ্যমান। মায়ের বংশেই সন্তানদের বংশ পরিচয় নির্ণিত হয়। পারিবারিক ও সমাজ কাঠামোতে মেয়েদের পরামর্শ ও সহযোগিতা থাকে। তবে পরিবার ও সমাজ পরিচালনার ভার পুরুষের উপরও বর্তায়। মায়ের সম্পদের উত্তরাধিকার হন মেয়েরা।

ধর্ম: গারোদের নিজস্ব কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। তাদের মতে বিশ্বে একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে, নাম তার তাতারা-রাগুবা, তিনিই সৃষ্টিকর্তা। গারোদের আদি ধর্মের নাম ‘সাংসারেক’ বা ‘সংসারেক’। তাদের অনেক দেবদেবীর মধ্যে কয়েকটি হল: স্তরা পাস্তুরা, জিপজিনি, জিপজানা, খুরাদক-খুরাফিন, সেফিরা-বলিরা, বিয়ামবি, বুলগিপ-ইমবাংগিপ অন্যতম। বর্তমানে গারোদেও প্রায় ৯৯ শতাংশ খ্রিষ্টান ধর্মেও অনুসারী। এরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত যার মধ্যে হল: রোমান ক্যাথলিক, ব্যাপ্টিষ্ট, সেভেন্থ-ডে-এডভেণ্টিস্ট, চার্চ অব বাংলাদেশ, ফেলোশিপ চার্চ, প্রেসবিটারিয়ান ইত্যাদি। গারো খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। এটি বছরের ২৫ ডিসেম্বর প্রতি বছর নিয়ম করে পালিত হয়ে থাকে। উৎসবগুলিতে প্রভু যীশু খ্রিষ্টের উদ্দেশ্যে গান, প্রার্থনা, ধন্যবাদ উৎসর্গ করে থাকেন এবং সবশেষ একটি বাড়িতে মহাভোজের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

গারো নৃত্য

জীবিকা নির্বাহ: গারোরা তাদের জীবিকার জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। পূর্বে পাহাড়ে জুম চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়ায় তাদের জুম চাষ বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়ছে। সমতল ভূমিতে লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ করে তারা ফসল ফলান। প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন খাদ্য-শস্য, শাক-সবজি নিজেরাই উৎপাদন করেন। গারো নারীরাও মাঠে কাজ করেন। তারা জীবজন্তু পালন করেন। পূর্বে তারা কাপড় তৈরী করতেন (সূতা তৈরি, রং করা), বাঁশ বেতের কাজ করতেন, কাঠের কাজ করতেন। হস্তশিল্পে দক্ষ ছিলেন। গারোদের পেশার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। কালের পরিক্রমায় গারোরা এখন শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী, স্কুল কলেজে শিক্ষকতা, মেয়েরা শহরে পার্লারে এবং গার্মেণ্টেসে কাজ করছেন।

বিবাহ: গারো সমাজে একই গোত্রের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। সমাজে বর্তমানে খ্রিস্টিয়ান রীতিতে বিবাহ বহুল প্রচলিত হলেও পূর্বে বিভিন্ন ধরনের বিবাহ রীতি যেমন : দো-দক্কা বা দো.সিয়া, চা. সেংআ, থুনাপা, চামে জি. কা. দকচাপা বা অন. চাপা, জিকগিদে রা. আ, সেককে খিম্মা, নকফান্তে গা.আ, চা-দিলা ইত্যাদি পদ্ধতিতে বিবাহ হত। গারো সমাজে বিয়ের প্রস্তাব মেয়ে পক্ষ হতে আসে, মেয়ে উপযুক্ত হয়ে যদি কোন ছেলেকে পছন্দের কথা অভিভাবকদেও জানায় তাহলে অভিভাবকরা ঐ ছেলেকে পাকড়াও করে মেয়ের কাছে নিয়ে আসে এবং বিয়ের ব্যবস্থা করেন।

সামাজিক অনুষ্ঠান: গারোদের সামাজিক উৎসবগুলি সাধারণত তাদের জীবিকা ও কৃষিকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। যেমন তাদের জুম চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাতটি উৎসবের মাধ্যমে কার্যাদি সম্পন্ন হয়ে থাকে। সেগুলো হল: আচিরকক্কা, জুম চাষের মঙ্গলের জন্য এ অনুষ্ঠান পালন করা হয়। রংচু গাললা যা হচ্ছে নতুন চিড়ার উৎসব। জামে গাপপা-আহাওয়া জুম ক্ষেতে ধান কাটার প্রথম অনুষ্ঠান এবং ওয়ানগালা যা জুমচাষকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় উৎসব। জুমের সব ফসল তোলা হয়ে গেলে কয়েকটি গ্রাম একত্রে ওয়ানগালা উৎসব পালন করেন। এ উৎসব সপ্তাহকাল পর্যন্ত চলে।
বাদ্যযন্ত্র: গারোদের মূল বাদ্যযন্ত্রের নাম দামা। এটি দাম্বিল গাছের কাঠ দিয়ে বানানো হয়। গারো জাতি নিজেদের জীবন উৎসবময় ও আনন্দময় রাখার চেষ্টা করেন।

মৃত্যু: গারো সমাজে মৃতদেহকে দাহ করানো এবং পোড়ানোও হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি মারা গেলে সাথে সাথে তার আত্মীয়স্বজনকে জানানো হয়। আত্মীয়স্বজন না আসা পর্যন্ত গারো সমাজে সৎকার করা তাদের নীতিবিরুদ্ধ। এমনকি আতœীয়স্বজন আসতে যদি ২-৩ দিন সময়ও লাগে তাহলেও তাদের জন্য অপেক্ষা করা হয়ে থাকে। এ সময় গ্রামের মুরব্বী নারী এবং প্রবীণেরা পুরোহিতের সহায়তায় সতকর্তার সহিত মৃতদেহটিকে পাহারা দেন। অন্যদিকে আত্মীয়স্বজনেরা মৃত ব্যক্তির বাড়িতে নিজ সামর্থ অনুযায়ী চাল, শূকর, মুরগি অথবা গরু প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে যান যাতে তাদের ব্যয় কিছুটা লাঘব হয়।

মৃত ব্যক্তিকে তার আপনজনেরা স্নান করান। মৃতব্যক্তি ধনী হলে খাঁটি দেশী মদের দ্বারা ভালভাবে প্রলেপ দেন। বিত্তহীন হলে জলের সাহায্যেই স্নান করানো হয়। মৃতদেহ যতক্ষণ ঘরে থাকে ততক্ষণ গ্রামবাসীরা গৃহে সমবেত হয়, মদপান করেন এবং সঙ্গে ক্রাম বাজনাও চলতে থাকে। রাতে মৃতদেহের পাশে আগুন জ্বালানো হয়। অন্তোষ্টিক্রিয়া উপলক্ষ্যে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়। এ সময় মৃত ব্যক্তির পিতামাতা জীবিত থাকলে তারা একটি ষাঁড় বা গরু এনে উৎসর্গ করেন। আতœীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সকলেই নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী ভোজ সভায় সাহায্য করেন।

তথ্যসূত্র :
সৃজন চাংমা ‘গারো’ প্রকাশিত হয়েছে মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফীয় গবেষণা (দ্বিতীয় খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা ২০০৪।
সুভাষ জেংচাম ‘গারো’ প্রকাশিত হয়েছে, মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম এবং সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।