রাহীদ এজাজ : করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মার্চের শুরু থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১ হাজার ২৩২ জন প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন বিশ্বের ১৯টি দেশে। এঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৬০৭ জন) মারা গেছেন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে। মূলত মধ্যপ্রাচ্য সহযোগিতা সংস্থা বা জিসিসির সদস্যভুক্ত দেশগুলোতেই কাজ করেন বাংলাদেশি কর্মীরা। অন্তত মে মাসের শুরুর দিকেও ওই দেশগুলোতে করোনাভাইরাস ততটা প্রবলভাবে আঘাত করতে পারেনি বাংলাদেশিদের।
গত দেড় মাসে হঠাৎ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বাংলাদেশের লোকজনের মৃত্যু আর আক্রান্ত হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই গাদাগাদি করে ডরমিটরিতে থাকতে হয় বাংলাদেশের কর্মীদের। ফলে এটি তাঁদের মধ্যে করোনার মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ। তা ছাড়া কর্মীদের বড় অংশ বড় বড় বিপণি, জনসমাগম বেশি এমন জায়গায় কাজ করেন। এটিও রোগ ছড়ানোতে বড় ভূমিকা রাখছে। এর পাশাপাশি তেলের দাম কমে যাওয়াতে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই বিদেশি কর্মীদের ছাঁটাইয়ের বিষয়টি জোরের সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে। ফলে বিপুল টাকা খরচ করে ঋণে জর্জরিত লোকজন নিজের চেয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশি উৎকণ্ঠায় ভুগছেন।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অধিকাংশই মারা গেছেন হাসপাতালে ভর্তির পর। সমীক্ষায় দেখা গেছে হাসপাতালে মারা যাওয়া এশিয়ার নাগরিকদের সংখ্যা ২০ শতাংশ। আর এশিয়ার যেসব লোক হাসপাতালে মারা গেছেন এঁদের অন্তত ১৮ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন।
ওই গবেষণার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইনে বাংলাদেশের মিশন ও প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই তিন দেশে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া বাংলাদেশিদের বড় অংশের হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ ছিল। হাসপাতালে ভর্তির পর এঁদের বড় অংশটির করোনা শনাক্ত হয়। পরে এঁরা মারা যান। অর্থাৎ মারা যাওয়া বাংলাদেশিদের আগে থেকেই কোনো না কোনো ধরনের শারীরিক জটিলতা ছিল।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সৌদি আরবে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫ জন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। ওই ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে ১ হাজার ৩০৭ জনের প্রাণ। সৌদি আরবে মঙ্গলবার পর্যন্ত সাড়ে ১৪ হাজার বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ৪১৫ জন।
সৌদি আরবে বাংলাদেশের লোকজনের অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রিয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধানটা কঠোরভাবে মেনে না চলায় বাংলাদেশের লোকজনের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাদাগাদি করে অন্তত সাত থেকে আটজন এক কামরায় থাকছেন। তিন সপ্তাহ ধরে দেখা গেছে, আক্রান্ত বাংলাদেশির সংখ্যা ঘুরেফিরে কাছাকাছি একটা জায়গায় আটকে থাকছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মিজানুর রহমান বলেন, ‘এখানে মঙ্গলবার পর্যন্ত এক শরও বেশি বাংলাদেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক হাজার। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে মারা যাওয়া বাংলাদেশিদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, তাঁদের বেশির ভাগই নানা রকম শারীরিক জটিলতা নিয়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হন। কারও ক্ষেত্রে মারা যাওয়ার আগে আবার কারও ক্ষেত্রে মারা যাওয়ার পরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।’
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। অর্থাৎ গাদাগাদি করে থাকা, চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা আর নানা রকম শারীরিক সমস্যার সঙ্গে করোনার মতো সংক্রামক ব্যাধি তাঁদের বিয়োগান্ত পরিণতির জন্য দায়ী।
কুয়েতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউল গনি মামুন বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশের মতো এখানেও আমাদের দেশের কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তারপর দেশ থেকে আসার সময় বিপুল অঙ্কের ঋণের বোঝা নিয়ে এসে দেখছেন চাকরিতে অনিশ্চয়তা। এটা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত যাঁরা করোনায় মারা গেছেন তাঁদের অর্ধেকের শারীরিক সমস্যা ছিল। আর বাকিরা করোনার পাশাপাশি বাড়তি উদ্বেগ তাঁদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার পর্যন্ত ৪৫ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২০০ বাংলাদেশি।
ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম সারওয়ার মঙ্গলবার বলেন, ‘এখানে লকডাউন তুলে দেওয়ার পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে আগে থেকেই সংক্রমণ বাড়ছিল। বিশেষ করে ডরমিটরিতে অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ায় এখানকার সরকার বিব্রত হয়ে পড়ে। ডরমিটরিগুলোতে ঘনবসতি বলে এখনো নিয়ন্ত্রণে আসছে না। স্থানীয় জনগণের চেয়ে বিদেশিদের সংখ্যা বেশি। ধারণা করা হচ্ছে এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ জন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন। এখানকার কর্তৃপক্ষ দেশ হিসেবে তথ্য জানায় না বলে সঠিক সংখ্যা জানা মুশকিল। তবে ধারণা করি আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক হাজার।’
মধ্যপ্রাচ্যের এ ছয়টি দেশেই খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের নাগরিকদের সেবায় দূতাবাসগুলো সেখানে কর্মরত বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নিয়ে ২৪ ঘণ্টার পুল গঠন করেছে। এতে করে আক্রান্ত লোকজন ফোনে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আশহুদ আহমেদ গত সোমবার বলেন, এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি সবাইকে কাতার সরকারের খরচে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ফলে এখানে যেসব বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের সবাই কাতার সরকারের খরচে চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন। তবে কাতারে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেও সুস্থতার হারও বেশ ভালো। এখন পর্যন্ত এখানে ১৮ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার বাংলাদেশি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাহরাইনে সবচেয়ে কমসংখ্যক বাংলাদেশি মারা গেছেন। মানামায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম গত রোববার জানান, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এখানে লকডাউন বা সান্ধ্য আইন কিছুই ছিল না। অপ্রয়োজনীয় সেবা বন্ধ ছিল। যা আবার জুনের শুরু থেকে চালু হয়েছে। এখানে বড় বিষয়টি হচ্ছে এ পর্যন্ত চার লাখ লোকের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। শুরুতে এখানকার কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল ডরমিটরিগুলো ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করা। সেটি সরকার পুরোপুরি করতে পারেনি। পরে সরকার নিয়োগকর্তাদের বলেছে, তারা যেন বিদেশি কর্মীদের জন্য বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করে এখন যে ডরমিটরিগুলো আছে সেখানে চাপ কমায়।