অনলাইন ডেস্ক : দীর্ঘ আন্দোলনের পর সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে তিন লাখ সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেল এক ধাপ বাড়িয়ে ১৩তম গ্রেডে নিয়েছে সরকার। অবশ্য শিক্ষকদের চাওয়া ছিল ১১তম গ্রেড। ১৩তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণে জটিলতার কারণে উল্টো এখন তাদের বেতন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শিক্ষকরা বলছেন, তাদের বেতন এমনকি ১৩ গ্রেডের নিচের ধাপে নির্ধারণ করলেও বর্তমানের চেয়ে কম টাকা পাবেন তারা। কারণ, বেশিরভাগ শিক্ষকই ইনক্রিমেন্ট পেয়ে ইতোমধ্যে ১৩ গ্রেডের নিচের ধাপের চেয়েও বেশি বেতন পাচ্ছেন। সে কারণে ১৩তম গ্রেডের ওপরের ধাপে বেতন নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে যাওয়ার সুফল পাবেন। বিষয়টি নিয়ে তারা ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, কারও বেতন কমানো হবে না। বেতন স্কেলের ধাপে ধাপে মেলানো হবে। না মিললে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শমতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানা গেছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে সহকারী শিক্ষকদের বেতনের ব্যবধান তিন ধাপ। এ বৈষম্য কমিয়ে আনতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন সব সহকারী শিক্ষকের বেতন ১৩তম গ্রেডে নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বর্তমানে ১৩তম গ্রেডের বেতন নির্ধারণের কাজ চলছে। এতে শিক্ষকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে যে, নতুন গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হলে সব শিক্ষকের মূল বেতন কমে যাবে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠনগুলো বরাবরই সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১১তম গ্রেডে নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছিল। এখন তারা বলছে, ১৩তম গ্রেডের উচ্চধাপে নির্ধারণ করা হলেই কেবল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
এই বিষয়ে শিক্ষক নেতারা গত নভেম্বরে অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেখানে অর্থসচিব বলেন, সরকার আপনাদের বেতন স্কেল বাড়িয়েছে সুবিধা দেওয়ার জন্য, কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়। কোনো শিক্ষকের বেতন কমবে না। তিনি ১৩তম গ্রেডের উচ্চধাপে বেতন নির্ধারণের আশ্বাস দেন। তবে এতদিনেও তা কার্যকর হয়নি।
জানা গেছে, মূলত সরকারি কর্মচারীদের চাকরিবিধি বা বিএসআরের প্রথম খণ্ডের ৪২(১)(২) বিধির কারণে বেতন নির্ধারণে সংকট তৈরি হয়েছে। এই বিধি অনুসারে, বেতন স্কেল উন্নীত করার অব্যবহিত আগে তার সর্বশেষ আহরিত বা প্রাপ্য মূল বেতনের ভিত্তিতে বেতন স্কেল উন্নীতকরণের তারিখে সরাসরি নির্ণীত সর্বশেষ স্কেলের কোন ধাপে মিললে ওই ধাপে, ধাপে না মিললে বিএসআর প্রথম খণ্ডে ৪২(১)(২) বিধি অনুসরণে নিম্নধাপে বেতন নির্ধারণ করে অবশিষ্ট টাকা পিপি হিসেবে প্রদান করতে হবে এবং ওই পিপি পরবর্তী বার্ষিক বেতন বৃদ্ধিতে তা সমন্বয় হবে।
শিক্ষকরা বলছেন, ২০১৫ সালের আগে (৮ম পে-স্কেল চালুর আগে) হলে এই বিধিতে বেতন নির্ধারণ করলে শিক্ষকদের খুব একটা ক্ষতি হতো না। কারণ তখন উন্নীত গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করার কারণে পরবর্তী বছর থেকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট অঙ্কের অতিরিক্ত টাকা ইনক্রিমেন্ট আকারে মূল বেতনের সঙ্গে যোগ হতো। তাই পিপি সমন্বয় করলেও মূল বেতন কমে যেত না।
শিক্ষকরা যা ভাবছেন : সিলেটের কায়েস্থরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কল্যাণ ব্রত বিশ্বাস বলেন, ১৩তম গ্রেডে উন্নীত স্কেল যদি নিম্নধাপে নির্ধারণ করা হয়, তাহলে শিক্ষকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। উচ্চধাপে নির্ধারণ করা হলে সিনিয়র ও জুনিয়র সব শিক্ষকই আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবেন এবং কমবেশি সবাই আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার ৫নং সলুয়া গোলাবাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিবাজী বিশ্বাস বলেন, বেতন স্কেল উন্নীত করার পরিপত্রে পরিস্কার বলা নেই, ১৩তম গ্রেডের উচ্চধাপে নাকি নিম্নধাপে আমাদের বেতন নির্ধারণ করা হবে। বেতন কমে গেলে ১৩তম গ্রেড চাই না। বিষয়টি দ্রুত পরিস্কার হওয়া দরকার।
পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব) সেলিম হোসেন বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল অন্য সব বিভাগ থেকে ভিন্ন। এখানে এমন অবস্থা যে, কোনো কোনো সহকারী শিক্ষক তিনটি টাইম স্কেল পেয়েছেন, আবার কোনো কোনো প্রধান শিক্ষক সহকারী শিক্ষকের গ্রেডে বেতন পান। আবার একদল প্রশিক্ষণ করসপেন্ডিং স্কেলে তিনজন সহকারী শিক্ষকের সমান বেতন পান। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার একটা সমন্বয় হওয়া দরকার। আর এবারের উন্নীত গ্রেডে কারও যেন আর্থিক ক্ষতি না হয় তার ব্যবস্থা করা উচিত, অর্থাৎ কোনো পিপি নয়, সবার বেতন উচ্চধাপেই হতে হবে।
রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আরা বীথি বলেন, ১৩তম গ্রেডে নিম্নধাপে নির্ধারণ করা হলে একদম নতুন যোগদানকারী শিক্ষক ছাড়া বাকি সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রসাত হবেন। কেননা ৮ম পে-স্কেলে কাছাকাছি নিম্নধাপে প্রশিক্ষণ গ্রেড আপগ্রেড করায় হাজার হাজার ডিপিএড ও সিইনএড প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী শিক্ষক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তখন তাদের বেতন ১৪তম গ্রেডে আপগ্রেড করা হলেও মূল বেতনে তারা একই সময়ে যোগদানকারী প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের তুলনায় একটি ইনক্রিমেন্ট ও একই সময়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হিসেবে যোগদানকারী শিক্ষকের তুলনায় দুটি ইনক্রিমেন্টে পিছিয়ে পড়েছেন। তারা বছরে হাজার হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এই ক্ষতি অব্যাহত থাকলে তারা পেনশনে কয়েক লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন। এখন আবার এ সমস্যার সমাধান না করেই ১৩তম গ্রেডে নিম্নধাপে বেতন নির্ধারণ করলে প্রশিক্ষণ গ্রেড পাওয়া শিক্ষকরা দ্বিগুণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন। কারণ, নতুন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগবিধিতে (২০১৯) প্রশিক্ষণ গ্রেড বলে কিছু রাখা হয়নি।
সবার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা : এদিকে, বেতন স্কেল নির্ধারণের পাশাপাশি ১৩তম গ্রেডের সুবিধা সহকারী শিক্ষকদের সবাই পাবেন কিনা এটা নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালের নতুন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগবিধিতে সব শিক্ষকের নিয়োগ যোগ্যতা দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৩তম গ্রেডের বেতন স্কেল উন্নীতকরণের প্রজ্ঞাপনেও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ থাকায়বিপুল সংখ্যক সহকারী শিক্ষক ১৩তম গ্রেড থেকে বঞ্চিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। এ বিষয়ে কুমিল্লা মহানগরের রেয়াজউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লায়লা নুর পিংকী বলেন, ১৩তম গ্রেড যেন সব শিক্ষকই পান। কারণ যেসব সহকর্মী এইচএসসি পাস, তারা তো তাদের নিয়োগের সময় সরকার নির্ধারিত সব শর্ত পূরণ করেই নিয়োগ পেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে এখন ১৩তম গ্রেড প্রাপ্তিতে শিক্ষকদের মধ্যে কোনো বিভাজন কাম্য নয়।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, ১৩তম গ্রেডের নিম্নধাপে বেতন নির্ধারণ করলে শিক্ষকদের বেতন ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত কমে যাবে, যা চাকরিজীবনে আর সমন্বয় করা সম্ভব হবে না। এই বিষয়ে অর্থসচিব তাদের কথা দিয়েছিলেন যে, তাদের বেতন নিম্নধাপের পরিবর্তে উচ্চধাপে হবে এবং সেখানে পিপি বলতে কিছু থাকবে না। কিন্তু ১৩তম গ্রেডের পৃষ্ঠাঙ্কন আসার পরও এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না আসায় শিক্ষকদের বেতন উচ্চধাপে নির্ধারণ সম্ভব হবে না। তারা চান অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চধাপের নির্দেশনা দ্রুত কেন্দ্রীয় হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠানো হোক। আর ১৩তম গ্রেডের সুবিধা সব সহকারী শিক্ষক যেন পান, সেই বিষয়েও স্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে।
মহাপরিচালকের অভয়বাণী : প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, বেতন স্কেল নির্ধারণের সাধারণ নিয়ম হলো ধাপে মিললে মিলল। না মিললে পে-প্রটেকশন দিয়ে পরের ধাপের ইনক্রিমেন্ট পেয়ে তা সমান হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধরুন কেউ ৩১২৫ টাকা বেতন পান। নতুন গ্রেডে বেতন স্কেল ৩১০০ টাকায় ফিক্সেশন হলেও তার ২৫ টাকা মার যাবে না। পিপি হিসেবে পরের বছর ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে তা যোগ হবে। মহাপরিচালক বলেন, শিক্ষকরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি উদাহরণ তাদের দেখিয়েছে। সেখানে স্কেলের উচ্চধাপে বেতন নির্ধারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ম হলো, জুনিয়রের চেয়ে কোনো সিনিয়র কখনও কম বেতন পাবেন না। তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলছেন।