ফরিদ আহমেদ : ১৮৮০ সালের দিকে একদল বাঙালি মুসলমান পা ফেলেছিলো আমেরিকাতে। এদের বাড়ি ছিলো পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। এই মুসলমান বাঙালিরা ভ্রমণের জন্য, কিংবা দেশ দেখা, চাকরি-বাকরি করা কিংবা আমেরিকাতে বসবাসের জন্য যায়নি। অত্যন্ত দরিদ্র মানুষ ছিলো তারা। গিয়েছিলো পেটের তাগিদে, ব্যবসা করার জন্য। এরা ছিলো মূলত ফেরিওয়ালা। এমব্রোয়ডারি করা সিল্ক এবং আরও সৌখিন জিনিসপত্র বিক্রি করতো তারা। ভারতীয় কাপড়চোপড় এবং প্রাচ্য দেশীয় সাজসজ্জার বিষয়ে আমেরিকান লোকদের ফ্যাশন নেশা তৈরি হয়েছিলো। সেই নেশার জ্বালানি সরবরাহ করতে গিয়েছিলো এরা।

তবে, এদের সেই যাত্রা খুব সহজ কিছু ছিলো না। আমেরিকান সমাজ তখন প্রচণ্ড রকমের প্রাচ্য-বিরোধী। একমাত্র চাইনিজ ছাড়া অন্য কোনো এশীয় দেশের শ্রমিককে তারা কাজ করতে দিতো না। শুধু কাজ করাই না, মানসিকতাটাও ছিলো শত্রুভাবাপন্ন। বাঙালি ফেরিওয়ালাদের ওই মানসিকতা সহ্য করেই আমেরিকাতে ফেরি করা লাগতো।

নিউ জার্সি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্টেটে তারা ছড়িয়ে পড়ে। মূলত ধনী এলাকাতে তাদের ব্যবসা হলেও, নিজেরা থাকতো দরিদ্র এলাকাতে। অনেকটা ঢাকা শহরে গ্রাম থেকে কোনো ফেরিওয়ালা এলে যেমন বস্তিতে ওঠে সেই রকম। এ রকম একদল বাঙালি ঠাঁই গেড়েছিলো নিউ অরলিন্সের ট্রেমে এলাকায়। ব্যবসার জন্য এদের কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছরও আমেরিকায় থাকতে হতো। ফলে, অনেকেই মামুনুল হকের মতো মানবিক বিয়েতে চলে যায়। স্থানীয় কালো নারীদের বিয়ে করে সংসার করাও শুরু করে। এদের বিয়ে যতোটা না শারীরিক প্রয়োজনে ছিলো, তার চেয়েও বেশি ছিলো ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। নতুন একটা দেশে ভাষাগত সমস্যা, নেটওয়ার্কিং, টিকে থাকা, আশ্রয়, এ সবের জন্য তাদের স্থানীয় সহযোগিতার প্রয়োজন ছিলো। সেই সহযোগিতাটা জুগিয়েছিলো তাদের এইসব মানবিক বিবিরা।

মজার বিষয় হচ্ছে, এদের পুরো ব্যবসাটাই ছিলো আসলে বিবি নির্ভর। যে সমস্ত সৌখিন জিনিস তারা নিয়ে এসেছিলো আমেরিকাতে বিক্রি করার জন্য, সেগুলো দেশে তাদের আসল বিবিরা তৈরি করে দিয়েছিলো। আমেরিকাতে আসার পরে মানবিক বিবিরা সহযোগিতা করেছিলো সেগুলো আমেরিকান ধনী সমাজে বিক্রি করার জন্য। শুধু বিক্রি করাই না, এদের স্থানীয়ভাবে টিকে থাকার পিছনেও তাদের অবদান ছিলো প্রচুর পরিমাণে। ১৮৮০ সাল থেকে শুরু করে ১৯২০ সাল পর্যন্ত স্রোতের মতো শত শত বাঙালি ফেরিওয়ালা এসেছে আমেরিকাতে। ১৯২০ সালের পরে এই স্রোতটা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৭ সালে এশিয়া বিরোধী যে আইন করা হয় আমেরিকাতে সেটাই মূলত এর জন্য দায়ী। ফেরিওয়ালাদের মধ্যে অল্প দুই চারজন ছাড়া, বাকি সবাই তাদের মানবিক বিবি এবং বাচ্চা-কাচ্চাদের পরিত্যাগ করে ফিরে আসে বাংলায়। আমেরিকায় বিয়ে করাটা যে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে করা হয়েছিলো, কোনো ভালবাসা কিংবা দায়িত্ববোধ সেখানে ছিলো না, সেটাই প্রমাণ করে এই ঘটনা।
তাদের সন্তান-সন্ততিরা, সেই সব অর্ধ বাঙালি বংশধরেরা, কালো মানুষদের অংশ হয়ে হারিয়ে যায় ইতিহাসে।