ডঃ বাহারুল হক
ক্রিমিনাল একটা ভয়ংকর শব্দ। টরন্টোর প্রত্যেকটা বাসে অপারেটরের সিটের পেছনে লেখা থাকে- “এভরিডে এট লিষ্ট ওয়ান টিটিসি ওয়ার্কার ইস এসল্টেড। দেটস ওয়ান টু মেনি। ইউ ক্যান বি ফাইন্ড আপ টু $২০০০। ইন এভরি কেস ইউ গেট এ ক্রিমিনাল রেকর্ড”।
কাউকে ক্রিমিনাল বললে তার আর প্রেস্টিজ বলতে কিছু থাকে না। এমনকি যিনি ক্রিমিনাল বলবেন তার বিরুদ্ধে মানহানির কেসও করে বসতে পারেন ঐ ব্যক্তি। তবে ক্রিমিনাল শব্দটির স্বযত্ন ব্যবহার দেখলাম টরন্টোতে। প্রবল উত্সাহে ক্রিমিলান শব্দটির ব্যবহার একেবারে নিজের নামের সাথে। এগলিন্টন এভিনিউতে গেলে আপনার চোখে পড়বে একটা নামফলক। তিনি একজন ল’ইয়ার। নিজের নামটা লিখে পাশে লিখে দিয়েছেন- ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। আসলে তিনি ল’ প্রফেশনে নিয়োজিত একজন ল’ইয়ার এবং ক্রিমিনাল কেস নিয়ে তার কারবার। ভালো কথা ক্রিমিনাল কেস নিয়ে তার কারবার বলে নিজেকে পরিচয় দেন একজন ক্রিমিনাল ল’ইয়ার হিসেবে। আমার এক বন্ধু বাংলাদেশে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’ ডিপার্টমেন্টে প্রফেসর। সে ক্রিমিনাল ল’ পড়ায়। তার বিজনেস কার্ড আছে। তাতে তার পরিচয় হলো- প্রফেসর, ল’ ডিপার্টমেন্ট। আমি তাকে বললাম- তুমি শুধু প্রফেসর লিখ কেন? তুমি পড়াও ক্রিমিনাল ল’। তোমারতো লিখা উচিত ক্রিমিনাল প্রফেসর। শুনে সে আমাকে একটা ঝাড়ি দিল এবং ক্রিমিনাল ল’ ইয়ারের উদাহরণ দেয়ার পরও সে নিজেকে একজন ক্রিমিনাল প্রফেসর হিসেবে পরিচয় দিতে রাজি হলো না। তার এক কথা- এটা কী বলছ, আমি বুঝি ক্রিমিনাল প্রফেসর?
মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদেরও পরিচয় তাদের মন্ত্রণালয় দিয়ে। যেমন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে আমরা জানি বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে। বাণিজ্য মন্ত্রীর মত আছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী, ক্রীড়া মন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রী, কৃষি মন্ত্রী ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে পশু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে নিয়ে। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিছুতেই চান না কেউ তাকে পশু মন্ত্রী বলুক। আমার বন্ধু যেমন মনে করেন ক্রিমিনাল প্রফেসর বললে মনে হয় প্রফেসর সাহেব একজন ক্রিমিনাল তেমনি পশু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মনে করেন পশু মন্ত্রী বললে মানুষ মনে করবে মন্ত্রী মহোদয় মনুষ্য নন, তিনি বুঝি পশুদের মধ্য থেকে নির্বাচিত এক পশু। পশু হতে কে চায় বলুন?
ডাক্তার বললে আমরা সোজাসুজি বুঝি একজন মানুষকে যিনি মানুষের চিকিৎসা করেন। কিন্তু রোগ বালাইতো শুধু মানুষের হয় না পশু-পাখিরও হয়। রোগ থেকে মুক্তির জন্য তাদেরও চিকিৎসা নিতে হয়। তাদের যারা চিকিৎসা দেয় তারা কারা? অবশ্যই তারাও ডাক্তার। কিন্তু লোকে ওসব ডাক্তারদেরকে ডাকে পশু ডাক্তার আর তাতেই তাদের আপত্তি। পশু মন্ত্রীর মত তাদের আপত্তি- বাহ, আমাদেরকে কেন পশু ডাক্তার বলা হবে, আমরা কী পশু?
আমার এক ভাই চট্টগ্রামের বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে মেরিন ইনজিনিয়ারিং পাস করার পর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের হয়ে একটা বাংলাদেশী জাহাজে যোগদান করলো। জাহাজ নিয়ে এখানে সেখানে যায়। বেতন কম। মন খারাপ। মন উড়ো উড়ো। মন চায় পালিয়ে যেতে। হাঁ, পালিয়ে যেতে। কারণ চাকুরির শর্ত মানলে সহসা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের চাকুরী ছাড়া সম্ভব নয়। শর্ত মেনে কয়েক বছর মেরিন ইনজিনিয়ার হিসেবে বাংলাদেশি জাহাজে চাকুরী করে যেতে হবে। কে করে ফকিরা বেতনে এখানে চাকুরী! ফলে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল পালাবে। যোগাযোগ শুরু করলো বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সাথে। চাকুরী হয়ে গেল। অনেক টাকা বেতন। একদিন পালিয়ে চলে গেল সিঙ্গাপুর। যোগদান করলো মেরিন ইনজিনিয়ার হিসেবে সে দেশের এক জাহাজে। কিছুদিন পর তার বাসার ঠিকানায় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন থেকে একটা চিঠি এলো। চিঠিতো পরে ,আগে খাম। খামটা দেখে বাসায় হাসির রোল। কী ব্যপার? ব্যপার হলো চিঠির খাম। খামের উপর বাঁ পাশে লেখা- প্রেরকঃ জাহিদ হোসেন
উপ-পরিচালক (পলাতক)
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন।
প্রেরক দেখে বোঝা গেল প্রায়ই কোন না কোন মেরিন ইনজিনিয়ার বাংলাদেশী জাহাজ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। পালানো বন্ধ করা যাচ্ছে না এবং পালানোর পর আর তাদের কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। পলাতক ইনজিনিয়ারদের নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন বেশ বেকায়দায় আছে। এতটা বেকায়দায় যে পলাতক বিষয়টা দেখ-ভালের জন্য বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে একজন উপ-পরিচালকও আছেন।
শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষার আগে এডমিট কার্ড তৈরী করে। এডমিট কার্ডে রোল নাম্বার থাকে। তবে সংখ্যার আগে থাকে কেন্দ্রের নাম। যেমন, চাঁদপুর – ১, চাঁদপুর – ২, এভাবে। বোর্ড কোন কোন সময় প্রিন্টিং কষ্ট কমানোর জন্য কেন্দ্রের সম্পুর্ন নাম না লিখে অংশ বিশেষ লিখে। যেমন, মৌলভি বাজার কেন্দ্র। বোর্ড মৌলভি বাজার না লিখে, লিখে মৌলভি এবং রোল নাম্বার হয় মৌলভি – ১, মৌলভি – ২, এভাবে। কিন্ত বিপত্তি বাধলো ছাগল নাইয়া কেন্দ্র নিয়ে। শিক্ষা বোর্ড ছাগল নাইয়া কেন্দ্রের জন্য এডমিট কার্ড ইসু করলো। এডমিট কার্ডে রোল নাম্বার আসলো : ছাগল – ১, ছাগল -২, এভাবে। এডমিট কার্ড কেন্দ্রে গেল। তারপর গেল পরীক্ষার্থীদের হাতে। এডমিট কার্ড দেখে ছাগল নাইয়ার মানুষ ভিষণ ক্ষেপে গেল। ছাগল – ১, ছাগল -২, এসব কী? তারা প্রতিবাদ জানালো। বোর্ডকে বলে দিল- ভবিষ্যতে এডমিট কার্ডে আর যেন ছাগল লেখা না হয়। বোর্ড আর কখনো ছাগল লিখে নাই। ছাগল নাইয়ার এডমিট কার্ডে ছাগল নাইয়া লেখা থাকে, ছাগল নয়। এ ঘটনার পর ফাজিলপুর নতুন পরীক্ষা কেন্দ্র হলে বোর্ড ফাজিলপুর কেন্দ্রের জন্য এডমিট কার্ড তৈরি করতে গিয়ে ভেবেছে এবং ফাজিলপুরকে ছোট করে ফাজিল লেখার কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। ফাজিলপুরকে ফাজিলপুরই লেখা হয়।
বাংলাদেশে ছাগল দরিদ্র জন গোষ্ঠির আয়ের অন্যতম গুরুত্ত¡পুর্ণ প্রানিসম্পদ। দ্রুত প্রজননশীলতা, উন্নত মাংস ও চামড়ার জন্য ছাগল বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয়। সাধারন দরিদ্র জনগন স্বল্প খরচে অনায়াসে ছাগল পালন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে বিধায় ছাগলকে বলা হয় “গরীবের গাভী”। সম্ভবত ২০০৭ সনে মত্স্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রনালয় একটি প্রকল্প তৈরী করলো ছাগল নিয়ে। প্রকল্পটির নাম – ছাগল উন্নয়ন ও স¤প্রসারন প্রকল্প। সে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ত¡ অর্পিত হলো প্রানিসম্পদ অধিদপ্তরের উপর। গ্রাম এলাকায় ছাগল প্রজননের জন্য পর্যাপ্ত পাঁঠা পাওয়া যায় না। ফলে ছাগল প্রজনন ব্যহত হচ্ছে এবং ছাগলের উত্পাদনও ব্যহত হচ্ছে। ফলে উৎপাদন যাতে ব্যহত না হয় সে লক্ষে প্রানিসম্পদ অধিদপ্তর ছাগল উন্নয়ন ও স¤প্রসারন প্রকল্পের আওতায় পাঁঠা নিয়ে পাঁঠা প্রকল্প নামে আরেকটি উপপ্রকল্প তৈরী করলো। এই প্রকল্প দেখ-ভাল করার জন্য অধিদপ্তরে নতুন একটি সহকারী পরিচালকের পদ সৃস্টি করা হলো। পদের নাম- সহকারী পরিচালক (পাঁঠা)। অচিরেই জসীম উদ্দিন নামে একজন জোগদান করলেন এই পদে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা কথা-বার্তা ও কাজ-কর্মে বেশ আন্তরিক মেধাবি যুবক জসীম উদ্দিন সাহেব অল্প দিনের মধ্যে পরিচালকের খুব স্নেহভাজন হয়ে উঠলেন। পরিচালক খুব রসিক মানুষ। রসিকতা করে জসীম সাহেবকে ডাকেন পাঁঠা। যেমন, জসীম সাহেবকে রুমে প্রয়োজন হলে তিনি পিয়নকে বলেন- যাও, পাঁঠাকে আসতে বলো। পিয়ন বলে- কাকে স্যার, জসীম স্যারকে? উত্তরে পরিচালক বলেন- তা আর কাকে? জসীম ছাড়া আর কী কোন পাঁঠা আছে অফিসে? কয়েক দিনের মধ্যে জসীম স্যার তাদের কাছে হয়ে গেলেন পাঁঠা স্যার। পাঁঠা স্যারের খবর বাসায়ও চলে গেল। জসীম সাহেবকে যারা জসীম ভাই ডাকতো তাদের কেউ কেউ জসীম সাহেবকে মজা করে ডাকা শুরু করলো- পাঁঠা ভাই। সব থেকে পোয়াবারো হলো জসীমের স্ত্রীর ছোট ভাই-বোনদের। তারা খিলখিলিয়ে হাসে আর জসীম সাহেবকে দুলাভাইর পরিবর্তে ডাকে পাঁঠা দুলাভাই। এসব দেখে শুনে জসীমের স্ত্রী একেবারে ত্যক্ত-বিরক্ত। রেগে গিয়ে একদিন সে জসীম সাহেবকে বললো- আচ্ছা, তুমি কী চাকরী কর যে লোকে তোমাকে পাঁঠা ডাকে? জসীম সাহেব ধীর-স্থীরভাবে বললেন- লোকে ঠিকই বলে। আমি পাঁঠা; সহকারী পরিচালক (পাঁঠা)। স্ত্রী বুঝলেন, কিন্ত, তারপরও অনুরোধ করলেন- পাঁঠার চাকরির দরকার নাই। তুমি চেস্টা করে এখান থেকে অন্য কোন ব্রাঞ্চে চলে যাও। জসীম সাহেব বললেন- আচ্ছা, ঠিক আছে।
দিন যায়, দিন গড়িয়ে যায় মাস। বার তের মাস পর একদিন অধিদপ্তরের পরিচালক জসীম সাহেবকে তার রুমে ডেকে আনলেন। প্রবল আত্মবিশ্বাসী জসীম সাহেব পরিচালকের মুখোমুখি হয়ে একটা চেয়ারে বসলেন। পরিচালক বললেন- “জসীম,আমি মন্ত্রনালয়ে লিখেছিলাম ছাগল প্রজনন বিশেষ করে পাঁঠা ছাগলের উপর উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য অধিদপ্তর থেকে একজনকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার ব্যব্স্থা নিতে। মন্ত্রনালয় দ্রুতই ব্যবস্থ গ্রহন করেছে। আমাদের অধিদপ্তর থেকে এখন একজন ছাগল প্রজনন বিশেষ করে পাঁঠা ছাগলের উপর উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে তিন মাসের জন্য ইংল্যান্ড যেতে পারবে। তুমি কী যেতে ইচ্ছুক? আমি তোমাকে এভাবে জিজ্ঞাসা করার একটা কারণ আছে। আমি জেনেছি তুমি এখান থেকে অন্য কোন ব্রাঞ্চে চলে যেতে চাচ্ছ। যদি চলেই যাবে তাহলে তোমাকে পাঠিয়ে অধিদপ্তরের কী লাভ হবে? তুমি এসে সার্ভিস দেবে এ ব্যপারেতো আমাদের নিশ্চিত হতে হবে”। জসীম সাহেব দৃঢ়ভাবে তাকে সে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কয়েকদিন পর জসীম সাহেব অফার লেটার পেয়ে গেলেন। স্ত্রীকে দেখালেন লেটারটা। স্ত্রী খুব খুশি। পাঁঠা নিয়ে আর কোন কথা নয়। মেধাবি জসীম সাহেব শুধু এটা পেয়েই বসে থাকলেন না। তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ শুরু করলেন ইংল্যান্ডের সাথে। জসীম সাহেব চাইলেন যে তিন মাস তিনি ইংল্যান্ড থাকবেন সে তিন মাস তার স্ত্রীও যেন তার সাথে থাকার সুযোগ পান। স্ত্রী সাথে থাকলে তিনি কী ভাবে উপকৃত হবেন তা তিনি খুব চমৎকারভাবে তার চিঠিতে তুলে ধরলেন। স্ত্রীর আসা যাওয়ার বিমান ভাড়া তিনি দিবেন, শুধু সেখানে তার স্ত্রীর থাকা খাওয়ার ব্যয় নির্বাহের জন্য ইংল্যান্ড যেন তার বৃত্তির টাকাটা বাড়িয়ে দেয়। জসীম সাহেবের যাদুকরী লেখার প্রভাবে ইংল্যান্ড তার বৃত্তির পরিমান বাড়িয়ে দিল। জসীম সাহেবের ইংল্যান্ড যাওয়ার দিন-তারিখ ঠিক হলো। ওদের বিদায় জানাতে বিমান বন্দরে এলো অন্যান্যদের সাথে স্ত্রীর ছোট ভাই-বোনেরাও। বিদায়ের একেবারে শেষ মুহুর্তে ওরা বললো- দুলাভাই, তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন। ফিরে আসলে আপনাকে নতুন নামে ডাকা হবে। জসীম সাহেব হেসে বললেন- কী নামে ডাকা হবে? ওদের উত্তর- বিলাতী পাঁঠা ডাকা হবে। জসীম সাহেব উচ্চস্বরে বললেন- কী নামে? ওদের উত্তর একই- বিলাতী পাঁঠা।