আতোয়ার রহমান : বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কানাডার টরন্টোতে পৌঁছাল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক ফ্লাইট। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে বিরতিহীন আঠার ঘন্টায় প্রায় তের হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমান এর অত্যাধুনিক মডেলের বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনারের ফ্লাইটটি নিরাপদে উড়ে এলো গত ২৭ মার্চ সকালে, তাও আবার গৌরবের মহান স্বাধীনতা দিবসের পুণ্যলগ্নে, এর চেয়ে খুশির খবর আর কি হতে পারে আমাদের মতো বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের জন্য!

সুদূর আটলান্টিকের পশ্চিম পাড়ের অন্য সকল বাংলাদেশি কানাডাপ্রবাসির মতো আমিও আনন্দিত, উচ্ছসিত। বহুল প্রতিক্ষীত এ ফ্লাইটের মাধ্যমে বিমানের ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা হলো। বিমানের ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইটের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের বন্ধুপ্রতীম দেশ কানাডার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সহজ হবে। দুই অঞ্চলের মধ্যে শিক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারেও ভূমিকা রাখবে বিমানের এই রুট।

ছবিতে টরন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের এমন দর্শনীয় অবতরণ দৃশ্য দেখে আনন্দে মন ভরে গেল, মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো-এবার সত্যি সত্যিই আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইটটি চালু হচ্ছে! দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এ ফ্লাইট চলাচল সূচনা করার জন্য আমরা বাংলাদেশ বিমান ও এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত কানাডাস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনসহ অন্যান্য সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
গত ২৭ মার্চ সকালে যখন বিমানটি টরন্টোতে অবতরণ করছিল, তখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের ভোরের আলোর লাল আভা বিশাল বিমানের লাল সবুজ খচিত লম্বা ডানায় প্রতিফলিত হয়ে টরন্টোর আকাশে একটা জাদুবাস্তবতার মতো আলোখেলা তৈরি করেছিল। যারা সরাসরি কাছে থেকে বাংলাদেশ বিমানের টরন্টোতে মেঘমুক্ত ভোরের আকাশের মৃদু লাল আভায় ধীরলয়ে চক্কর দেওয়ার এই মোহনীয় দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছেন তাদের আবেগ অনুভূতির শিহরণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। নিজেকে খুব বঞ্চিত মনে হলো এই ভেবে যে, কাছে থেকে চোখ ভরে এ ঐতিহাসিক অপূর্ব দৃশ্যটির সাক্ষী হতে পারলাম না, বিমানের মৃদুমধুর গর্জন শুনতে পারলাম না। দেশ থেকে দূরে থাকার কারণে সৃষ্ট অতৃপ্তির অনুশোচনার লম্বা তালিকায় আর একটি অতৃপ্তি যেন যোগ হলো। অন্য একটি ছবিতে দেখলাম নীল তিমির মতো বিশাল আকৃতির বিমানটি এয়ারপোর্টে পড়ে আছে। মনে হলো টরন্টোর পিয়ারসন এয়ারপোর্টটি যেন নতুন করে সেজেছে বাংলাদেশি লাল সবুজ রঙের চাদরে। শরীরে ডানায় লাল সবুজের রঙে যেন পুরো এয়ারপোর্ট একটুকরো বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে।
যেখানে এমিরেটস এয়ারলাইনসের মতো অনেক নামকরা এয়ারলাইনস দীর্ঘদিন চেষ্টা করার পরেও টরন্টোতে সরাসরি ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি পায়নি, সেখানে বাংলাদেশ বিমানকে এই সুযোগ দেয়া বাংলাদেশে-কানাডার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গভীরতাকেই নির্দেশ করে। এ অনুমতি প্রদানের জন্য কানাডা সরকারকে সকল বাংলাদেশি কানাডিয়ানের পক্ষ থেকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।

বিমান কর্তপক্ষ প্রথমে বলেছিল, এবছর জুনের ১১ তারিখ থেকে সপ্তাহে তিনদিন এই ঢাকা-টরন্টো সরাসরি ফ্লাইট চলবে।কিন্তু সর্বশেষ প্রাপ্ত এক সংবাদসুত্রে জানা গেছে, বহুল আলোচিত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-টরেন্টো রুটের এই ফ্লাইটটি সরাসরি ফ্লাইট হিসেবে পরিচালিত হবে না। এই রুটটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে না বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।বিমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ফ্লাইটটি অতিরিক্ত যাত্রী এবং পুনরায় জ্বালানি নিতে ইউরোপের জার্মানি বা এশিয়ার তাশখন্দ বা অন্য যে কোনো দেশে বিরতি নিয়ে পরিচালিত হবে। বিরতি নেওয়ার কারণে ফ্লাইটে জ্বালানি নিতে পারা জাবে, সেখান থেকে অতিরিক্ত যাত্রীও পাওয়া জাবে। যা রুটটিকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করবে। রিফুয়েলিংয়ের সুযোগের কারণে টরেন্টো ফ্লাইটের অপারেটিং খরচ কমবে এবং লোড ফ্যাক্টর বিবেচনায় বিমান এই রুটে আরও বেশি যাত্রী বহনে সক্ষম হবে। এতে সরাসরি রুটের চেয়ে যাত্রীদের টিকিটের দামও কম হবে। বিমান কর্তৃপক্ষের এই পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত বাস্তবসন্মত বলে মনে হয়।যদিও সরাসরি ফ্লাইট হলে প্রবীন তথা বৃদ্ধ ও অসুস্থ যাত্রীরা উপকৃত হতো।

সরাসরি ফ্লাইট হলে বিমানের আসন সংখ্যা ২৯৮ হলেও টেকনিক্যাল কারণে তথা লোড ইস্যুজনিত কারণে তারা সর্বাধিক দুই শত জন যাত্রী বহন করতে পারতো। তাহলে প্রতি সপ্তাহে তিনদিন লাভজনক যাতায়াতের জন্য প্রায় ছয় শত জন যাত্রীর প্রয়োজন হতো। প্রতি সপ্তাহে টরন্টো থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য ছয় শত বা এর কাছাকাছি সংখ্যক যাত্রী পাওয়া প্রায় অসম্ভব হতো। বর্তমানে কানাডাতে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীসহ বাংলাদেশ কম্যুনিটির জনসংখ্যা সর্বসাকুল্যে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখের কাছাকাছি। তার মধ্যে টরন্টো ও তত্সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি কানাডিয়ান।
সকলের মতো আমিও চাই বাংলাদেশ বিমানের এই শুভ উড়াল যেন দীর্ঘায়ু লাভ করে, যেন অকাল মৃত্যু না হয় এই শুভযাত্রার। তাই আমি মনে করি বিমানের এই ফ্লাইট লাভজনক তথা দীর্ঘায়ু করার লক্ষে ঢাকা-টরন্টো সরাসরি চলাচল না করে ট্রানজিট নিয়ে চলাচল করার সিদ্ধান্ত সমীচীন হয়েছে। এখন যাত্রীর অভাব হবে না। হয়তো সময় একটু বেশি লাগবে, কিন্তু যাত্রীর সঙ্কট হবে না। একই সুবিধা ও ব্যয়ে অন্য প্লেনের পরিবর্তে দেশের টানে হৃদয়ের টানে এক টুকরো বাংলাদেশে তথা বাংলাদেশ বিমানেই চলাচল করবে যাত্রীরা। তাছাড়া এসব রুটে বিদেশি যাত্রীও পাওয়া যাবে। সেবার মান ভালো হলে এই রুট লাভজনক হবে।
তবে বিমানের এই ঢাকা-টরন্টো রুটটিকে লাভজনক ও টেকসই করতে হলে, দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা উঁচু করে আকাশে উড়তে হলে বিমান পরিচালনা ব্যবস্থাপনায় লুকোচুরি ভাব এড়িয়ে স্বচ্ছতাও বজায় রাখতে হবে। আমরা চাই আগের বিমানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটের মতো এই রুটটিরও যেন অকাল মৃত্যু না হয়, সেজন্য বিমান কতৃপক্ষ লাগাতার প্রয়োজনীয় বাজার গবেষণা ও বাজার বিশ্লেষণ করবেন।
সমাপ্ত