মুহাম্মদ মুসা খান : এক. সচেতন শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন থাকে বিদেশে পড়াশোনার। অনেকের স্বপ্ন পূরণ হয় এবং অনেকের স্বপ্ন বিভিন্ন কারণে অধরাই থেকে যায়। বাংলাদেশ হতে প্রতিবছর ৬০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। ‘ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনের ওপেন ডোরস ডাটা’র তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৭,৪৯৬ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৮,৯৮৬, যুক্তরাজ্যে ৩,১১৬, কানাডায় ২,০২৮, ও মালয়েশিয়াতে ২৮,৪৫৬ জন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে পড়তে যায়।(বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে) এছাড়াও ইউরোপের জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, এস্তোনিয়া, রাশিয়া এবং এশিয়ার চীন,জাপান, ইন্ডিয়াতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য যাচ্ছে।
দুই. শিক্ষার্থীর পরিবারের বাজেট, শিক্ষার মান, অভিজ্ঞ শিক্ষার্থী ও কন্সাল্টেন্সি ফার্মের উপদেশ ইত্যাদি বিবেচনা করে শিক্ষার্থী/ অভিভাবকরা ভিন্ন ভিন্ন দেশ/বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেন। তবে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বেছে নেয়ার প্রধান কারণ, এসব দেশে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে অভিবাসনে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। অবশ্য কানাডাতে আন্ডারগ্রেডে স্কলারশিপের সুযোগ কম থাকায় এবং স¤প্রতি টিউশন ফি ও দৈনন্দিন ব্যয় প্রচুর বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। কারণ ইউরোপ ও এশিয়ার পড়াশোনার ব্যবস্থা আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় হতে সামান্য বেশি হয়। তবে ইউরোপের অনেক দেশের এম্ব্যাসি না থাকায় শিক্ষার্থীদের ইন্ডিয়া গিয়ে ভিসা সংগ্রহ করতে হয়।
তিন. শিক্ষার্থীরা কেন বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়!
শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে বিদেশমুখী হয়, যেমন – (ক) বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিমুক্ত সুন্দর পরিবেশ (আমাদের মত ছাত্র রাজনীতি বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাই। সেখানে রেগিং নাই। (খ) উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা। (গ) ক্যারিয়ার গঠন। (ঘ) বিদেশে ভাল প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুযোগ। (ঙ) পড়াশোনা শেষে উন্নত দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ।
(চ) নিজের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা। প্রধানত এসব কারণে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়ি জমাচ্ছে।
চার. বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট করতে হয় এবং অভিভাবকদেরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। যেমন- সামান্য কিছু অভিভাবকের কালো টাকা বা ব্যবসার টাকা থাকলেও অধিকাংশ অভিভাবকই সারাজীবনের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠায়। অনেক অভিভাবককে জায়গা/ফ্ল্যাট বিক্রি করে বা ধারদেনা করেও সন্তানের জন্য টাকা পাঠাতে দেখা যায়। মূলত সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্যই পিতামাতা এই ত্যাগ স্বীকার করেন।
পাঁচ. সন্তানের উচিত বিদেশে এসে পিতামাতার এসব ত্যাগের কথা স্মরণ রেখে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা এবং পড়াশোনার ফাঁকে চাকরি করে পিতামাতাকে আংশিক হলেও সহযোগিতা করা। দূ:খজনক ভাবে লক্ষ্য করা যায় যে, কিছু শিক্ষার্থী (সংখ্যায় যদিও খুব কম) বিদেশে এসে পিতামাতার ত্যাগের কথা/কষ্টের কথা ভুলে যায়। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ‘আড্ডায়’ সময় কাটায়, ফলে তাঁদের রেজাল্ট খারাপ হয় এবং অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী মাদকে আসক্ত হওয়ার দূ:খজনক সংবাদও চোখে পরে। অথচ একজন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের জন্য “সময়” অত্যন্ত মূল্যবান। যে সময় সে আড্ডা দিয়ে নষ্ট করে, সে সময়ে পড়াশোনা করলে ভাল রেজাল্ট করা যায় এবং রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে স্কলারশিপও পাওয়া যায়। যেসব বন্ধু- অপর বন্ধুর পড়াশোনার ক্ষতির কথা চিন্তা করে না এবং যে শিক্ষার্থী বন্ধু অন্য বন্ধুকে মাদক সেবনের আড্ডায় আহবান জানায়- সে বন্ধু প্রকৃত বন্ধু নয়, সে পরম শত্রু। বাংলাদেশ হতে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে “প্রতিষ্ঠিত হওয়ার” স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে আসে, কিন্তু তথাকথিত বন্ধু নামের ‘শত্রুর’ পাল্লায় পরে নিজের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়-সেটা শিক্ষার্থীর ও পিতামাতার জন্য খুবই কষ্টদায়ক হয়। জ্ঞানী মানুষরা বলে গেছেন- ঞরসব ধহফ ঃরফব ধিরঃ ভড়ৎ হড়হব. সময় আসলেই কারও জন্য বসে থাকে না। আড্ডা আর মাদকের পাল্লায় পরে যখন ভাল রেজাল্ট করা যায় না, তখন ‘কান্না করা’ ব্যতিত অন্যকোনো পথ খোলা থাকে না। এবং তখন সেই আড্ডাবাজ ও মাদকসেবি বন্ধুরা পাশে থাকে না। (হাঁ, শিক্ষা-জীবন শেষে ‘প্রতিষ্ঠিত হওয়ার’ পর অবসরে বন্ধু আড্ডা আপত্তিকর নয়)।
ছয়. আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের একটা মাত্র জীবন। এক জীবনে ভুল করলে শোধরানোর সুযোগ পাওয়া যাবে না। (ভুল হলে কান্না’ই একমাত্র সংগী হয়)। আর, এই পৃথিবীতে পিতামাতাই হলো একমাত্র আপনজন ও প্রকৃত বন্ধু। সন্তানকে দশমাস দশদিন গর্ভে রাখার কষ্ট সহ্য করে একমাত্র- মা। শৈশবের দিন গুলোতে সন্তানকে লালন-পালন করেন- মা। আর পিতা খেয়ে-না খেয়ে সন্তানের মুখে আহার তুলে দেন। সন্তানের যখন জ্বর হয়, পিতামাতার তখন টাইফয়েড হয়। পিতামাতা তখনই খুশি হোন-যখন সন্তান বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় হতে একটি মর্যাদাবান সার্টিফিকেট হাতে পায়। মনে রাখতে হবে যে, নিজের পরিবার হলো মূল শক্তি, যার পরিবার পাশে থাকে, সেই তত বেশি শক্তিশালী মানুষ। সুতরাং যারা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে, তাঁদের দায়িত্ব হলো পড়াশোনার পাশাপাশি পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং তাঁদের আদেশ-উপদেশ মেনে চলা। অন্যদিকে অভিভাবককেও নিয়মিত সন্তানের খোঁজখবর নিতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত খরচের টাকা যোগান দিলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যা বিবেচনায় রাখতে হবে।
অনেক শিক্ষার্থী বন্ধুদের (নাকি শত্রু?) পাল্লায় পরে পিতামাতাকে ভুলে যায়। কিন্তু বন্ধুর সাথে আড্ডার কথা মনে রাখে। প্রকৃত সত্য হলো, এসব অবিবেচক বন্ধুদের দুর্দিনে পাশে পাওয়া যাবে না। পকেটে টাকা না থাকলে হওলাত পাওয়া যাবে না।
সাত. বিদেশে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের যা যা অর্জনের লক্ষ্য/চেষ্টা থাকতে হবে- ১. ভাল রেজাল্ট করা, ২.পার্টটাইম ও সামারে ফুলটাইম জব করা, ৩.মিতব্যয়ীতা, ৪.সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার (অযথা সময় নষ্ট না করা), যথাসম্ভব ‘আড্ডা’ এভয়েড করা। ৫.শিক্ষা জীবন শেষে একটি সম্মানজনক চাকরি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। পরবর্তী বিষয়গুলো (সংসার জীবন শুরু, যা অটোম্যাটিকলি হবে)। ৬. নিজেকে এলকোহল থেকে দূরে রাখা এবং ধুমপান হতে বিরত থাকা। ৭. ‘খারাপ হিসেবে চিহ্নিত’ বন্ধুর সংগ ত্যাগ করা। এবং ভালো বন্ধু/মানুষের সংস্পর্শে থাকা, ৮. স্ব স্ব বিশ্বাস অনুযায়ী ধার্মিকতার চর্চা করা। ধার্মিকতা মানুষকে পরিশুদ্ধ রাখে, যা পরীক্ষিত সত্য। মানুষের যখন সব আশ্রয় শেষ হয়ে যায়, তখন সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানায়। সৃষ্টিকর্তাই শেষ আশ্রয়স্থল। যা ভুলে যাওয়া অনুচিত। ৯. বাংলাদেশি সংস্কৃতি চর্চার সাথে নিজেকে যুক্ত রাখা। ১০. পিতামাতা/আত্মীয়- স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করা। ১১. স্বদেশের গরীব মানুষের উপকারে কিছু করার জন্য পরিকল্পনা করা ও বাস্তবায়ন করা।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, অনেকে ভালমন্দ চিন্তা না করে বিদেশে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। যা সঠিক নয়। বিশেষ করে আন্ডার গ্রেডে না এসে মাস্টার্স করার জন্য বিদেশে পড়তে আসা অধিক যুক্তিযুক্ত। এতে ম্যাচিউরিটি বাড়ে, টাকা কম খরচ হয় এবং শিক্ষার্থীর কষ্টও কম হয়। তাছাড়া সাবজেক্ট সিলেক্ট করার সময় মনে রাখতে হবে, যে সাবজেক্ট পড়ে শিক্ষার্থী আনন্দ পায় এবং দক্ষতা বেশি সে সাবজেক্ট নিয়েই পড়াশোনা করা উচিত
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা যেনো শুধুই আনন্দ ভ্রমণ না হয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে এবং যে চার বছর বা দু’বছর পড়াশোনা করা হয়, সেটা যেনো সিরিয়াসলি করা হয়। এটাই যেনো শিক্ষার্থীর সংকল্প হয়।
মুহাম্মদ মুসা খান, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।