আতোয়ার রহমান : পুরনো বছরের দুঃখকষ্ট, ব্যর্থতা ভুলে নতুন বছরে নতুন করে শুরু করি আমরা আমাদের জীবনের পথ চলা। সময়ের সঙ্গে অনেক ব্যথা-বেদনার, কষ্ট-যন্ত্রণার কথা ভুলেও যাই। কিন্তু ২০২০ এমন এক বছর যা চাইলেও ভুলতে ভুলতে পারবো না আমরা, ভুলতে পারবে না মানবসভ্যতা। এই বিষময় বছরে একের পর এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছে, গৃহহীন হয়েছে, ক্ষুদার্ত থেকেছে। মৃত্যু হয়েছে বহু কৃতী মানুষের, সন্তানের, বন্ধুর, প্রিয়জনের, স্বজনের।
করোনার ভ্যাকসিন সম্পর্কে আশাবাদ সত্তে¡ও নতুন বছরটি (২০২১) একই রকম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা এখন যে বছরটিকে বিদায় জানাচ্ছি তা ইতিহাসের সবচেয়ে অস্বাভাবিক একটি বছর ছিল এবং অস্বাভাবিকতার এই উত্তরাধিকারটি টিকে থাকবে অনেক বছর ধরে। করোনাভাইরাস মহামারীর বিধ্বংসী আক্রমণ আমাদের জীবনকে ওলট-পালট করে দিয়েছে, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে এবং আমাদের চিন্তাভাবনার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধণ করেছে।
আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম মানুষ যখন মহাকাশ বিজয়ের নতুন নতুন স্বপ্নে বিভোর, তখন তারা একটি অদৃশ্য, অণুবীক্ষণিক ভাইরাসকে পরাস্ত করতে অক্ষম যা এক বছর ধরে বিশ্বকে মুক্তিপণ হিসাবে ধরে রেখেছে। আমরা দেখলাম দৌর্দণ্ডপ্রতাপ আমেরিকাও তার অঢেল ধনসম্পদ, সামরিক শক্তি ও টেকনোলজি নিয়ে এই ক্ষুদ্র ভাইরাসটির কাছে কতটা অসহায়। পৃথিবীর সবচেয়ে এই ধনী দেশটিতে গত নয় মাসে ৩ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছে। এটি উপলব্ধি করার এক বছর হয়ে গেল যে আমরা আমাদের পায়ের নিচে এতদিন যাকে শক্ত ভূমি বলে ভেবেছিলাম তা আসলে একটি খাড়া যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা এক তীব্র আঘাতের সাথে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। গণতন্ত্র এবং ধনী দেশগুলির শক্তিমত্তা থেকে শুরু করে আপনার পরিবারকে খাওয়ানোর এবং মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহ করার ক্ষমতা পর্যন্ত সবকিছু হুমকির মুখে পড়লে, সুরক্ষা ও স্বাভাবিকতার বোধের জন্য আপনি আর কী আঁকড়ে ধরে থাকবেন?
মহামারীবিজ্ঞানের বহুল উপেক্ষিত বিষয়টি এখন একটি ট্রেন্ডিং বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। মুখোশ পরা, স্যানিটাইজার এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের মূল ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা ভ্যাকসিনের বিষয়ে প্রচুর পরিমাণে আশাবাদ সত্তে¡ও, নতুন বছরটি একই রকম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আসছে বছরে ভাইরাস প্রতিরোধী নির্দেশনাগুলি যথারীতি অব্যাহত থাকবে এবং খুব ধীরে ধীরে এবং সতর্কতার সাথে তা শিথিল করা হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
গত বছরের ঠিক এই সময়ে, আমরা করোনা মহামারীর একটি বৃহৎ প্রাদুর্ভাবের কবলে ছিলাম, যদিও আমরা শুরুতে এর তীব্রতা ততটা বুঝতে পারিনি। এ বছরও, আমরা আরো দ্রæত ছড়িয়ে পড়ার এবং সংক্রমিত করার মতো অনেক তেজী বা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন ধরনের করোনা ভাইরাসের সরব উত্থান দেখতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড, কানাডা, ফ্রান্স, স্পেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নাইজেরিয়া, ভারতসহ আরো অনেক দেশে এ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে কানাডার চিফ মেডিক্যাল অফিসার ড: সুপ্রিয়া শর্মা বলেছেন, ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিন স¤প্রতি দেখা দেওয়া এ নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাসের উপর কার্যকরী হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তাই এ নতুন ধরণের ভাইরাস নিয়ে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তারপরেও সামনে কী আরো লকডাউন এবং শাটডাউন আসছে? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন-আশা করি না, যদিও কী উপায়ে এটি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে তা বলা শক্ত। এই মুহূর্তে সারাদুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন যুক্তরাজ্য এ নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাসের সাথে তুমুল লড়াই করছে।
একে অপরের মধ্যে নিরাপদ শারীরিক অবস্থান বোঝাতে একটি আলোচিত শব্দ ‘সামাজিক দূরত্ব’ আমাদের জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে। এটি আমাদেরকে আলিঙ্গন এবং হ্যান্ডশেক এড়িয়ে চলার গুরুত্ব শিখিয়েছে। স্যানিটাইজার এবং মুখোশ এখন যে কোনও ভ্রমণ কিটের অংশ। ভাসমান ভাইরাসের উড়ন্ত কণা থেকে আমাদের বাঁচাতে রঙিন কাপড়ের তৈরি মুখোশ পরা হয়। এগুলি অদূর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের ইউনিফর্মের অংশ হয়ে থাকবে। পুর্ব সতর্কতা নতুন কোভিড স্ট্রেনের বিরুদ্ধে সেরা প্রহরী হিসেবে রয়ে যাবে আরো অনেক দিন। ভ্যাকসিনের পাশাপাশি কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞদের দেয়া পদক্ষেপগুলি মেনে চলা পরিস্থিতি আরো ভালভাবে মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে। আমরা যদি এখনও সাবধান না হই, যদি বিজ্ঞান না মেনে চলি, তা হলে আরো কঠিন বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের পড়তে হবে।
মহামারী-আক্রান্ত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী বিষয়গুলি মোকাবেলা করে চলেছে। করোনাভাইরাসের বিরুপ প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ অনেকাংশে কমে যাওয়ায় বায়ুদূষন অস্থায়ীভাবে হ্রাস পেয়েছে। যদিও মনুষ্যসৃষ্ট কার্বন নিঃসরণ সাত শতাংশ কমেছিল, আমেরিকা এবং অন্যান্য স্থানে ভয়াবহ দাবানলের দরুণ মোট নির্গমন বেড়েছে। এই বছরটি এযাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। যারা জলবায়ু বিজ্ঞানে বিশ্বাসী তারা সবাই জলবায়ু সংশয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্থান উদযাপন করছেন। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, যা পৃথিবীকে আসন্ন ধ্বংস থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করবে।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে, ঘরে বসে কাজের নীতিমালার কারণে আমরা আমাদের নিকটাত্মীয় ও পরিবারের সদস্যদের সাথে আরো সংযুক্ত হতে পেরেছিলাম। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম এবং আরো অনেক স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট ঘরে বসে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা তৈরি করে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। বিনোদনমূলক এই নতুন পদ্ধতিটি আমাদের জীবনে অনেকদিন থেকে যাওয়ার জন্য এসেছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে ভাইরাস আমাদের জীবন থেকে পুরো বছরটি ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদেরকে এই আশ্বাস না দিয়েই যে, নতুন যে বছরটি আসছে সেটি তার কাছে জিম্মি নয়। মহামারীটির চূড়ান্ত অবসান ঘটানোর পরেও জীবন আর কখনো একই রকম হবে না।
সবাইকে নতুন বছরের (২০২১) শুভেচ্ছা। নতুন বছর নিরাময়ের বছর হোক, বয়ে আনুক সকলের জীবনে অনাবিল আনন্দ।