বিদ্যুৎ রঞ্জন দে : বর্তমান বিশ্বে একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সম্বৃদ্ধির পরিমাপ তার প্রবৃদ্ধির হার বা মাথাপিছু আয় দ্বারা নির্ধারণ করা হয় না, নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের জনগণ বা জাতি কতটুকু আনন্দে, খুশিতে ও নিরাপদে আছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সূচক বিশ্লেষণে আমরা উপসংহারে উপনীত হতে যে উপাদানগুলি বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো বাংলাদেশ-পূর্ব পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো। পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত আমরা বাঙ্গালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরেও আমাদে ভাষা, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা, সা¤প্রদায়িকতা, আঞ্চলিক শোষণ, প্রভুত্তবাদী মনোভাব ও বাকরুদ্ধকর পরিস্থিতি আমাদেরকে ঐ শিকল ভাঙ্গার শক্তি ও সামর্থ জুগিয়েছিল। দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম ও আন্দোলনের ফসল হলো মুক্তিযুদ্ধ আর ঐ মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে আসতে অনেক পোড় খাওয়া ত্যাগী নেতৃত্ব তাদের জীবন ও যৌবন উৎসর্গ করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের পথে প্রান্তরে, হাঠে মাঠে, গ্রামে গঞ্জে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুড়ে কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র জনতার মধ্যে যারা তদানিন্তন পাকিস্তানের শোষক গোষ্ঠীর চরিত্র উন্মোচন করে, বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে, এক ইউনিট বাতিল করে স্বায়ত্ত¡শাসনের দাবি উপস্থাপন করেছিলেন, তাদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ফসল মুক্তিযুদ্ধ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ধর্মীয় উন্মাদনার রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না এবং ঐ রাষ্ট্রে অন্যায় অবিচার, দুর্নীতি, খুন-জখম ইত্যাদি চলবে যতক্ষণ না রাষ্ট্রের চরিত্র নিরপেক্ষ ও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। প্রথমেই যে খড়গটি রাষ্ট্রের অখন্ডতার ওপর চালানো হয়েছিল তা হলো রাষ্ট্রভাষা। কায়দে-আজম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষিত হওয়ার পর এর প্রতিবাদ ক্ষীণকন্ঠে হলেও আসে তদানিন্তন পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সদস্য ধীরেন্দ্র দত্তের কাছ থেকে ১৯৪৮ সনের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। এর পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে ছাত্র জনতা রাজপথ রক্তরঞ্জিত করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সফল করে। প্রাণ দেয় রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, সালাম ও নাম না জানা অনেকে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ১৯৫২ সনের ১৬ই অক্টোবর গুলি করে হত্যা ও পরবর্তিতে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মাধ্যমে গদিতে আরোহন ও অপসারণ চলতে থাকে ১৯৫৮ সালের ৬ই অক্টোবর পর্যন্ত। যারা ঐ সময় ক্ষমতার খেলার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন তারা সবাই ছিলেন জোতদার, জমিদার, নবাবজাদা ও পীরজাদা, তাদের সাথে সাধারণ মানুষের কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর ইস্কান্দর মির্জা সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খানকে সামরিক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন। একই সালের ২৭শে অক্টোবর আইয়ুব খান ইস্কান্দর মির্জাকে ইংল্যান্ডে নির্বাসনে পাঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এবং নিজে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সামরিক ফরমান জারি করে মানুষের ন্যূনতম অধিকার হরণ করে দুর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। ১৯৬০ সালে হ্যাঁ বা না ভোটের মাধ্যমে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন এবং মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধুলিস্যাত ও ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ১৯৫৯ সালের ২৭শে অক্টোবর মৌলিক গণতন্ত্র (Basic Democracy) নামে এক কিম্ভুত-কিমাকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন।
যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ১৯৪৮ সালেই অনুধাবন করতে পেরেছিল মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটি সাধারণ মানুষের আশা আকাক্সক্ষা ধারণ করে না এবং ভুঁয়া আশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে আঞ্চলিক বৈষম্যকে চাপা দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায় তাই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ১৯৫৩ সনের ৪ ডিসেম্বর “যুক্তফ্রন্ট” গঠন করেন এবং ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং মুসলিম লীগকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন কিন্তু ৯২ (ক) ধারায় ঐ নির্বাচন বাতিল করা হয়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ নেতৃত্বের মনে যে বিষয়টি রেখাপাত করেছিল তা হলো নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণবিরোধী সা¤প্রদায়িক ও পুঁজিবাদী মুসলিম লীগ সরকার ও তার দোসরদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। টাই ১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে অবস্থানকারী মৌলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করেন এবং এক ইউনিট বাতিল করে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন ও সুষ্ঠু গণতন্ত্রের দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের সামরিক সরকারের ঘোষিত গণবিরোধী শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন করে এবং সরকারকে রিপোর্ট বাতিল করতে বাধ্য করে। ১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রæয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের পক্ষে সুনির্দিষ্টভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবি ৬ দফা পেশ করেন। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন আওয়ামী লীগ ৬ দফার দাবিতে হরতালের ডাক দেয় তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপক সাড়া দেয়। পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরে এবং প্রশাসনকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে তখনকারমত আন্দোলনকে স্থিমিত করে এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বুনতে থাকে। ১৯৬৮ সনের শুরুতে আইয়ুব খান আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান ও আরও ৩৪ জন উচ্চ পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভারতের সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার এক ষড়যন্ত্র মামলা ঢাকা ক্যান্টমেন্ট বিশেষ ট্রাইবুনালে রজু করে। যার নাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ঐ মামলা চলাকালীন সময়ে আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক (Decade of Development) পালিত হয় এবং প্রশাসন জনতার ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ফলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঐ মামলার ব্যাপারে কোন আন্দোলন বা সংগ্রাম গড়ে তোলতে পারেনি। এমনই পরিস্থিতিতে এক বছর পর ১৯৬৯ সালে ১৪ই জানুয়ারী আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবিকে ১১ দফা দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ সর্বদলীয় ছাত্রাসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং ১৯৬৯ সনের ১৭ই জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত¡র থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দোল আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ এবং অঘোষিত কমুনিস্ট পার্টি ছাত্রদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। অনেক শহীদের রক্ত ঝড়িয়ে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রæয়ারী শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের করে নিয়ে আসা হয় এবং রমনা রেইসকোর্সে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৬৯ সনের ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন ও সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত করতে ছাত্রদেরকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস দেন এবং ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ সাধে ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ গণতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে এক দফা আন্দোলনে রুপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের ২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর ফলে ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনতা স্থানে স্থানে বেরিকেড সৃষ্টি করে পাক আর্মিকে প্রতিহত করে কিন্তু শেষ অবধি টিকে থাকা সম্ভব হয়নি কারণ তারা ছিল নিরস্ত্র। ফলে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেই প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ভারতের জনগণ ও সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সাহায্যপ্রার্থী শরণার্থী ও মুক্তিযুদ্ধাদের প্রতি। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে শত্রæমুক্ত করতে চেয়েছিলেন তাদেরকে ভারত সরকার নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে এবং একটি প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠনের অনুমতি দেয়। ফলে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে নিয়ে ১৯৭১ সনের ১০ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথপুর আম্রকাননে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী, বিদেশমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ, ত্রাণ মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং কমান্ডের-ইন-চীফ করা হয় এম এ জি ওসমানীকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ের জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয় মৌলানা ভাসানী, মোজাফফর আহমেদ ও মণি সিংহকে নিয়ে। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও সফল কুটনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে, খন্দকার মোশতাক ও তার দোসররা ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু -না-বাংলাদেশ এই ধুঁয়া তুলে মুক্তিযুদ্ধকে ভন্ডুল করতে চেয়েছিল, তা প্রতিহত করে ভারত সরকারের আস্থা সুদৃঢ় করেছিলেন। অন্যদিকে উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য মোজাফফর আহমদ ও মণি সিং সোভিয়েট ইউনিয়নকে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ফলে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে একটি স্বাক্ষরিত হয় যাতে যে কেউ আক্রান্ত হলে একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এই চুক্তির ফলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদেরকে সংযত করে এবং ভারত ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে সাথে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তান তার সমর্থনকারী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বন্ধ ও সৈন্য ফিরায়ে নেওয়ার দাবি উথাপন করে তাতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়ন ৩ বার ভেটো প্রয়োগ করে। অবশেষে ১৯৭১ সনের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। শুরু হয় বিজয় মিছিল, শ্রদ্ধা জানানো হয় ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি এবং ৩ লক্ষ মা-বোন যারা তাদের ইজ্জত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে উপহার দিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতা। প্রবাস থেকে ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা সরকার। শুরু হয় পুনর্গঠন কর্মসূচী। এরই মধ্যে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিশ্ব নেতাদের চাপে মুক্তি দেয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী দেশে ফিরেন। মাত্র ৩ বছর (১৯৭২ – ১৯৭৫) তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এরই মধ্যে একটি সংবিধান অপহার দেন যার মুখবন্ধে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশকে একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দু:খের বিষয় ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট কুচক্রী মোশতাক গংরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং ৩রা নভেম্বর স্বাধীন বাংলা সরকারের চার নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ওই একই কুচক্রী মহল জেলের ভিতরে হত্যা করে। এই ঘটনার পর কুচক্রী মোশতাককেও ক্ষমতা ছাড়তে হয় এবং ক্ষমতায় আসীন হন সামরিক সরকার জিয়াউর রহমান। আবারও পাকিস্তানি সামরিক ধারায় ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সংবিধানকে সংশোধন করা হয় এবং সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচার, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র হ্যা বা না ভোটের মাধ্যমে নির্বাসন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার স্থানে বিসমিল্লাহির রহমানের রহিম সংযোজন করা হয়। তারপরেও জিয়াউর রহমান নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। কারণ তিনি একসময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হন। ক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক সরকার হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। তিনি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করেন। ১৯৯১ সালে ছাত্র আন্দোলনের ফলে এরশাদের পতন হয় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আসন গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন বেগম খালেদা জিয়া আর বিরোধী দলের প্রধান হিসাবে শেখ হাসিনা। শুরু হয় গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র। পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার অন্তরালে পৃষ্টপোষকতা পায় ব্রিফকেস ব্যবসায়ী, কালোবাজারী, আদম ব্যবসায়ী ও নমিনেশন ব্যবসায়ী। ঘুষ, দুর্নীতি, কালো টাকা ও মুনাফালোভী গোষ্ঠীর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। টাকা পাচার হয় বিদেশে। গণতন্ত্রের নামে হয় ভোট ডাকাতি, উন্নয়নের নামে হয় পুকুরচুরি। ১৯৯৬ সালে জনগণ ওই সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে ক্ষমতায় বসায় আওয়ামী লীগকে। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণের কোনো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
আবার ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি, সাথে ধর্মীয় মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামী। এর পরবর্তী নির্বাচনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাদা ছোঁড়াছুড়ির ফলে ২ বছর সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকে। ২০০৮ সালে পুনরায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে সাথে নিয়ে জয়লাভ করে এবং আরো ২টি নির্বাচনেও জয়লাভ করে। কিন্তু জনগণ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে, কালোটাকার মালিকরা অর্থের বিনিময়ে নির্বাচিত হয়ে সংসদকে ব্যবসায়ীদের সংসদে পরিণত করার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে। সর্বোপরি বিএনপি সময়ের যে অপসংস্কৃতির রাজনীতি দেশে ছিল আওয়ামী লীগ আমলেও একই ধারার রাজনীতি চলতে থাকে। ঘুষ, দুর্নীতি, টাকা পাচার ও আরও যে সমস্ত সামাজিক অন্যায় ও ব্যভিচার বিএনপি আমলে ছিল তা বর্তমানেও বহাল আছে। উভয় দলই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে মৌলবাদী ও স্বৈরাচারীদের তোষণ করছে। ৭২ এর সংবিধানের মূলনীতি থেকে তারা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে, তাদের মূল দাবি ক্ষমতা। তাই জনগণ আজ রাজনীতিশুন্য বাংলাদেশে হতাশায় ভোগছে এবং খুঁজছে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি যারা মুক্ত সমাজ ও সুখী সম্বৃদ্ধশালী বাংলাদেশ উপহার দেবে।