ভজন সরকার : নেহেরু-জিন্নাহ ১৯৪৭ সালে ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকুন্ডের মধ্যে পূর্ববংগের বাঙালিদের ঠেলে দিয়েছিলেন। তার ঠিক ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সে অগ্নিকুন্ড থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে আবার উদ্ধার করেন। আর কোন কিছুর কথা বিবেচনায় না এনেও শুধু এই একটি কারণের জন্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি আমরা আমৃত্যু কৃতজ্ঞ।
কৃতজ্ঞ এ কারণে যে, পৃথিবীর একটি নিকৃষ্ট রাষ্ট্র, যার নাম পাকিস্তান, সে পাকিস্তান নামটি আর আমাদের সাথে বয়ে নিতে হয় না। বরং এক বুক গর্ব নিয়ে আমরা আজ বলতে পারি যে, পাকিস্তানীদেরকে আমরা ঘাড় ধরে আমাদের ভূখন্ড থেকে বের করে দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কী বিপদজ্জনক তা ১৯৭১ থেকে আজ পঞ্চাশ বছর পরেও অনুধাবন করা যায়। পৃথিবী যেখানে প্রগতির পথে যাচ্ছে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানীরা তখন চলছে উল্টো পথে। আজ সারা বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানী থেকে উদ্ভুত “পাকি” শব্দটি যেন এক অপমানকর গালি। আর যাই হোক না কেন, “পাকি” শব্দটি বুকে-পিঠে ধারণ করে তো আমাদেরকে আর চলতে হয় না। এটা এক প্রকার সুখকর অনুভূতিই বটে। আর এ অনুভূতিটুকু আমরা পেয়েছিলাম ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে এক বিজয়ের মধ্যে দিয়ে।

পাকিস্তানীদেরকে ঘাড় ধরে বের করে দিলেও তাদের দালাল-খাদেম-পাইক-পেয়াদাদের কেউ কেউ এখনো জীবিত আছেন বাংলাদেশে। সেই গুটি কয়েক দালাল-খাদেমদের জন্য পাকিস্তানীদের দরদ এখনো আকাশচুম্বী। সেই দালালেরা তাই সুযোগ বুঝে মাঝেমধ্যে ঘেউ ঘেউ করে। কখনো কখনো নখের আঁচড় কাটারও চেষ্টা করে।

পাকিস্তানী এবং পাকিস্তানীদের প্রতি আকাশচুম্বী দরদ ১৯৭১ সালেও ছিল। সে দরদ থেকেই তৈরী হয়েছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে নদীমাতৃক বাংলার পথ-ঘাট-মাঠ-বাড়ি-ঘর চিনিয়ে দিয়েছিল দেশীয় এই রাজাকারেরা। মা-বোনদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যেত এই রাজাকারেরা। দেশের মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের হত্যাও করেছিল এই রাজাকারেরা। তখন দেশীয় রাজাকারদের সাথে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের মধ্যেও একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিল আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের সংগ্রামের বিরুদ্ধাচারণই শুধু করেনি, তখনকার আমেরিকার প্রশাসন পাকিস্তানী বাহিনীর গনহত্যাকেও সমর্থন জানিয়েছিল।

যে আমেরিকা আজ মানবতার ধারক-বাহক বলে দাবী করে, নিছক রাজনীতির জন্য ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন বিসর্জন এবং দুই লক্ষ নারীর প্রতি অমানবিক অত্যাচারকেও তখন সেই আমেরিকা এবং তাদের মিত্ররা ন্যায্যতাই দিয়েছিল। তখন এক মহীয়সী নারী বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা যদি রাশিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়াতেন তবে আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতা এতো সহজে সম্ভব হতো না। আজ যখন আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মানবতার কথা বলে, তখন বাংলাদেশের মানুষ হতবাক হয়ে যায় তাদের এই দ্বিচারীতা দেখে।

১৯৭৫ সালে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়ে আবার সেই পাকিস্তানী ভাবধারাতেই চলে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে যারা পরাজিত হয়েছিল, তারা আবার মাথা গজিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন হিমাগারে। মুক্তিযোদ্ধারা হত্যাকান্ডের শিকার। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আবার কলুষিত করতে শুরু করছিল পাকিস্তানপন্থী সামরিক বাহিনীর অফিসারেররা। রাজনীতি তখন সামরিক ব্যারাকে। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পাকিস্তানের আদর্শে আবার সা¤প্রদায়িক করে গড়ে তোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।

দেশীয় এই ষড়যন্ত্রের সাথে আগের মতোই যুক্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক কিছু গোষ্ঠী। এবার আমেরিকার সাথে সংযুক্ত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কিছু সা¤প্রদায়িক দেশ এবং সংগঠন। অসা¤প্রদায়িক চেতনার উপর ভিত্তি করে যে মুক্তিযুদ্ধ, যে স্বাধীনতার সংগ্রাম, সেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ যোগ হয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই মৌলবাদের সূতিকাগারে তখন।

রাজনীতিকে ধ্বংস করার জন্য রাজনীতিবিদদের বেচাকেনার পণ্য হিসেবে ব্যবহার, ঠিক যেন আজকের পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের আবির্ভাব। এসবের পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের মনে রাজনীতির প্রতি ঘৃণা তৈরী করে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা, যা আজ দেখা যায় পাকিস্তানী-আফগানিস্তানসহ অনেক দেশেই।

একথা বলে অত্যুক্তি হবে না যে, তখনকার বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান ছিল খুবই সামান্য। সত্যি কথা বলতে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ তো পাকিস্তানের পথেই চলছিল। কিন্তু বাঁধ সেধেছিলেন আরেক মহিয়সী নারী। পিতা যেমন রক্ষা করেছিলেন, কন্যাও সেই পথেই বাঙালিকেই রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। অসংখ্যবার হত্যাচেষ্টা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। মৃত্যুর দ্বার থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছিলেন অসংখ্যবার বংগবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

১৯৯৬ সালে ২১ বছর পরে ক্ষমতায় এসে তিনিই বাংলাদেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নেওয়ার পথে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু এই ২১ বছরে প্রায় সব কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে সব কিছুই মুক্তিযুদ্ধের মূলচেতনার বাইরে চলে গেছে। দেশের নতুন প্রজন্মও সা¤প্রদায়িকতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবুও হাল ছাড়েননি বংগবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

কিন্তু আবার সেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। আবার পাকিস্তানপ্রেমী সা¤প্রদায়িকগোষ্ঠীর ক্ষমতা দখল। বেসামরিক-সামরিক তকমা লাগিয়ে সে ক্ষমতা ছিল প্রায় এক যুগের মতোই, দীর্ঘ আটটি বছর, ২০০১ থেকে ২০০৯।

নানা প্রতিক‚লতা সরিয়ে ২০০৯ সালে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল ক্ষমতায় এসেছিল শেখ হাসিনারই নেতৃত্বে। কিন্তু দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চক্রান্ত বারবার বাংলাদেশকে পেছনে ঠেলেই দিয়েছে। বারবার পাকিস্তান এবং সেই আদর্শের সা¤প্রদায়িক রাষ্ট্রের দিকেই নিয়ে যেতে চেয়েছে। সে চেষ্টা এখনো চলছে নিরন্তর এবং অব্যাহত ভাবেই। এই দীর্ঘ দিনে স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের কৌশল বদল করেছে। সা¤প্রদায়িক পাকিস্তানীগোষ্ঠীরা ইদানিং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পালক গায়ে জড়িয়েছে বর্ণচোরার মতো। আগে যাদের সহজেই চেনা যেত, এখন তারা সবাই ক্যামোফ্লেজে। বিপদ এখানেই। ঘরে ঢুকে পড়া শত্রুরাই এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনীতির বড় শত্রু।
প্রতিটি বিজয় দিবসে আশা -আকাঙ্খা থাকে, আশঙ্কাও থাকে; বাংলাদেশ যেন কখনোই পেছনে ফিরে না যায়; বাংলাদেশ যেন আজকের পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ এবং নিকৃষ্ট রাষ্ট্রে পরিণত না হয় কোনদিনই। জয় বাংলা।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা। )