হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

হরিণের মাংস ভক্ষণ ও অ-লেখক সমাচার

চোরা শিকারিদের ধরা হরিণের মাংস চুরি করে কিনে খাওয়ার কথা বলছি না। বলছি হরিণ মাংস খায়- সেরকম একটি বিষয়ের কথা। হরিণ মাংস খেতে পারে, সেটা একটা বিখ্যাত বই পড়ে জেনেছি। আমার সংগ্রহে বিখ্যাত শিকারি Fred G. Merfield-এর Gorilla Hunter (১৯৫৬) গ্রন্থটি রয়েছে। বইটা পড়ে জেনেছি যে, কোনো কোনো প্রজাতির হরিণ অন্য জন্তুর মাংস খেয়ে থাকে। ডুইকার (Duiker) তেমন এক জাতের অ্যান্টিলোপ বা হরিণ। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশেই এই প্রাণীটি বিদ্যমান। প্রাণীটি ছোটো, সুন্দর ও দ্রুত গতিসম্পন্ন। শিকারি ম্যারফিল্ড ক্যামেরুনের রেইনফরেস্টে একটি গোরিলা শিকার করেন। তিনি ও তার লোকজনেরা গোরিলার চামড়া ছাড়ান। মাংস বিলিয়ে দেন গ্রামবাসীদের মধ্যে। গোরিলার মাংস ওদের কাছে খুবই উপাদেয়! এক বালক তার ভাগের মাংস না খেয়ে সেই মাংসের টুকরো দিয়ে ফাঁদ পাতল ডুইকার ধরার জন্য। ম্যারফিল্ড নিজে অনেকবার ডুইকার প্রজাতির হরিণকে হাড্ডি চিবোতে দেখেছেন। উদাহরণটি এজন্য যে, বই (ভালো বই) পড়লে অজানা অনেককিছু জানা যায়। আর তা মনে গেঁথে থাকে।

বই লিখতে হলে বই পড়তে হয়। যতটা সম্ভব ভালোমানের লেখা লিখতে হবে, লেখার চাইতে পড়তে হবে তার চেয়ে বেশি। অথচ বর্তমান সময়ে পড়াশোনা না করে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বা নাম কুড়াবার জন্য বই লেখার যে প্রতিযোগিতা দেখছি, তাতে আতঙ্কিত হতে হয়। রাতারাতি লেখক গজিয়ে যাচ্ছে। বইমেলায় প্রকাশ করছে। এত বইয়ের ভিড়ে পাঠক-ক্রেতারা বিভ্রান্ত হন। আমি সাধারণ পাঠকের কথাই বলছি। অনেক স্টলে বিশাল চটকদার ব্যানার টানানো হয়। সেসাথে ‘লেখক’ বসে থাকেন স্টলে এবং কোনো মেয়ে সেজেগুজে সেই লেখক এবং লেখা সম্পর্কে অনবরত লিপ সার্ভিস দিয়ে যায়। এরকম লেখকরা বহুমুখি কৌশল গ্রহণ করে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম ব্যানার ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, যাতে লেখা থাকে ‘মেলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী বা পাঠকদের সর্বোচ্চ ভোটে সেরা উপন্যাস।’ এইসব লেখকদের ‘আলোড়ন সৃষ্টিকারী’ ঐতিহাসিক লেখা হরিণ কর্তৃক গোরিলার মাংস ভক্ষণ করার মতোই বিসদৃশ।

সত্যিকার অর্থে জ্ঞানী হওয়া ও জ্ঞানার্জনের বিষয়টি অনস্বীকার্য। তা আমি নিজে বহুবার আর বহু পরিস্থিতিতে উপলব্ধি করেছি। আবার শুধু জ্ঞানী হয়ে আত্মম্ভরিতা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। জাহির করাও যাবে না। গুণবান জ্ঞানী হতে হবে। আর যে বিষয়ে আমি জানি, তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। যা জানি না, তা নিয়ে ভাব ধরার চেষ্টা করাটা জগতে সবচেয়ে অসুন্দর একটি কাজ।

২০১০ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় এক কবি বন্ধু’র সাথে সাহিত্য আলোচনা করছিলাম। সেসময়ে আমি অ্যালিস মানরো’র ‘দি প্রোগ্রেস অব লাভ’ অনুবাদরত ছিলাম। কাজটা যে কী কঠিন-সেটা বারবার উল্লেখ করছিলাম। একসময় কবি বন্ধু আধুনিক নৃতত্ত¡বিদ্যার জনক ক্লদ লেভি স্ট্রসের প্রসঙ্গ টানল। আমি অকপটে স্বীকার করে ফেললাম যে, ক্লদ লেভি স্ট্রস সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ। আমার অকপট স্বীকারোক্তিতে কবি ভারী খুশি হয়েছিল। সেই কবি’র সাথে সাহিত্যালাপের সূত্র ধরে ক্লদ লেভি স্ট্রস সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা করেছিলাম পরবর্তীতে। চিন্তা-চেতনা, সমাজ ও দর্শন বিষয়ে ক্লদ একজন অগ্রগামী স্ট্রাকচারালিস্ট। সাহিত্য, সমাজ ও মানব মনকে বুঝতে ও সাহিত্য চর্চা যারা করেন তাদের জন্য লেভি স্ট্রস ও তার কর্মকে জানা বেশ জরুরি একটি বিষয় বলে আমি মনে করি।
স্টলে বিশাল চটকদার ব্যানার টানানোর পরিবর্তে এখানে আমি বিনীতভাবে জানাতে চাই যে, আমার গল্প নিয়ে (২০১৯) আমার গল্পগ্রন্থ ‘প্রেয়সী ও গোলাপের কাঁটা’ অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত এবং প্রশংসিত হয়েছে। সেবার আমার বই প্রকাশের বিষয়টা একটু ব্যতিক্রমী ছিল। কেননা, আমি কানাডার টরোন্টো-এ অবস্থান করছিলাম। শেষ পর্যন্ত অর্থকড়ি ম্যানেজ করে এলাম ঢাকায়। আসা যাওয়া উপলক্ষে যে খরচাপাতি হয়েছে, তার তুলনায় প্রাপ্ত সম্মানী খুবই নগণ্য। সৃষ্টিশীল কাজে এমনটা হতে পারে। আর তা নিয়ে কোনো খেদ প্রকাশ করতে নেই।

পাঠক বা পাঠিকা স্টলে এসে বইটা উল্টেপাল্টে দেখল, কেউ বা কিনল। সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্ত থেকে বঞ্চিত হইনি।
এবং কামনা করি, হরিণ যেন গোরিলার মাংস আর না খায়।