হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
১৯৮৮ সালের বন্যার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। সেই বছর ঢাকা শহরের মধ্যেই নৌকা চলেছিল। আমি তখন অনার্স পাস করে আমার জীবনের প্রথম চাকরিতে প্রবেশ করি। পরে অবশ্যি এমএ পড়ার জন্য দীর্ঘ সময়ের ছুটি নিই। এটি অবশ্যই একটি ব্যতিক্রমী বিষয় ছিল। কোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান প্রায় একবছর সময়ের জন্য ছুটি দেয় কিনা আমার জানা নেই। আমি ঢাবিতে ইংরেজি বিভাগে অনার্স পাস করে আর্থিক দুর্গতির কারণে চাকরিতে ঢুকেছিলাম। আমার চাকরিস্থল ছিল কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লি.।
অবশ্য লম্বা ছুটি নিতে আমি খুঁটির জোর প্রয়োগ করেছিলাম। তবুও ভেবে রেখেছিলাম যে, উইদাউদ পে-তে ছুটিতে গিয়ে ফিরে এসে চাকরিতে যোগদান করতে না পারলে কীইবা এমন আসে যায়।
খুঁটিটা ছিল আমার মেজো দুলাভাই। তিনি তখন রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি উনাকে দিয়ে কনকর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে ফোন করিয়ে ছুটি মঞ্জুর করিয়েছিলাম।
পরে আমি যথারীতি এমএ পাস করি কৃতিত্বের সাথে। কনকর্ডে যোগাযোগ করে জেনে অবাক হই যে, আমার চাকরিটা নাকি আছে। যোগ দিলাম ফের; যদিও সেই চাকরিটি আমি করিনি বেশিদিন। সাংবাদিকতার নেশা ভর করায় কনকর্ডের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দি নিউ নেশন পত্রিকায় সাব এডিটর হই, পরে সিনিয়র সাব এডিটর। সেই চাকরিটিও বেশিদিন করিনি। সেই উপাখ্যান সামনের কোনো পর্বে বয়ান করব।
কনকর্ডে পুনরাগমন করে আমার একখানা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। বন্যার পরপরই কমলাপুর থেকে প্রথম ট্রেন যাবে চট্টগ্রাম। কর্তৃপক্ষ আমাকে বলল চট্টগ্রাম যেতে হবে। তথাস্তু-বলে রাজি হয়ে গেলাম। আমি তখন টগবগে তরুণ, যেকোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে যাই যখন তখন। যদিও প্রচুর রিস্ক ছিল, সব স্থানে পানি সম্পূর্ণ নামেনি, রেলের লাইনের অবস্থা অনেক জায়গায় নড়বড়ে। বন্ধু আলমকে সাথে নিয়ে কমলাপুর এসে টিকেট কাটলাম, কিন্তু টিকেটসমেত আর টিকেটবিহীন হাজারো মানুষ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। যে কম্পার্টমেন্টে উঠলাম তাতে আমাদের সিট নাম্বার থাকলেও সেই সিটের ধারে কাছেও পৌঁছানো গেল না। প্রকৃতপক্ষে, দরজা দিয়ে ভেতরেই ঢুকতে পারছিলাম না। অনেক কসরৎ করে ঢুকলেও দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলাম না। মনে হলো ছাদে উঠে বসতে পারলে ভালো হতো।
যাইহোক, গাদাগাদি করে চললাম। বিভিন্ন স্টেশনে লোক নেমে যাওয়াতে একসময় ভিড় হালকা হলেও সমস্ত পথ দাঁড়িয়েই যেতে হলো। আমার কাজ ছিল, চিটাগাং-এ কনকর্ডের কাজ সেরে দেয় এমন একটি ইন্ডেটিং ফার্মে গিয়ে তাদের সাথে কিছু এক্সেসরিস আমদানির বিষয়টি ত্বরান্বিত করে আসা। ফার্মটির নাম ছিল ট্রেড সিন্ডিকেট। আগ্রাবাদে ছিল সেই ফার্মটি। চিটাগাং এসে আমি উঠলাম খালাতো ভাই শাহরিয়ার ভাইজানদের বাসায়। আর আলম চলে গেল ওর বড় আপার বাসায়। কাজ সারতে দেড় দিন লাগল। একদিন ঘুরে কাটালাম।
তৃতীয় দিন সকালে দেখলাম, ঢাকায় যাবার সরাসরি কোনো ট্রেন নেই। অবশেষে চাঁদপুর যাবার ট্রেনে প্রথম শ্রেণিতে উঠে বসলাম আমি আর আলম। চাঁদপুর নেমে চরম হতাশ হতে হলো। ঢাকায় যাবার শেষ লঞ্চটিও চলে গেছে। আলম বলল, আগে খাওয়ার কাম সাইরা লই, তারপর দেখি কী করা যায়। হোটেলে খেতে বসেই জানলাম, রাত সোয়া এগারোটায় নাকি একটা লঞ্চ আছে। তবে টিকেট নেই, সব স্থান পূরণ হয়ে গেছে। আলমকে বললাম গিয়ে দেখ না ওদের কাউন্টারে যদি একটা ক্যাবিন ম্যানেজ করা যায়। আলম নানা জারিজুরি দিয়ে, বিচিত্রসব কথার ফাঁদে ফেলে একটা ক্যাবিন ম্যানেজ করে ফেলল। তবে, ভাড়া অতিরিক্ত দিতে হবে। এবার আমিও যোগ দিলাম আলমের সাথে। অনেক কথা চালাচালির পর, মোটামুটি একটা অংকে ফেলে ক্যাবিন ভাড়া করে ফেললাম। সারারাত না ঘুমিয়ে শেষরাতে যখন চোখটা একটু লেগে এসেছিল, এসময় টের পেলাম আমাদের ক্যাবিনে হুড়মুড় করে লোকজন ঢুকে পড়েছে। ব্যাপারটা কী?
ঝড়। প্রচণ্ড ঝড়। মনে হলো, দানবীয় ঝড়ের ঝাপটায় বিশাল কূলকিনারাহীন জলধারায় লঞ্চটা বুঝি এই ডুবল। আমাদের সলিল সমাধির বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। অ্যাসিডিটির প্রবলেমটাও বেড়ে গেল। আলম জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে লঞ্চের ক্যাবিনের একটা টিনের গøাসে বৃষ্টির পানি ধরে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। সেটুকু খেয়ে একটু আরাম বোধ করলাম। মানুষের ভিড়ে, তাদের গায়ের দুর্গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমাদের ক্যাবিনে আশ্রয় নেয়া লোকগুলো সবাই প্যাসেজের যাত্রী।
না, সে যাত্রায় লঞ্চটা ডোবেনি, আমাদেরও করুণ পরিণতি হয়নি। ঝড় থেমে গেল, লোকগুলো চলে গেলে একটু আরাম করে শুয়েছি, এমনি সময় দেখলাম লঞ্চটা উল্টাপাল্টা দুলছে। আমার চাইতে লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আলমের বেশি, কারণ তার বাড়ি বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুরে (বর্তমানে জেলা) হওয়ায় সে লঞ্চ ভ্রমণ করেছে শতবার। আলম জানাল যে, নদীর ঘূর্ণিতে পড়ে গেছে লঞ্চ। দুই নদীর সংযোগস্থলে এমনটা নাকি হয়, খুব সম্ভব পদ্মার শেষসীমা অতিক্রম করে আমরা বুড়িগঙ্গায় পড়ছিলাম তখন। আলম অকথ্য ভাষায় সারেং-এর উদ্দেশ্যে গালি ঝাড়তে লাগল। ভদ্রভাষায় ব্যাখ্যা করলে যার সারাংশ হয়-এই ব্যাটা পাকা সারেং না। নতুন। গাঁজাখোর। ইচ্ছে করলে আর অভিজ্ঞ সারেং হলে এরকম ঘূর্ণি এড়িয়ে চলা যায়। আর আমি ভাবছিলাম- প্রথমে ঝড় বুঝি আমাদেরকে এক ধাক্কায় পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে, সেটা থেকে বেঁচে এখন তো দেখছি ঘূর্ণি-ভূত বোধহয় ঘুরাতে ঘুরাতে মেরে ফেলবে। আলম জানাল, ভয়ের কিছু নেই। পুরোপুরি ঘূর্ণির ভেতরে পড়েনি, তাহলে খবর হতো। একসময় দেখলাম, লঞ্চের গতিবিধি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তারপর তো পৌঁছুলাম সাতসকালে।
পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে জানালাম কী বিপাকে পড়েছিলাম। কাজটা সেরে এসেছি, সেটাও জানালাম। বাহবা পাইনি; কাজ সেরে এসেছি তাতেই কর্তৃপক্ষ খুশি। কীভাবে প্রাণ হাতে করে গেছি আর ফিরে এসেছি- তাতে তাদের খুব বেশি আগ্রহ নেই যেহেতু তারা মাসশেষে কিছু পয়সা দেয়!
আজ এতবছর পরে ভাবি, এরকম একটি ভ্রমণ না করলেও পারতাম। কর্তৃপক্ষকে বুঝাতে পারতাম যে, যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। স্থানে বিপদ ও ঝুঁকি। একে অনভিজ্ঞ ছিলাম, তার ওপর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে বসেছিল।
আবারও দেখা হবে বালুকা বেলায়। অনেক গল্পই যে বাকি রয়ে গেছে।