Home কলাম বালুকা বেলা : ভাটি অঞ্চলের দেশে

বালুকা বেলা : ভাটি অঞ্চলের দেশে

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আশির দশকের পুরোটাই বলতে গেলে আমার কেটেছে ঘোরলাগা স্বপ্নময় জগতে। সেই সময়টার সাথে এখনকার সময়ের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য, স্যাটেলাইট আর ইন্টারনেটের আশির্বাদে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণে নতুন ছোঁয়া লেগেছে, পুরোনোকে তাড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। কোনো পিছুটান আর এখন তাদের নেই। কেবল সামনে চলা।

আশির দশক ও বর্তমান সময়টার মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা আমার কাছে মনে হয় সময়েরই শুধু পার্থক্য না, পার্থক্য মানুষের বহিঃমুখী প্রবণতা। নতুন নতুন পেশা ও জীবিকার সৃষ্টি এবং কম্পিউটার, সেলফোন ও ইন্টারনেটের ব্যপ্তি। সেইসাথে অভিনব সব চ্যালেঞ্জ, যার অন্যতম হলো এক নেশা, অর্থের নেশা। যে নেশায় গোটা দেশ ডুবে যাচ্ছে। এই নেশাকে কেন্দ্র করে ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে চলেছে হিংসা-দ্বেষ-প্রতিযোগিতা-ভেজাল-খুন-গুম-মাদক-অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ আমদানি, মানব-পাচার ও আদম ব্যবসা এবং রাজনৈতিক সংঘাত আর জিরো টলারেন্স। যাইহোক, সাদামাটাভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, আশির দশকটি ৭০ ও ৯০ দশকের মাঝামাঝি একটি ট্র্যানজিশন পিরিয়ড কিন্তু স্বর্ণালি একটা সময় ছিল। কিছু ঘোর লাগা, কিছুটা ঘোর থেকে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার মতো একটি সময়।

এই পর্যায়ে আমি একটি ভ্রমণ দিয়েই শুরু করছি আজকের বালুকা বেলায় বিচরণ। ভাটি অঞ্চলে ভ্রমণ। সুবীর নন্দী’র কন্ঠে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সেই গান টার কথা মনে পড়ছে- ‘এক যে ছিল সোনার কন্যা, মেঘবরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ।’ তখন অবশ্যি সেই গান বা নাটক সৃষ্টি হয়নি; কিন্তু পরবর্তী সময়ে নাটকটি দেখার পর আমার দেখা ভাটি অঞ্চলের সাথে সেই গানের অনুপম সাদৃশ্য খূুঁজে পেয়েছিলাম।
ভাটি অঞ্চলের রূপ সম্পূর্ণ আলাদা ও সুষমামণ্ডিত। এর পৃথক একটি রূপ আছে, আছে লাবণ্য ও স্বাতন্ত্র। ভৌগোলিক বিশিষ্টতা এই অঞ্চলকে অন্যসব এলাকা থেকে অভিনব একটা অবয়ব দিয়েছে। ভাটি অঞ্চলে একবার গিয়েছিলাম বর্ষাকালে, আরেকবার শীতকালে।

যেবার বর্ষায় গেলাম সেসময়কার অপরূপ দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। স্থানটার নাম হুমায়ূনপুর। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ’র বাড়ি এখানেই। হুমায়ূনপুর কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলাধীন একটি ইউনিয়ন। স্থানীয়ভাবে পরিচিত একটি গ্রাম হুমাইপুর। এই গ্রামেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম এবং দিনকয়েক সেখানে ছিলাম। তবে আরও বিস্তৃত ভাটি এলাকা করিমগঞ্জের ইটনা বা নেত্রকোণার ভাটি অঞ্চলে আমার যাওয়া হয়নি। ভৈরব জংশনের পরে উত্তরে কয়েকটি স্টেশন পরেই একে একে বাজিতপুর, সরারচর ও কুলিয়ারচর। আমি আর মামাতো ভাই রেজাউল সরারচর থেকে লঞ্চে ঘন্টা তিনেকের যাত্রায় হুমায়ূনপুর পৌঁছুলাম। যেতে আসতে দুয়েকটি শাখা নদী বোধহয় পার হয়েছিলাম। বিপুল জলরাশির মধ্য দিয়ে লঞ্চে ভ্রমণের সময় মনে হচ্ছিল কোনো কূলকিনারা যেন নেই। যতদূর চোখ যায়, শুধু উত্তাল পানি আর পানি। একসময় ঘাটে পৌঁছুলাম।

একটি ছোটো লঞ্চঘাট। টানা লম্বা একটা দ্বীপ সেটা। হেঁটে আর রিকশায় এলাম হুমাইপুর গ্রামে। এখন এটি একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম, আলাদা একটি উঁচুভূমি। এর তলদেশ ডুবে আছে পানিতে, বর্ষা চলে গেলে সে ফিরে পাবে তলদেশ, তার প্রান্তর আর চাষযোগ্য জমি। বর্ষাকালে এখানকার মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা বা লঞ্চ। এসময় তাদের কেটে যায় মাছ ধরে বা অলসতায়। আইড়মাছ, বোয়াল মাছ আর ছোটো মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে কেটে গেল ক’টি দিন।

পরের বার গেলাম শীতে। তখন হুমাইপুরের অন্য আরেক রূপ। পরিযায়ী পাখি শিকারের ধুম পড়ে যায় ভাটি অঞ্চলে। আমি বন্দুক দিয়ে পাখি শিকারের পক্ষপাতি কখনোই ছিলাম না। অনেকদিন ভোরে সবাই দল বেঁধে পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে গেলেও আমি শীতের কুয়াশাঘেরা সকালে প্রকৃতির বুকে বিচরণশীল অপরূপ সুন্দর পাখিগুলো দেখতাম। শিকারের নেশা জাগত না। তবে সরালি বা ওই জাতীয় অনেক অতিথি পাখির গোশত খেয়েছি। কেননা, পাখিগুলোকে মেরে যখন ফেলা হয়েছে, এবং ঝাল-ঝাল করে রান্না করাও যখন হয়ে গেছে তখন তো আর বসে থাকা যায় না। আমি তো মারিনি। কিন্তু না খেলে ঠকে যেতে হবে। যেদিন পাখি রান্না হয়, সেদিন তো আর বড় বড় রুই-কাতলা তো রান্না হবার কথা না।

সেবার মোনায়েম খাঁ’র বাড়িটা দেখলাম। অনেকটা প্রাচীন ভগ্নাবশেষের মতোই। এতদঞ্চলের লোকজনের দুর্ভাগ্য যে, মোনায়েম খাঁ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। খাঁ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরে ঢামেক হাসপাতালে মারা যান।

সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভিবাজারের হাওর ও বাঁওড় অঞ্চলে, মানে বহুবিস্তৃত স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হাওর অঞ্চলই যে আমার দেখা হয়নি! বলা যায়, হাওর অঞ্চলের পরিপূর্ণ রূপ আমি এখনও দেখিনি। এই এক জীবনে সেটা আর সম্ভব না-ও হতে পারে। একটা সুযোগ এসেছিল হাওর অঞ্চলের পরিবেশগত দিক দেখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পে যোগ দিতে। আমি যোগ দিইনি। ফলে হাওর ও বাঁওড় আমার দেখা হয়নি। বেঁচে থাকলে বা কখনও কোনো সুযোগ এলে হাওর-বাঁওড় দেখার ইচ্ছেটা এখনও সযতনে লালন করছি।

Exit mobile version