হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
প্রতিবছর বিশ^জুড়ে ৫ জুন পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। মূলত সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই পালিত হয় এই দিবস। ইউনেপ বা জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি এই দায়িত্ব পালন করে আসছে। ইউএনইপি বা ইউনেপ নিষ্ঠার সাথেই পালন করছে তার দায়িত্ব আর প্রতিবছর বিশেষ একটি থিমের ওপর তারা প্রচারকার্য চালায়। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা. দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, ইকোসিস্টেমের ধ্বংসসাধন ও প্রকৃতির ওপর মানব হস্তক্ষেপের ফলে বর্তমান বিরূপ পরিস্থিতি ও ভবিষৎ হুমকি ও সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করতে এই থিম বা স্লোগান আঞ্চলিক ও বিশ^ প্রেক্ষাপটে অবদান রাখে।
এবছর পরিবেশ দিবসের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ এবং খরা প্রতিরোধের ওপর ভিত্তি করে- “Our land. Our future. We are #GenerationRestoration.” লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে যে, এই বছরের হোস্ট কান্ট্রি সৌদি আরব, যেখানে মরুভূমিতে এখন তুষারপাত হচ্ছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই প্রকৃতির এমন বিরূপ ও বিসদৃশ আচরণ।
‘সবুজ ভবিষ্যতের যাত্রা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০২৪ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপিত হবে। এই বছরের পরিবেশ দিবসের মূল লক্ষ্য হবে অগ্রাধিকার হিসেবে ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ এবং খরা স্থিতিস্থাপকতা।
বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয় যথাযথভাবে। একসময় বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের নানা কর্মসূচির একটা অংশ ছিলাম আমি। বিশেষভাবে এই দিবস উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশের দায়িত্বে থাকতাম, আমি যখন আমি পরিবেশে চাকরি করতাম। গত তিন চার বছরের স্মরণিকায় অবশ্য আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এবার শারীরিক অসুস্থতা ও অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে আমি লেখা দিতে পারিনি।
সৌদি আরব ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ এবং খরা স্থিতিস্থাপকতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ২০২৪ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজন করবে। ভূমি পুনরুদ্ধার ও ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের ওপর জাতিসংঘের দশকের (২০২১-২০৩০) একটি মূল স্তম্ভ যা বিশ্বজুড়ে বাসÍুতন্ত্রের সুরক্ষা এবং পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি সমবেত আহ্বান, যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কিছুদিন আগেও মানুষ পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। ৯০ দশক থেকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক নাড়াচাড়া হয়। ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরোতো অনুষ্ঠিত হয় ধরিত্রী সম্মেলন বা আর্থ সামিট ১৯৯২ সালে। জাতিসংঘের ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসির বৈজ্ঞানিকেরা নিরলসলভাবে কাজ করে প্রতিষ্ঠিত করেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন মানবসৃষ্ট। আর তা চরম আকার ধারণ করে বর্তমান শতাব্দীতে এসে। ১৭০০ শতকের শেষদিক থেকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব হয়, তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইয়োরোপে। পরের শতাব্দীগুলোতে এই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে বিশ^জুড়ে। কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, সিএফসি প্রভৃতি আকাশ-বাতাস-পাতাল ও সমুদ্র তলদেশ ও উপরিভাগ দূষিত করে চলে বৃহত্তর কলেবরে। যেসব দেশ বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে যত্রতত্র কলকারখানা বা শিল্পায়ন করে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছিলো, তাদের পক্ষ থেকে একটা প্রচারণা ছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তন মানবসৃষ্ট নয়। প্রাকৃতিক সাইকেলের কারণে এটি ঘটছে। তাদের এই অপপ্রচার রুখে দিয়ে আইপিসিসির বৈজ্ঞানিকগণ প্রতিষ্ঠা করেন যে, দ্রুততম সময়ে জলবায়ুর ব্যাপক ও নেতিবাচক পরিবর্তন মানবজাতির ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কুফল।
ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (Global Warming) প্রক্রিয়া হলো জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিশেষ প্রপঞ্চ (phenomenon). বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মানুষের কারণে সৃষ্ট- অনেক বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে ইউএনএফসিসিসি ও আইপিসিসি এই বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করেছে। মানুষের কারণে পরিবর্তনকে মনুষ্যসৃষ্ট (Anthropogenic) পরিবর্তন বলে। আর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী ক্ষতিকর গ্যাস হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড এবং সালফারের অন্যান্য অক্সাইডসমূহ, নাইট্রিক অক্সাইড, মিথেন এবং ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) প্রভৃতি।
এখন এটাই বাস্তবতা যে, উন্নত বিশ্ব পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক বড় বড় সম্মেলনে রাখা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করবে না তাদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে, অন্যদিকে দুর্বল ও বিপন্ন দেশগুলোর ভূমিকা হবে আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা ও ক্ষতিপূরণ দাবি। এজন্য বাংলাদেশকে যেমন অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে, তেমনি সচেষ্ট থাকতে হবে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সাহায্য পেতে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, ইকোসিস্টেম, ভূমি, বাতাস ও সাগর-নদী-জলাভূমি- সবকিছুই একটা চেইন বা শৃক্সক্ষলে আবদ্ধ। এরা একে অপরের পরিপূরক। এদের যে কোনো একটি বিনাশ বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, অন্য উপাদানসমূহেও তার প্রভাব পড়বে।
প্রতিবারের বিশ^ পরিবেশ দিবস উপলক্ষে একটি থিম বেছে নেয়া হয়, যা বর্ণিত চেইনের আওতাভুক্ত। আর এটা করা হয়, বিশেষ থিমের ওপর বিশ^জুড়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনে বিশে^র ধনী রাষ্ট্রগুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখবে এবং কার্বন নিঃসরণ রোধে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে- এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।