হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
ধরিত্রী বেচাকেনা ও সবুজের সংলাপ
১৮৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন প্রেসিডেন্ট সিয়াটল উপজাতিদের নির্দেশ দেন তারা যেন তাদের বসতি উঠিয়ে সেই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সেখানে তৈরি হবে ‘আধুনিক-সভ্য’ শহর ও বসতি। নির্মিত হবে কারখানা, বড় বড় রাস্তা এবং আরও কতকিছু! উপজাতীয় সর্দার তখন বড় সর্দারের (প্রেসিডেন্ট) কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধানকে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে যা লেখা হয়েছিল তা একইসাথে একটি মহামূল্যবান দলিল আর ভাষা, ভাববস্তু ও আবেদনের মহিমায় এক অসাধারণ কাব্য। তার দুয়েকটি লাইন এখানে তুলে ধরা হলো:
‘ঝরনাগুলোর জলের মর্মরে আমার বাবার ও তার পিতৃপুরুষদের স্বর শোনা যায়।’
‘কী করে তোমরা বিকিকিনি করবে আকাশ, ধরিত্রীর উষ্ণতা?’
‘সুগন্ধ ফুলগুলি আমাদের বোন, হরিণ, ঘোড়া, বিশাল সব ঈগলপাখি-এরা আমাদের ভাই।’
‘বাতাসের সতেজতা, জলের ঝিকিমিকি-আমরা তো এগুলোর মালিক নই। তবে তোমরা (আমাদের কাছ থেকে) এগুলো কিনবে কেমন করে?’
ছোটো সর্দারের লেখা এই চিঠিটিকে জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দলিল হিসেবে। ভাবতে অবাক লাগে ১৬২ বছর আগে কী অসাধারণ এক বোধ কাজ করেছিল সামান্য উপজাতীয় সর্দারের মস্তিষ্কে!
প্রকৃতিকে বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। ওজোনস্তরের ক্ষয়, ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভৃতি সেই ইঙ্গিতই আমাদেরকে দেয়।
পৃথিবীর স্বাস্থ্য যে ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছে তার বহু সহস্র নজির আছে। পর্যটন শিল্পের অতিবাহুল্য কর্মকাণ্ডে, অতি আহরণ এবং কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে নয়নাভিরাম ভূ-মধ্যসাগরের নাভিশ্বাস উঠেছে। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকরী হাতিয়ার বৃক্ষসম্পদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে আমাজন রেইন ফরেস্ট ও সেখানকার আদিবাসীরা। সূত্রমতে, প্রতিবছর ১৫ মিলিয়ন হেক্টর বন (বেশিরভাগই আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায়) উজাড় হচ্ছে। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত/ ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিষাক্ত বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম।
শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগ করে পৃথিবীর মানুষ অতি ভোগবিলাসী জীবনযাপন করে একসময় দেখল অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। বর্জ্য ও বিষাক্ত ধাতুর সমস্যা এখন পৃথিবীর সবদেশেরই সমস্যা। শিল্পবিপ্লব পরবর্তীতে প্রায় দুইশ’ বছর ধরে ইয়োরোপের দেশসমূহে উৎপাদনের চাকাকে সচল রাখতেই ব্যস্ত ছিল উদ্যোক্তারা। শিল্পবিপ্লবকালিন যে দূষণ ইয়োরোপে ছড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় কলেবরে, তেমনি সেসব শিল্পের কাঁচামাল যোগানোর জন্য এশিয়া ও আফ্রিকার শস্যক্ষেত্রগুলো অবিন্যস্ত ব্যবহারের কবলে পড়ে উৎপাদন শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং প্রতিবেশ-ব্যবস্থার অবনতি হয়। আজ তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো যেসব জটিল পরিবেশগত ও প্রাতিবেশিক ভঙ্গুরতার শিকার, তার অনেকগুলোরই শেকড় গাঁথা আছে উন্নত দেশগুলোর অতিভোগ ও অতিরঞ্জিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে।
বিশ্বের দেশগুলো কে কতটা কার্বন নিঃসরণ কমাবে, সেই বিষয়ে আশু সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দৃশ্যমান না হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউনেপ) সবুজীকরণের দিকে ঝুঁকছে। ইউনেপ-এর যৌবন পার হয়ে গেল। কিন্তু থেমে নেই তারা। বিশ্বের পরিবেশ স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির প্রেক্ষিতে সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি তারা চালিয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ-জলবায়ু-টেকসই উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে নানা মেরুকরণ চলছে। পৃথিবীর উষ্ণায়নে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ভারত, চীন, ব্রাজিল, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশের দ্রুত শিল্পায়নের প্রেক্ষাপটে। জলবায়ুজনিত হুমকির মুখে বাংলাদেশের মানসিক অবস্থা অনেকটাই ঝুঁকে আছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়ার দিকেই। টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়া ও অর্থনীতিকে বেগবান করার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু অজ¯্র গুরুভার কাঁধে। বিশেষভাবে বিগত চারদশকেরও অধিক সময়ে বহু চুক্তি কিংবা কনভেনশন সহিসাবুদের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করলেও নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থেকেছে উন্নত বিশ্ব।
যখন বৈশ্বিক কূটচাল নিয়ে আমাদের ভাববার কথা তখন ঘরের সমস্যাই আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত রাখছে। শিক্ষা, খাদ্য-আশ্রয়, নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট অর্জন, পরিবেশ-বান্ধব শিল্পায়ন- সবই তো টপ প্রায়োরিটি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মূল লক্ষ্য দারিদ্রবিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। কিন্তু এই লক্ষ্য ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য একবিংশ শতাব্দীর সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সেই অর্জনের লক্ষ্যের পদক্ষেপকে শ্লথ করে দিচ্ছে। উন্নতবিশ্ব এবং অধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর দায়ভার বহন করছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিকভাবে নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার দেশটি। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘনঘন শিকার হচ্ছে ঝড়-ঝঞ্ঝা-সাইক্লোন ও জলোচ্ছ¡াসের। পরিবেশ-উদ্বাস্তু সৃষ্টি হচ্ছে। সম্পদ ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ব্যপ্তির দিক থেকে নিঃসন্দেহে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে পরিবেশ রক্ষার ধারণাটি। কিছু অর্জন হয়েছে, একথা অনস্বীকার্য, ওজোনস্তরের ক্ষয়রোধে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি রোধে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা সন্তোষজনক নয়।
আমাদের দেশের আর্তি ও মানুষের দুর্ভোগে বিশ্বনেতারা দুয়েকটা উপদেশমূলক বাণী দেন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বা জলবায়ু/ পরিবেশ সম্মেলনে। নানা সমস্যাক্রান্ত, দারিদ্রপীড়িত, হুমকিগ্রস্ত, ভৌগোলিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ বিগত চারদশকেরও বেশি সময়ে অনেক চুক্তিতে স্বাক্ষর ও র্যাটিফাই করেছে, অনেক ঐতিহাসিক প্রখ্যাপনের সাক্ষী হয়ে আছে এই দেশ। বহু অভ্যন্তরীণ আইন প্রণয়ন ও প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। ঘটা করে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। কিন্তু সাফল্য কি প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছেছে?
বাংলাদেশ এবং অনুরূপ উন্নয়নশীল নিম্নকার্বন নিঃসরণকারী কয়েকটি দেশ যদি শিল্প-কলকারখানা বন্ধ করে দিয়ে চুপটি করে বসে থাকে, তাতে বিশ্ব উষ্ণায়ন থেমে যাবে না। ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে প্রসার ঘটাতে হবে শিল্প ও কলকারখানার। তবে তা কোনোভাবেই স্থানিক ও বৈশ্বিক পরিবেশকে দূষিত করে নয়। পরিবেশ-বান্ধব শিল্পায়ন ও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কিন্তু ফান্ড ও লাগসই প্রযুক্তি কোথায়? সেসব যে এখনো আমাদের নাগালের বাইরে। অথচ এই সবুজীকরণের কনসেপ্ট জোরালোভাবে ঝুঁকছে আমাদের দিকে। কে কতটা কার্বন উগড়ে দিল, কে দিল না-তা নিয়ে কালক্ষেপ না করে সবুজের দিকে এগুতে হবে। কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ, সম্পদ, টেকনোলজি ও অর্থ তো হাওয়ায় ভেসে আসবে না।
ঘুরেফিরে মানেটা দাঁড়াচ্ছে কিন্তু একই-জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সবুজের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সুতরাং পাঁকে যখন পড়া গেছে, তখন উত্তরণের পথে আগাতে হবেÑহোক তা কচ্ছপ গতির। বিশ্বদরবারে আমাদের বিপন্নতার মাত্রা জোরালোভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের নীতি-নির্ধারক, পরিবেশবিদ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রকদের। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগে উঠলে চলবে না। কম ঘুমিয়ে জাগ্রত থাকবার সময়টা বাড়াতে হবে। বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে এখনই তৎপর হতে হবে। সরব হতে হবে বিশ্বের দরবারে। উন্নত বিশ্বের পরিবেশবাদী ও চিন্তাবিদদের নজর কেন্দ্রীভূত করতে হবে এই দেশটির দিকে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কুফলের বর্তমান নমুনা ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তলিয়ে যাবার আশংকার আগাম চিত্রটি করোটিতে গেঁথে নিতে হবে। যা কিছু তহবিল গড়ে উঠছে বা উঠবে, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। শর্ষেয় ভূতের মতো পরিবেশ ও জলবায়ু তহবিল তসরুপের অনেক ঘটনা অজানা বা নতুন কিছু নয়।
পরিবেশ সমস্যা ও ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ দ্বিমুখী সমস্যায় দোদুল্যমান-অভ্যন্তরীণ দূষণ ও অব্যস্থাপনা এবং অনতিক্রম্য জলবায়ু হুমকি। বাস্তবতা আর উদ্ভুত জটিল পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই বাংলাদেশেকে প্রতিকার ও মানিয়ে নেয়ার কৌশল ও সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আর যত বেশি সম্ভব পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে হবে আর দেন-দরবার করে অনুদান ও ফান্ড আদায় করে নিতে হবে। বাংলাদেশের পরিবেশ-খাতে যে দুর্নীতি বিদ্যমান, তা সমূলে উৎপাটন করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হবে পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদেরকে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং অধীনস্থ সংস্থাগুলোর পক্ষে এককভাবে গুরুভার বহন সম্ভব নয়। সরকারের অন্যান্য সংস্থা বা মন্ত্রণালয়-কোনোটিই পরিবেশ সংরক্ষণ বা টেকসই উন্নয়ন অর্জনের কঠিন সংগ্রামের দায় এড়াতে পারবে না। কেননা, পরিবেশ উন্নয়ন ও টেকসই ধারণাটির পরিধি সুবিস্তৃত এবং প্রতিটি সেক্টরে এগুলোর সম্পৃক্ততা রয়েছে। পরিবেশ ও যাবতীয় উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনের দায়িত্ব এখন গোটা বিশ্বের- রাষ্ট্রনায়ক থেকে সাধারণ ব্যক্তি পর্যন্ত। সিয়াটলের উপজাতীয় সর্দারের কাছ থেকে বর্তমান পৃথিবীবাসী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সেই সর্দারকে আমরা শ্রদ্ধা করি, কেননা সেই সর্দার বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের এবং জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতীক। আমরা বিপন্ন ও বিপদাপন্ন। ধনী ও দায়ী রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আমাদের দিকে ফেরাতে হবে। আশা করা যায়, কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী দেশগূলোর বোধোদয় হবে।