হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
বাংলা কাগজে আমার নিয়মিত কলামে ইতোমধ্যেই অনেক এপিসোড লিখেছি। আর ‘বালুকা বেলা’ কলামও অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। আর অসংখ্য বিষয়ে লিখেছি। ক্যানেডীয় আদিবাসী থেকে শুরু করে আমার জীবনের ঘটনাবলি (যাকে আংশিক আত্মজীবনী বলা যেতে পারে), প্যান্ডেমিক, সাহিত্য, গান-বাজনা, স্বাস্থ্য ও ডিপ্রেশন বিষয়ে আর বিশেষত পরিবেশ এবং জলবায়ু বিষয়ে লিখেছি।
বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। তাই গত কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম এবিষয়ে এবারের এপিসোডটি তৈরি করব।
পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, ডেঙ্গুতে নতুন করে দেশে আরো ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মৃত ১৬ জনের মধ্যে আটজন ঢাকার এবং আটজন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা ছিল।
এ নিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে ৬৩৪ জনের মৃত্যু হলো। এটা রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু। এক কোরীয় নাগরিক ঢাকায় এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় (২ সেপ্টেম্বর) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৬০৮ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার ৩০২ জনে।
রবিবার (৩ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত হবার আর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ঢাকা মহানগর ও আশেপাশের এলাকার নানারকম উন্নয়ন কর্মকান্ড বাড়লেও এবং জীবনযাত্রার উন্নয়ন হলেও অবনতি হয়েছে পরিবেশের, দুষণ বেড়েছে, বায়ুদূষণ তো বেড়েই চলেছে। সেইসাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ও পবিকল্পনাহীন নির্মাণ ও নানা জাতের চরম দুষণকারী ক্ষুদ্র ও বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও কারখানা গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো। মূলত বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা, ময়লা-আবর্জনা, দূষিত ডোবা, অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এডিস মশার লার্ভা বৃদ্ধিতে মদদ দিচ্ছে। এছাড়া অসংখ্য বাড়িতে নানা আধারে ময়লা জমানো পানি ডেঙ্গু পরিস্থিতির সার্বিক অবনতির আরও একটি বড় কারণ। এর সাথে যোগ হয়েছে জনগণের অসচেতনতা।
ঢাকা শহর একইসাথে উন্নয়ন ও দূষণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সবচেয়ে বড় ক্ষতি সাধিত করছে প্লাস্টিক ব্যাগ। এই ব্যাগ ড্রেনেজ সিস্টেম, জলাধার ও ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর দূষণকে শেষসীমায় নিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা নদী এখন একটি মৃত নদী। একে আবর্জনার অতিকায় আকৃতির ভাগাড় বললে অত্যুক্তি হয় না। এর পাড়ের অনেক জায়গা অবৈধ দখলে, আর মলমূত্র ত্যাগের অসংখ্য কাচা পায়খানা ও আবর্জনা ফেলার আদর্র্শ স্থান। নদীর কিনারের পানি প্রচণ্ড রকমের দূষিত ও স্থির। লক্ষকোটি লার্ভা জন্মাবার জন্য এসব কিনারার পানি আদর্শ আধার।
বহু বিলাসবহুল দালানকোঠা, আধুনিক মল, আর নানা ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে উঠলেও ঢাকা মহানগরকে সার্বিক বিচারে অপরিচ্ছন্ন, জীবাণুযুক্ত ও নানা ভাইরাস জীবাণুর আবাসস্থল বলা যায়।
আমার পরিচিত অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে একজন ইহধাম ত্যাগ করেছে।
ডেঙ্গু জ্বর (সমার্থক ভিন্ন বানান ডেঙ্গি) একটি এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষয়ী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষয়ী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার (চষধঃবষবঃ) মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনও বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধান। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়।
ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে।
পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে, যেমন, ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা যায়।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে। তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর।
মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তবে এই উপায় বাংলাদেশের মতো দেশে কার্যকর করা কঠিন কাজ। যে দেশে মানুষ অসচেতন, এবং যে দেশে এডিস মশার আবাসস্থল প্রতিনিয়ত তৈরি হবার সবরকম উপাদানই অস্তিত্বমান।
মোদ্দা বিষয় হলো, মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহকে ও জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারকে এডিস মশা নিধনে সুদূরপ্রসারী ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
এজন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন, কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। মশারি ব্যবহার করতে হবে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি এতো সংহারী রূপ ধারণ করল কেন? এর একটি বড় কারণ ডেঙ্গু রোগটিকে খুব হালকাভাবে দেখা আর এর বিরুদ্ধে গোড়াতেই কার্যকরী ব্যবস্থা না নেয়া।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আর এই রোগের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরেও সেদিকে নজর না দেয়ায় এই বছরে মারাত্মক হয়ে উঠেছে বলে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন।
তারা বলছেন, একসময়ে বাংলাদেশে রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও, গত কয়েক বছর ধরে সারাবছর জুড়ে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে এই রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রোগটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আশা করছি, জনগণ আরও সচেতন হয়ে উঠবেন আর সরকার চিকিৎসা সেবা ও এডিস মশা নিধনে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। (সূত্র: পত্রপত্রিকা, উইকিপিডিয়া ও বিবিসি বাংলা নিউজ)।