হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
আকারে যেমন বড়, কাজেকর্মেও তেমন। বলছি রাজকীয় কানাডীয় ছারপোকার কথা। হতেই হবে, কানাডা দেশটি যেমন বড় এর ছারপোকাগুলো যদি আকারে বড় না হয়, তাহলে মান থাকে না। এই রয়েল ছারপোকাগুলো আপনাকে ছাড় দেবে না কিছুতেই। ক্ষেত্রবিশেষে ধনীরা যেমন গরিবের রক্ত চুষে খায়, এরাও তেমন অভিবাসীদের রক্ত খেয়ে পেটমোটা হয়ে নড়তে পারে না। এরা রাজকীয় এজন্য যে কানাডার মোনার্কি প্রধান রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দেশ ব্রিটেনেও এইসব ছারপোকা বসবাস করে! আর প্রতিবেশী দেশ অ্যামেরিকা হলো মোটামুটি এসব বাঘা পোকাদের উৎপত্তিস্থল বলে মনে করা হয়।
কানাডিয়রা এসব পোকাকে বলে থাকে বেডবাগ। বিছানার পোকা আরকি। বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আমরা তখন নতুন এসেছি কানাডায়। আমার ছেলে একদিন বলল যে ওর শরীর চুলকায়। আমি ভাবলাম, বোধহয় ওর বেডকভারে ধুলো জমে গায়ে অ্যালার্জির সৃষ্টি করছে। ওর বিছানার কভার পাউডার সাবান আর ডেটল পানি দিয়ে ধুয়ে ভালো করে শুকিয়ে তারপর বিছিয়ে দিলাম। তখনও ভাবিনি যে, বেডকভার যতই পরিষ্কার করে ধুই না কেন, চুলকানির কারণ অন্য কিছু। এরকমই হয়, এদেরকে সহসা দেখা যায় না। একদিন দেখলাম ছেলের বিছানায় একটা পোকা হাঁটছে। পোকাটাকে মেরে সেটা চোখের সামনে রেখে অনলাইনে কানাডীয় ছারপোকার ছবি বের করে আমার আবিষ্কার করা পোকাটার চেহারা মিলালাম। মিলে গেল। কিন্তু ভাবতে পারিনি আমরা ইনফেস্টেড। এই পোকাটাকে আমাদের দেশের মন্ত্রী’র মতো ‘একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ মনে করলাম।
হয়তো অন্য কোথাও থেকে এটা আমাদের বাসায় চলে এসেছে। ভাবিনি যে আমাদের বিছানায় ছারপোকা থাকতে পারে। কারণ আমরা সেকেন্ড হ্যান্ড কোনো জিনিস কিনিনি। ক’দিন যাবত আমার শরীরও চুলকাচ্ছিল। আমার বরাবরই অ্যালার্জি আছে। ঢাকায় থাকতে ধুলোবালিতে আমার শরীর চুলকাত এবং চাকা চাকা হয়ে যেত। তেমনি একটা সিম্পটম আমারও দেখা দিল। ভাবলাম খাবার থেকে বা ঘরের জীবাণুদুষ্ট আবহ থেকে আমার শরীরে অ্যালার্জি হচ্ছে। ডাক্তারের কাছে যাব মনস্থ করলাম। সমস্ত শরীরে আমার প্রায় ঘায়ের মতো হয়ে গেল! তবুও ভাবতে পারছিলাম না যে, এটা ছারপোকার কামড়জনিত কারণে হতে পারে। ভাবতে না পারার কারণও আছে। এদেরকে তো দেখা যায় না। ঘুমনোর সময়, রাতের অন্ধকারে এরা কামড়ায়। খুব দ্রুত পালিয়ে যায়। ক’দিন পর আরো দুয়েকটি ছারপোকা দেখলাম ছেলের বিছানায়। আর আমার স্ত্রী একদিন আবিষ্কার করল আমাদের বিছানার ভাঁজে অসংখ্য ছারপোকা! সেদিন থেকে লেগে গেলাম কাজে। সমস্ত ঘর বিøচিং পানি দিয়ে মুছতে লাগলাম নিয়মিত। বিছানার আর কাপড়ের ছারপোকা ধ্বংস করলাম। তারপর প্রথম কয়েকদিন ¯েপ্র করলাম লাইজল। তাতে ছারপোকা কমলেও একেবারে চলে গেল না। বিছানার সূ²তম খাঁজে কোথাও লুকিয়ে থেকে রাতে কামড়ে যাচ্ছিল। এরপর ১৪ ডলার দিয়ে কিনে আনলাম ‘বেডবাগ কিলার’ অ্যারোসল ¯েপ্র। এতে উপাদান হিশেবে আছে ডি-ফেনোথ্রাইন ও টেরামেথ্রাইন। এই ¯েপ্র খুব কাজে দিল। দিনকয়েকের মধ্যেই অবশিষ্ট ছারপোকা মেরে ফেলতে পারলাম। জানিনা, দুয়েকটি হয়তো আমাদের মাঝারি আকারের অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া, এগুলো ছড়ায় খুব দ্রুত। দেয়াল বেয়ে, পাইপ বেয়ে এমনকি করিডোর দিয়েও এরা এক বাসা থেকে অন্য বাসায় চলে আসতে পারে। তবে আমি নিয়মিত ¯েপ্র করে যাচ্ছিলাম আর বিøচিং পানি দিয়ে ঘর মুছে যাচ্ছিলাম।
আমাদের বাসায় ছারপোকার আক্রমণের কারণ হলো অ্যাপার্টমেন্টের পূর্বের বাসিন্দারা। আমরা যেখানে থাকি, অর্থাৎ ৭ ক্রেসেন্ট প্লেস-এর স্বত্ত¡াধিকারী হলো টরোন্টোর পাইনডেল প্রোপার্টিজ লি.। অবস্থার প্রেক্ষিতে আমরা এক বাঙালি পরিবারের কাছ থেকে অ্যাপার্টমেন্ট বুঝে নিয়ে পরে পাইনডেলের সাথে চুক্তি করি বিশেষ বিবেচনায়। সেই ফ্যামিলি নোংরাভাবে বসবাস করায় এবং বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন না রাখায় অসংখ্য ছারপোকা লুকিয়ে ছিল বাসার আনাচেকানাচে। আমি আর আমার স্ত্রী মিলে ম্যাসিভ পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে কিছুটা জাতে তুলি বাসাটাকে। কিন্তু ক’দিন পরেই ক্লোসেটে আর ক্যাবিনেটে লুকিয়ে থাকা ছারপোকাগুলো আক্রমণ করতে শুরু করল আমাদের, যেন তারা অক্ষশক্তি আর আমরা মিত্রবাহিনি। লেগে গেল গৃহযৃদ্ধ।
আমার একটা ধারণা ছিল, বোধহয় অভিবাসীদের (বিশেষভাবে পাক-ভারত-বাংলাদেশি) দ্বারা ছারপোকা আমদানি হয় এই দেশে, কিন্তু পরে বুঝলাম, পাকভারতীয় উপমহাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠি দ্বারা নয়, এরা এই দেশেরই রাজকীয় বাসিন্দা।
প্রাচীন ঔপনিবেশিকদের দ্বারা ছারপোকা ছড়িয়ে পড়ে মূলত অ্যামেরিকা ও ইয়োরোপে। কলোনিস্টদের পালতোলা জাহাজগুলো ছিল ছারপোকা বোঝাই। এসব জাহাজ দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়ে ছড়াতে থাকে ছারপোকা। কোনো শহর, লোকালয় বা বসতিতে ছারপোকা দেখা দিলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরনো আসবাবপত্র/বিছানাপত্র প্রভৃতি আদানপ্রদান বা ক্রয়বিক্রয়ের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে ছারপোকা। ডিডিটি ও ম্যালাথিওন ব্যবহার করে প্রায় নির্মূল করা হয় ছারপোকা। নব্বই দশকে এই পোকা আবার ছড়িয়ে পড়ে অ্যামেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশে। কানাডার ছারপোকাগুলো আকারে এক বেশ বড়ই। চ্যাপ্টা, প্রায় কাগজের মতো পাতলা। রক্ত খেলে একটু মোটা ও লালচে হয় এরা। এদের পাখা নেই। তবে দ্রুত এরা লুকিয়ে যেতে পারে। আর একবার লুকিয়ে পড়লে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। কোনো খাঁজে বা ভাঁজে দুয়েকটা ছারপোকা লুকিয়ে থাকলে বা ডিমগুলো ধ্বংস না হলে এরা আবার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
তারপর মনস্থির করলাম, এই অ্যাপার্টমেন্টে আর নয়। এই গেরিলাবাহিনিকে ধ্বংস করার সাধ্য আমাদের নেই। আর বাংলাদেশে আমাদের এরকম কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কানাডার মতো দেশে এসে যদি ছারপোকারই কামড় খেতে হয়, তবে এদেশে এসে লাভ কী হলো?
এস্পার-ওস্পার। তো খুঁজতে লেগে গেলাম অন্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট। পাইনডেলে বসে এমন একজন সুইট্জারল্যান্ডের মহিলাকে দিয়ে খুঁজে বের করলাম দুই বেডরুমের একটি বাসা। ততোদিনে আমার চাকরি হয়েছে অক্সি নামের একটা এনভায়রনমেন্টাল কোম্পানিতে। এটোবিকোতে তাদের সাইট।
আগের ফার্নিচার ফেলে দিয়ে লিয়নস ও একটা বাংলাদেশি দোকান থেকে ফার্নিচার কিনে ঘর সাজালাম।
রুয়ান্ডান বিদ্রোহী, যারা গোরিলা শিকার করে তাদের মাংস খেয়ে ফেলে, তেমন হাড়ে হাড়ে বজ্জাত ছারপোকা থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের কানাডীয় জীবন কিছুটা আনন্দময় হয়ে উঠল। সবচাইতে খুশি হলো আমার ছেলে। নিজের রুমে দরজা-জানালা ভালোভাবে আটকে সে প্লে স্টেশন ফোর-এ যাবতীয় গেমস খেলতে লাগল হাই ভলিউমে।
আর আমি ও আমার স্ত্রী জীবিকার তাগিদে জেরবার হতে লাগলাম।