Home কলাম বালুকা বেলা : জীবনী, আত্মজীবনী, মেমোয়ের না স্মৃতিকথা?

বালুকা বেলা : জীবনী, আত্মজীবনী, মেমোয়ের না স্মৃতিকথা?

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

কাজটা শুরু করেছিলাম সুদূর কানাডার টরোন্টোতে অবস্থান করে। তখন কানাডায় আমার প্রথমদিকের সময়। হতাশা-অনিশ্চয়তা আর বিবমিষায় সময় কাটছিল। মাঝেমধ্যে ছোটোখাটো কোনো ট্রেইনিং বা ভলান্টিয়ারিংএ অংশগ্রহণ করছিলাম। যে বিষয়টা গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধছিল তা হলো বেকারত্ব। আর আমার স্ত্রী কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছিল ‘একটা কিছু করো’ বলে। তাকে দোষ দেয়া যায় না। অনিশ্চয়তায় ভুগছিল সে-ও। আর সে নিজেও চেষ্টা করে যাচ্ছিল। সত্যি বলতে কি, আমার চেয়ে বেশি উদ্যমী সে-ই ছিল।
ছেলে স্কুলে যাচ্ছিল, কম্পিউটার আর প্লে স্টেশন নিয়ে রাত জাগছিল, আর আমার বা তার মায়ের সাথে গপ্পো করত। আর এদিকে আমার মাথায় খেলে গেল উদ্ভট ভাবনা। পাগলের পাগলামি আরকি। অন্তত আমার স্ত্রী’র ধারণা সেরকমই ছিল। একটা লোক রাতভর জেগে কম্পিউটারে এত কী লিখে যায়!
বললাম, জীবনী।
কার জীবনী?

কার আবার, আমার জীবনী। আত্মজীবনী। অন্যের জীবনী আমি লিখতে যাব কেন? কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমার মতো নগণ্য মানুষের জীবনী কে পড়তে যাবে? ধুত্তুরি, বলে লেখা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আমার অন্তর্ধানে না হয় এটা আমার জীবনের ডায়েরি হয়েই থাকুক না; কেউ না কেউ তো পড়বে।

তো শুরু হলো জীবনী লেখা পর্ব। এর আগে অনেক বিশিষ্ট মনীষীদের জীবনী বা অটোবায়োগ্রাফি পড়েছি। একটা ব্যাপক তাগাদা অনুভব করছিলাম আমার প্রিয় সংগীতশিল্পী কিংবদন্তি মান্না দে’র আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসা ঘরে’ পড়ার। কিন্তু বইটা আমার সংগ্রহে ছিল না। পরবর্তীতে বাংলাদেশে এসে বইটা গিফট পেয়েছিলাম ছোটোভাইয়ের কাছ থেকে। সে কলকাতা সফরে গিয়ে সেখান থেকে বইটা এনেছিল আমার জন্য। পড়ে ফেললাম। কিন্তু এই পঠন থেকে জীবনীতে কোনো উপাদান যোগ করিনি। করব কীভাবে। অন্যান্য লেখা ও বই প্রকাশে ব্যাপক সময় দিতে হলো। ফলে জীবনী লেখা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে একসময় বন্ধই হয়ে গেল। তবে, বেশ খানিকটা লিখেছি একথা বলা যায়। আবার কবে আরম্ভ করব সেটা এইমুহূর্তে বলতে পারছি না। এই সঙ্গে এই কথাও বলছি খোলাসা করে যে, আমার নিয়মিত কলাম ‘বালুকা বেলা’য় আমার চলমান আত্মজীবনীর কোনো কোনো অংশ পরিশোধিত ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছি।

বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। যা লিখছি, তাকে আত্মজীবনী বলতে চাচ্ছি। কিন্তু তা কি হচ্ছে? ঠিকভাবে এগুচ্ছে? কোনো সংজ্ঞা আছে আত্মজীবনীর? এইসব দিক নিয়ে ভাবছি। যা বলছি জীবনীতে বা যেসব ঘটনা, স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত জীবন প্রভৃতির অবতারণা করছি-সেগুলোকে কি আত্মজীবনীর ছকে ফেলতে পারছি? নিজের প্রশ্নেরই মুখোমুখি হলাম। কবীর চৌধুরী’র লেখা সাহিত্য-কোষ নামে একটা বই আছে আমার সংগ্রহে। বইটি মূলত বাংলায় লিখিত ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কিত শব্দাবলির সংগ্রহ। এখানে লিটারেরি টার্মস-এর সংজ্ঞা ও নাতিদীর্ঘ ব্যাখ্যা রয়েছে। অটোবায়োগ্রাফি বা আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে লেখক নিজেই নিজের জীবনের কথা লিপিবদ্ধ করেন-কবীর চৌধুরী অটোবায়োগ্রাফির সংজ্ঞায় এমন বর্ণনাই দিয়েছেন। এটি বিবেচনা করলে আমি সঠিক পথেই এগুচ্ছি। যদিও এই আত্মজীবনী লেখার বিভিন্ন পর্বে আমি একে ‘জীবনী’ বা প্রকৃত প্রস্তাবে আত্মজীবনী, মানে আমার জীবনী লিখছি।
তবে সাধারণভাবে বায়োগ্রাফি বা জীবনী হলো একটি মানুষের জীবনের ঘটনাবলির বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্র, অভিজ্ঞতাসমূহ ও কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন, এবং সর্বোপরি যুগ মানসের চিত্র অঙ্কন। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে বিখ্যাত ইংরেজ কবি-সমালোচক-নাট্যকার জন ড্রাইডেন বায়োগ্রাফির সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘বিশেষ মানুষের জীবনের ইতিহাস’ বলে (সাহিত্য-কোষ)। এখানে লক্ষণীয় যে, জীবনী লেখন হলো কোনো ব্যক্তির জীবনী আরেক ব্যক্তি লিখবেন। যেমন, জেমস বসওয়েলের ‘লাইফ অব স্যামুয়েল জনসন’ (১৭৯১)। এত আগের একটি জীবনী উল্লেখ করার কারণ হলো, এই জীবনীটি ইংরেজি সাহিত্যে জীবনচরিতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনার সময় এটি আমাদের পাঠ্য ছিল। বিংশ শতাব্দীর একটি সাড়াজাগানো বায়োগ্রাফি হলো অ্যান ফ্র্যাংক: ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল।

লেখার প্রারম্ভে আত্মজৈবনিক পর্বের নামকরণ নিয়ে ভেবেছিলাম। তখন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল মেমোয়ের, স্মৃতিকথা, স্মৃতিচারণ প্রভৃতি শব্দাবলি। এইসব নাম দেয়া যেতে পারে, তাতে বড় কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না, কিন্তু আমার ধারণা ছিল মেমোয়ের (memoir) বোধহয় আত্মজীবনী এবং অবশ্যই আত্মস্মৃতির বিবরণ। কিন্তু সাহিত্য-কোষ বইটির বায়োগ্রাফি অংশ পড়ে আমার ধারণা পাল্টে যায়-মানে মেমোয়ের-এর ভুল সংজ্ঞা ধারণ করছিলাম। সেরকমই উল্লেখ আছে বইটিতে: ‘মেমোয়ের বা স্মৃতিকথায় লেখকের আপন বিকাশের বিষয় ততটা গুরুত্ব পায় না যতটা পায় সেইসব ঘটনার কথা যা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, সেইসব মানুষের কথা যাদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন তিনি।’ অতঃপর সৃষ্টিসুখের উল্লাসে Oxford English Dictionary দেখলাম। সেখানে সংজ্ঞা আছে এভাবে: ‘a book or other piece of writing based on the writer’s personal knowledge of famous people, places, or events.’
এখানে স্মরণ করছি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম কবীর চৌধুরীকে। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন, আবার আমার শিক্ষকেরও শিক্ষক ছিলেন।

সিদ্ধান্তে এলাম, অটোবায়োগ্রাফিই সই। কারণ আমি শুধু অন্যকে দেখা, অন্যের সম্পর্কে লেখা, কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাৎলাভ, সেই সম্পর্কে বিবরণ এবং আমার দেখা ঘটনাবলির মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকতে চাচ্ছি না। আমার ইচ্ছে নিজের সম্পর্কে কিছু বলব, আর নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে পারিপার্শ্বিকতাও এসে যাবে। ওপরের সংজ্ঞায় ‘আপন বিকাশের বিষয়’ অবশ্যি আমার একমাত্র লক্ষ নয়। যদি আমার বিকশিত হবার কোনো প্রসঙ্গ এসে যায়, তা বর্ণনা করব বা করেছি ইতোমধ্যে, আর অবশ্যই বর্ণনা করব আমার স্মৃতিচারণ ও অভিজ্ঞতার কথা। সেইসঙ্গে ডায়েরি বা জার্নালের আদলে কিছু স্মৃতি বা ঘটনা বর্ণনা করার স্বাধীনতা নেব, যেহেতু অটোবায়োগ্রাফি, সেহেতু ‘অটো’-ম্যাটিক্যালি বের হয়ে আসবে মনের কথা। আমার বিশ্বাস, আত্মজীবনী লেখার উদ্দেশ্য ও অবস্থান পরিষ্কার করতে পেরেছি, তাই আমার মনে হচ্ছে, জীবনী লেখার কাজে আবার নেমে পড়লে পরবর্তীতে লিখিতব্য অধ্যায়গুলোতে পাঠকদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারব। সাথে থাকুন পাঠক।

Exit mobile version