হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
দুঃখজনক ও অপমানসূচক হলেও বিশ^দরবারে বাংলাদেশের এজাতীয় নামকরণই হয়। আর জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুঁজি করে প্রচুর পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন বানিয়ে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে ফান্ড হাতাবার মতো প্রচুর তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ আমাদের দেশে বিদ্যমান।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড ‘Poster Child’ আখ্যা দিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীমাতৃক বাংলাদেশে পানিসম্পদের ওপর নজিরবিহীন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। ফসলহানি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, কৃষিজমি গ্রাস, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, সেইসাথে অগণিত সংখ্যক উদ্বাস্তু সৃষ্টি হবে। এরা যাবে কোথায়? কোথায়-কীভাবে পুনর্বাসিত হবে? স্ফীত হয়ে বাংলাদেশের ভূভাগের অনেকখানি গ্রাস করে নেবে সাগর। এই ছোট্ট দেশটিতে তখন তিল ধারণের ঠাঁই থাকবে না। জলবায়ু পরিবর্তন সামাল দিতে বাংলাদেশের একটি স্বীকৃত উপায় হলো অ্যাডেপ্টেশন বা খাপ খাইয়ে নেয়া। যে বিপুল জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হবেন তারা কোথায়-কীভাবে অ্যাডেপ্টেড হবেন? খাপ খাওয়ানোর তো একটা সীমারেখা আছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান প্রভাব (অপূরণীয় ক্ষতিকর দিক) হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় লবণাক্ততা বৃদ্ধি।
বাংলাদেশের বৃহত্তর খুলনা বরিশাল এবং ভোলার মতো জেলায় লবণাক্ততা অনেকদিনের সমস্যা। সূত্রমতে, এইসব অঞ্চলে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায় যে, দৃশ্যত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই লবণাক্ততা বাড়ছে, এবং তাতে এখানকার কৃষিতে গভীর ও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন এমনভাবে বাড়ছে যে, কোপেনহ্যাগেন ও প্যারিস চুক্তিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা সীমিত রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছিল তাতে আর কাজ হচ্ছে না।
১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহল্মে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘের মানব-পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলন। তখন স্লোগান ছিল “Only One Earth” বা আমাদের একটিই পৃথিবী। দীর্ঘ অর্ধ শতক পরে ২০২২ আবার ফিরে এলো সেই একই স্লোগান বা থিম। ১৯৯২ সালে রিও আর্থ সম্মেলন ও পরবর্তী বছরগুলোতে অনেক কনফারেন্স/ট্রিটি ও কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ) অনুষ্ঠিত হয়, এবং সর্বশেষ কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হয় মিশরের শার্ম এল-শেইখে ৬-১৮ নভেম্বর ২০২২। এতো সম্মেলন/ট্রিটি আর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর সেই একই স্লোগান ফিরে আসার সোজা অর্থ হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবনয়ন পরিস্থিতি ও পৃথিবীর স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়নি; বরং অবনতি হয়েছে।
প্যারিস সম্মেলনের লক্ষ্য অর্জনে নানা অ্যাকশন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সম্প্রতি কপ-২৬ (UN Climate Change Conference of the Parties, Glasgow, 31 October–13 November 2021) অনুষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে সই করা দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, তা নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থা নিতে একমত হয়েছিল।
২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনাভাইরাস অতিমারির উত্থানের পর ২০২১এ কপ-২৬ সশরীরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। চারটি লক্ষ্যকে সম্মেলনে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।
-২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যতে নামিয়ে আনতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা।
-জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধার করা, প্রতিরক্ষা ও সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ, অবকাঠামো তৈরি ও কৃষি ব্যবস্থাকে স্থিতিস্থাপক করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
-এসব কাজ সম্পাদনের জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল করার জন্য উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা রাখা এবং
-জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করা।
কপ ২৬ সম্মেলনে “গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন” সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য “গ্লাসগো-শার্ম এল-শেইখ ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন দি গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন” প্রতিষ্ঠা করা হয় যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অ্যাডেপ্টেশন কার্যক্রমকে বেগবান করবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
ঘুরেফিরে সেই অ্যাডেপ্টেশনের বিষয়টিই বারবার উঠে আসছে। অ্যাডেপ্টেশনই বাংলাদেশের একমাত্র অপশন। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে এতো মানুষ কোথায়-কীভাবে অ্যাডেপ্টেড হবে (তা নির্ভর করে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ, তার ওপর)। অ্যাডেপশন বা খাপ খাইয়ে নিতে যে পরিকল্পনা, অর্থ ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে, সেই বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমাদের মিশন ও ভিশন হতে হবে।
বিশ^ উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বা কার্বন নিঃসরণ ঘটিয়ে আজকের বিশ^কে বিপর্যস্ত করায় বাংলাদেশের কোনো দায়ভাগ নেই। কিন্তু ভঙ্গুর ভৌগোলিক অবস্থান ও নি¤œাঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশ শিকার হচ্ছে উন্নত বিশে^র লাগামহীন কার্বন নিঃসরণের কুফলে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য প্যারিস সম্মেলনের চুক্তি সুফল বয়ে আনত বিগত সাত বছরে। দৃশ্যত তা যখন হয়নি, তখন কপ-২৬ সামিট তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হয় কিনা, সেটা সারা বিশে^র মানুষের দেখার বিষয় ছিল। যদিও ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে যথেষ্ট নয়। তবু সেটা মন্দের ভালো।
এদিকে যথারীতি বড় রকমের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় কপ-২৭ সম্মেলন। জলবায়ু আলোচনায় যে বিষয়টি সবসময় প্রাধান্য পাওয়ার কথা, অর্থাৎ তাপমাত্রা কমিয়ে এনে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি কমাতে বিশে^র ধনী ও প্রভাবশালী দেশগুলোর যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেবার কথা, তার সুরাহা এই সম্মেলনেও হয়নি। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, গাছ লাগানো হলো, কিন্তু তার পরিচর্যা করা হলো না। বৈশি^ক তাপমাত্রা কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেই কাজটিই হচ্ছে না। গোড়ায় যে গলদ, তা সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে লালন করা হচ্ছে বিশে^র কতিপয় মহাশক্তিধর দেশগুলোর জন্যই।
মিশরে কপ-২৭ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে একটি তহবিল গঠন করার বিষয়ে চুক্তিতে সম্মত হয়েছে বিশ্বের দেশগুলো। কপ ২৬ এ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেখানে দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি সম্মেলনে এলেও কোনো কোনো দেশের জন্য, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য খুব কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। আবার সেই নেগোশিয়েশন, তদ্বির আর আশাহত হবার বিষয়টি তো রয়ে গেল। লস অ্যান্ড ড্যামেজের অর্থ আদায়ে বাংলাদেশকে যে জটিল মেকানিজম ও পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে সেটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তহবিল গঠনে ‘সন্তুষ্ট’ হলেও জলবায়ু মোকাবিলায় কোনো চুক্তি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ঝুঁকিতে থাকা দেশ এবং পরিবেশ কর্মীরা।
বাংলাদেশের নদীমোহনা আর উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে যথা- কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ভোলা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুর জেলায় তিন কোটিরও ওপরে লোক বাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ এক মিটার স্ফীত হলে তাদের ওপর নেমে আসবে চরম বিপর্যয়। শত শত বর্গ কি.মি. উপকূলীয় ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল অধিকতর মাত্রায় প্লাবিত হবে।
অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুুকনো মৌসুমে প্রধান প্রধান নদীর পানি হ্রাস পায়। নদীর ক্ষীণপ্রবাহের কারণে সামুদ্রিক লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নদনদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দিচ্ছে- বর্তমান চালচিত্রে তা-ই ঘটছে। বাড়ছে লবণাক্ততা।
ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)’র মতে উন্নয়নের ধারায় যদি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনও সাধিত হয় তাহলেও আগামী শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত হবে তার পরিমাণ হবে শিল্পবিপ্লবের পূর্বের মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি। আইপিসিসি’র হিসেব অনুযায়ী বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি থেকে ৪.৫ পর্যন্ত বাড়বে।
বাংলাদেশের পানিসম্পদ ও নদী ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীই তীব্র দূষণের শিকার। এর ওপর রয়েছে উজানে বাঁধ দেবার ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত নদীগুলোর অনেকগুলোই অব্যস্থাপনা ও মানবসৃষ্ট কৃত্রিম বাঁধের খেয়ালিপনার শিকার হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উদাহরণত তিস্তা ব্যারেজের কথা বলা যায়। দীর্ঘদিন ধরে উজানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে তিস্তা এখন পানিশূন্য।
বাংলাদেশের পানিসম্পদের ওপর বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাব, বহির্দেশীয় নদী বা নদী-অববাহিকার পরিবর্তন/কুফল, ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠস্থ পানি, দেশীয় প্রেক্ষাপটে পানির চাহিদা ও প্রাপ্তি- এসব বিশাল চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই পানিসম্পদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ভাবতে হবে।
বাংলাদেশে পানিসম্পদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার কতগুলি জটিল ও দুরূহ ক্ষেত্র রয়েছে। এসবের মধ্যে প্রধান হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও শুষ্ক মৌসুমে খরার সমস্যা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ক্রমবর্ধমান পানি চাহিদার সাথে নিরন্তর সংগ্রাম, নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, আর্সেনিকদূষণ, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি। এছাড়া পানিসম্পদভিত্তিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা, বিশেষ করে মৎস্যসম্পদের এলাকাসমূহ এবং জলাভূমি এলাকার পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সীমাহীন গুরুত্ব বহন করলেও এই দিকটি অবহেলিত।
অন্যদিকে, জলাভূমি ভরাট করে বিবিধ প্রকল্প ও আবাসন প্রকল্প নির্মাণের যে প্রতিযোগিতা বর্তমানে চলছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম আঘাত আসার পূর্বেই বাংলাদেশ নত হয়ে গেছে চূড়ান্ত শিকারে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। বাংলাদেশ অতিকায় কোনো দেশ নয় যে, বিবিধ প্রকল্প ও আবাসন নির্মাণে এই দেশের ওপর ক্ষতিকর কোনো প্রভাব পড়বে না।
বর্তমান প্রেক্ষিতে সরকার বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরের বিভিন্ন বিষয় যেমন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, অভিন্ন নদীপ্রবাহের পানির ভাগ-বাটোয়ারা বা নদী অববাহিকার পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজটিকে অভাবিত জটিলতায় ফেলে দিয়েছে। সর্বোপরি, পানির বিভিন্ন ব্যবহারকারীদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাহিদার বিষয়টি তো রয়েছেই।
বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রতিবেশী দেশগুলোর, বিশেষত ভারতের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সফল করা সম্ভব নয়। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভূ-অভ্যন্তর ভাগের ও ভূপৃষ্ঠস্থ পানিব্যবস্থাপনা ও বৃষ্টির পানি ব্যবহারেও সমান গুরুত্ব দেবার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও কোনোদিকে কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
বহুবছর যাবত মরণফাঁদ হয়ে আছে যে ফারাক্কা বাঁধ, তার সাথে অধুনা যুক্ত হয়েছে আরেকটি ভীতিকর বিষয়- তিস্তার পানি বন্টন না হওয়া।
তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ ভারতের সঙ্গে পানি বন্টন চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশকে গভীর জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এমন মত দিয়েছেন।
শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি শুকিয়ে যায় (এখন যা চলছে) এবং বাংলাদেশ অংশে তীব্র হারে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় মানুষের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। পরিবেশগত প্রভাবের কারণে এ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষের আশা, বাংলাদেশে পানির মাত্রা কমে যাওয়ার নেতিবাচক দিকগুলো মাথায় রেখে তিস্তার পানি বন্টনে সাম্যতা নিশ্চিতকরণে চুক্তি করতে ভারত এগিয়ে আসবে।
নদীর পানি না পাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ সেচের জন্য ভূপৃষ্ঠের গভীরের পানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সূত্রমতে, সেচ প্রকল্পের জন্য তিস্তা বাঁধে ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশ পাচ্ছে মাত্র ৪০০ কিউসেক।
২০১৪ সালে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের ৬৫ হাজার হেক্টর জমি সেচ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। কিন্তু পানির অভাবে সেচ দেয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাত্র ১০ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় ছিল। পানির অভাবে সেচের আওতায় আনার জন্য ক্রমেই জমির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হচ্ছে। তিস্তা নদীর তীরে বসবাসরত হাজার হাজার মানুষ নদীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নিয়মিতভাবে পানির মাত্রা কমতে থাকায় তাদের জীবিকা এখন হুমকির মুখে।
সমঝোতার মাধ্যমে পানিসম্পদ খাতে বিরাজমান সমস্যাগুলো কিছুটা দূর হলেও বাংলাদেশের জন্য পানিসম্পদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার কাজটি অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। সার্ক সম্মেলন করে, ঘোষণা স্বাক্ষর করে, আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলে এ পর্যন্ত কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ১৫তম সার্ক সম্মেলনে ৪টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য কোনো তহবিল গঠন করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের জন্য এ ধরনের তহবিল গঠন জরুরি। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে ভারত নেপালের সঙ্গে পানিসম্পদ আহরণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে নেপালের ৪টি নদীতে (কর্নালি, পঞ্চেশ্বর, সপ্তকোসি, বুড়িগন্ধকি) স্টোরেজ ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। কেননা, এসব নদী শুকনো মৌসুমে ফারাক্কায় গঙ্গার মোট প্রবাহের ৫৬ শতাংশ প্রদান করে। ভূটানের সাংকোশ নদীতে একটি বহুমুখি ড্যাম তৈরির চুক্তিতে ভারত স্বাক্ষর করে ১৯৯৩ সালে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে সাড়ে ১২ লাখ একর জমি সেচ সুবিধা পায়। অথচ এই সাংকোশ নদী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী। ভারতের সাথে ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বন্টনবিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। একটি সংবাদপত্রের সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের প্রথম ১১০ দিনে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো কোনো দেশের পানিব্যবস্থাপনায় প্রত্যক্ষ আঘাত। দেশের অভ্যন্তরের নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে নানা খাতে- কৃষি, মৎস্যসম্পদ, সুপেয় পানি ও ক্ষেত্রবিশেষে মরুময়তা কিংবা বন্যা। একদিকে পানিপ্রবাহ ক্ষীণ হয়ে গিয়ে লবণাক্ততায় বিপর্যস্ত হবে, অন্যদিকে বন্যার পর ফসলী জমি স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা হারাবে লবণাক্ততার কারণে, আর ক্রমে ক্রমে মরুময়তার কারণে মাটি স্বাভাবিক গুণাগুণ হারাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও তার কুপ্রভাব, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য কেন হুমকি হয়ে উঠল, কীভাবে হলো, আগামী পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য রাখতে কী করে যেতে হবে বর্তমান পৃথিবীকে- এসব এখন বিপন্ন বিশ্ববাসীর সামনে ক্রসওয়ার্ড পাজল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবুও আমরা আশাবাদী, কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে আগামী সম্মেলনে বিশে^র ধনী-দরিদ্র দেশগুলো একমত হবে। শক্তিশালী ফান্ড গঠন করে কোটা সিস্টেমে বিপন্ন দেশগুলোকে ফান্ড ও প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করবে।
পরাশক্তিধর দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে খুব মাথা ব্যথা আছে বলে বোধ হয় না; তারা ব্যস্ত যুদ্ধের দামামা বাজাতে আর নিজেদের দায় অন্য দেশের ওপর চাপিয়ে দিতে। তাই আমাদের দেশের বিপন্নতার মাত্রা অনুযায়ী এখনই সার্বিকভাবে শর্ট টার্ম ও লং টার্ম সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। আর তৎপর হতে হবে বিভিন্ন সম্মেলনে দেন-দারবার করে যত বেশি সম্ভব ফান্ড আদায় করে নিতে।
অনস্বীকার্য যে, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী ও পরাশক্তির দেশগুলো বিলাসিতায় ও আরাম-আয়েশে থেকে, পৃথিবীর সিংহভাগ ভূখণ্ডকে চরম বিপদের মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন নামের দানবের জন্ম দিয়ে।
তারা জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। তারা জানত, এই পৃথিবীটা আমাদের নয়; আমরা শুধুমাত্র একে ধার নিয়েছি আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে:
‘We do not inherit the Earth from our ancestors; we borrow it from our children.’ Cree Indian prophecy.