হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক কপ-২৮ (কনফারেন্স অব পার্টিজ) সম্মেলন সম্প্রতি দুবাইয়ে শেষ হয়েছে। পরপর কয়েকটি কপ সম্মেলন হয়ে গেলো। যে বিষয়ে এই সম্মেলন হয়, তা হলো বিশ^জুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো। কার্বন উদগীরণের কারণে বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রস্ফীতি, এবং তৎজনিত কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশে^র নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানের দেশগুলো ও দ্বীপরাষ্ট্রের অধিকাংশই সমুদ্র গহ্বরে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনায় রয়েছে।
দেখা যাচ্ছে যে, কপ সম্মেলনে কোন্ দেশ কতোটা কার্বন নিঃসরণ কমাবে, প্রতিটি সম্মেলনেই অংশগ্রহণকারী দেশগুলো, বিষেশত বিশে^র ধনী ও প্রভাবশালী দেশগুলো সে বিষয় থেকে দূরে গিয়ে নানা এজেন্ডা প্রণয়ন করে আর বিতর্কে জড়ায়। এবারের সম্মেলনেও সেইরকম বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বলতে পারি জলবায়ু সম্মেলন স্ক্যান্ডাল।
দুবাইয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শুরুর আগেই আয়োজক দেশ আরব আমিরাতের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের শুরু। কপ-২৮ সম্মেলনের সভাপতি সুলতান আল জাবের তেলের ব্যবসা বাড়াতে সম্মেলনকে ব্যবহার করছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা ইউএনএফসিসি আয়োজিত এরকম বৈশি^ক সম্মেলনে এধরনের বির্তকের শুরু বিশে^র জন্য অশনি সংকেত।
ফলে এই সম্মেলনে খুব বেশি আশাবাদ তৈরি হয়নি।
তবে, সম্মেলনের মোদ্দা বিষয়-যা তারা বিশ^বাসীকে জানাচ্ছেন, তা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি তহবিল ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ গঠনের পরই সেখানে ৭০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। আরেকটি বিষয় হলো, কোন্ দেশ কী পরিমাণ নিঃসরণ কমাবে তার একটি ‘কাঠামোগত’ ঘোষণা এসেছে। এরকম কাঠামোগত ঘোষণা বহু এসেছে। কোনোটা কি সঠিকভাবে কার্যকরী হয়েছে? গ্লাসগো সম্মেলন (কপ ২৬) শেষে বিক্ষোভকারীরা ধুয়ো ধ্বনি দিয়েছিলো। সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ কটাক্ষ করে বলেছিলেন-ব্লা ব্লা ব্লা।
জলবায়ু সংকট গোটা বিশে^র দ্রুত ও র্যাডিক্যাল একটা রূপান্তরের দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্যারিস-সম্মেলনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনও অনেক দূরে, যেখানে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমাবার সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয়। ফলে, শিল্প-বিপ্লবের আগের সময়ের বায়ুমণ্ডলের স্থিতাবস্থায় আসাটা সুদূরপরাহত। শুধুমাত্র একটি জরুরি সিস্টেমাইজড পরিবর্তনই জলবায়ুজনিত বিপর্যয় এড়াতে পারে।
প্যারিস সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ও লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ভারসাম্যপূর্ণ ছিলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এক পর্যায়ে প্যারিস সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসে। তাকে অনুসরণ করে ক্যানেডা ও কতিপয় দেশ। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার প্রতিশ্রুতিতে প্যারিস সম্মেলনে ফিরে আসবেন বলে জানিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ফিরে এলেও কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোটায় তারা জানায় এতে তাদের শিল্প ও আর্থিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সমুদ্রস্ফীতি ও নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানের বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশে^র অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হবে এবং হচ্ছে। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরির নাজুক অবস্থা। বাংলাদেশ বিশ^জুড়ে আখ্যা লাভ করেছে ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে। এতোদিন ধারণা করা হচ্ছিলো যে, ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও ভঙ্গুর ভৌগোলিক অবস্থানের দেশগুলোই চরম বিপন্ন, কিন্ত এখন দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানেডার উপকুলীয় অঞ্চল চরম বিপন্নতার শিকার হতে যাচ্ছে। ক্যানেডার অনেক অঞ্চল আছে যেগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
মিশরে কপ-২৭ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে একটি তহবিল গঠন করার বিষয়ে চুক্তিতে সম্মত হয়েছিলো বিশ্বের দেশগুলো। কপ ২৬এ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেখানে দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি সেই সম্মেলনে এলেও কোনো কোনো দেশের জন্য, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য খুব কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে ক্ষতিপূরণ আদায়ে। আবার সেই নেগোশিয়েশন, তদ্বির আর আশাহত হবার বিষয়টি তো রয়ে গেল। লস অ্যান্ড ড্যামেজের অর্থ আদায়ে বাংলাদেশকে যে জটিল মেকানিজম ও পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে সেটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
দুবাই সম্মেলনেও তহবিল গঠিত হয়েছে। আলোচনা ও তদ্বির করে রিলিফের মালের মতো ডলার এদেশে এসে পৌঁছুলেও লাভের গুড় পিঁড়ড়েরা খাওয়ার মতো অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি রয়েছেন।
প্রকৃত সমাধান হলো, প্রথমত কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে বিশ^জুড়ে। দ্বিতীয়ত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে সহজ উপায়ে ও বিনা শর্তে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভ্যন্তরীণ দূষণ ও নিঃসরণ কমাতে হবে নিজস্ব অর্থয়ানে ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে।
সবশেষে বলি, আজ থেকে অর্ধশতক আগে বিশ^ পরিবেশ ও জলবায়ু পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানি স্টকহলমে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো জাতিসংঘের মানব-পরিবেশ সম্মেলন। তখন স্লোগান ছিলো-Our Only Earth. সেই স্লোগান বা থিম আবার ফিরে আসে ২০২২ সালে। অর্থ, গত অর্ধশতাব্দীতে পৃথিবীর স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি; বরং অবনতি হয়েছে।
মহাত্মা গান্ধির উক্তিটি মনে পড়ছে। মানুষের লোভী মনোবৃত্তিটা তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি-‘Earth provides enough to satisfy every man’s needs, but not every man’s greed.’