হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। কানাডীয় রীতিনীতি ও লাইফস্টাইল দৃশ্যপটে। এবিষয়ে যদিও আমার জ্ঞান খুব প্রসারিত নয়। বরং বলা যায় সীমিত; তবে এখানে পড়াশোনার সুবাদে কিছু অভিনব বিষয় জানার সুযোগ আমার হয়েছে। অভিনব এজন্য যে, এসব নিয়ে সাধারণত কোনো আলোচনা বা বিশ্লেষণ হয় না। এসব অলক্ষ্যে ও নীরবে বয়ে যায়। আর আমরা সবাই ওদের জীবনযাত্রা দেখেছি; কিন্তু তেমনভাবে ভাববার অবকাশ হয়তো হয়নি। আমি আলস্যে ভরপুর একজন মানুষ, তবে লেখার তাগিদে বা জানার আগ্রহে কিছু কিছু বিষয় আমি পর্যবেক্ষণ করি। এর সাথে যোগ হয়েছে কানাডায় আমার সাংবাদিকতা ও কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে পড়াশোনার সুবাদে। সেখান থেকে সঞ্চিত কিছু অভিজ্ঞতার কথা আজ বলব।
এদেশীয় কাজকারবারের অনেক মজার মজার উদাহরণ আছে। যেমন কোনো টিন এজ ছেলে হয়তো কোনো টিন এজ মেয়েকে ডেটিংয়ের আমন্ত্রণ জানাল। এখন মেয়েটির যদি কোনো বয়ফ্রেন্ড থেকে থাকে তবে সে সোজাসাপ্টা বলে দেবে, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। এই ডেটিংয়ের আরেকটি উদাহরণ হলো কোনো ছেলের আমন্ত্রণের প্রেক্ষিতে কোনো মেয়ে যদি যেতে নারাজ হয়, তবে সে বলে থাকে, আমাকে চুল ওয়াশ করতে হবে অমুক দিন বা বারে (যে দিন বা বারে ছেলেটা ডেটিং-এ বেরুতে প্রস্তাব করেছে)। এই কথাটিতে ছেলেটি সবকিছু বুঝে নেয়। ছেলেটাকে চরম আঘাত করা হলো না বা মেয়েটাকেও বলতে হলো না যে তোমার মতো ছুঁচোমুখোর সাথে ডেটিংয়ে যেতে বয়েই গেছে আমার।
“One moment on the lips, forever on the hips.” উদ্ধৃতিটি বিশ্বজুড়ে ফাস্টফুডের দৌড়াত্ম বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়। মজাদার, সহজে পরিবেশন ও ভক্ষণযোগ্য ফাস্টফুড যান্ত্রিক যুগের সাথে তাল মেলাবার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তা সত্তে¡ও এর বহুবিধ নেতিবাচক দিক রয়েছে। আর এই কারণেই একে জাঙ্ক ফুডও বলা হয়। অধিকাংশ ফাস্টফুডই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আর যত্রতত্র ও যখন তখন খাওয়ার সুযোগ থাকায় এর সাথে মিলিত হয় অনেক জীবাণু। এইসব ফাস্টফুডে থাকে প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট ও ব্যাকটেরিয়া। এই ফাস্টফুড নিয়ে Eric Schlosser (সাংবাদিক ও নন-ফিকশন রাইটার) এর লেখা Fast Food Nation: The Dark Side of the All-American Meal (2001) সাম্প্রতিককালে বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। বইটিতে তিনি ফাস্টফুডের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করেছেন।
“When you feel blue, wear red.” কথাটা রঙের মাহাত্ম নিয়ে। ব্লু বেদনার প্রতীক। অন্যদিকে লাল হলো আনন্দের প্রতীক। তাই যখন কেউ ব্যথাতুর হয়ে ওঠে তখন সে যেন মন ভালো করার জন্য লাল পরিচ্ছদ পরিধান করে। পিঙ্ক বা গোলাপি রঙটি মেয়েদের খুব প্রিয় এবং মূলত মেয়েরাই এই কালারটি ব্যবহার করে থাকে। মেয়েদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন- পোশাক, পড়ার ডেস্ক, ব্যাগ, ফিতা, ঘড়ি, সেলফোনসহ প্রায় প্রতিটি জিনিসই গোলাপি বর্ণের। পিঙ্ক রঙকে রোম্যান্টিক কালারও বলা হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো যে, এই রঙটি ১৯২০ সালের আগে ছেলেদের রঙ ছিল!
ইংরেজি Purple রঙটি কেমন? বাংলায় র্পাপল অর্থ কী? এই কালারটি উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের চোখে সুনির্দিষ্ট কোনো রং ভাসে না। কেন? এই কালারটাকে কেউ বলে বেগুনি, কেউ বা লাল। আসলে এর বাংলা কোনো নাম নেই। রক্তবর্ণ বলা হলেও এর অবয়ব ঠিক রক্তবর্ণ নয়। যাইহোক, এই রঙটি রাজকীয়তার প্রতীক। রাজা রানী বা রাজকীয় সদস্যরা এই রঙের কাপড় পরেন। র্পাপল মূল্যবান রঙ। রাজারাজড়ারা ধনী ও প্রতাপশালী, সুতরাং তাদেরকে মূল্যবান পরিচ্ছদ পরতে হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এই রঙটি তৈরি করতে অনেক অর্থ ব্যয়িত হতো। আগে, এক পাউন্ড পরিমাণ এই রঙ তৈরি করতে ষাট হাজার শামুকের জীবন যেত।
কালো রঙকে বলা হয় সিরিয়াস কালার। এই রঙটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত। পশ্চিমা দেশে সাধারণত অন্তেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে কালো গাউন বা পোশাক পরা হয়। অন্যদিকে, একইসাথে কালো পোশাক আভিজাত্যেরও প্রতীক। অনেক মানুষই কোনো পার্টিতে বা অনুষ্ঠানে কালো পোশাক পরে। মহিলাদের ইভনিং ড্রেসও কালো রঙের হয়।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পশ্চিমা দেশের বিয়ের কনেরা শাদা পোশাক পরত। শাদা রঙ মঙ্গল ও সুখের প্রতীক। কিন্তু চিন দেশে এর ঠিক উল্টো অর্থ। সেখানে শাদা মৃতের প্রতীক। ডাক্তার ও নার্স শাদা পোশাক পরে কেন? দাগহীন শাদা পোশাক পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য তারা শাদা কাপড় পরিধান করে। হাসপাতালের কর্মচারি, অপারেশন রোগির ডাক্তার বা নার্স সবুজ রঙের পোশাকও পরে। সবুজকে বলা হয় শান্ত কালার। এটি সমৃদ্ধ বা বিকাশেরও প্রতীক। এই রঙটি রোগীদের চোখে প্রশান্তি এনে দেয়। ইয়োরোপে বহুবছর আগে নববধূরা উর্বরতার প্রতীক হিশেবে সবুজ পোশাক পরত।
নীল রঙ বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। নীল পৃথিবীতে সর্বাধিক জনপ্রিয় রঙ। নীল রঙ আনুগত্যের প্রতীক। তাই পুলিস সদস্য ছাড়াও অনেক কর্মচারি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্য নীল পোশাক পরে থাকে। পৃথিবীতে ব্লু জিন্স ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আপনারা বাসস্টপে টিটিসি’র বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে দূর থেকে কী দেখেন? নীল রঙ, তার মানে টিটিসি’র বাসের সামনের উপরিভাগে নীল বাতি জ¦লে, নীল বাতি অনেক দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হয়। তাই রাস্তায় দূরে, নীল আলো দেখলে বুঝতে হবে আপনার অপেক্ষার পালা শেষ।
হলুদ ও কমলা খুব সহজেই চোখে পড়ে। প্রাচীন রোমের মানুষ বিয়ের আসরে হলুদ পোশাক পরত। হলুদ নিরাপত্তার প্রতীক। কনস্ট্রাকশন কাজে বা কলকারখানায় নিরাপত্তার কাজে হলুদ ও কমলা রঙের পোশাক পরা হয়। প্রবল বৃষ্টির সময় রাস্তাঘাটে অনেকে হলুদ রেইনকোট পরে এই কারণে যে, ঝাপসা বৃষ্টিতেও তারা দৃশ্যমান থাকে। বাংলাদেশে হলুদ রঙ ঋতুরাজ বসন্তের প্রতীক। বসন্তের প্রথমদিনে বিশেষত মেয়েরা হলুদ শাড়ির সাজে মেতে ওঠে বসন্তকে বরণ করতে।
“Bend it like Beckham” ২০০২ সালে নির্মিত কমেডি-ড্রামা জাতীয় একটি সিনেমা। ফুটবল-লেজেন্ড বেকহামের অপূর্ব শৈলী দ্বারা প্রভাবিত ছবিটি মূলত এর নামকরণের কারণেই খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। গোলমুখে ডিফেন্ডারদের দুর্ভেদ্য দূর্গ ভেদ করে বেকহামের বাঁকানো কুশলী শটের গোল বিশ্বের কোটি দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। সেটা থেকে প্রেরণা লাভ করে এই ছবিটি নির্মিত হবার পর তা এক স্মরণীয় রেকর্ড স্থাপন করে।
এখানে দু’টি শব্দের সামান্য ব্যাখ্যা করে এবং একটি বিশেষ শব্দের মর্মার্থ উদ্ধার করে এই অধ্যায়ের ইতি টানব। শব্দ দুটি- Dyslexia I Goatee. Dyslexia-এর প্রকৃত অর্থ প্রদান করা কিছুটা দুঃসাধ্য বৈকি। মানেটা দাঁড়ায় অনেকটা শব্দান্ধতা- পড়তে বা বানান করতে অক্ষমতা বুঝাতে। আর এটি ঘটে মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য কোনো ভাষা শিখতে গিয়ে। Goatee শব্দটা পশ্চিমবঙ্গের ঘটিদের কথা মনে করিয়ে দিলেও এটির মানে ঘটিদের ধারেকাছেও নেই। এর মানে ছাগুলে। যদিও ঘটিদের মধ্যে ছাগুলে দাড়িসমৃদ্ধ লোকজন থাকতে পারে। তবে এই গোটি শব্দটা ছাগলের সাথে মানুষের মিল খুঁজে পাবার প্রচেষ্টা চালায়, যা আমাদের মোটেও কাম্য নয়। আমরা তাই ছাগল-টাগল না বলে ফ্রেঞ্চকাট বলি। দুর্ভাগ্যবশত দাড়ির বিশেষ কায়দার কারণে অনেক ধনী ও মানী ব্যক্তিও গোটি বনে যান।
আমার আজকের বর্ণনার সবশেষ শব্দটি হলো Ghost writer. এখানে দু’টি শব্দ থাকলেও অর্থ কিন্তু একটি এবং একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গোস্ট রাইটার বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ভৌতিক গল্প বা উপন্যাসের বিজাতীয় কাঠামোর চিত্র। মানে বলতে বুঝি ভৌতিক কাহিনী লেখক। ভূতীয় বর্ণনার ভয়াল কিচ্ছা। আসলে কিন্তু তা নয়। যদিও ভূত কথাটি এখানে রয়েছে। তাই ভূতীয় প্রভাবও এতে আছে। কিন্তু মানেটা হলো যিনি অন্যের হয়ে আড়ালে থেকে তার লেখা লিখে দেন, তাকে বলা হয় গোস্ট রাইটার। এখন তিনি ভূতের লেখা লিখবেন নাকি প্রেমের কাহিনী লিখবেন, সেটা নির্ভর করে কাহিনী গ্রহীতা ও কাহিনী বিক্রেতা ব্যক্তিদ্বয়ের ওপর। এই বিষয়টি নিয়ে বছর কয়েক আগে খানিকটা বেকায়দায় পড়েছিলাম। আমি www.freelanced.com নামের একটি সমৃদ্ধ সাইটের একজন সদস্য। এই সাইটে আমার কিছু কীর্তিকাহিনীর কথা বলা আছে। আমার প্রোফাইল, স্কিল ও লেখালেখির কথা বিস্তারিত লেখা আছে। মূলত ফ্রিল্যান্সার লেখকদের নিয়েই এই সাইট।
আমি দুয়েকটি অফার পেয়েছি এই সাইট থেকে। আমার অন্যান্য কিছু কুকীর্তির মধ্যে গোস্ট রাইটার শব্দটিও ছিল। যদিও তেমন কাজ আমি করিনি বা করব না বলেই মনস্থ করেছি। তো একটা অফার এলো টরোন্টোর এক এদেশীয় কিশোরের কাছ থেকে। সে আমাকে ফোন করে তাকে একটি ভূতের কাহিনী লিখে দিতে অনুরোধ করল। জিজ্ঞেস করলাম সে আঠারো বছর বয়সের কিনা। সে জানাল সে আঠারোর নিচে। তখন বললাম, তোমার কিছু কাজ করার জন্য আমাকে তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। ছেলেটা দমে গেল বলে মনে হলো। সে আমতা আমতা করছিল। আমি তখন গোস্ট রাইটারের প্রকৃত অর্থটা বলে দিলাম। ছেলেটা আরও দমে গেল। জানালাম, সে যদি নিতান্তই চায় আমি যেহেতু লেখক, বিশেষত গল্পকার এবং বেশক’টি ভূত-গল্পেরও ¯্রষ্টা, তাকে আমি ভূতের গল্প লিখে দিতে পারি, তবে তার বাবা-মা’র অনুমতি লাগবে। ছেলেটা পরে আবার ফোন করবে বলে জানালেও আর ফোন করেনি সে। সম্ভবত বুঝেছিল যে, সে বাবা-মা’র অনুমতি পাবে না।
আজ বালুকা বেলায় হাঁটাহাঁটি এই পর্যন্তই। কামনা করি, বিশ^জুড়ে থেমে যাক যুদ্ধ ও হানাহানি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ^ নেতৃবৃন্দ একযোগে কাজ করতে সম্মত হোন। তাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে দায়মুক্ত হবো আমরা।