হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।

এলোমেলো শব্দের পদাবলি

আমার আজকের ‘বালুকা বেলা’র বিষয়বস্তু সুনির্দিষ্ট নয়। বলা যায়, আমার জীবনটার মতোই এলোমেলো। আমি আজ পরাবাস্তবতার মতো এক অনুভবের মুখোমুখি হয়েছি।
আমি একাধারে অনেককিছু হতে চেয়েছিলাম। তাই বুঝি আজ হতে পারিনি কিছু। আমার ক্ষেত্রে ‘Jack of all trade, master of none’ কথাটা বোধহয় খাটতে পারে। একসময় (ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি) আমি আঁকিয়ে হতে চেয়েছিলাম। কারণ ছোটোকাল থেকেই আমি ভালো আঁকতাম। সেই গাছপালা থেকে শুরু করে সিংহ পর্যন্ত। আমি মাটির জিনিসও বানাতে পারতাম (এখনও বোধহয় পারি)।

গান গাইতাম। গান গাওয়ার স্থানগুলো ছিল টিনের চাল, গাছের ডাল আর দেয়াল। গান গাইবার জন্য প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ডাক পড়ত। ক্লাস নাইন পর্যন্ত আর্ট-ভাস্কর্য চালিয়ে যাই। এরপর মন দিই সাহিত্যে। কী করে যেন বড়দের উপযোগী ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’ আর ‘খেলারাম খেলে যা’ বইদুটো পেয়ে যাই এবং পড়ে ফেললাম! অন্যঘরে অন্যস্বর বইটির মালমশলা ছিল প্রখর হাস্যরসপূর্ণ। আর ছিল জীবনবোধ আর পুরোনো ঢাকার জীবনযাত্রার প্রকৃত মিশেল। এর হাস্যকর দিকগুলো কিন্তু জোর করে হাসানোর জন্য ছিল না- লোকাল কালার, তাদের চরিত্র ও সংলাপ এবং আচরণ এমনি যে হাসি পেয়ে যায়। আমি প্রয়াত বন্ধু আলমের সাথে এইসব চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতাম, সেইসব সংলাপ দুজনে আওড়ে হাসিতে গড়াগড়ি দিতাম। মাঝখানে পড়ে ফেললাম ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এবং পরবর্তীতে, আমি যখন খুলনায় বদলি হয়ে যাই তখন পড়ি ‘খোয়াবনামা।’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন শক্তিমান লেখক।

বোধহয় সাহিত্যের আলোচনাতেই চলে এলাম! আসলে ‘কী হতে চেয়েছিলাম’ বললে বোধহয় সাহিত্যের প্রসঙ্গটিই বেশি আসবে। ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’ সবই করি। কারুর মোবাইলের সমস্যা হলে সেটা ঠিক করে দিই, বাড়ির টিউবলাইট-ফ্যান নিজহাতে লাগাই। নিজহাতে বারান্দায় ফুলের গাছ লাগাই, এমনি কত কী! এমনকি, ক্ষেত্রবিশেষে চিকিত্সাও করে থাকি। বললে পেত্যয় যাবে না আপনাদের যে আমার হোমিও চিকিত্সায় আমার এক কলিগের চোখের অ্যালার্জি ভালো হয়ে গেছিল! ক’দিন ধরে ওই মহিলা কলিগের চোখ চুলকাচ্ছিল। আমি তাকে থুজা ২০০ শক্তির গ্লোবিউল দিই। নিয়মাবলি বলে দিই। ক’দিন পরেই কলিগ জানাল যে তার চোখ ভালো হয়ে গেছে। কিছুদিন হোমিও-চর্চা করেছিলাম। সেটা চালু রেখেছিলাম বিয়ের পরও। তবে নিজের ক্ষেত্রে খুব কমই হোমিওর কঠিন নিয়মাবলি পালন করতে পারতাম বলে আমার ক্ষেত্রে হোমিও তেমন কাজ করত না। মাঝেমধ্যে নিজের কিছু চিকিত্সা করেছিলাম, তাতে ফলও পাচ্ছিলাম, কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে পারিনি। হোমিওতে ধৈর্য লাগে আর লাগে সময়।

সংগীতচর্চাও করেছি। অবশ্যি এই চর্চা আমি এখনও করি। আর সংগীতের মোহে স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়াম কিনেছিলাম। আমার আনন্দ ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ঘুরে বেড়ানো। সিনেমা দেখতাম মাঝেমধ্যে তবে বাংলা ছবি (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) দেখতাম না। সেই অল্পবয়স থেকেই। বাংলা সিনেমা দেখতাম না তবে একটা ক্লাসিক বাংলা সিনেমা বানাবার স্বপ্নিল আবেশে অনেকদিন কল্পনার জাল বুনেছি। সিনেমা বানাবার ইচ্ছে ছিল বাংলা ছবিকে মানুষ করার জন্য। বাংলা সিনেমা দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। নিজে স্ক্রিপ্ট লিখব, পরিচালনা করব আর অভিনয় করব। আমার বিয়ের মাসতিনেক আগে একদিন ঢুকে গেলাম বেঙ্গল স্টুডিয়োতে। না শুটিং দেখতে না; গল্প করতে। সাথে ছিল আলম। আমার গোপিবাগের পুরোনো দুয়েকজন আমাকে দেখে অবাক। এমন পাতলা চেহারায় এরকম জেল্লা আসল কেমন করে? (তখন বিক্রমপুর হাউসে থাকতাম)। আমি উচ্চতায় ৫ ফিট সাড়ে ৭ ইঞ্চি। ওজন ছিল ৬১ কেজি। গায়ের রং শ্যামলা।

সেদিন একটা শুটিং চলছিল কোনো একটা ছবির। বেঙ্গল স্টুডিয়োতে সবার ঢোকার প্রবেশাধিকার ছিল না। আমি ঢুকতে পারতাম। আমার বডি ল্যাংগুয়েজ বলে দিতে যে আমি ঢুকতে পারি (মহল্লার ছেলে)। দারোয়ান পকেট গেট খুলে দিত। মজার ব্যাপার হলো, বিশেষভাবে আমি আর আলম সহস্রবার বেঙ্গল স্টুডিয়োতে ঢুকেছি, তবে সেটা শুটিং দেখতে নয়। গল্প করতে। অনেকবারই শুুটিং চলছে শুনে ঢুকতাম না বা ঢুকলেও বেরিয়ে যেতাম। বেঙ্গল স্টুডিয়োর বাগান, জমিদারবাড়ি, পুকুর-গাছপালা আর জঙ্গলের ভেতরে বসে আলম আর আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। সেদিন ঢুকেই বললাম, ‘আমি আর নেই, গ্যাঞ্জাম (শুটিং) চলছে।’ আলম বলল, ‘তর আইজকার লায়কের (নায়ক) চেহারাডা হালাগো দেহাইয়া দিবি না? কী যে…ছিঃনেমা বানায় হালারা। চেহারাসুরুত নাই, কাহিনি নাই। নাই অভিনয়। আর আহারে! হালাগো কী ডায়ালগ একেকটা! তারপর কী গান! গানের চোটে ডাইল ভাইঙ্গা কোকিল পড়ে!’

হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল আমার। দুয়েকজন কলাকুশলী ও এক্সট্রা বাইরে দাঁড়িয়ে গপ্পোগুজব করছিল। তাদের কেউ একজন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। বোধহয় ভাবছিল- কোন্ নায়ক এলো আবার! আমি গর্বিত পদক্ষেপে, পুলকিত মনে ওদের সামনে দিয়ে চলে এলাম। একসময় বীরদর্পে ওদের পাশ কাটিয়ে বেঙ্গল স্টুডিয়ো ছেড়ে বের হয়ে গেলাম। সেটাই মনে হয় আমার শেষ যাওয়া সেখানে। আর কোনোদিন যাইনি। আমার সাথে থেকে থেকে আলমও আমার মতানুসারী হয়ে উঠছিল। আমি আগে দুয়েকটি পুরোনো বাংলা ছায়াছবি (৭০ দশকের বাংলাদেশের, ৫০/৬০/৭০ দশকের উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা) কালেভদ্রে দেখতাম। এরপর তা-ও দেখা ছেড়ে দিলাম।

বেঙ্গল স্টুডিয়ো কেবলই একটা স্টুডিয়ো মাত্র। আসলে একটা শুটিং স্পট, অনেকটা জায়গা নিয়ে। ১৯৬৯ সালে বজলুর রহমান নামের এক ভদ্রলোক স্টুডিয়োটি স্থাপন করেন। এখানে কিছু শুটিং হয়, ডাবিং হয় এবং ছোটখাটো একটা এডিটিং রুমও বোধহয় আছে। বেঙ্গল স্টুডিয়োর কারণে আজ ‘রোজ গার্ডেন’ নামটি হারিয়ে যেতে বসেছে। বেঙ্গল স্টুডিয়ো যেহেতু সিনেমাশিল্পের সাথে জড়িত এবং সিনেমা সেই ৫০-এর দশক থেকেই সবচেয়ে বড় বিনোদন মাধ্যম হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে, সেই কারণে স্টুডিয়োটি রোজ গার্ডেনের চৌহদ্দিতে অবস্থিত হয়েও রোজ গার্ডেন নামটিকে পেছনে ফেলে দেয়। আর রোজ গার্ডেন যে কারণে একটি শুটিং স্পট তা হলো আট বিঘা বিশাল চৌহদ্দিতে স্থাপিত জমিদারবাড়িটি। এই জমিদারবাড়িটিকে আপনারা বহু ছায়াছবিতে চিত্রায়িত হতে দেখেছেন। হিন্দু জমিদার হৃষিকেশ দাস উনিশ শ’ সালের শেষদিকে গ্রীকস্থাপত্যের আদলে বাড়িটি তৈরি করেন। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় এটি প্রাচীন গ্রীসের করিন্থ শহরের স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি হয়েছিল; ফলে একে করিন্থিয়ান স্থাপত্য বললেও ভুল হবে না। এখানে আরেকটি কথা প্রসঙ্গক্রমে বলা ভালো যে, রোজ গার্ডেন বুঝাতে অনেকে এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে ‘হুমায়ূন সাহেবের বাড়ি’ বলেও থাকেন। কোনো একসময় হয়তো হুমায়ূন সাহেব নামের এক ব্যক্তি রোজ গার্ডেনের অংশবিশেষ কিনে তারপর এর একপ্রান্তে আরেকটি বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে থাকেন। একারণে রিকশাওয়ালাকে বেঙ্গল স্টুডিয়ো বললে পশ্চিমদিকের গেইটে নামাবে। আর হুমায়ূন সাহেবের বাড়ি বললে পুবপাশে কে.এম. দাশ লেনের মাথায় হূমায়ূন সাহেবের বাড়ির গেইটে নামাবে। এই হুমায়ূন সাহেব আর কেউ নন, তিনি কবি ও লেখক হুমায়ূন কবির, যাঁর কবিতা ‘মেঘনার ঢল’ ছোটোবেলায় আমরা পড়েছি। এই কবিতাটি ইংরেজ কবি Charles Kingsley-এর The Sands of Dee কবিতা ‘O Mary go, and call the cattle home, and call the cattle home…’এর বাংলা ভাবানুবাদ।

এই রোজ গার্ডেন নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কবিতাও কিছু রচিত হয়েছে। একটি কবিতার চরণ আমার আজও মনে আছে- ‘রোজ গার্ডেন, গোলাপের বাগ, ছিলে কি কভু রক্তের রাগ।’ ভাবতে ভালো লাগে যে কবিতাটি আমি আমার ‘সুহৃদ’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় ছাপিয়েছিলাম। লেখাটি জোগাড় করে দিয়েছিলেন মহল্লার সিনিয়র ভাই প্রয়াত শামীম করিম রঞ্জন। তিনিও ভালো লেখক ছিলেন।

কবিতাটি লিখেছিলেন সম্ভবত কবি আবুল হাসান। আমার ভুল হয়ে থাকলে আমি আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

তারপর কী হলাম জীবনে? একটি ল্যাটিন প্রবাদ মনে পড়ছে- ‘Omni ignotumn pro magnificio.’ যার সাদা বাংলা হলো?‘যা চেয়েছি আমি পাইনা, যা পেয়েছি আমি তা চাই না।’ একটা সময় গেছে যখন বাটা’র তৈরি মোটা নীল স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে কলেজে গিয়েছি। আবার সেই সময়ও এসেছিল যখন আমি একটা গাড়িও কিনে ফেলেছিলাম। স্পঞ্জ-এর চপ্পল পরা আর গাড়ি কেনা কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। সেসব কথা বালুকা বেলা’র পরবর্তী কোনো পর্বে লিখব।

আমি ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার হবো না সেটা বহু পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে গেছিল যেহেতু আমি অঙ্কে নাজুক রকমের কাঁচা ছিলাম। লক্ষ্য যেখানে স্থির নয়, সেখানে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না।

অতএব সেভাবেই চলতে লাগলাম। একসময় দেখলাম, সব শুভঙ্করের ফাঁকি। জীবনে অর্জন করতে পারলাম না কোনোকিছুই। তাতে অবশ্যি আমার এলোমেলো চলার গতি থেমে যায়নি। আমি ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না কখনো। বর্তমানটাকেই উপভোগ করেছি যতটা সম্ভব। ভবিষ্যত নিয়ে বিন্দু পরিমাণ ভাবলে বোধহয় আমার জীবনটা সাজানো বাগানের মতোই হতো। কারণ যেসব সুবিধা ও সুযোগ আমি পেয়েছিলাম, তা কাজে লাগাইনি। একটা কল্পনা, একটা ‘ইউটোপিয়া’য় বিভোর থাকতাম আমি। আর তাতে মদদ যোগাত আমার পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত পাঠের মালমশলা। আমার এসএসসি পরীক্ষার আগে বা পরের দিনগুলোতে সেবা প্রকাশনীর বিখ্যাত শিকারি ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের ‘জঙ্গল’ পড়েছিলাম। বইটি অ্যান্ডারসনের ‘This is the Jungle’-এর অনুবাদ ছিল। বইটি পড়ে দারুণভাবে প্রভাবিত হই এবং পরবর্তীতে শিকারের যাবতীয় বই সংগ্রহ করতে লাগলাম এবং পড়তে লাগলাম। সেবা প্রকাশনীর সেই ‘রুদ্রপ্রয়াগের চিতা’, ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো’ ছাড়াও সংগ্রহ করলাম শিকার সম্পর্কিত সেবা’র প্রায় সব বই। এরমধ্যে জন হান্টারের ‘অনুসরণ’ ছিল অন্যতম। সংগ্রহ করলাম J. Butt-এর (Khan Shahib Jamshed Butt) ‘Shiker.)’ বেশ ক’বছর পর সংগ্রহ করলাম অ্যান্ডারসনের ‘The Tiger Roars’, ‘In a Jungle Long Ago’, ‘The Call of the Man Eater,’ ‘Nine Maneaters and One Rogue’, ‘Queer Things’, J.H. Patterson (Lt. Colonel John Henry Patterson)-এর ‘The Man-eaters of Tsavo’ (সাভোর মানুষখেকো, ১৯০৭)। এই বইটি পড়ার বহুবছর পর (২০০৯) প্যাটারসনের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত ‘The Ghost and the Darkness’ ছবিটি দেখলাম আমি আর আমার ছেলে। আমার সংগ্রহে আরো আছে জিম করবেটের ‘Man Eaters of Kumaon,’ ‘Jungle Lore’, ‘The Temple Tiger’ ‘Gorilla Hunter’ প্রভৃতি। তবে করবেটের ‘My India,’ বইটি সংগ্রহ করতে পারিনি। সেটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে আছে। Gorilla Hunter (by Fred G. Merfield with co-author Harry Miller) বইটি আমি ক্যানেডায় এসে সংগ্রহ করেছি।

বিক্রমপুর হাউসে থাকাকালিন অ্যান্ডারসনের একটি বই থেকে অনুবাদ শুরু করলাম। সেসময় রমজান মাস চলছিল। ভোররাতে সাহরি খেয়ে আর ঘুমাতাম না। অনুবাদের কাজ করতাম। সেখান থেকে একটা এপিসোড (Novice of Manchi) অনুবাদ করে নাম দিলাম ‘মাঞ্চির ত্রাস’। তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে। অল্পদিনেই উত্তর এসে গেল। তিনি দেখা করতে বলেছেন আমাকে। দেখা করলাম, আমার অনুবাদের প্রশংসা করলেন তিনি এবং আমাকে জানালেন যে, শিকারের (জিম করবেট আর ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের) প্রায় সব অনুবাদই সম্পন্ন। রকিব হাসান সেকাজটি সম্পন্ন করে রেখেছেন। আমি যেন যেগুলো বাকি আছে, মানে কয়েকটি বই থেকে খুঁজে বার করে অনুবাদযোগ্য অন্য এপিসোডগুলো অনুবাদ করে ফেলি। তিনি আমাকে ৭% পারিশ্রমিকের প্রস্তাবনা করলেন। আমি রাজি হয়ে তারপর সেগুনবাগিচাতেই অফিসে বসেন এমন দু’জন লেখক সম্প্রতি প্রয়াত শেখ আবদুল হাকিম ও রকিব হাসানের সাথে কথা বললাম। তাদের সাথে কথা বলার পর আমি লেগে গেলাম কাজে। কিন্তু একটা বই হবার মতো যথেষ্ট এপিসোড খুঁজে পেলাম না। যেগুলো পেলাম তা আমার ভালো লাগল না। সুতরাং ইস্তফা দিলাম। আর একটা অতৃপ্তি মনের মধ্যে থেকেই গেল চিরতরে। পরে আমার অনুবাদকৃত ‘মাঞ্চির ত্রাস’ অধ্যায়টি কয়েক কিস্তিতে একটি স্বল্প প্রচারিত দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ছাপিয়ে ফেললাম। কারণ এটি ভালো কোনো পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে ছাপাবার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় ছিল না। বই হিসাবে সেবা প্রকাশনী থেকে বের হলে সেটা অন্যরকম ডাইমেনশন পেতে পারত। আমার অতৃপ্তিটা এতই প্রবল ছিল যে শিকার সম্পর্কে যে পড়াশোনা করেছি সেটা শেয়ার করতে অনেকের সাথেই শিকার বিষয়ে আলোচনা করতাম। মালয়েশিয়ায় আমি ট্রেইনিং করেছিলাম পরিবেশ বিষয়ে। সেখানে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বেলুম উপত্যকায় যাবার। সেখানের রেইনফরেস্টে আমার ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ট্রেইনিদের অভিযান চলে রাতব্যাপি। মায়া হরিণ আর টাপিরের বসবাসস্থল, অসংখ্য প্রাণী ও পোকামাকড় আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল (র‌্যাফেলশিয়া- এক ধরনের বড় ছত্রাক) প্রভৃতির প্রাপ্তিস্থান এই ভ্যালি। আমার এই অভিজ্ঞতার ওপর একটি লেখা তৈরি করে নাম দিলাম- ‘A Night in Belum Valley’. তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলাম ডেইলি স্টার উইকএন্ড ম্যাগাজিনে। সেখানে আমার প্রকৃতি-প্রীতি, শিকার ও প্রাণী সম্পর্কিত আমার আগ্রহ ও পড়াশোনার কথা মন খুলে বললাম। ডেইলি স্টার ম্যাগাজিনে সেটা ছাপা হলো। মনে হলো, আমি আমার মনের কথাটা প্রকাশ করতে সক্ষম হলাম।

এখন তো আর শিকারের যুগ না। সুতরাং শিকারের নতুন কাহিনি আর সৃষ্টি হবে না। যা সৃষ্টি হয়েছে, সেসব এখন কিংবদন্তি। কিন্তু সেসব নিয়ে গবেষণা হতে পারে। বই হতে পারে, তাতে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম প্রাণী সম্পর্কে জানতে পারবে। প্রাণিসংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় তারা অবদান রাখবে। সেই রুদ্রপ্রয়াগের চিতার কথাই ভাবুন। জিম করবেট যার পেছনে আটটি বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন! কীভাবে সেই চিতাটি (চিতাবাঘ) সুদীর্ঘসময় ধরে ৫০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ‘কারফিউ’ জারি করে রেখেছিল! মিথ নয় কি! সেসময় শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই কী বিপুল পরিমাণ জীববৈচিত্র্য ছিল, আর ছিল কত হরেক রকমের পাখি আর প্রাণী!

ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করে আমার সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাহিত্য অন্তহীন মহাসাগরের মতো, যার শেষ নেই। আমি যদি ইংরেজি সাহিত্য পড়ে তার থেকে বালিকণা পরিমাণও জ্ঞান অর্জন করে থাকি, ভাবব সেটা আমার সম্পদ। এরপর তো শুধুু পড়েই গেলাম। খুব পড়েছি তা বলব না, আসলে যেহেতু কিঞ্চিত সাহিত্যচর্চা করে থাকি, সেজন্য পড়াশোনাও তো কিছু করতে হয়। তাই আমার পড়াটা পাঠ্যবই পাঠ করার মতো। উত্তরাধুনিকতা, ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি। আমার পড়া সেই শিকার কাহিনি থেকে শুরু করে এখন Peter Barry-এর ‘Beginning Theory’ ও Kurt Vonnegut পর্যন্ত বিস্তৃৃত করেছি। অনুবাদও করেছি?ম্যান বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত কানাডীয় গল্পকার Alice Munro-এর ‘The Progress of Love.’ সেটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছে অন্যধারা ২০১০ সালে। আমার এই সাহিত্য বিষয়ে অধিক আলোচনা হয়তো আপনাদেরকে ক্লান্ত করে তুলতে পারে। কিন্তু এসব তো আমার মাঝে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো বইতে থাকে। তাই হয়তো প্রসঙ্গটি বারবার এসে যেতে পারে।

সাহিত্যের প্রসঙ্গ তো শেষ হবার নয়। সাহিত্য অসীম। তাই সাহিত্য সম্পর্কে অন্য অধ্যায়ে আরো আলোচনা করব।

আমি একবার প্রয়াত শামীম করিম রঞ্জনের নাম লিখেছিলাম এভাবে- শাক রন্ধন। কারণ সংক্ষেপে তিনি নিজের নাম লিখতেন এভাবে: শা.ক. রঞ্জন। তিনি তো মহাখাপ্পা। আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিবেন বলে জানালেন। তিনি সমাজ বিজ্ঞানে সম্মান ও মাস্টার্স করে আইন পড়েছেন। মহল্লায় অনেকের কাছেই তিনি মামলাবাজ বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের পদে ইস্তফা দিলেন। সেটা ঘটা করেই করলেন। আমার প্রতিবেশী হয়েও (তার বাসা থেকে আমার বাসা স্বল্প দূরত্বে হলেও ইস্তফা পত্র ও আমার যাবতীয় কুকর্মের ফিরিস্তি দিয়ে তিনি রীতিমতো রেজির্স্টাড ডাকে পত্র দিয়েছিলেন)। তার কাছ থেকে মহল্লার জুনিয়র ছেলেপেলেরা একশ’ হাত দূরে থাকত বা তাকে দেখলে ‘মামলাবাজ রঞ্জন আসতেছে’ বলে পালাত। তিনি বই ধার দিতেন। বই ফেরত দিতে এসে অনেকেই নাজেহাল হয়েছে বই ছেঁড়ার জন্য বা ময়লা করার জন্য। দুই তিনটি ছেলেকে তিনি হাজতবাসও করিয়েছিলেন বইঘটিত অপরাধে।

আমি যথেষ্ট তত্পর ছিলাম। উনাকে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছিলাম অবশেষে; সেটা এক বিচিত্র উপায়ে। পরে তার গল্প করব কোনো একসময়। তিনি ছিলেন একজন বিচিত্র মানুষ। হাতির মতো শরীর। মাথা কামাতেন নিয়মিত। সেটা ঢেকে রাখতেন হ্যাট পড়ে। তিনি রিকশায় চড়লে চাকা বার্স্ট করত, কিংবা কোনো একটা অঘটন ঘটত সেই রিকশার। অতএব হেঁটে চলাফেরা করাটাই পছন্দ করতেন তিনি। আর তিনি রাস্তায় বেরুলে গোটা মহল্লায় সেটা নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ত। ওই যায় মামলাবাজ, ওই এলো অসুর। আর রক্ষে নেই।

পাঠকদের একটু জানিয়ে রাখি, বালুকা বেলার আগামী পর্বেও আমার এলোমেলো ভাবনার প্রতিফলন ‘কী হতে চেয়েছি’, কেন হলাম না বা কিছু হবার মতো স্বপ্ন কেন দেখি, সে বিষয়ে কিছু বলব।