হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।
এক স্বর্ণালি দিনে
দিনটি ছিল ১১ নভেম্বর ২০২২। ঢাকায় অবস্থান করছি অনেক লম্বা সময় ধরে। গান রেকর্ডিং, লেখালেখি, ছাত্রী পড়ানো ও শুটিং নিয়ে। এর সাথে আগের বার জলবায়ু সম্পর্কিত লিখিত পাণ্ডুলিপিটি আবার পরিমার্জনা করলাম। গতবার কোনো প্রকাশনা সংস্থার সাথে আলোচনায় একমত হওয়া সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সময়ের প্যান্ডেমিক-পরিস্থিতি জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে কুপ্রভাব ফেলেনি। বৈশি^ক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি আচরণগত দিকে অনেক আকার ও প্রকারের কুপ্রভাব ফেলেছে, এবং ফেলে যাচ্ছে।
যাইহোক, এবছর (২০২২) এক নামী প্রকাশনা সংস্থার সাথে আলাপের প্রেক্ষিতে আমার জলবায়ু পাণ্ডুলিপিটি ২০২৩ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হবে বলে তারা জানাল এবং সেইসাথে তারা এই পাণ্ডুলিপিটির জন্য আমাকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্তও নিল।
এইভাবেই আমার সময়গুলো কাটছিল আনন্দ-ব্যস্ততা ও আশায়। সেসাথে করোনা ভাইরাসসহ নানারকম অসুখে ও ঝুট-ঝামেলায় ভুগেছি।
আমার মূল বিষয় একটি বিশেষ দিন সম্পর্কে পাঠককে জানানো। তার জন্য কিঞ্চিত ভূমিকা, আর নিকট অতীতের কিছু স্মৃতি না বললে স্বর্ণালি দিনটির বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই গোড়ার কথা কিছু বলব। আমার ঢাকায় আগমন ও টরোন্টোতে প্রত্যাগমন প্রায়শই ঘটে। এই অদলবদলের পালায় অনেক স্মৃতিই মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে সঞ্চিত হচ্ছে।
বহুবছর পর অনেকটা বৃহত্তর কলেবরে আমি আবার গানের জগতে লগ্নীকৃত হই গোপিবাগে থাকতে মহল্লার বড়ভাই সংগীতশিল্পী পারভেজ রব ভাইয়ের তাগাদায়। তিনিই নিজ উদ্যোগে তুরাগ থেকে আমার জন্য তবলা গড়িয়ে আনেন, আর কিনে আনেন হারমোনিয়াম। এরপর আর থেমে থাকিনি। তার মাধ্যমেই পরিচয় হয় এক ভদ্রমহিলার সাথে, যিনি গান করেন আর বেতার-টেলিভিশন আর্টিস্ট। তিনি এলেন একদিন। তবে গানের বিষয়ে নয়। তার বড় মেয়েকে আইলটস শেখানোর বিষয়ে। বিশেষ কারণবশত আমি এখানে অনেকের নাম অনুল্লেখিত রাখব।
মেয়েটা দারুণ ডান্স করে থাকে। যে কোনো অনুষ্ঠান বা শিল্পকলা একাডেমি মাতিয়ে দেয়। তো আমি একদিন তাকে বললাম, তুমি, তোমার মা ও তোমার বাবা ভালো গান করেন। তুমি করো না কেন? সেই থেকে আমি ওকে পড়াশোনার সাথে সাথে গানে নামিয়ে দিলাম। আমার বাসায় নিয়মিত তবলাবদক আসত, আর পারভেজ ভাই তো আসতেনই। আমার বাজানো হারমোনিয়ামে আর পারভেজ ভাইয়ের জাদুকরি তবলায় আমার ছাত্রীর গানাভ্যাস চলল। এরপর আমি আর ছাত্রী দ্বৈত গান আর দৃশ্যায়নে নেমে পড়লাম।
তারপর ভাঙল মিলন মেলা। পারভেজ রব ভাই রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন। আর তার কিছুদিন পর আমার ছাত্রী আমার কাছে আইলটস পড়ে পাস করে বিদেশে পাড়ি দিল।
আমার একাকীত্ব আর অসহায়ত্ব আমার প্রিয় ছাত্রীটি বুঝতে পেরেছিল। সে তার এক মডেল বান্ধবীকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেল। নতুন মেয়েটি প্রথমে আইলটস শিখবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পড়ে ওর কলেজে অনার্সে লেখাপড়ার চাপে আর সেটা হয়নি। তবে সে আমার বিভিন্ন গানে বা দৈ¦ত গানে নিয়মিত মডেলের ভূমিকা পালন করে যেতে লাগল। বর্তমানে আমার একটিই ছাত্রী আছে, সে হলো আমার পরবাসী প্রথম ছাত্রীর ছোটোবোন। সে ও-লেভেলে পড়ে, আমি তাকে ইংরেজি ও বাংলা পড়াই। ওর মা ওকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন, আর পড়া শেষে নিয়ে যান মেয়েকে। এই মেয়েটা আসে শুক্র-শনিবারে। আমার দিন টা ভালোই কাটে। কিউট একটা মেয়ে আর সে আমার সাথে ক্যাফেতে গিয়ে ওরিও ক্রাশার বা সাব স্যান্ডুইচ খেতে পছন্দ করে। আমার সময়টা বেশ কেটে যায় ওর কান্ডকীর্তি দেখে। এদিকে আমার প্রবাসী ছাত্রী আমার সম্পর্কে, তার ছোটোবোন কেমন পড়াশোনা করছে জানতে চায় আর প্রবাসে ওর জীবন সম্পর্কে ফোনে সবকিছু জানায়।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। ধরা যাক, আমার প্রথম ছাত্রী যে মেয়েটিকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, তার নাম অরণী। অবশ্যি যারা আমার ভিডিও সং বা আডিয়ো সং নিয়মিত দেখেন-শোনেন তারা মেয়েটির নাম জানতে পারেন। এই প্রসঙ্গে আমি ‘বালুকা বেলা’ কলামে কোনো এক এপিসোডে কিছুটা আলোকপাত করেছি। শুটিং, বেড়ানো বা ¯্রফে নানারকম ক্যাফেতে খেয়ে বেড়ানো হলো আমার আর অরণীর অন্যতম কাজ। আরেকটা কাজ হলো শপিং করা। বলাই বাহুল্য, শপিং-এর ধাক্কাটা আমার ওপর দিয়েই যায়। প্রথমত, ও ছাত্রী। দ্বিতীয়ত, সে আমার একাকীত্বের সঙ্গিনী। আর তৃতীয়ত, আমি তাকে স্নেহ করি, মমতা দিয়ে ঘিরে রাখি। জীবনে অনেক কাজের মধ্যে সাম্প্রতিককালে এই কাজগুলো আমার আর ওর মজ্জায় ঢুকে গেছে।
১০ নভেম্বর রাতে আমরা ম্যাসেঞ্জারে অনেক চ্যাট করলাম। উদ্দেশ্য নতুন কিছু করা। বৃন্দাবন, উত্তরা দিয়াবাড়ি. চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, তিনশ’ ফিট, ভাওয়াল গড়Ñসবই তো চষে বেড়ালাম। এবার ভাবলাম নয়া আদলে আর নয়া ঢংয়ে কী করা যায়।
অনেক আলোচনা হলো, তবে সিদ্ধান্ত হয়নি। শেষে বললাম তুমি আগে আসো তারপর দেখা যাবে। পরদিন সে সকাল ১১টায় এলো। আমাদের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। কিছু কিছু বিষয় ঘটে যায়। প্ল্যান করে সেই প্ল্যানমতো কাজ সম্পাদন করা বাংলাদেশে একটা কঠিন কাজ। সেটা আনন্দ উপভোগের জন্য হোক বা কোনো দরকারি কাজে হোক।
আমরা বৃন্দাবনের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। এটা ভারতের তীর্থস্থান ও লীলাভূমি বৃন্দাবন নয়। বৃন্দাবন হলো ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মথুরা জেলার অন্তর্গত একটি শহর। ঈশ্বর পরম রাধামাধব এখানে নিজেদের সচ্চিদানন্দ ছেলেবেলার লীলা প্রকাশ করে থাকেন । শহরটি ঈশ্বর পরম রাধামাধবের ভূ লোকের লীলা ভূমি জেলাসদর মথুরা থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আগ্রা-দিল্লি হাইওয়ের ওপর অবস্থিত। বৃন্দাবন শহরে রাধা ও কৃষ্ণের অনেকগুলি মন্দির আছে। হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব স¤প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান।
আর আমি যে বৃন্দাবনের কথা বলছি সেটি খোদ ঢাকা শহরের ভেতরে অবস্থিত। এখানে শরত্কালে কাশফুল ফোটে। খোলামেলা জায়গা। অনেক লোকের সমাগম হয়। আমরা অটো রিকশায় মিরপুর ডিওএইচএস পেরিয়ে বৃন্দাবনের উঁচুনিচু স্থানে এসে প্রথমে টং দোকানে চা বিস্কিট খেলাম। অরণী প্রাচীন আমলের নাগরদোলায় চড়ল। এরপর আমরা খালি প্লট, জংলা জায়গা ও শন-আগাছার কাছে ও ভেতরে ভিডিও করলাম। ছবি তুললাম। আমাদের সাথে সাথে ভিডিওতে অংশ নিল কতগুলো ষাঁড় ও গাই গোরু।
আমরা জানতাম না যে এখানে অপেক্ষমাণ অনেক প্রকার বাহন উত্তরা দিয়াবাড়ি যায়। তেমনি একটা অটো বাহনে আমরা চারপাশের মনোরম দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে চললাম। থামলাম এসে লেকের পারে। একদিকে এয়ারপোর্ট রোড ও মেট্রোরেল, অন্যদিকে বড় বড় পাকা রাস্তা ও গ্রামীণ পটভূমিকায় খালি প্লট ও জংলা স্থান। আমরা লেকের ওই পাড়ে দেখতে পেলাম সারি সারি বোট। এক অটো রিকশায় উঠে ঘুরপথে আমরা লেকের ওই পাড়ে বোটগুলোর কাছে গেলাম। দেড়ঘন্টার জন্য প্যাডেলচালিত বোট চালালাম প্রায় পুরো লেকজুড়ে। অরণী ও আমার জন্য এটা ছিল পরম আনন্দদায়ক ও নয়া অভিজ্ঞতা।
ততক্ষণে সূর্য হেলে পড়েছে। এক দোকানে চা খেতে খেতে দেখতে পেলাম ঘোড়ার গাড়িটাকে। চমত্কার রাজপ্রাসাদের কোঠার মতো মূল গাড়িটা। খয়েরি কালারের স্বাস্থ্যবান ও দৃষ্টিনন্দন দুটি ঘোড়া। আমরা ঘোড়ায় চড়ে সার্কুলার ওয়েতে ঘুরলাম অনেকটা এলাকা। এরপর আমরা বন্দুক হাতে নিয়ে বেলুন ফোটানো প্র্যাক্টিস করলাম। সন্ধ্যা নামছিল। এবার খাবারের পালা। অরণী তার মোবাইল ঘেঁটে একটা রিসোর্টের সন্ধান পেল। জেনেও নিল খাবারের মেনিউ। তখন সন্ধ্যা। সব নির্জন হয়ে গেছে। পুরো এলাকাটাকে কেমন ভৌতিক লাগছিল। কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম। একটা রিকশা নিয়ে এলাম NEUVE ‘MI cafe & restaurant এ। সে এক এলাহী কান্ড। আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের রেস্তরাঁ এসব নয়। তবুও আমরা এখানেই খেলাম। একদিন বৈ তো নয়। বিশাল এলাকা নিয়ে আলোকসজ্জার অন্যতম ক্ষেত্র এই রেস্তরাঁ। মশার উপদ্রব ছিল। তারা কয়েল ও ধূপ জ¦ালিয়ে দিল।
এখান থেকে বের হয়ে অন্ধকার পথে ফের রিকশা নিয়ে আমরা উত্তরা মেইন রোডে এলাম। অরণীর অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল রেশমী কাবাব খাবে। সেটা কোথায় পাওয়া যায়, তার জানা ছিল। রেস্তরাঁর নাম ছিল সম্ভবত কোল অ্যান্ড কফি। সেখানে আমরা সেভেন্থ ফ্লোরে বসে স্ট্রিট ভিউ উপভোগ করতে করতে রেশমী কাবাব, নান রুটি আর কফির সদ্ব্যবহার করলাম।
তখন রাত। বেরিয়েছিলাম এক স্বর্ণালি দিনে। ফিরলাম জ্যাম, দূষণ আর হট্টগোলের ভেতর দিয়ে অনেক রাতে বাসায়। সিএনজিতে ফিরছিলাম। পথে খিলখেতে নেমে গেল অরণী, আর আমি অর্ধ স্বপ্ন ও অর্ধ জাগরণে বাসায় ফিরলাম রাত প্রায় বারোটায়।
এমন একটি স্বর্ণালি দিন বোধহয় আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
হাসান জাহিদ : টরন্টো, কানাডা