হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
মোটামুটি ৮০ ও ৯০ দশকের সময়। সেই সময়টায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো যেমন রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে, তেমনি ঘটেছে রোমাঞ্চকর ও রোমান্সসমৃদ্ধ ঘটনা। ঘটেছে বিপদ। সম্মুখিন হয়েছিলাম অজস্র চ্যালেঞ্জের।
একটা সময় মগবাজারে থাকতাম। সেখানেরই একটা স্কুলে পড়তাম। পরে চলে যাই নয়াপল্টনে, এরপর গোপিবাগে। গোপিবাগ থেকে মগবাজার এসে আড্ডা দিতাম। আবার আমার বন্ধুরা গোপিবাগে এসে আমার সাথে আড্ডা জমাত। সেইসময় একটা ঘটনা ঘটেছিল, যা আমাকে রীতিমতো ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল; কোনো সূত্রেই সমীকরণটা মেলাতে পারছিলাম না।
মগবাজারে আমার এক মাস্তান বন্ধু ছিল। তার নাম টা উহ্য রাখছি। এই বন্ধু, আমি, আলম ও আরও কয়েকজন জুনিয়র-সিনিয়র বন্ধুরা প্রায়ই দলাদলি-মারামারিতে লিপ্ত থাকতাম। আমি তখন কেবল নটরডেম কলেজ সমাপ্ত করে ঢাবি’র ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলাম। কলেজ জীবন থেকেই আমি একটা পত্রিকা বের করতাম। সেখান থেকে আমার আয় হতো। ঢাবিতে এসে সেই পত্রিকার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। এই পত্রিকা ও বেঙ্গল স্টুডিয়ো সম্পর্কে আমি ইতোমধ্যে বালুকা বেলার বিভিন্ন অধ্যায়ে অনেকবার লিখেছি।
আমার শিক্ষা, ব্যকগ্রাউন্ড ও ব্যক্তিত্বের কারণে মারামারি বা দলাদলিতে আমি বা আমার মিত্রবাহিনি প্রায়শই অক্ষশক্তিকে হারিয়ে দিতাম। যদিও মারামারি-দলাদলি আমি পছন্দ করতাম না। তাই গোড়াতেই সমূলে শত্রæতা বিনষ্ট করে আমি আমার প্রয়াত বন্ধু আলম ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমি আমার স্টাইলে ভ্রমণ করতাম বা আড্ডা দিতাম। তো একদিন আমার সেই মাস্তান বন্ধু আমাকে বলল যে সে একটি কবিতা লিখেছে। আমি যেন আমার পত্রিকায় সেটা প্রকাশ করি। আমার ভেতরের তাচ্ছি¡ল্য ভাব গোপন করে আমি তার লেখাটি নিয়ে বাসায় এসে পড়ে একটু বিস্মিতই হলাম। কবিতার ভাববস্তু, ভাষা ও উপস্থাপনা আমার পছন্দ হলো। কবিতাটি প্রকাশ করলাম।
একদিন মগবাজার নয়াটোলার একটি রেস্তরাঁয় বসে মাস্তান বন্ধু’র কাহিনি শুনে আমার শুধু হেঁচকি ওঠাটা বাকি ছিল। জানলাম, সে নিয়মিত টানবাজারের পতিতা পল্লীতে যায়। বিস্ময়কর বিষয়, সে নিষিদ্ধ পল্লীর এক সুন্দরী পতিতার প্রেমে পড়ে যায়। শুনে টাস্কি খেলাম। এরপরের পর্ব শুনে আমি হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সেই পতিতাকে সে বিয়ে করে গৃহবধূর পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে বাড়িতে তুলল। এবার আমি বন্ধুটির তারিফ করলাম।
আজও তাকে আমি মনে মনে স্যালুট জানাই। একদিন নিজেই বন্ধু আলমকে নিয়ে আমি টানবাজার দেখতে এলাম। বাইরে থেকেই যতটুকু সম্ভব দেখেশুনে নিলাম। আমার ভয় করছিল; সান্দ্র ভয়। আশেপাশের লোকেরা যেভাবে তাকাচ্ছিল মনে হলো আমরা যেন খদ্দের। এক দালালও এসে হাজির হলো কোথা থেকে।
এরপর একদিন আমি মাস্তান বন্ধু ও আলমের কাছে টানবাজারের প্রস অ্যান্ড কোনস সবকিছু শুনে মনে হলো নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে পতিতাদের প্রাচীন আমলের কুঠুরীগুলো আমার মনের পটে আঁকা হয়ে গেছে।
তখন আমি পূর্ণ উদ্যমে সাহিত্য চর্চা করতাম। মাস্তান বন্ধু’র পতিতালয় অভিযান নিয়ে আমি একটি গল্প রচনা করে ফেললাম। নাম দিলাম- ‘আর্টেমিস ও একটি কুহকী রাত।’ এই গল্পটি ‘শৈলী’তে ছাপা হয়েছিল। পরে গল্পটি আমি আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘প্রত্নপ্রাচীন দেবী’তে অন্তর্ভুক্ত করি।
৮০’র দশকের ঢাকার টঙ্গী, গাজীপুর, জয়দেবপুর, বৃহত্তর টাঙ্গাইল, নরসিংদী এবং ভৈরব হয়ে মোটামুটি কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত একটি লাইন কল্পনা করলে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে তা ২০২৩ সালের সাথে কোনোভাবেই মিলবে না। বলতে গেলে আমূল পরিবর্তন হয়েছে দৃশ্যগত, পরিবেশগতভাবে এবং জনসংখ্যা, অবকাঠোমো ও অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন সাধিত হয়েছে, তেমনি অবকাঠামোর উন্নয়নও ঘটেছে বড়সড় কলেবরে। আবার তেমন ক্ষতিবৃদ্ধিও হয়েছে। অবনতি হয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের, ধ্বংস ও সঙ্কুচিত হয়েছে জলাভূমি, বৃক্ষ ও বনভূমি। বেড়েছে মানবসংখ্যা।
যে কল্পিত রেখার কথা বললাম, সেই রেখাতেই যে আমাদের কর্মকান্ডগুলি সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়, ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত দেশজুড়েই। এই রেখাটির কথা বলার উদ্দেশ্য হলো এখানে আমার পদচারণা ঘটেছে বহুবার। একবার নরসিংদীর পলাশে গিয়েছিলাম ঘোড়াশাল সার কারখানায় টেন্ডারের কাগজপত্র সংগ্রহ করতে। কনকর্ড থেকে অফিসিয়্যাল ট্যুর ছিল। কাজ সেরে দুপুরে নদীর ধারের এক সাধারণ রেস্তরাঁয় ঢুকলাম ভাত খেতে। তাজা সরপুটি মাছের তরকারি দিয়ে ঝরঝরে ভাত খেয়ে আমার আর উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম সাদামাটা হোটেলের সাধারণ চেয়ারে। জীবনে এত তৃপ্তির সাথে কমই খেয়েছি।
শৈশবে যখন ট্রেনে দেশের বাড়িতে যেতাম তখন ঘোড়াশাল এবং ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশন পাড়ি দিয়ে ভৈরব জাংশনে ট্রেন থামত। সেখানে নেমে আবার লোকাল ট্রেনে চেপে আমরা নামতাম ইপ্সিত স্টেশনে। ঘোড়াশাল নামটি এবং ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ-এর সেই লোহার কাঠামো আমার মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ৮০’র দশকের গোড়ার দিকেও জনসংখ্যা এতটা বাড়েনি। তখন ভাবিনি, সারাদেশে বয়ে যাবে মানুষে-মানুষে এত সংঘাত আর অস্থিরতার স্রোত।
টাঙ্গাইল জেলার করোটিয়া, মির্জাপুর, ঘাটাইল, বাসাইল, টাঙ্গাইল শহর আর গড় এলাকা ঘুরে বেরিয়েছি অনেকবার। ভাওয়ালের গড় দেখেছি দুইবার। একবার আমি, শিমুল আর আলম যখন গজারিবনে গিয়েছিলাম, তখন শুনেছিলাম সেই অঞ্চলে কয়েক বছর আগেও (সেই সময় থেকে/৮০’র দশকের গোড়ার দিকে) হনুমান দেখা যেত। দেখা যেত ময়ূর। বিষয়টি এমন- সূর্য যখন ধীরে ধীরে পাটে বসে এবং একটা সময় মিলিয়ে যায়, তবুও তার রেশ থাকে। আমার তেমনি মনে হয়েছিল, এই পরিবেশ, এই গাছ আর প্রকৃতি- সবকিছু বুঝি হনুমান আর ময়ূরের খুবই উপযোগী। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে হনুমান আর ময়ূর নাম শুনে মনে হলো- ওরা বুঝি এখনও সেখানে আছে, খুঁজলে দুয়েকটা পাওয়া যেতে পারে। আলম আর শিমুলের চোখ এড়িয়ে একা একা খুঁজেছিলাম আমি! মনে মনে বলেছিলাম, একটা হনুমান বা ময়ূর যদি দেখতে পেতাম! একটা সময় (চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে) বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড় থেকে শুরু করে জয়দেবপুর-শ্রীপুর এবং বৃহত্তর ভাওয়ালের গড়ে অসংখ্য বন্যপ্রাণির বসবাস ছিল। চিতাবাঘ, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, গুঁইসাপ, গন্ধগোকুল, ময়ূর, সাপ, হনুমান, অজগর এবং আরও অসংখ্য পশুপাখি। তারা আজ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। যে কয়টা এখনও টিকে আছে, তারা কোণঠাসা হয়ে সরতে সরতে গারো পাহাড়ের গহিন ঘন অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে। হয়তো তারাও একদিন হারিয়ে যাবে। একসময় যমুনা নদীতে অসংখ্য কুমির ছিল। এমনকি বুড়িগঙ্গা নদীতে সত্তরের শেষভাগেও শুশুক (গাঙ্গেয় ডলফিন) দেখা যেত। শিমুলদের বাড়ি বিক্রমপুরের লৌহজংয়ে। নদীপথে দেশের বাড়িতে যেতে আসতে শুশুক দেখার গল্প করত সে।
বুড়িগঙ্গা আজ একটি মৃত নদী। আমি খুলনাতে চাকরিরত অবস্থায় আমার এক স্থানীয় বন্ধু’র সাথে খুলনা নগরীর ভেতরেই একটা স্পটে বেড়াতে যেতাম, সেখানে বেশকিছু শুশুক দেখতাম- পাকা অ্যাক্রোব্যাটদের মতো শারীরিক কসরৎ দেখিয়ে চলেছে তারা, তবে সেটা কোনো জিমন্যাসিয়ামে নয়- স্রোতপূর্ণ পানিতে। রূপসা নদীর একটি পয়েন্টে। স্থানটার নাম ভুলে গেছি। আসলে আমি বেড়াবার নামে সেইসব শুশুকদেরই দেখতে যেতাম।
এখন দেখি শুধু টিকটক, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও মোবাইল বা কম্পিউটার। অল্পক্ষণের জন্য ওয়াইফাই না থাকলে বা ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে দম আটকে আসে। এখন যেসব যন্ত্রপাতির মধ্যে ডুবে আছি, নব্বই দশকে ডুবে থাকতাম প্রকৃতিতে। বনে-বাদাড়ে দুর্লভ পাখি বা জন্তুর সন্ধান করতাম।
আজ এখানেই সমাপ্তি। সামনের বার আসব নতুন কোনো বিষয় নিয়ে।