Home কলাম বালুকা বেলা : আমার স্মৃতিতে ঢাকা স্টেডিয়াম

বালুকা বেলা : আমার স্মৃতিতে ঢাকা স্টেডিয়াম

হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।

“In my life I have lived, loved, lost, missed, hurt, and trusted. I have made mistakes, but most of all, I have learned.”
এই উক্তিটি দিয়েই শুরু করছি আজকের ‘বালুকা বেলা’ পর্ব। আমার জীবনে বৈচিত্র্যের কোনো কমতি ছিল না। আমি আগের দুয়েকটি পর্বে আমার বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেছি।

“Variety is the spice of life”-এই যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবাদটি আমার জীবনে অনেকাংশেই প্রযোজ্য।

আমার একটা বড় বিনোদন ছিল ছেলেবেলার বন্ধু আলমের (প্রয়াত) সাথে ঘুরে বেড়ানো। আমরা চলে যেতাম দূরদূরান্তে। কখনও গাজীপুরের গজারিবনে, কখনও চিড়িয়াখানায় বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে, কখনও বা ভৈরবে। আর যেতাম বোর্ডবাজারে, নারায়ণগঞ্জে এবং নরসিংদীতে। জয়দেবপুর শ্মশানঘাটে বহুবার গিয়েছি দুজনে। আর চষে বেড়াতাম ঢাকা শহরের আনাচেকানাচে, বুড়িগঙ্গার তীরে, বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে অনেকদূরে। সেসব দিনগুলোর কথা মনে পড়লে ভেতরাটা দুমড়ে ওঠে। কত বিচিত্র মানুষ দেখেছি, দেখেছি তাদের জীবনযাত্রা, তাদের কষ্ট, আনন্দ আর বেদনা।

তখন তো ঢাকা এমন দূষণ, জনারণ্য আর যানজটের শহর ছিল না। মনের আনন্দে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের আরেকটা বিনোদন ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম)। সেই স্বপ্নের স্টেডিয়াম, ছোটোকাল থেকেই যেখানে যেতাম। যেতাম ছেলেবেলায় আমাদের মহল্লার লিডারের সাথে। অনেকসময় আমাদের কাছে পয়সা থাকত না। গেটের পুলিস আমাদেরকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে বিনে পয়সায় ঢুকিয়ে দিত গ্যালারিতে। তখন স্টেডিয়ামটা দ্ইুতলা ছিল।

বন্ধু আলমকে নিয়ে সেই আগাখান গোল্ডকাপ থেকে শুরু করে ক্লাব কাপ, দক্ষিণ এশীয় কাপ এবং মোহামেডান-আবাহনী ইত্যাদি সব খেলাই দেখতাম। একবার মোহামেডান-আবাহনী খেলায় স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করছিল আমাদের মগবাজারের এক দোস্ত হুমায়ূন। আসলে তার বাড়ি ছিল পুরোনো ঢাকার বাংলাদেশ মাঠের কোনো একটা স্থানে। সে মগবাজার বেড়াতে আসত তার খালার বাসায়। তখন আমাদের সাথে বন্ধুত্ব হয়।

সে একদিন স্টেডিয়ামের গেটে ডিউটি করছিল। আমি আর আলম ইতোমধ্যে টিকেট কেটে ফেলেছিলাম। আমরা তো আর জানতাম না যে আমাদের বন্ধু স্টেডিয়ামের গেটে ডিউটি করবে।

হুমায়ূন আমাদেরকে দেখে দূর থেকে কী যেন বলল। বুঝতে পারলাম না। সে ইশারা করল আমাদেরকে একটু দূরে সরে অপেক্ষা করতে। তাই করলাম আলম আর আমি। কিছুক্ষণ পর সে হাত উঁচিয়ে আমাদেরকে আসার সিগন্যাল দিল। আমরা কাছে এলে হুমায়ূন দুজনের হাতে একমুঠো করে টিকেট গুঁজে দিল। দর্শকদের প্রচণ্ড ভিড়ের সুযোগে হুমায়ূন বেশ ক’টি টিকেট না ছিঁড়ে এবং দর্শকদের কাছে সেটা ফেরত না দিয়ে পকেটে জমাতে লাগল। দর্শকরা সাধারণত গেটম্যানকে টিকেট দিয়ে দ্রুত ঢুকে যায়, ছেঁড়া টিকেট নেয়ার তাড়া থাকে না। থাকবেই বা কেমন করে। দুইপাশে লোহার গ্রিলের স্বল্প জায়গায় পেছন থেকে দর্শকদের ধাক্কায় টিকেট ফেরত নেবার আগে ঠেলার চোটেই তারা নিজেদের আবিষ্কার করে গ্যালারিতে। আমি আর আলম দুইজনের সেই দুই টিকেটসহ হুমায়ূনের দেয়া টিকেটগুলো চড়াদামে বিক্রি করে দিলাম টিকেট না পাওয়া দর্শকদের কাছে। একসময় শেষ হয়ে গেল টিকেট কিন্তু দর্শকরা ছাড়ছে না: ‘ভাই আমারে একটা টিকেট দেন ম্যানেজ করে।’ নাই বললেও শুনছে না! শেষে আমি আর আলম ঝাড়া দৌড় লাগালাম। নিরাপদ স্থানে এসে টাকা গুনতে লাগলাম। পাঁচটাকা, দশটাকা, পঞ্চাশ টাকায় পকেট ভরে গেছে। আলম বলল, ‘গোনার দরকার নাই। আগে আইসক্রিম খাই, তারপরে গ্যালারিতে ঢুকি। গেট বন্ধ হইয়া যাইব একটু পরেই।’ আমিও তা যুক্তিসঙ্গত মনে করলাম। মনটা ফুর্তিতে ভরে গেছে। পকেটে কয়েকশ’ টাকা। আর এদিকে আইসক্রিম খাওয়ার মজা। আমি হুমায়ূনের জন্য আরেকটি আইসক্রিম কিনলাম। ফিরে গিয়ে দেখলাম ওই বেচারা, আর দুইজন স্বেচ্ছাসেবী আর পুলিস-আনসারদের নাভিশ্বাস উঠেছে, ঘামছে দর্শক সামলাতে গিয়ে। ভেতরটা ভ্যাপসা আর অন্ধকার। আলম ওর হাতে কোনোক্রমে গুঁজে দিল আইসক্রিম। এবার আমাদের ঢোকার পালা। আমরা বাইরে এসে আবার লাইনে দাঁড়ালাম। হাতে টিকেট নেই, বেচে দিয়েছি। তাতে কী, হুমায়ূন তো আছে।

কিন্তু সেদিন বাসায় ফিরলাম টিয়ারগ্যাস খেয়ে। গণ্ডগোল বেঁধে গেছিল দ্ইু ভাইয়ের মধ্যে। মোহামেডানের ক্যাপ্টেন মঞ্জু (বড় ভাই) আর আবাহনীর ক্যাপ্টেন নান্নু (ছোটো ভাই) ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড উঠিয়ে তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। এদিকে গ্যালারিতেও বেঁধে গেছে যুদ্ধ! আমি আর আলম কোনোক্রমে ম্যানেজট্যানেজ করে ততক্ষণে বায়তুল মোকাররমের সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে পুরানাপল্টনে ঢুকে গেলাম। সেখানে দেখি শ্রীমান দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। কে? আর কে, স্বয়ং বাদশাহ্ হুমায়ূন! আমাদেরকে দেখে বলতে চেষ্টা করল, ‘টি-টি-টি…।’ আলম বলল, ‘টিয়ারগ্যাস।’ আমি বললাম, ‘মারাত্মক টিয়ার শেল।’ আমাদের বন্ধুটি ছিল তোতলা। আমরা ওর মনের কথাটা বলে দিলাম বলে কষ্ট করে ওকে বলতে হলো না, তাই সে খুব খুশি। তারপর আলমের দিকে ফিরে আবার বলল, ‘টা-টাকাডা দে। তি-তিনজনে ভা-ভা-ভাগ…।’ আমি হেসে বললাম, ‘ভাগ হয়ে গেছে অলরেডি।’ আলম টাকাটা হুমায়ূনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এইটা তর ভাগের টাকা।’

টিকেট মেরে খাওয়ার সাথে যে পাপ বা পাপবোধের একটি বিষয় থাকে, সেই হিসেব তখন আমাদের ছিল না। আমরা ছিলাম নজরুলের মতো কাল বোশেখির ঝড়।
খেলা দেখলাম, মুখ আইসক্রিমে ঠান্ডা আর পকেট গরম টাকায়। টিয়ার গ্যাস খেয়েও জয়ধ্বনি করতে লাগলাম। সেদিন আমরা নজরুলের মতো দুর্বার, টর্পেডো। তাই আমরা আমাদের ভাব প্রকাশ করেছিলাম নজরুলের ভাষায়:
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
কাল্-বোশেখির ঝড়।’

Exit mobile version