হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
আমার সক্রিয় সংগীত জীবন মানুষের গড় আয়ুর সাথে তুলনা করলে খুব সংক্ষিপ্ত বলা যায়। তবে তার বিস্তার কিন্তু অনেকটাই। শৈশব থেকে আশির দশক পর্যন্ত আমার সংগীত চর্চা অসীম সময়ের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে অচেনা সংবিত্তিতে ঝুলে ছিল। ঘরোয়া আসর ও বন্ধুদের আড্ডায় আমার গান সীমাবদ্ধ ছিল।
কৈশোরে স্কুলে বার্ষিক ফাংশানে গান করতাম। তখন আমার আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না সংগীতে। তারুণ্যে এসে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ওস্তাদের কাছে সংগীত শিক্ষার আগ্রহ জন্মায়।
তবে তা আলোর মুখ দেখেনি। আমি তখন পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার বেড়াজালে আটকে ছিলাম আমার লেখালেখিকে ঘিরে। পরবর্তীতে ইত্তেফাক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রথম গল্প প্রকাশ করে আবির্ভূত হই আশির দশকের গল্পকার হিসেবে। তখন আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিল লেখালেখিকে ঘিরে। তৎকালিন দি বাংলাদেশ অবজারভার-এর ইয়ং অবজারভার পাতায় ইংরেজিতে মূলত সাহিত্যবিষয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করতে লাগলাম। পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করি। ততদিনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের গর্বিত ছাত্র আমি।
মাঝেমধ্যেই গান প্রসঙ্গ আসত বা গান গাইবার অনুরোধ আসত। আমি একদিন অনেকটা খেয়ালের বশেই হারমোনিয়াম কিনে ফেললাম। অবসরে হারমোনিয়ামে নিজেই সারগাম করতাম। এভাবে একদিন আবিষ্কার করলাম আমি হারমোনিয়ামে গান তুলতে পারি।
অনার্স ও এমএ সমাপ্ত করে আমি চাকরিতে প্রবেশ করি, কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন লি.এ। সেখানে আমার কলিগ ছিলেন সাইফুল ভাই। তার স্ত্রী গান করতেন। কথায় কথায় জানালেন তিনি যে, ভাবিকে নিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী বশির আহমেদ-এর কাছে যান। আমি তো আহ্লাদিত হয়ে উঠলাম। আমার স্বপ্নের গায়ক- যাঁর গান শৈশব থেকে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেই বশির আহমেদ! সাইফুল ভাই ও আমি একই পদে চাকরি করলেও তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের।
সাইফুল ভাইয়ের সাথে গেলাম বশির আহমেদ-এর মোহাম্মদপুর জহুরি মহল্লার বাড়িতে। ব্যস শুরু হলো ওস্তাদজীর কাছে আমার সংগীত শিক্ষা। সেই সাথে চলল সাহিত্য চর্চা। আমি কনকর্ড ছেড়ে দি নিউ নেশন পত্রিকায় যোগ দিলাম। খুব দ্রুত উন্নতি করি আমি সেখানে। একসময় শিফ্ট ইনচার্জ হলাম। পত্রিকার কাজ সমাপ্ত করার পর রাত দুটোয় গান করতাম। শ্রোতা ছিলেন নিউজ এডিটর ও আমার জুনিয়র-সিনিয়র সাংবাদিকেরা। এমনকি কখনও এডিটর এসেও যোগ দিতেন। বাংলায় গল্প লেখার পাশাপাশি দি নিউ নেশন ও ডেইলি স্টার পত্রিকায় পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করতাম।
ইতোমধ্যে আমি স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়াম কিনলাম। বাবু নামের একজন তবলাবাদক আসতেন নিয়মিত আমাদের বিক্রমপুর হাউসের বাসায় আমার একান্ত কক্ষে। সেইসময় একমাত্র টিভি চ্যানেল ছিল বিটিভি। অনার্সে পড়ার সময় বিটিভিতে আমি সহকারি প্রযোজক হিসেবে কিছুদিন পার্টটাইম চাকরি করতাম। সেইসময় একটা দলীয় সংগীতে অংশগ্রহণ করি। ঢাবিতে শিক্ষক আসার আগে কøাসমেটদের গান শোনাতাম ক্লাসরুমে বসে। এমএ পরীক্ষার আগে আমি ক্যাম্পাসের একটা অনুষ্ঠানে মান্না দে’র সেই বিখ্যাত ‘কফিহাউসের সেই আড্ডাটা’ গান টা করেছিলাম।
সময় বসে থাকে না। আমার কাছে এখন মনে হয়, আমার ক্ষেত্রে সময় যেন দ্রুতগতিতে বø্যাকহোলে চিরতরে হারিয়ে গেল। একটা সময় ওস্তাদজী বশির আহমেদের কাছে শিক্ষাপর্ব শেষ করে সংগীতের চেয়ে সাহিত্যের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়লাম।
নব্বই’র দশকটা আমার সংগীত পর্বের সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগ দিয়ে একধরনের রুটিন জীবনে প্রবেশ করলাম, আর মনে হতে লাগল যে, এই চাকরি আমার স্বাধীনতা ও শখ-আহ্লাদ সব কেড়ে নিল। তবে সময় বের করে নিয়ে সমসাময়িক কবি-গল্পকারদের নিয়ে জাদুবাস্তবতা আন্দোলন, পঠন ও নিরীক্ষায় ব্যপৃত ছিলাম।
আমার একটা আনন্দের জায়গা ছিল নানাবাড়ি। প্রায়ই সেখানে যেতাম। তখন গ্রামগুলো বিদ্যুৎবাতির আলোর মুখ দেখেনি। হ্যারিক্যান ও ল্যাম্পের আলো জ¦লত। আমার ছোটো মামা ভালো গান করতেন। তাঁর সাথে রাতভর গান করতাম। মাঝেমধ্যে মামার সাথে ছোটোখালার বাড়িতে যেতাম। সেখানেও গান করতাম। নানাবাড়িতে ও ছোটোখালার বাড়িতে আমার অসংখ্য শ্রোতা-ভক্ত ছিল। এইসব ভক্তদের মধ্যে আমার খালাতো-মামাতো বোন ও তাদের বান্ধবীরাও ছিল।
একটা রাতের কথা জীবনে কোনোদিন ভুলব না। আমার ছোটোখালার বাড়িতে গেলাম। গ্রামের নাম রাজারবাগ। নরসিংদী জেলার ওয়ারী-বটেশ^রের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। গাছগাছালি, আনারস বাগান আর ঘন জঙ্গলে ভরপুর এক গ্রাম। লাল মাটি ও টিলার গ্রাম। আম-কাঁঠাল-লিচু ও জলপাই গাছে চারপাশ ঠাসাঠাসি অবস্থা।
খালাদের বাসায় একটা পুরোনো হারমোনিয়াম ছিল। একরাতে বিশাল এক চাঁদ উঠেছিল। সেই মায়াবী আলোয়, সেই পরাবাস্তবময় আধিভৌতিক আবহে আমি হারমোনিয়াম সহযোগে গান করেছিলাম- ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে…।’ আমার খালাতো বোনেরা ও পাশের দুয়েকটি বাড়ির শ্রোতারা আকাশের মতো নীরবতায় আমার গানে মনোনিবেশ করেছিল।
সেটা আরও পরের কথা। আমি গান থেকে দূরে ছিলাম অনেকবছর। স্ত্রী’র সাথে অভিমান করে। সেসময় বিভিন্ন জনের কাছ থেকে, এমনকি একটা চ্যানেল থেকেও গানের অফার এসেছিল। আমি গান করিনি। তবে লিখতাম। বই প্রকাশ করতাম বইমেলায়। বাইরের কোনো আসরে বা উপলক্ষে অবশ্যি গান করতাম।
আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলাম একসময়ে। কিছুদিন বেকার থেকে শেষে আওয়ার টাইম নামের একটি পত্রিকায় ডেপুটি এডিটর পদে চাকরি নিলাম। এরপর তো পাড়ি দিলাম সুদূর ক্যানেডায়।
ক্যানেডাতেও আমি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। কিছু পড়াশোনাও করেছি সেই দেশে। এখানে এসে আবার গানের আসরে যোগ দিতাম। আসর বলতে একক গানের অনুষ্ঠান। স্টেজে একক ও দৈ¦ত গান করলাম। দ্বৈত গানে আমার সাথে ছিল আমার স্ত্রী’র বান্ধবী। সে আমার গান পছন্দ করল, এবং জানাল সে ক্রেসেন্ট টাউনের হারমোনি হলে পহেলা বৈশাখে আমার সাথে গান করবে। গান নিয়ে আমি অভিমান করেছিলাম স্ত্রী’র সাথে। সেই অভিমান ভাঙাতেই বোধহয় স্ত্রী দ্বৈত গানে সম্মতি তো দিলই, এবিষয়ে সে ব্যাপক প্রচারণাও চালাল। তার ফল হলো- সেভেন ক্রেসেন্ট প্লেসের কোনো না কোনো অ্যাপার্টমেন্টে ঘরোয়া আসর বসত ও খানাপিনার আয়োজন হতো।
২০১৮ সাল থেকে আমি সংগীতে নিয়মিত হলাম। সেই বছর ও পরের কয়েকটি বছর বাংলাদেশে আমার অবস্থান দীর্ঘ সময়ের ছিল। আমার ভূতপূর্ব মহল্লা গোপিবাগের বড়ভাই পারভেজ রব ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হলো। তিনি একাধারে কন্ঠশিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও বাদক। পারভেজ ভাই নিজেই হারমোনিয়াম তবলা কিনে আনলেন। তারপর থেকে তিনি তবলা বাজাতেন আর আমি হারমোনিয়ামে গান করতাম।
২০১৮ ও ২০১৯ সাল আমার জন্য উল্লেখযোগ্য সময়। এই সময় আমি গানবাজনা, লেখালেখি ও পড়ার পাশাপাশি একজন ছাত্রীকে আইলটস পড়াতাম। মেয়েটা তুখোড় নৃত্যশিল্পী। পড়ার ফাঁকে আমি তাকে গানের তালিম দিতে লাগলাম। পারভেজ ভাই আসতেন, তিনি গানের সার্বিক দিক তদারক করতেন। একদিন ঠিক হলো আমি ও আমার ছাত্রী ঐশী দৈ¦ত গান করব।
পারভেজ ভাইয়ের সংগীত পরিচালনায় ‘তুমি সাত সাগরের ওপার হতে’ আর ‘তুমি যে আমার কবিতা’ গান দুটি রেকর্ড করা হলো। গানের দৃশ্যায়নও হলো গাজীপুর ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে ও ঢাকার তিনশ’ ফিটে। আমার ও ঐশী’র কন্ঠে গানে কে মডেল হবে? ঐশী জানাল, সে-ই হবে। তার যুক্তি ছিল: স্যার আমাকে গান শিখিয়েছেন, তার সাথে মডেল আমিই হবো।
আমি অবশ্যি ঐশীর আম্মুর সাথে ফোনে কথা বলেছি। তিনি সায় দিলেন। গান হলো। ইউটিউবে বিপুল ভিউজ হলো।
এরপর ঐশীর রেজাল্ট হলো। ভালোই স্কোর করল। আমি চাচ্ছিলাম ওকে ক্যানেডায় পাঠাতে। কিন্তু ঐশীর আম্মু দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে চাইলেন না। তিনি মেয়েকে পর্তুগালে পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন। স্বল্পসময়ে পর্তুগালে ভিসা হয়ে গেল ঐশীর।
ঐশী চলে যাবার আগে একটা মেয়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সে টিভি নাটকে অভিনয় করতে ইচ্ছুক ছিল। আমার লেখা নাটক টিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। এই কারণেই মেয়েটি এসেছিল।
মেয়েটার টিভি নাটকে অভিনয় করা হয়নি। এরপর আর পারভেজ ভাইও আমার গানের সাথে তবলা সঙ্গত করেননি বা আমার আর ঐশীর সংগীত চর্চার তদারক করেননি।
…একদিন আমি ও ঐশী পড়াশেষে একটা নতুন গান হারমোনিয়ামে প্র্যাক্টিস করছিলাম। এই সময়ে হৃদয় বিদীর্ণকারী সংবাদটা পেলাম। পারভেজ রব ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। অশ্রু নামল আমাদের দুজনের চোখে।
কিছুদিন পর ঐশী পাড়ি দিল পর্তুগালে। আমি একা হয়ে পড়লাম। মিলন মেলা ভাঙল। ডিপ্রেশনে ভুগতে লাগলাম। ঐশীর যাবার সময় এয়ারপোর্টে আমি নিঃশব্দ কান্নায় ভাসলাম।
আমার নিঃসঙ্গতা দূর করতে এগিয়ে এলো নাদিয়া। ওকে নিয়ে শপিং করতাম ও বাইরে খেতাম। আর আশায় ছিলাম, পরিচালক শীঘ্রই শুটিং শুরু করবে।
আমার টিভি নাটকের দুটি স্ত্রিপ্ট ছিল পরিচালকের কাছে। সে আমার খুব আপনজন। সে মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। আমার একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে নাটক করবে। এসময় সমস্ত পৃথিবীজুড়ে নেমে এলো কোভিড-১৯।
অনেক স্মৃতি, অনেক আলাপন ও আড্ডা ফেলে রেখে আমি পাড়ি দিলাম টরোন্টোতে।
পরবর্তীতে ঢাকায় ফিরে আমি ও নাদিয়া একসাথে গান করেছি। এই মেয়েটিরও গানের গলা ভালো। সে আমার সাথে দুটি দ্বৈত গান করল। অনার্স পড়াশোনার পাশাপাশি সে আমার একক অনেক গানের মডেলিং করল। ওকে ঘিরে তৈরি হলো আরেক রকম স্মৃতির সূতিকাগার।
এরমধ্যে আমি টরোন্টোতে গিয়ে আবারও এক বইমেলায় ঢাকায় ফিরে এলাম। সেই থেকে ঢাকায় আছি। অনেক গানের শুটিং হলো, রেকর্ডিং হলো। আরও একজন মডেলের সাথেও আমি আমার গানের শুটিং করেছি। সে এখন টিভি নাটকের অন্যতম ব্যস্ত নায়িকা।
সময় করছি গানে, লেখালেখিতে আর নানা ব্যস্ততায়। তৈরি করে যাচ্ছি ভবিষ্যতের স্মৃতি।