ভজন সরকার : শিলিগুড়ি এসে ডুয়ার্সে যাবো না, তা কি হয়? পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হিমালয়ের পাদদেশের এই বনাঞ্চল। ডুয়ার্সের যে অংশ পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সেটির আয়তনও বিশাল। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার জেলা নিয়ে পশ্চিমবংগের ডুয়ার্স অঞ্চল। অধিকাংশই ঘনবনাঞ্চল দিয়ে আবৃত। গোরুমারা এবং জলদাপাড়া বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। তাছাড়া কয়েকটি জাতীয় উদ্যান এবং বিশাল এলাকা জুড়ে চা-বাগান।

জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলার চা বাগানগুলোর অধিকাংশই আমার দেখা। সে গল্পকথা আগেই বলেছি। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’ এবং ‘কালবেলা’ পড়ে আগেই অনেক স্থানের সাথে পরিচয় ছিল। এক সময় আত্মীয়তার সূত্রে বইয়ে পড়া সে স্থানগুলো দেখার সুযোগ ঘটে যায়। তাই বেশ ক’বার ডুয়ার্সের চা বাগানে ঘুরেছি। কিন্তু বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য দেখার সুযোগ হয়নি তেমন। গাড়ি চালিয়ে গেছি মাইলের পর মাইল গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে। বিশেষকরে গোরুমারা ফরেস্ট দিয়ে। রাতে থাকার সুযোগ হয়নি কোনদিন।

শৈলশহর দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি ফিরে আবার মনে হলো, হাতে আরও দুদিন সময় আছে। গোরুমারা ফরেস্টে যদি এক কিংবা দু’রাতের জন্য রিসোর্ট পাওয়া যেতো! তখন হোলি চলছে। সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে মোট চারদিনের লম্বা ছুটি। চৈত্র মাসের গরমে এ রকম ছুটিতে সবাই পাহাড়ে বেড়াতে যায়। দু’বছর মহামারী কোভিড-১৯ এর জন্য অনেকেই ঘরবন্দী। তাই কোভিডের প্রাদুর্ভাব একটু কমতেই মানুষের ঢল ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে। খোঁজাখুঁজির পরেও কোথাও কোন রিসোর্ট পাওয়া যাচ্ছিল না।

গোরুমারা ফরেস্টের চিন্তা এক প্রকার হতাশ হয়েই ক্ষ্যান্ত দিয়েছিলাম। এক আত্মীয়ার মাধ্যমেই হঠাত করেই জুটে গেল একটা ব্যবস্থা। এক রাতের জন্য চারটা রুম পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো রিসোর্টটি ঠিক ফরেস্টের ভিতরে না, একটু দূরে। ফরস্টের গা ঘেঁষে যে লোকালয় ঠিক সেখানে; লাটাগুড়ি। কিছু না-পাওয়ার চেয়ে কিছু তো পেলাম। সেই সান্ত¡না নিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম এক রাতের জন্য হলেও যাব।

দার্জিলিং যখন যাই পাহাড়ে ওঠা-নামার অজুহাতে বাবাকে নেইনি। মা-কেও বাবার দেখাশোনার জন্যই রেখে যেতে হয়েছিল। কিন্তু এবার তো কোনো অজুহাত খাটবে না। সব মিলিয়ে মানুষ আটজন। দু’টো গাড়ি লাগবেই। ড্রাইভার সব হোলির ছুটিতে। ভাড়া গাড়িও নেই কোথাও। ফলে দুই রাত থাকার পরিকল্পনা বাদ দিতেই হয়েছে। তাই একদিন পিছিয়ে দিলাম গোরুমারা ফরেস্টে রাত্রিবাস।

সংশোধিত পরিকল্পনায় সুবিধেই হলো। সুযোগ পেলাম সে সময়ে ভারত জুড়ে আলোড়ন ফেলা সিনেমা ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দেখার। সাথে আরো একটা আনন্দ সংবাদ। আমার মা নিজে থেকেই সিনেমা দেখতে যেতে চাইলেন। জীবনে এই প্রথম মায়ের সাথে সিনেমা দেখা।
মা-কে জিজ্ঞেস করলাম, “কতদিন পরে হলে এসে সিনেমা দেখছো?”

মা অনেক ভেবে বললেন, “হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছিলাম অনেক আগে। বিয়ের ঠিক পরপরই। সিনেমার নাম ‘সুতরাং”।

আমি বললাম, “সে তো ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি। সুভাষ দত্তের পরিচালনা। নায়িকা কবরী।”

আমারও জন্মেরও আগে মা সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছিল ‘সুতরাং’ সিনেমাটি। পুরানো ঢাকার কোন এক সিনেমা হলে। ১৯৬৪ থেকে ২০২২ সাল। প্রায় ছয় দশক পরে মা আবার সিনেমা হলে এসেছেন। বাবাকে নিয়ে আসতে পারলে ভালোই হতো। কিন্তু মধ্যরাতের শো ছাড়া আর কোথাও টিকিট নেই। এতো রাতে তাই বাবাকে নিয়ে সিনেমা দেখা সমীচীন হবে না স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই। মায়ের সাথে আমি, আমার বোন, বোনের বর, এক ভাগ্নে। মায়ের চোখে মুখে আনন্দের আভা। যদিও ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর অতিরঞ্জিত কাহিনি এবং এক বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উছিলাদুষ্ট এ সিনেমাটি মায়ের তেমন ভালো লাগেনি বলেই হতাশা। যা আমার নিজের কাছেও তেমনটাই লেগেছে।

‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটিই বানানো হয়েছে ভারতের সকল বিরোধীদল তথা কংগ্রেস, বামদল এবং অন্যান্য প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে হেয় করার জন্য। ভারতের ক্ষমতাশীল বিজেপির ভোট-প্রচারণার প্রপাগান্ডাই এ সিনেমাটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই তো কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত সিনেমাটিকে বিজেপি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রদর্শনের ব্যবস্থাও করছে। ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর বহুত্ববাদী সমাজের দেশে এ ধরণের নীতি প্রচন্ড ভয়ঙ্কর। ১৯৮৯-৯০ সালে কাশ্মীরের ধর্মান্ধ ইসলামী জঙ্গীরা পাকিস্তানের সহায়তায় কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপর নির্যাতন করেছিল এটা যেমন সত্যি, এটাও সত্যি যে সে সময়েই কাশ্মীরের প্রগতিশীল মুসলিম সমাজের অনেক বিশিষ্টজনকেও হত্যা করেছিল জংগীরা। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটিতে মূদ্রার এক পিঠকে তুলে আনা হয়েছে। সিনেমাটি এক পাক্ষিক সা¤প্রদায়িক প্রপাগান্ডা- যা সমাজের অস্থিরতাই সৃষ্টি করবে। এতো অতিরঞ্জিত কাহিনি বিন্যাস অনেক সময় আসল ঘটনাকেই আড়াল করে ফেলে। এ সিনেমাটিতেও সেটিই ঘটেছে।

যা হোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে চললাম গোরুমারা ফরেস্ট রিসোর্টে। শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি বাইপাস ধরে চলে গাজলডোবা ক্যানেল রোড ধরে তিস্তা নদী পর্যন্ত তৈরী করা অপূর্ব এক সড়ক। গাজলডোবা ক্যানেল দিয়েই তিস্তা নদীর জল মহানন্দা নদীতে পাঠানো হয়। এক পাশে ঘন বনাঞ্চল, অন্যদিকে নির্মিত এ রাস্তাটি। মাঝখান দিয়ে স্বচ্ছ জলের স্রোতধারা বহে চলছে এ কৃত্রিম খালটি দিয়ে। কানায় কানায় পূর্ণ যাকে বলে এ খালটির জল তেমনি এক উচ্চতায় রাখা হয় সব সময়। তাই তো খালটির জলরাশির সৌন্দর্য এক কথায় অনিন্দ্য সুন্দর।

প্রায় ৫০ কিলোমিটারের এ রাস্তাটি দিয়ে চললে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। খাল পাড় দিয়ে চলা শেষ হলেই তিস্তা নদী। তিস্তা নদীর উপর দিয়ে তৈরী করা ব্যারাজ। পাহাড় থেকে নেমে আসা জল বিশাল আকারের স্লুইচ গেইটগুলো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ব্যারেজের উজান এবং ভাটিতে জলের তারতম্য দেখেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের জলবন্টনের বৈষম্যের চিত্র। কেন তিস্তা জলবন্টন চুক্তি বাংলাদেশের জন্য আবশ্যিক সেটিও বোঝা যায় তিস্তার অতি উজানে তৈরী করা গাজলডোবার ব্যারেজের উপরে দাঁড়িয়েই। ভাটিতে ধুধু বালুচর। উজানে পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলরাশি।

গাজলডোবার ব্যারেজ পার হলেই গোরুমারা ফরেস্ট এলাকা শুরু। হাতি এবং ভারতীয় গন্ডারের জন্য অভয়ারণ্য এই গোরুমারা ফরেস্ট। কয়েক কিলোমিটারব্যাপি লোকালয়। তারপরেই ঘন বনাঞ্চল। বনাঞ্চলের একেবারে শুরুতেই লাটাগুড়ি। গোরুমারা ফরেস্টে ঢুকার যে রাস্তা তার দুই পাশে এ রকম ডজনখানিক রিসোর্ট। আমাদের রিসোর্টটিও গোরুমারা ফরেস্ট ঘেঁষেই। একচালা অনেকগুলো বাংলো। সামনে পেছনে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বাগান। ঘরগুলো বেশ আধুনিক।

ফাইভ স্টার মানের। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। খাওয়া -দাওয়াতেও নানান বৈচিত্র। ঘরোয়া বাঙালি খাবার থেকে আধুনিক খাবার। আধুনিকতা থেকে অনেক দূরের এই ঘন জঙ্গলকেও পর্যটন শিল্পের জন্য এমন করে সাজানো সত্যি বিস্ময়ের। তখন চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়। এই অকালে কাঁঠাল এবং কাঁঠালের এঁচোড় খাওয়া আরো এক উপরি পাওনাই ছিল বটে।

ভাগ্যক্রমে সেদিন ছিল পূর্ণিমা। গোরুমারা ফরেস্টের প্রকৃতি সেদিন চাঁদের আলোয় সেজেছে । ফরেস্ট ঘেঁষা রিসোর্টেও সে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা এসে পড়েছিল সে রাতে। কোভিডের মতো মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে যাওয়া অশীতিপর বাবা-মায়ের সাথে এমন কিছু সময় কাটানো সত্যি এক পরম সৌভাগ্যের। এই বিশ্ব-মহামারীর সময়ে লাখ-কোটি মানুষের সে সৌভাগ্য হয়নি। সে দিক থেকে এ ছিল আমার জীবনের এক মহার্ঘ্য পাওয়া। (চলবে)
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও )