ভজন সরকার : শেষটা দিয়েই শুরু করি। কলকাতা থেকে ঢাকার ফ্লাইট ১১টায়। অন্তত ৯টার মধ্যে রিপোর্ট করতে হবে। বোনের বাসা থেকে মিনিট ১৫ লাগে বিমানবন্দর যেতে। কলকাতার ট্রাফিক এখন প্রায় ঘড়ির কাঁটায় চলে। তবু সাড়ে ৮টার মধ্যে তো বের হতেই হবে। তখন সাড়ে ৭টা। দেখলাম, সল্ট লেক ঘুরে এক ডজন জ্যান্ত কই মাছ নিয়ে উপস্থিত বোনের বর।
কোনো এক ফাঁকে কই মাছ ভাজা খেতে চেয়েছিলাম। দু’সপ্তাহেও রায়গঞ্জ কিংবা শিলিগুড়ির মাছের বাজারে কই মাছ জুটেনি। তাই শেষ চেষ্টা কলকাতায়। জানতাম, মা কিংবা বোনেরা কই মাছ না খাইয়ে আমাকে ছাড়বে না। ঠিক গতবারের মতো এবারেও ব্যাপারটা একেবারে শেষ সময়ে মিলবে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি।
সে বারেও শেষ দিন সকালে কলকাতায় এক মামার কাছে মায়ের ফোন। মা আমাকে কাঁঠালের এঁচোড় খাওয়াতে ভুলে গেছে। তক্ষুণি বাজার থেকে কাঁচা কাঁঠাল কেনা হলো। কঠিন আঠার সাথে যুদ্ধ করে এঁচোড় রান্না করে খাইয়ে তারপর বিমান ধরিয়ে দিয়েছিল মামা। এবারেও সেই একই পরিস্থিতি। ঢাউস দু’টো কই মাছ ভাজা খেয়ে ঢাকাগামী বিমানে উঠলাম।
বাঙালির সম্পর্কগুলো এখনো এমন সব মধুর ভালোবাসা আর মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ আছে। কই মাছ কিংবা কাঁঠালের এঁচোড়ের এ গল্পগুলো শুধু প্রতীকি নয়, এর সাথে মিশে আছে বাঙালির আবহমান কাল থেকে চলে আসা পারিবারিক অপত্য স্নেহ, আবেগ, ভালোবাসা। এই আবেগকে কোনো বিশেষণ দিয়েই হয়ত বিশেষায?িত করা যাবে না। যুগ বদলে যাচ্ছে। মানুষ যন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে যন্ত্রকে হার মানাচ্ছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে মানবিক ও পারিবারিক বন্ধনগুলো এখনো হয়ত তেমনি আছে; অকৃত্রিম, আবহমান এবং শাশ্বত।
বিমান বন্দরের প্রায় অস্বচ্ছ পুরু কাঁচের ভিতর দিয়ে তাই স্বজনের চোখ- যতক্ষণ দেখা যায়, তা হোক না আবছায়া। চেইক-ইনের লম্বা লাইন পেরিয়ে ইমিগ্রশনের লাইন। দীর্ঘ সময়। যতবার হাত দিয়ে ইশারা দিই-চলে যা। ঠায় অপেক্ষায় থাকা কয়েক জোড়া চোখ। নিজের চোখও এক সময় জলে ভিজে যায়। যতবার স্বজনের কাছে ফিরি, এ চিত্র ততবারের। আগে বাবা-মাকে নিয়ে আসতাম। বিড়ম্বনা এড়াতে এখন আর ইচ্ছে করেই আনি না। কিন্তু ছোট বোনটি? ওকে ঠেকাবো কিভাবে। আমার অবয়ব এক সময় রেখা এবং রেখাও এক সময় বিন্দুতে পৌঁছায়। বিন্দুর শেষ সীমা পর্যন্ত বোনটি তাকিয়ে থাকবেই। স্নেহ-মায়া-ভালোবাসাকে সময় এবং দূরত্ব দিয়ে ঠেকানো যায় কি?
যাক সে আবেগের কথা। যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, বাঙালির আহার-বিহার, সে কথাতেই থাকি এবং ঢাকার আতিথেয়তার কথা না হয় আপাতত শিকেয় তুলেই রাখি।
উত্তরবঙ্গে মার্চ মাসের মাঝামাঝি কাঠ-ফাঁটা রোদ। শীত শেষ হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু এখন তো শাক-সবজি কিংবা আনাজপাতি প্রায় বারো মাসেরই হয়ে গেছে সবখানে। তাই সকাল দুপুর রাত তিন বেলাতেই সব প্রিয় শাকসব্জি রান্না। আমার ভালোলাগা খাবারের তালিকা মা-বোনেদের জানা। প্রায় দু’সপ্তাহে ওজন বাড়িয়ে নিলাম কয়েক কিলোগ্রাম। রসনার তৃপ্তির জন্য এই সাময়িক অনিয়ন্ত্রণ হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিলাম এবার; যদিও প্রতিবার এ রকমই হয়।
“ছেলে আসবে” মা যদি পাঁচ জনকে বলে থাকে, “দাদা আসবে” এ কথা বোনেরা বলেছে আরও দশ জনকে। তাই সব্জিওয়ালা থেকে মাছ বিক্রেতা সবার সরবরাহে প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি।
এর মধ্যেই শৈল শহর দার্জিলিং বেড়ানোর আয়োজন। বিশ-ত্রিশ বছরে আট-ন’বার শিলিগুড়ি-ডুয়ার্সে এসেছি। চা বাগান আর জংগলেই ঘুরেছি বেশি। পাহাড়ে তেমন উঠিনি। একবার মিরিক এসেছিলাম। ‘উত্তর থেকে উত্তরায়ণ’ নামে ক’বছর আগে একটা সিরিজ রচনা লিখেছিলাম। ঢাকা-কলকাতার বেশ ক’টি পত্রিকা রেরিয়েও ছিল।
এবার মিরিক থেকেও আরো উপরে সোজা দার্জিলিং। সদলবলে যাত্রা। বয়সের ভারে বাবা বেশ কাবু। তবুও মনের জোর অফুরাণ। তাই দার্জিলিং যেতে আগ্রহী হলেও নানা বাহানায় পাশ কাটিয়ে মা-বাবাকে রেখেই গেলাম। এবারের সহযাত্রী ছোটবোন, ওর বর, ভাগ্নে-ভাগ্নী এবং আরেক বোনের ছেলে। শিলিগুড়ি থেকে কার্সিয়াং হয়ে ঘুম। ঘুম থেকে সোজা দার্জিলিং। ফেরার পথে ঘুম থেকে মিরিক হয়ে শিলিগুড়ি।
আমার প্রচন্ড মোশন-সিকনেস। দীর্ঘ এক দশক আরিচা রোড ধরে ঢাকা গিয়েছি। মাসে অন্তত দু’বার দু’বার করে চার বার যাতায়াত। এমন কোন দিন নেই যে, ঢাকা যাওয়া কিংবা ঢাকা থেকে ফেরার পথে বমি করিনি। সে কথা স্মরণ করেই আগাম প্রস্তুতি; প্লাস্টিকের ব্যাগের মজুদ। যদিও পাহাড় দেখার উত্তেজনায় এবার সে কম্মটি হয়নি একবারও।
হিমালয় অঞ্চলের এ পাহাড়গুলো পৃথিবীর অন্যান্য পাহাড়ের চেয়ে একটু আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। উচ্চতায় বেশি তো বটেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে গজানো গাছগুলোও নানা বৈচিত্রময়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিপদজ্জনকভাবে গড়ে ওঠা ঘর-বাড়িগুলো যে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে, এক কথায় তাও অনবদ্য এবং অনন্য।
ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই কার্সিয়াং পৌঁছানো গেল। পাহাড় কেটে কেটে তৈরী করা সরু রাস্তা। প্রায় সবাই অতি দক্ষচালক । সুদক্ষ নৈপুন্যে একে অপরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়িগুলো। একটু পরে পরে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড়ানোর জায়গা। পাহাড় উপত্যকা দেখার এবং ফটো শ্যুটের ব্যবস্থা।
কার্সিয়াং শহর ছাড়িয়ে কিছু দূর গেলেই ঘুম। ছোট এক শহরের নাম ঘুম। হয়ত এক সময় সুনসান নিরবতায় আচ্ছন্ন ছিল এ লোকালয়টি। যদিও এখন আর তেমনটি নেই। পর্যটকের ভীড়ে ক্লান্ত শহরটি নিজেই ঘুমে ঢুলুঢুলু। ভারতের সর্বোচ্চ উচ্চতার রেল স্টেশন এই ঘুমে।
ঘুমে ঢোকার আগেই সকালের জলখাবারের তাড়া। গাড়ি থামলো পাহাড়ের খাড়িতে ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট ও রিসোর্ট ‘মার্গারেট ডেক’-এ। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত চা পাওয়া যায় এখানে। চা পান চললো। সাথে সকালের খাবার। যাত্রা পথে কিংবা ভ্রমণে আমার খাবার বিলাসিতা নেই। কিন্তু তার ঠিক উল্টো আমার দু’ভাগ্নে, তনয় আর দীপঙ্করের। ভ্রমণ এবং খাবার এমন টানে যে তনয় ওর পেশা নির্বাচনেও এগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েছে। বছর দু’আগে এমবিবিএস শেষ করে মেডিক্যালে কলেজে লেকচারের চাকুরী পেয়েছে। ওর বাবা চায় মেডিসিনে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট করুক। কিন্তু ছেলে করবে সার্জারিতে। অদ্ভুত যুক্তি। মাসে দু’একটা সার্জারি করবে। বাকী সময় পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াবে। লোভনীয় খাবার খাবে।
সারা রাস্তা বাবা-ছেলের অদ্ভুতসব যুক্তি-তর্ক চললো। ‘মার্গারেট ডেক’-এর রেস্টুরেন্টেও তনয়ের বাহারি খাবার অর্ডার। স্যান্ডুইচের সাথে বেকন। আমি শুকনো স্যান্ডুইচ চিবালাম। সাথে দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত চা। চার কাপ চায়ের মূল্য প্রায় হাজারখানিক রুপি। বেশ চড়াই বটে। পর্যটন কেন্দ্র বলে কথা। পর্যটকেরাও জানে জীবনে একবার মাত্র এই বেচাকেনা। আর সে সুযোগটাই নেয় দোকানীরাও।
দার্জিলিং গিয়েও খাবারের বৈচিত্র। অসংখ্যবার পশ্চিমবংগে এসেছি কিন্তু মমো খাইনি। এবার দার্জিলিং মল স্কয়ারে প্রথম মমো খেলাম। দার্জিলিংয়ে স্টেক খাবে দু’ভাগ্নে। আমার বিদেশী খাবারে রুচি নেই তেমন। ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টেও ডাল-ভাত খুঁজি। আমার জন্য হোটেলের কিচেনই যথেষ্ঠ। কব্জি ডুবিয়ে ডাল-ভাত সাথে দু’একটা মাছের উপকরণ।
যদিও রসনার তৃপ্তি হয়েছিল ডুয়ার্সের ‘গরুমারা ফরেস্ট’- এর রিসোর্টে। সে কাহিনির সাথে বাংলাদেশের বন্ধুদের আন্তরিক আতিথেয়তার সকৃতজ্ঞ ঋণ স্বীকার, এগুলো জমা থাক পরের এপিসডের জন্য। (চলবে)
(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওন্টারিও)