মুরশাদ সুবহানী : লালন শাহ বা লালন সাঁই ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক রহস্যময় কবি এবং বাঙালি বাউল ও গীতিকার। তিনি এই উপমহাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় বাউল শিল্পী ও গীতিকার ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল আল্লাহ এবং অন্যান্য সৃষ্টিকর্মের শক্তির উপর। লালন সাঁই তাঁর গানগুলিতে দেহ ও আত্মার মধ্যে সর্ম্পক খোঁজার চেষ্টা করছেন। তাঁর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল। তাঁর গান থেকে সুপার পাওয়ার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, আধ্যাত্মিক তত্ত¡ দর্শনের মাধ্যমে। লালন শাহ একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তাঁর গানগুলি অনেক কবিকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছিল। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যালেন গিন্সবার্গ লালন সাঁই গানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আমেরিকান কবি-লেখক অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর আফটার লালন গ্রন্থে লিখেছেন,
After Lalon
BY ALLEN GINSBERG
1
It’s ture I got caught in
the world
When I was young Blake
tipped me off
Other teachers followed:
Better prepare for Death
Don’t get entangled with
Possessions
That was when I was young,
I was warned
Now I’m a senior Citizen
and stuck with a million
books
a million thoughts a million
dollars a million
loves
How’II I ever leave my body?
Allen Ginsberg says, I’m
really up shits creek
(Page 470 courtesy : Princeton University Library)
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুর পরিবারের তৎকালে জমিদারী এলাকার কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদাহ থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ছেউঁরিয়া। এটি লালন শাহ এর আখড়া।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লন্ডনে তাঁর হাভার্ড ইউনিভার্সিটির ভাষণে (১৯৩৩ খ্রী:) লালন শাহের প্রশংসা করেন এবং তাঁকে বিশ্ব মাঝে পরিচয় করিয়ে দেন এই ভাষণের মাধ্যমে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৪ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর গোরা উপন্যাসে লালনের গান ব্যবহার করেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন থেকে মাঘ অবধি চার কিস্তিতে প্রবাসী পত্রিকায় লালনের ২০টি গান প্রকাশ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
লালন গবেষক, অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন তাঁর এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, তখন থেকেই সুধি মহল এই গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। ‘লালনগীতি’ তথা বাউল গানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা বোঝাতে গবেষক, অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য উপস্থাপন করে বর্ণনা করেছেন-
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানে বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স-শিলাইদহে (কুষ্টিয়া) অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল,
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।
হারায়ে সেই মানুষ, তার উদ্দেশ্যে,
দেশ বিদেশে বেড়ায় ঘুরে।’
এই গানটি বাউল সুরে লালন শাহের ভাব শিষ্য গগন হরকরার রচনা। তার পূর্ণনাম বাউল গগন চন্দ্র দাস। তিনি শিলাইদহের বাসিন্দা ছিলেন। এ কথা সবাই জানেন, এই গানের সুরে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান-
‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।।’
এই গানের ১০ লাইন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহিত হয়।
এই গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ এবং তাঁর ভাব শিষ্য গগন হরকরাকেই সম্মানিত করা হয়েছে।
লালন শাহ শৈশবকাল আনন্দদায়ক ছিল না একথা সবাই জানেন। তাঁর শৈশব কাল ছিল দু:খময়। কয়েকটি সূত্র মতে, লালন শাহ মুর্শিদাবাদে হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং অন্যান্য সূত্রে জানা যায় যে, লালন শাহ বর্তমানে বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই নিয়ে গবেষক মহলে নানা তর্ক আছে। আছে কিংবদন্তি ও গুজব। আমরা গুজব, কিংবদন্তি এগুলোকে এই লেখা থেকে এড়িয়ে যাবো।
অধ্যাপক মনসুর উদ্দীন লিখেছেন, ‘লালন জন্ম থেকেই হিন্দু ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল পদ্মাবতী দেবী। পিতার নাম মাধব, তাঁর প্রদত্ত এই তথ্য অনেক সূত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এই তথ্যকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া যায়।
কিন্তু লালন শাহ নিজে কখনও তাঁর পরিচয় পরিষ্কার করেননি। তিনি জাতের বিষয়ে জানতে চাইলে গানের মাধ্যমে সেটির উত্তর দিয়েছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালন কয় জাতের কী রূপ/ আমি দেখলাম না দুই নজরে।….’ ‘কেউ মালা’য় কেউ তছবি গলায়, তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়/ যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে।……… লালন সে জেতের ফাতা ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে।’…..।’
লালন শাহ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
লালন গবেষক কুষ্টিয়া জেলার অ্যাড. মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের মতে, ‘প্রায় দুই শত বছর আগে কালিগঙ্গা নদী ক‚লে ভেসে আসে ১৬/১৭ বছর বয়সী এক যুবক। হাফেজ মালম দেখেন যে, ছেলেটির মুখ এবং শরীরে পক্স-এর দাগ। হাফেজ মালমের কোন সন্তান ছিল না। তিনি এবং তাঁর চার ভাই তাঁকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। তিনি ও তার স্ত্রী মতিজান লালনের সেবাযত্ন করতে থাকেন। লালন সুস্থ হলে তার নাম জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দেয়, তার নাম লালন।’
লালন শাহ সুস্থ হয়ে তাঁর নিজ গ্রামে ফিরে যান এবং অবস্থা বর্ণনা করলে নিজ স¤প্রদায় তাকে অস্বীকার করে সে মুসলমান পরিবারে আশ্রয় নিয়েছে বলে। লালনের উপর গবেষণা করেছেন এমন কয়েকজন গবেষক বলেছেন, লালন হিন্দু ছিলেন। নিজ স¤প্রদায় কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গ্রাম থেকে ফিরে আসাই ছিল লালনের টার্নিং পয়েন্ট। ফিরে এসে লালন শাহ কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউরিতে একটি আখড়া স্থাপন করেন।
লালন সাঁই বা লালন ফকির একটি গানের দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং সিরাজ সাঁইয়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।
বাউল লালন সাঁইয়ের গানগুলি আধ্যাত্মিক চিন্তার। কেউ কেউ মনে করেন, লালনের গানগুলি হচ্ছে ‘একিন’(বিশ্বাস) এবং সুফি ইজম। লালনের গান সুফিবাদের এটি অস্বীকার করেন অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ। সুফি ইজম এসেছে ইসলামী দর্শন থেকে। (চলবে)