Home কলাম বহুমাত্রিক সৃষ্টির কলমযোদ্ধা কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে – শ্রদ্ধাঞ্জলী

বহুমাত্রিক সৃষ্টির কলমযোদ্ধা কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে – শ্রদ্ধাঞ্জলী

সোনা কান্তি বড়ুয়া : বাংলাদেশের অনেক দৈনিক পত্রিকায় কলাম রচনায় সমর্পিত বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত অবিভক্ত ভারতের বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি জয় বাংলা, পরে যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেন। কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-এর রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। লন্ডনের একটি হাসপাতালে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ( ১৯ মে ২০২২) সকাল ৬টা ৫৯ মিনিটে তিনি মারা যান। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বড় মেয়ে তনিমা চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গাফ্?ফার চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তার কর্ম আগামীতে আমাদের অনুসন্ধানের আলো দেখাবে। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজ বদলের আন্দোলনে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা বাঁকবদলের সাক্ষী তিনি। দেশের এই বরেণ্য মানুষের মৃত্যুতে সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরাও শোকাহত। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘গাফ্ফার চৌধুরী তার মেধা-কর্ম ও লেখনিতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন ও বাঙালির অসা¤প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।’

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি?” এই গান লেখার সময় বহুমাত্রিক সৃষ্টির কলমসৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা কলেজের বিদায়ী ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর খবর পেয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান খোঁজ নিতে। সেই সময় আউটডোরে এক নিহত ছাত্রের লাশ দেখে তিনি আবেগে আপ্লæত হয়ে পড়েন। গুলিতে ছাত্রটির মাথার খুলি উড়ে গেছিল। নিহত ছাত্রটি ছিলেন শহীদ রফিকুদ্দীন।

১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর সেখানেই স্থায়ী হন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। যুক্তরাজ্যে তিনি নতুন দিন নামে একটি সংবাদপত্র চালু করেন। এছাড়া সেখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি। তিনি সাংবাদিকতা জীবনে ‘ডানপিটে শওকত’, ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘নাম না জানা ভোরে’, ‘নীল যমুনা’, ‘শেষ রজনীর চাঁদ’ ও ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’র মতো ৩৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নামের একটি ফিল্মও প্রযোজনা করেন। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৯ সালে তিনি স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পদক, স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পদক, সংহতি আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

একুশের গান কবিতার মোট পঙ্ক্তি ছিল ত্রিশ। এই অমর গানটি লিখতে তার ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রæয়ারি তিন দিন সময় লেগেছিল। কিন্তু বর্তমানে গানটির প্রথম ছয় পঙ্ক্তি মাত্র গাওয়া হয়। ১৯৫২ সালের “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো “অগ্নিঝরা মুহূর্তে কালজয়ী এই গানে প্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। পরে দ্বিতীয়বার সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ। এই সুরেই এখন গাওয়া হয় একুশের গান। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা গানটি এখানে পুরোটুকু দেয়া হলো-
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।”

কবি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপ্তি ছড়িয়েছেন। তাঁর এই ব্যাপ্তি জাতির গৌরব ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’- এই কালজয়ী গানটি লিখে যিনি জাতীয় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন, তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বের দেশে দেশে উদযাপনে তিনি, অর্থাৎ আমাদের এই গর্ব ও অহংবোধ তিনি উত্তরোত্তর আরও সমৃদ্ধ করেছেন নিজ গুণেই। সাংবাদিক, কবি, গল্পকার, কথাসাহিত্যিক ইত্যাদি কোন অধ্যায়ে তাঁর সর্বাধিক মর্যাদার আসন- এ প্রশ্নের জবাব সম্ভবত একটিই, আর তাহলো ‘একুশের গান’। এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। নির্দিষ্ট করে এই একটি ক্ষেত্রে তিনি অপ্রতিদ্ব›দ্বী ও নিঃসন্দেহে কালজয়ী স্রষ্টা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জীবনসায়াহ্নেও ছিলেন নিরলস একজন কলমসৈনিক। পাঠককে ধরে রাখার শক্তি সব লেখকের থাকে না, কারও কারও থাকে। এই কারও কারোর মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অন্যতম। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী হতে হয় সেই রকম কর্মময় অধ্যায়ের মধ্য দিয়েই। তিনি তাঁর কর্মগুণেই আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাংলা ভাষার দাবিতে প্রাণ দেওয়া শহিদদের স্মৃতির স্মরণে তিনি লিখেছিলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। শুধু এ গানটির জন্যই একজন গীতিকার হিসাবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অমর হয়ে থাকবেন। গানটি তৈরির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি এ গানটি লিখেছেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবিতে এদেশের ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি চালানোকে কেন্দ্র করে। এ গানে ফুটে উঠছে ৫২’র ভাষা আন্দোলনে শহিদদের মহান আত্মত্যাগের কথা।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ক্ষুরধার কলমের গতি আমরা দেখেছি অবিরাম। বায়ান্নর সেই দিনগুলোর স্মৃতি আমাদের মানসপটে এখনও জ্বলজ্বল। আমরা যাঁরা একুশের পূর্বাপর অধ্যায়ে সরাসরি যুক্ত ছিলাম, তাঁরা খুব ভালো করেই জানি- আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ অংশের অংশীদার প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বহুমাত্রিক সৃষ্টির কলমযোদ্ধা দীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিকতার ভুবনে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী র অবস্থান ছিল প্রধানত গণতান্ত্রিক, অসা¤প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে কেন্দ্র করে। এ ধারাতেই স্বদেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর খ্যাতি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে ধারণ করেছিলেন এবং এ দুই উৎস থেকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তিতে ঋদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব নীতিতে অটল থেকেছেন।

তাঁর সাংবাদিকতার কর্মজীবন প্রধানত ইনসাফ থেকে শুরু করে আজাদ, সংবাদ, ইত্তেফাক ও পূর্বদেশের মতো দৈনিক পত্রিকা ঘিরে আবর্তিত। এরই মধ্যে কাজ করেন একাধিক সাপ্তাহিক, কচিৎ মাসিক পত্রিকায়। লন্ডনের প্রবাস জীবনেও তিনি একাধিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন; কখনও সম্পাদনায়, কখনও প্রকাশন-সম্পাদনায় এবং সে জীবন দেশের অনেক দৈনিক পত্রিকায় কলাম রচনায় সমর্পিত। তাতেও মাঝেমধ্যে বিতর্কের ঢেউ উঠতে দেখা গেছে। কিন্তু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জীবন একজন সাংবাদিক প্রবরের অনন্য জীবন এবং তাতেই তাঁর সব তৃপ্তি। আর এ কারণেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সৃষ্টিশীলতা সাংবাদিকতার জন্য অনেকটা আড়ালে চলে যায়। সেই পঞ্চাশের দশকে ‘কথাশিল্প :জীবন প্রত্যয় ও সাফল্য!

১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স পাস করে ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’ এর দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’য় কাজ করেন গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৭৪ সালে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান তিনি। এরপর সেখানেই স্থায়ী হন। লন্ডন থেকে দেশের সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লেখেন! আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের রচয়িতা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর মেধা-কর্ম ও লেখনীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন ও বাঙালির অসা¤প্রদায়িক মননকে ধারণ করে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে,জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। সেখানে তাঁর ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা এবং পর্যায়ক্রমে শিক্ষাজীবন শেষ করে জীবনের স্তরে স্তরে তাঁর সৃজনশীলতা-সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখে তিনি হয়ে যান ইতিহাসসংলগ্ন। ছাত্রজীবন থেকে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষিত ছিলেন বরিশালের এই কৃতী সন্তান। কবিতা ও গল্প লেখার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূচনা। পরে এ সৃষ্টিশীলতার বিস্তার ঘটে একাধিক উপন্যাস রচনায়। কিন্তু সাংবাদিকতায় ব্যস্ত কর্মজীবন তাঁর সাহিত্য সাধনার পথ সংকুচিত করে ফেলে।

২২ ফেব্রæয়ারি নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজা হয়েছিল এবং মওলানা ভাসানী সেই জানাজায় ইমামতি করেন। জানাজা শেষ হওয়ার পর গণমিছিল শুরু হয়, যে মিছিলে আবদুল গাফফার চৌধুরী পুলিশের লাঠিচার্জে আহত ও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তার বন্ধুরা তাকে প্রথমে কার্জন হলে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে গেন্ডারিয়ার একটি বাসায় নিয়ে যান। আহত অবস্থায় সেই বাসাতেই তিনি এই কবিতা লিখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।

এরপর গেন্ডারিয়ায় গোপন এক সভায় এক ইশতেহার প্রকাশ করা হয় এবং সেই ইশতেহারেই প্রথম এই গান ছাপানো হয়। প্রথমে আবদুল লতিফ কবিতাটির সুরারোপ করেন এবং ১৯৫৩ সালে গুলিস্তানের ব্রিটেনিয়া হলে ঢাকা কলেজের নবনির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে আব্দুল লতিফ ও আতিকুল ইসলাম প্রথম গানটি পরিবেশন করেন। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময় গানটি গাওয়ার অপরাধে তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অনুরোধে শহীদ শেখ সোহরাওয়ার্দী বহিষ্কারের জন্য তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানালে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হয়। গানটি গাওয়ার অপরাধে সে বছর আবদুল লতিফ এর বাসাতেও গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ আসে।

ভাষা আন্দোলনের সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। রাজপথে ভাষার দাবিতে মিছিলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে হতাহত হলে তাদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ঢাকা মেডিকেলের গেটের সামনে তিনি একটি রক্তমাখা লাশ দেখতে পান। লাশটির মাথার খুলি বুলেটের আঘাতে উড়ে গিয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে গাফ্ফার চৌধুরী জানিয়েছেন, এ লাশটি ছিল ভাষাশহিদ রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তার কাছে মনে হয়, এটা যেন তার নিজেরই ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে ওঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। গানটি প্রথম প্রকাশ হয় একটি লিফলেটে। সেখানে ‘একুশের গান’ শিরোনামে কবিতা আকারে ছাপা হয়েছিল এটি। ১৯৫৩ সালে ‘একুশে সংকলনে’ও এটি স্থান পায়। প্রথমে আবদুল লতিফ গানটিতে সুর করেন। পরে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই বেশি জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে প্রথম গাওয়া হয় আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি। এ সুরটিই এখন প্রচলিত।

পূর্ব পাকিস্তানে যখন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন জহির রায়হান ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলনভিত্তিক একটি সিনেমা বানান, নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। এ সিনেমায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা একুশের গানটি সংযোজন করা হয়। এই সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

আরেকটি সাক্ষাৎকারে এ গান প্রসঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফরাসি দার্শনিক আঁন্দ্রে মারলো ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির সুর শুনে মুগ্ধ হন এবং তার একটি রেকর্ড সঙ্গে নিতে চান। বঙ্গবন্ধু সেকথা শুনে গাফ্ফার চৌধুরীকে বললেন, ‘গাফফার, দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়ে এরকম একটি গান লেখো না কেন?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি সাতই মার্চের ভাষণের মতো দেশবাসীর সামনে আরেকটি ভাষণ দেন না কেন?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দূর পাগল, তা কি সম্ভব?’ তিনিও বিনীতভাবে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আমার পক্ষেও কি আরেকটি একুশের গান লেখা আর সম্ভব?’

পরবর্তীতে সেসময়কার খ্যাতিমান সুরকার আলতাফ মাহমুদ গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব জেলা, সব শহর থেকে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গান ইংরেজি, হিন্দি, মালয়, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়!

একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৪ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করলেও মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও অসা¤প্রদায়িক চেতনার পক্ষে তার কলম সোচ্চার ছিল বরাবর। ভালোবাসতেন দেশ, মাটি ও মানুষকে। এজন্য লন্ডনে বসেও তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তার লেখায় বারবার সে কথাই উঠে এসেছে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ একুশের এই কালজয়ী গানের জন্যই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে। গানটি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারিতে গানটি রচনা করেন। এতে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ফুটে উঠেছে। ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতা!

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আজ মারা গেছেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা। অনেক কবিতাও লিখেছেন তিনি। এই পাঁচটি কবিতা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১ সালের ২৪ আগস্ট। কবিতা পাঁচটি আজ আবার প্রকাশ করা হলো।
প্রথম আলো ডেস্ক প্রকাশ: ১৯ মে ২০২২,

এক.
নদী বলে সমুদ্রকে দ্যাখো সূর্য কতোই প্রখর
তোমার ঢেউ তো তাকে চূর্ণ করে, দেয় না পূর্ণতা আমার
ঊর্মি হলো চাঁদ আর নক্ষত্রের মিতা
আমার বুকেতে নেই দিবারাত্রি কোনোই শূন্যতা।
সমুদ্র দত্তের সুরে বলে, শোনো নদী
নদী আর নারী হলো সাগর-দুহিতা
তুমি তো কান্নার জল আমি কোলাহল
আমি যদি হল হই তুমি হলে সীতা।
সূর্য গেল অস্তাচলে চাঁদ নির্বাসিত
বেহুলা বাতাস কাঁদে সাগরের বুকে
ঝড়ে ভেসে গেছে বুঝি তার লখিন্দর
কালের ভেলায় তার ঘুম চির সুখে।
শতভিষা আকাশের ছোট তারা আজ
একদিন বড় হবে নক্ষত্রের মতো
এখনই কিশোর প্রজ্ঞা অরুণ আভায়
সাগরে জোনাকি হয়ে জ্বলে অবিরত।

দুই.
দুঃসময়ের মিত্র ভেবে যার দিকে এই হাত বাড়ালাম
বধির চিত্ত, তার কাছে যেই এই হৃদয়ের ভার নামালাম
চাঁদের পিঠে সওয়ার দেখি মিত্র সে নয়, কালাপাহাড়
বন্ধ করে একে একে ভালোবাসার সকল প্রাকার।
ভস্মাবশেষ পার হয়ে যেই শ্যামল ক্ষেতে নেমেছিলাম
নষ্ট তারার নগ্ন আলোয় যে বীজ আমি পুঁতেছিলাম
শস্য হয়ে জন্ম নিলো সবুজ পাতায় সে স্বৈরিণী
ভালোবাসার পণ্য লয়ে করলো কেবল বিকিকিনি।

তিন.
একটি কথা মনে রেখো ভুলতে গেলে কষ্ট পাবে
এই আকাশের যতো তারা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে
তবু জোনাক জ্বালবে আলো
ছোট্ট হৃদয় বাসবে ভালো
নদীর জলে করবে খেলা নোঙর করা নায়ের বাতি
জলসা ঘরে শেষের গানের সুর ছড়াবে মত্ত হাতি।

চার.
‘তোমাকে চাই তোমাকে চাই, তোমাকে চাই’
রাতের রুপালি জোছনায় আমি তোমাকে চাই
ভোরের পাখির গানের মতন তোমাকে চাই
বিকেলের রোদ গাছের আড়ালে লুকানোর মতো তোমাকে চাই
সন্ধ্যায় লাল মেঘের রঙের লালিমা মাথা যে তোমাকে চাই
তোমার চুলের অতল কালোতে ডুবতে চাই
তোমার শরীরে ভরা বর্ষার দুরন্ত স্রোতে ভাসতে চাই
তোমার বুকের উপত্যকায় শিউলি ঝরার গন্ধ চাই
তোমাকে চাই তোমাকে চাই তোমাকে চাই।

পাঁচ.
(জ্যোতির বয়স বাড়ে না তো প্রকাশ বাড়ে এবং তা তো *পূরবীরই অলৌকিক সে সুরের ভারে-)
–অতঃপর ঈশ্বর দিলেন দেখা
বাজজীবী কালের সে রেখা
দিব্যজ্যোতি হয়ে গেলো
আকাশের নক্ষত্র হারালো
নীলিমার গ্রহকুঞ্জ
ভেসে যাওয়া মেঘপুঞ্জ
অতলান্ত সময়ের নদী
পাড়ি দিয়ে নিরবধি
*পূরবীর মগ্ন তান মনে
সত্যের বোধিরা গেল বনে
নিয়ে এলো জন্মদিন
জ্যোতির্ময় অমলিন।
ঈশ্বর নিজেই সেই নির্মাণের ভার
দিলেন শিল্পের মতো কার-
যুগ্ম হাতে তুলে তার অধীর উচ্ছ¡াস
দিলেন জ্যোতিকে তার নিজের প্রকাশ।
দিলেন সৃষ্টির মন্ত্র মৃত্যুমন্ত্র নয়
জ্যোতি তাই আজো জ্যোতির্ময়!

লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, কানাডা, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা, প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, থাইল্যান্ডের ব্যঙ্কস্থ বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব সঙ্ঘ পত্রিকারসহ সম্পাদক, এবং জাতিসংঘে সাবেক বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!

Exit mobile version