ভজন সরকার : (ক)
রাজা মন্ত্রীসভা থেকে পালিয়ে এসেছেন কবির কাছে। কবি বলছেন, রাজা মাঝে-মাঝে সরে দাঁড়ালে প্রজারা রাজত্ব করবার অবকাশ পায়।
রাজকোষ শূন্য। কবি বলেন, রাজার অর্থ যখন শূন্যে এসে ঠেকে প্রজা তখন নিজের অর্থ খুঁজে বের করে, তাতেই তার রক্ষা।
তবুও রাজা শান্ত হতে পারেন না। প্রজাদের দুর্ভিক্ষের কথার চেয়ে রাজা নিজেকে রক্ষার কথা ভেবেই বেশি চিন্তিত। কবি রাজাকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমাদের সাথে ঋতুরাজ বসন্ত আছেন; উনি ক্ষুধার কথা সুধা দিয়ে ভোলান।
ঋতুরাজ বসন্তের আগমনীতে আকাশ ডাকছে নিজেকে পূর্ণ করে বিলিয়ে দিতে। অথচ রাজা ভাবতেই পারেন না যে, নিজেকে শূন্য করে দেওয়া দানে অন্যকে ভরিয়ে দেয়- অন্যকে পূর্ণ করে। কবি রাজাকে বলেন, যে-দান সত্য তার দ্বারা বাইরের ধন বিনাশ পায়, অন্তরের ধন বিকাশ পেতে থাকে।
কবি রাজাকে বনভূমিতে আম্রকুঞ্জের গান শোনান,
“ফল ফলাবার আশা আমি মনেই রাখি নি রে।
আজ আমি তাই মুকুল ঝরাই দক্ষিণসমীরে”।
রাজা ভাবেন এ উপদেশ বাণী। মনের আনন্দে ‘ফল চাই নে’ বলতে পারলে, ফল আপনি ফলে ওঠে। আম্রকুঞ্জ মুকুল ঝরাতে ভরসা পায় বলেই তার ফল ধরে।
বসন্তরাজের আগমনে চারিদিকে উৎসব। করবী গাইছে,
“যদি তারে নাই চিনিগো
সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে”
দখিনহাওয়ায় উদ্বেলিত বেনুবন গাইছে,
“দখিনহাওয়া, জাগো জাগো
জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।”
ঘরের নিভৃতে দীপশিখাটি শঙ্কিত দখিনহাওয়ার আগমনে যদি সব নিভে যায় সে আশঙ্কায়!
“ধীরে ধীরে ধীরে বও
ওগো উতল হাওয়া”।
অর্থাৎ বসন্তের আগমনে প্রকৃতি উতলা। ডাল-পালা সহসা উতলা হয়ে উঠেছে, রঙে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে ফুলদল, প্রকৃতির পায়ের নূপুর বেজে চলেছে চারিদিকে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র উদিত হয়েছে। শালবনবিথীকা গাইছে,
“ও আমার চাঁদের আলো,
আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে
ধরা দিয়েছ যে আমার
পাতায় পাতায় ডালে ডালে”।
এভাবেই বসন্তরাজ এসেছে ধরণীতে। রাজা চাইছেন মানুষ দুর্ভিক্ষের কথা ভুলে ঋতুরাজ বসন্তের উৎসবে মোহিত হয়ে থাকুক। কবি বলেন, এবার ঋতুরাজ বসন্তের যাবার সময় হয়েছে।
রাজা আবার শঙ্কিত। কবি আবার বলেন, যথার্থ পূর্ণ হয়ে উঠলে রিক্ত হওয়ার খেলায় ভয় থাকে না। এদিকে রাজা দেখছেন, আভিজাত্য ভুলে রাজপরিষদ বসন্ত উৎসবে মাতোয়ারা। কবি বলছেন, আজ ধরণীতে অগৌরবের উৎসব। রাজা ভাবছেন, রাজগৌরব কি বিলীন হতে চলেছে? কবি বলেন, রাজগৌরব, সেও আজ টিঁকল না। তাই তো ঋতুরাজ আজ রাজবেশ খসিয়ে দিয়ে বৈরাগী হয়ে বেরিয়ে চলেছেন। এবার ধরণীতে তপস্যার দিন এসেছে; এসেছে নিজেকে শূন্য করে অন্যকে পূর্ণ করে বিলিয়ে দেওয়ার সময়।
বসন্তের আগমন, রঙ ও নতুনের আবহে প্রকৃতির উন্মাদনা এবং সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে- সবাইকে ভরিয়ে দিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে দেওয়ার আনন্দ নিয়ে বসন্তের বিদায় –মোটামুটিভাবে এটুকুই “বসন্ত” গীতিনাট্যের মূলকথা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গীতিনাট্যের কবি ও রাজার কথোপকথের মাধ্যমে কিছু উপদেশ বাণী দিয়েছেন- যা উল্লেখ করেছি; সেটুকু বাদ দিলে অনেকগুলো প্রকৃতি পর্যায়ের গান আছে-যেখানে বর্ণনা আছে প্রকৃতির, আছে নবজাগরণের উন্মাদনার আর্তি, আছে বিষাদের-বিদায়ের সুরও।
(খ)
এতো গেল ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যের কথা। এবার এ গীতিনাট্যটিকে নিয়ে আরও কিছু পেছনের ও সামনের কথা আছে- সেগুলোর দিকে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করা যাক।
একথা সবাই জানেন যে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন আলীপুর জেলে অবরুদ্ধ তখন রবীন্দ্রনাথ এ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুল ইসলামকে “কবি” বলে সম্বোধন করলেন। ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যের উৎসর্গে লিখলেন, “শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু”।
এর পরে কাজী নজরুল ইসলামকে স্থানান্তর করা হয় হুগলি জেলে। সেখানে কাজী নজরুল অনশন শুরু করেন। কাজী নজরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি শুরু হয়। এ প্রসংগে বিশিষ্ট নজরুলবিশেষজ্ঞ ডঃ করুণাময় গোস্বামী লিখেছেন,
“১৯২৩ সাল। নজরুল তখন হুগলি জেলে অনশনরত। রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতার বাইরে শিলংয়ে। সেখানে থেকে তিনি নজরুলকে টেলিগ্রাম পাঠালেন, তিনি যেন অনশন ত্যাগ করেন, এ বাংলা সাহিত্যের দাবি। তিনি লিখেছিলেন, গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক। আওয়ার লিটরেচার ক্লেইমস ইউ। এ বড় কম ভালোবাসা নয়। নোবেলজয়ী বিশ্ববিখ্যাত ষাটোর্ধ্ব কবি সাহিত্যে মাত্র প্রবেশ করা তরুণকে, এ আমাদের সাহিত্যের দাবি, তুমি আত্মহননের পথে যেও না বলে অনুরোধ জানিয়ে তারবার্তা পাঠালেন। প্রাপককে পাওয়া যায়নি, এই অজুহাতে টেলিগ্রামটি নজরুলকে পৌঁছে দেওয়া হয়নি। রবীন্দ্রনাথের কাছে সেটি ফিরে আসে।
পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমি নজরুলকে প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম। জেল থেকে সেটি ফেরত এসেছে, বলা হচ্ছে প্রাপককে পাওয়া যায়নি। বোঝা যাচ্ছে, আমার বার্তা ওরা তাকে পৌঁছাতে চায় না। নজরুল প্রেসিডেন্সি জেলে না থাকলে ওরা তো জানে সে এখন কোথায় আছে। অর্থাৎ এরা তাকে আত্মহননের পথ থেকে ফেরাতে চায় না।’ রবীন্দ্রনাথ যে নজরুলের জীবন রক্ষার জন্য কতটা উদ্বিগ্ন, রথীন্দ্রনাথকে লেখা এ চিঠি থেকে তা আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।”
এ তারবার্তার অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ প্রসংগেও ডঃ করুণাময় গোস্বামী বলেছেন,
“জেলে অনশন শুরু করার আগেই আলিপুর কারাগারে অবরুদ্ধ নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিনাট্য বসন্ত উৎসর্গ করেন। জাতির জীবনে নজরুল বসন্ত এনেছেন বলে রবীন্দ্রনাথের ধারণা, সে জন্য তরুণ কবিকে অভিনন্দিত করতে তিনি গীতিনাট্য বসন্ত উৎসর্গ করেন। এ বসন্ত কোকিলের পাখায় ভর করে দক্ষিণের মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা পুষ্পগন্ধে আমোদিত বসন্ত নয়। এ বসন্ত বিদ্রোহের, এ বসন্ত ইংরেজ শাসনকে না বলার, এ বসন্ত না বলার জন্য নিগ্রহ স্বীকার করার, এ বসন্ত দেশের মানুষকে মাথা উঁচু করে বীরের মতো দাঁড়ানোর আহŸান জানানোর ঋতু। নজরুল বসন্তের অনুষঙ্গটিই পাল্টে দিলেন”।
ডঃ করুণাময় গোস্বামীর মতো অনেকের মতই এ রকম যে, রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুল ইসলামের তারুণ্যকে স্মরণ করেই লিখিত। কিন্তু একটি প্রশ্ন এখানে করা যেতেই পারে , ‘বসন্ত’ নাটকটি রবিঠাকুর কাজী নজরুলের কথা মনে রেখেই কি রচনা করেছিলেন? কিংবা গীতিনাট্যটি রচনা করার পর কাজী নজরুলের ইংরেজবিরোধী অবস্থানকে সমর্থন করে দেশবাসীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতেই কি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন?
এখানে অনেকে বলে থাকেন, ‘বসন্ত’ নাটকের চরিত্র “কবি” কি কাজী নজরুল ইসলাম? “রাজা” কি ইংরেজ শাসক?
এ প্রসংগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্নেহধন্য সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছিলেন,
‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও।’
এ নিয়ে আরও কিছু তথ্য পবিত্র বাবু বলেছেন,
“নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।…নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে। আমি যদি তরুণ হতাম তা হলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো।’
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যের ‘বসন্ত’ প্রকৃতির ঋতুরাজ বসন্ত। এ বসন্ত বন্দনার অনুসংগের সাথে কাজী নজরুল নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন দেশাত্মবোধক দ্যোতনায়। প্রকৃতির বসন্ত প্রতীকি অর্থে কাজী নজরুলের জীবনে অন্য অর্থ বহে নিয়ে এসেছিল, যাকে ডঃ করুণাময় গোস্বামী বলেছেন,
“এ বসন্ত কোকিলের পাখায় ভর করে দক্ষিণের মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা পুষ্পগন্ধে আমোদিত বসন্ত নয়। এ বসন্ত বিদ্রোহের, এ বসন্ত ইংরেজ শাসনকে না বলার, এ বসন্ত না বলার জন্য নিগ্রহ স্বীকার করার, এ বসন্ত দেশের মানুষকে মাথা উঁচু করে বীরের মতো দাঁড়ানোর আহ্বান জানানোর ঋতু।”
যদিও কাজী নজরুল ইসলামের এ উৎসর্গ পর্বটুকু না-জানা থাকলে রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি একটি নিটোল প্রকৃতি- বন্দনা বৈ অন্য কিছু নয়; যেখানে কেবল শান্তির খোঁজে পালিয়ে আসা যায় কবির কাছে অর্থাৎ সৃষ্টির সান্নিধ্যে, যেখানে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে ঋতুরাজ বসন্ত।
কৃতজ্ঞতা : গবেষক, সংগীতবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডঃ করুণাময় গোস্বামী
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)