বিনোদন ডেস্ক : বলিউড তারকাদের মধ্যে বেড়েছে অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা। এই প্রবণতায় জড়িয়েছেন অভিনেতা ডোয়েন জনসন, লেডি গাগা, বিয়ান্স, অ্যাডেল-এর মতো গায়িকারা। এমনকি হ্যানামন্টানা খ্যাত মাইলি সাইরাস, এ আর রহমান, অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোন, ম্রুণাল ঠাকুর, আমিত সাধ, অমিতাভ বচ্চন ও শাহরুখ খানের মতো একাধিক বিখ্যাত বলিউড তারকা অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতায় জড়িয়েছেন।
সম্প্রতি আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আধ্যাত্মিকতা আর জীবন নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অস্কারজয়ী সংগীতকার এ আর রহমান। অনুষ্ঠানে তার ছেলেবেলায় সম্মুখীন হওয়া লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, একসময় নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে এ আর রহমান জানিয়েছেন, মায়ের বলা কয়েকটা কথা নিজেকে শেষ করে দেয়ার চিন্তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে শক্তি জুগিয়েছিল তাকে। দিয়েছিল বেঁচে থাকার রসদ।
শুধু এ আর রহমান একা নন, এই মানসিক অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে কথা বলতে শোনা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তরে থাকা তারকাদের। বাবাকে অল্প বয়সে হারানোর পর এ আর রহমান এবং তার পরিবারকে আর্থিক সমস্যাসহ একাধিক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
ছোটবেলা থেকে চলে আসা নিজের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে এ আর রহমান বলেন, যে সময়ে আমার আত্মহত্যার কথা মনে হতো, সেসময় আমার বয়স কম। তখন মা বলতেন, যদি তুমি অন্যের জন্য বাঁচো, তাহলে এসব চিন্তা আর মাথায় আসবে না। এটা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আমার জীবনের সেরা উপদেশ।
ওই অনুষ্ঠানে অক্সফোর্ড শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে এ আর রহমানকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে যাই। সবাই এই পৃথিবীতে ছোট সফরে এসেছি। এটাই একটা ধ্রুব সত্য। আমরা জন্মেছি, আবার চলেও যাব। এটা আমাদের স্থায়ী জায়গা নয়।
বছরখানেক আগে মানসিক অবসাদ নিয়ে প্রথমবার কথা বলেছিলেন বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানসিক অবসাদ শুরু হয়েছিল। একদিন সকালে উঠে পেটে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। এমন একটা অনুভূতি যা আগে কখনও হয়নি। এরপর বেশ কয়েকদিন ভেতরটা শূন্য মনে হচ্ছিল, দিশাহীন, কোনও লক্ষ্য নেই।
দীপিকা বলেন, যেন সবকিছুই অর্থহীন। শারীরিক বা মানসিকভাবে কিছুই যেন অনুভব করতে পারছিলাম না। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। যার এই অনুভূতি হয়নি তাকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলাটা কঠিন। ওই অভিনেত্রীর মা প্রথমে বিষয়টা লক্ষ্য করেন।
অভিনেত্রী বলেন, মা সবার আগে বুঝতে পারেন এই কান্নাটা অন্যরকম। এটা কিন্তু কাজ বা প্রেমিক সংক্রান্ত বিষয় নয়। তিনি ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করতে থাকেন আমাকে। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারিনি। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়ার কথা বলেন মা। আমার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও ছিল। এক এক সময় আত্মহত্যার কথাও মাথায় আসতো।
একসময় মানসিক অবসাদে পড়েছিলেন অভিনেতা অমিতাভ। তার সংস্থা এবিসিএল-এর ভরাডুবির পর আর্থিকভাবে তার ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেসময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তবে হাল ছেড়ে দেননি। আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।
এছাড়া বলিউডের বাদশাহ হিসেবে পরিচিত শাহরুখও হতাশার সম্মুখীন হন। কাঁধে চোট লাগার পর আগের মতো পারফর্মেন্স করতে পারবেন কি না এই আশঙ্কা তাকে গ্রাস করেছিল। তিনিও অবসাদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক বল জুটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ান তিনি।
তবে সবার ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। আত্মহত্যার কারণে একাধিক প্রতিভাময় তারকাকে হারিয়েছে বলিউড। অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর বলিউডের অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু কেন এই অবসাদ, কেনই বা তারকাদের মধ্যে দেখা যায় আত্মহত্যার প্রবণতা?
বলিউড বা বিনোদন জগতের তারকাদের অবসাদ বা অন্যান্য মানসিক রোগের সঙ্গে লড়াই নতুন বিষয় নয়। পারভীন ববির মতো অনেকেই এর সঙ্গে লড়াই করেছেন। এ বিষয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট এবং কলকাতা ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. শর্মিলা সরকার বলেন, প্রত্যেকটা জীবিকাতেই একটা লড়াই থাকে। তারকাদের ক্ষেত্রে এটা হয়তো একটু বেশি। অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক বা বিনোদন দুনিয়ায় যারা আছেন, তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। চড়াই-উতরাই অনেকটা বেশি থাকায় বিনোদন জগতে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশনের সমস্যাও বেশি দেখা যায়।
তার মতে, অনেকেই অনেক স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজনই বা খ্যাতি পান। বাকিরা সাফল্য পান না বা লাইমলাইটে পৌঁছানোর আগেই ফিরে আসতে হয়। নতুন মুখ এলে পুরোনোদের জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে- এমন উদাহরণও বিস্তর রয়েছে। এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না।
এ ব্যাপারে আরজি কর হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. রাজর্ষি নিয়োগী বলেন, যদি ধরে নিই জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের মানসিক অবসাদ রয়েছে, তাহলে ১০০ জন তারকার মধ্যে পাঁচজনের ডিপ্রেশন থাকবে। কিন্তু তাদের বিষয়টা আরও কঠিন।
বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ডিপ্রেশনের ডিটারমিনেন্টের মধ্যে (যে যে কারণে অবসাদ হতে পারে) সোশ্যাল ডিটারমিনেন্ট (সামাজিক মাপকাঠি), তাদের জীবনশৈলী, লড়াই, প্রতিযোগীসুলভ মনোভাব ইত্যাদি রয়েছে।
ড. রাজর্ষি বলেন, প্রতিনিয়ত তারকাদের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। তারা চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেতে পারেন না বা মন খুলে আড্ডা দিতে পারেন না। এই ভয়ে যে সাধারণ মানুষ কী বলবে, যদি গণমাধ্যমে তার ব্যক্তিগত জীবন ফাঁস হয়ে যায়। তারা মন খুলে বাঁচতেও পারেন না। এছাড়া মাদক সেবন বা অন্য নেশার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
তার মতে, তারকাদের অর্থ আছে। একই সঙ্গে মাদকও তারা সহজেই পেতে পারেন। এটা কিন্তু একটা বড় সমস্যা। দু’একজন উঠতি গায়ক- গায়িকাদের মুখে শুনেছি মাদক সেবন না করলে নাকি গানই করা যায় না! মানসিক সমস্যাকে যা আরও জটিল করে তোলে। হয়তো ভাবেন মাদক সেবন করলে ভালো লাগবে, পরে সেটা আর মজার বিষয় থাকে না। নেশার পর্যায় চলে যায়।
বিনোদন জগতে বিশেষত বলিউডে টিকে থাকার লড়াইটা সহজ নয়। বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন একই কথা। ড. শর্মিলা সরকার বলেন, কর্মজীবনে শুরুর দিকে লড়াইটা হয়তো বেশি থাকে। কিন্তু কষ্ট করে শক্ত মাটি তৈরি করার পর যদি তাকে ফিরে আসতে হয়; তাহলে সেটা মেনে নেয়া বেশ কঠিন। তখন মনের মধ্যে ঝড় চলতে থাকে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের তার প্রতি উচ্চাশা থাকে।
তিনি বলেন, এই অবস্থায় ফিরে আসাটা খুব মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তারা মনে করেছে, এত কষ্ট করে এসেছি, কী মুখে ফিরব। এর থেকে নিজেকে শেষ করে দেয়া বোধ হয় সহজ। শুধু মানসিক অবসাদ নয়, ইম্পালসিভ হয়েও অনেকে এই চরমতম পদক্ষেপ নিয়েছেন এমনটাও আমরা দেখেছি। এই জগতে থাকতে গেলে ধৈর্য ধরাটা খুব দরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তারকাদের অনেকেই সাহায্য চাইতে দ্বিধা বোধ করেন। ড. নিয়োগী বলেন, আমি দেখেছি, মুম্বাইয়ের তারকারা বাড়িতে বসে মনোবিদদের সঙ্গে কথা বলতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্টের বা সাইকোলজিস্টের অফিসে কাউন্সেলিং সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু তারকারা চাইছেন বাড়িতে বসে কথা বলতে, যাতে পাঁচকান না হয়। সাইকোলোজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট চুপিচুপি বাড়িতে যাচ্ছেন কাউন্সেলিং করতে। গোপনীয়তার কথা ভেবে কেউ কেউ অবশ্য টেলিফোন মারফত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী।
তবে মাধ্যম যাহোক, অবসাদের ক্ষেত্রে কথা বলাটা, বিশেষজ্ঞের সাহায্য চাওয়াটা প্রয়োজন সে বিষয়ে জোর দিয়েছেন তিনি। একই কথা বলেছেন ড. সরকার। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সৌভিক মণ্ডল এ বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, অনেক সেলেব্রেটিরাই সমাজমাধ্যমে বা সংবাদমাধ্যমের কাছে এই বিষয়ে কথা বলছেন, এটা প্রমাণ করে তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার বিষয়ে ট্যাবুটা একটু হলেও কমেছে। যেমন- দীপিকা খুব সাবলীলভাবেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন। মানসিক অবসাদ বা আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সামাজিক অবস্থানের কথাও বলেছেন অধ্যাপক মণ্ডল।
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, হয়তো এটার মধ্যে একটা ক্লাস ডায়নামিক্স আছে। একইসঙ্গে তিনি লিঙ্গ-ভিত্তিক দিকের কথারও উল্লেখ করেন। একজন নারীর পক্ষে তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা একজন পুরুষের চেয়ে কথা বলাটা কতটা সহজ বা কঠিন এটা দেখার বিষয়। সমাজে অন্য যে ধরনের স্টিরিওটাইপ বা ট্যাবু আছে, এক্ষেত্রেও কিন্তু সেটা প্রযোজ্য।
মনোবিদদের পাশাপাশি বাবা-মা, পরিবার, পরিচিতদের সান্নিধ্য ও সাহায্যের হাত যে মানসিক অবসাদের সঙ্গে লড়াইকে কিছুটা হলেও সহজ করে দেয়; সেই বিষয়ে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ আর রহমান বা দীপিকা নিজেদের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়েও একই কথা বলেছেন।
এই বিষয়ে ড সরকার বলেন, বাবা-মায়ের ভূমিকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেখাপড়ার ছাড়াও জীবনে কেউ যদি অন্য পথ বেছে নিয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাহলেও বাবা-মায়ের উচিত পাশে থাকা। তারা যদি সন্তানকে এটুকু বুঝিয়ে বলতে পারেন, যাই হোক আমরা পাশে আছি, তাহলেই সমস্যা অনেকটা কমিয়ে যায়।