ফারহানা আজিম শিউলী: টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪৪তম ভার্চুয়াল আসরটি ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। সদ্য প্রয়াত বাংলা ভাষার অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরী স্মরণে এই আসরে, আসাদ চৌধুরীর কাব্য ও অন্যান্য রচনা নিয়ে আলোচনা করেন প্রাবন্ধিক-অনুবাদক আবেদীন কাদের, প্রাবন্ধিক-অনুবাদক-শিশু সাহিত্যিক আহমাদ মাযহার ও গালিব গবেষক-অনুবাদক জাভেদ হুসেন। সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী। এই আসরটি পাঠশালার ষষ্ঠ বর্ষপূর্তির আসরও ছিল একইসঙ্গে।
আসাদ চৌধুরী গত শতকের ষাটের দশকের বাংলা ভাষার অন্যতম কবি। সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম কবি। বাংলাদেশের কবিতায় “তবক দেওয়া পান” নিয়ে তাঁর আবির্ভাব। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন শিশু-কিশোর সাহিত্য, গদ্য, প্রবন্ধ, অনুবাদ কবিতা। মনোগ্রাহী টেলিভিশন উপস্থাপনা ও চমৎকার আবৃত্তির জন্যও জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও জীবন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পাঠশালার এই আসরে স্মরণ করা হয় পাঠশালার একান্ত সুহৃদ, মিষ্টভাষী-সজ্জন সদ্য প্রয়াত কবি আসাদ চৌধুরীকে।
আলোচক আবেদীন কাদের, আহমাদ মাযহার, জাভেদ হুসেন ও সঞ্চালক ফারহানা আজিম শিউলীর মধ্যে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক আলাপচারিতার মাধ্যমে কবি আসাদ চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম নিয়ে কয়েকটি ভাগে আলোচনা হয়।
আসাদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়া গ্রামে। বাবা আরিফ চৌধুরী। মা সৈয়দা মাহমুদা বেগম। স্ত্রী সাহানা চৌধুরী। দুই পুত্র আসিফ চৌধুরী, জারিফ চৌধুরী ও কন্যা নুসরাত জাহান চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর আসাদ চৌধুরী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ এই তিন বছর ভয়েস অফ জার্মানির বাংলা বিভাগে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন (বাংলা একাডেমি থেকে লিয়েনে)। ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘ ২৬ বছর চাকরির পর এর পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য আসাদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক।
পাঠশালার আসাদ চৌধুরী স্মরণ আসরের শুরুতেই পাঠশালার সঙ্গে কবি আসাদ চৌধুরীর পথচলা একটি ভিডিওক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়। পাঠশালার ২০১৭ ও ২০২২ সালের দুটি আসরের আলোচক ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। এছাড়াও পাঠশালা এর যাত্রাপথের শুরু থেকেই আসাদ চৌধুরীর প্রীতিময় সহযোগিতা পেয়ে এসেছে।
২০১৭ সালের আসরে স্বরচিত রচনা পাঠ ও আলোচনায় ছিলেন বাংলাদেশের কবি আসাদ চৌধুরী ও কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত কবি রিচার্ড গ্রীন। আর ২০২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আসরে রবীন্দ্রনাথের “মুসলমানীর গল্প” ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক রচনা নিয়ে আলোচনা করেন আসাদ চৌধুরী। ৩৬ পাতা জুড়ে দীর্ঘ এই আসরের আলাপচারিতা ছাপা হয় এ বছরের বইমেলায় ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত “আসাদ চৌধুরী কহেন” বইতে। বইটি আসাদ চৌধুরীর নির্বাচিত সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতা নিয়ে।
আসাদ চৌধুরীর লেখা সবশেষ কবিতা “সুরায় ভরা বসুন্ধরা”র সঙ্গেও জড়িয়ে আছে পাঠশালার স্মৃতি। উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে এ বছরের সেপ্টেম্বরে টরন্টোতে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী পঞ্চম বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশের স্থানীয় আয়োজক ছিল পাঠশালা এবং সমাবেশ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক-সাহিত্য সংকলন “হৃদবাংলা’য় প্রকাশিত হয় আসাদ চৌধুরীর এই কবিতা। কবিতার জন্য কবির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এই কবিতাটি দেন। কবির পুত্র আসিফ কবির নিজ হাতে খাতায় লেখা কবিতাটির ইমেজ পাঠান। তখন কবি বেশ খানিকটা অসুস্থ। হাসপাতালেই প্রুফ দেখিয়ে নিতে হয়। উল্লেখ্য, কবির হাতের লেখা রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার মতো। আসাদ চৌধুরীর শিক্ষক শহীদ মুনীর চৌধুরী বাজে লেখার জন্য তাঁকে বকেছিলেন। তখন তিনি রবীন্দ্র-হস্তাক্ষর অনুকরণ করে বারবার লিখে লিখে রবীন্দ্রনাথের মতো হাতের লেখা সার্থকভাবে রপ্ত করেন।
আসাদ চৌধুরীর কবিতার আলোচনায় যাবার আগে তাঁর কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদগুলো ভিডিওক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়। আসাদ চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ১) “তবক দেওয়া পান” – ডিসেম্বর ১৯৭৫ সালে অনন্যা থেকে প্রকাশিত। এর প্রচ্ছদশিল্পী মুক্তিযোদ্ধা আবুল বারাক আলভী। ৫২টি কবিতা আছে আবুল হাসান স্মৃতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই বইয়ে। ২) “বিত্ত নাই বেসাত নাই” – ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে আছে ৬৭টি কবিতা ৩) “প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়” – ৫৬টি কবিতা ঠাঁই পেয়েছে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত বইটিতে। ৪) “জলের মধ্যে লেখাজোখা” – ১৯৮২ সালে প্রকাশিত। আছে ৪৭টি কবিতা। ৫) “যে পারে পারুক” ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত। আছে ৬২টি কবিতা। ৬) “মধ্যমাঠ থেকে” বইয়ে আছে ২৯টি কবিতা। প্রকাশ সাল ১৯৮৪। ৭) “মেঘের জুলুম পাখির জুলুম” – ১৯৮৫তে প্রকাশিত এই গ্রন্থে আছে ৩৫টি কবিতা। ৮) “দুঃখীরা গল্প করে” – ১৯৮৭। ৪৬টি কবিতা আছে। ৯) “নদীও বিবস্ত্র হয়” ১৯৯২ সালের। আছে ৩৪টি কবিতা। ১০) “বৃষ্টির সংসারে আমি কেউ নই” ১৯৯৮ সালের। এতে আছে ৬৬টি কবিতা। ১১) “কিছু ফুল আমি নিভিয়ে দিয়েছি” ২০০৩ সালের। আছে ৪৯টি কবিতা। ১২) “ঘরে ফেরা সোজা নয়” – ২০০৬ সালে প্রকাশিত আলাওল সাহিত্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই বইয়ে আছে ৪৫টি কবিতা। ১৩) “বজ্রকণ্ঠ থেমে গেলে” – পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে আছে ৩৫টি কবিতা। ১৪) “নদীর ভাঙন আর পাখির ঠোঁটে খড়” ২০০৮ সালের। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত এই বইয়ে আছে ৫১টি কবিতা। ১৫) “যেতে যেতে মধ্যযুগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে” – সময় প্রকাশনী থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত বইটিতে রয়েছে ৩৭টি কবিতা। ১৬) “এই ফুলটির অন্তত দশ-দশটি প্রেমপত্র পাওয়ার কথা” – ২০১৪ সালে প্রকাশিত সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই বইয়ে আছে ২২টি কবিতা। ১৭) “বিকলাঙ্গ দীর্ঘশ্বাসগুলো” ২০১৬ সালের। এতে আছে ৩৯টি কবিতা। ১৮) “তৃণে-ছাওয়া আদিম ঠিকানা” ২০১৭ সালে প্রকাশিত। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত এই বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে ৪০টি কবিতা।
কবি আসাদ চৌধুরীর অনুবাদ-কবিতার বই: ১) “বাড়ির কাছে আরশিনগর: বাংলাদেশের উর্দু কবিতা” শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে ২০০০ সালে প্রকাশিত। ২) “ফিলিস্তিন ও প্রতিবেশী দেশের প্রতিবাদী আরবী কবিতা” – শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ইয়াসির আরাফাতকে। ৩) “জার্মান কবিতা।” সাহস পাবলিকেশন্স থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত। উৎসর্গ করা হয়েছে – ফ্রাউ ডোরিস গোয়েটিং আর ডয়েশ্চেভেলের বেতারকর্মী ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে। এ বইটিতে বিভিন্ন সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল জার্মান কবিদের কবিতা আছে। ৪) “হাইকু” ২০১৭ সালে প্রকাশিত।
কবির কবিতা-সংকলনের মধ্যে আছে: ১) ভালোবাসার কবিতা। ১৯৮৩। ২) আমার কবিতা। ১৯৮৫। বইয়ের পেছনের মলাটে কবির প্রতিকৃতি এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। এই বইটির একটি কবি নিজে বাঁধাই করে বাংলা একাডেমি লাইব্রেরিকে দিয়েছিলেন সম্ভবত। এতে নানা মানুষের লেখা শুভেচ্ছাবার্তা আছে। জার্মানির ডয়েশ্চে ভেলের সহকর্মীদের লেখাও আছে এতে। এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে। আমরা জানি আসাদ চৌধুরীর সামগ্রিক জীবনে তাঁর আত্মীয় গাফফার চৌধুরীর অসামান্য অবদানের কথা। ৩) টান ভালোবাসার কবিতা। ১৯৯৭। ৪) বাতাস যেমন পরিচিত। ১৯৯৮। ৫) প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা। ২০০৩। অনন্যা। উৎসর্গ করা হয়েছে ওয়াহিদুল হক ও দ্বিজেন শর্মাকে। ৬) কবিতাসমগ্র। ২০০৮। অনন্যা। ৭) কবিতা নির্বাচিতা। সেপ্টেম্বর ২০১৪। চন্দ্রদীপ প্রকাশনী। ৮) ও নদীরে। ২০১৫। ৯) “কবিতা সমগ্র” তিন খণ্ড ২০১৯ সালে অনিন্দ্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত। ৩ খণ্ডের ১ম খণ্ডটি জীবনানন্দ দাশ ও কাজী নজরুল ইসলামের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা জানিয়ে, ২য় খণ্ড আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে, ৩য় খণ্ড মুহম্মদ মুজাদ্দেদকে উৎসর্গ করা হয়েছে। ১০) সবুজ গম্বুজের নিচে। ২০১৯। ১১) নির্বাচিত ১০০ কবিতা। ১২) নির্বাচিত ৩০০ কবিতা। ২০২০। ১৩) শ্রেষ্ঠ কবিতা? ১৪) মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ১৫) Selected Poems of Asad Chowdhury। বাংলা একাডেমি। ২০০৭। কবির ১১৮টি কবিতা বিভিন্ন অনুবাদকের অনুবাদে।
“বাতাস যেমন পরিচিত,” “সবুজ গম্বুজের নিচে” এই নামগুলো দেখে মনে হয় না সংকলনের নাম। কিন্তু এ দুটোও সংকলন। এবং “বাতাস যেমন পরিচিত” কবিতাটি আছে “তবক দেওয়া পান”-এ, আর “সবুজ গম্বুজের নিচে” কবিতাটি আছে “বৃষ্টির সংসারে আমি কেউ নই”-এ।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কবি আসাদ চৌধুরীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে – কবিতার বই ১৮টি, অনুবাদ কবিতার বই ৪টি, ১৫টিরও বেশি কবিতা সংকলন – এর মধ্যে ১টি তাঁর নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদের সংকলন। মোট ৪০টির মতো কাব্যগ্রন্থ সব মিলিয়ে।
ফারহানা আজিম শিউলী: ষাটের দশক বাংলা কবিতার, বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ চৌধুরী সেই সময়ের, সেই ধারার অন্যতম প্রতিনিধি। বাংলা কবিতার ষাটীয় ধারা এবং আসাদ চৌধুরীর কবিতা – এই নিয়ে আবেদীন ভাই আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
আবেদীন কাদের: আসাদ চৌধুরী ষাটের কবি এইভাবে আমরা সাধারণত আলোচনা করে থাকি। গত চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর যাবতই দশকওয়ারি আলোচনা হয় সাহিত্যে। দশকওয়ারি সাহিত্যের আলোচনায় ভালো দিক যেমন আছে, আবার কিছুটা সমালোচনাও আছে। আমাদের ৫০, ৬০, ৭০, ৮০ এবং ৯০ এই দশকগুলোর মধ্যে ষাটের দশক সবচেয়ে উজ্জ্বল। উজ্জ্বলতম ষাটের কবি এবং গদ্যকাররাও। পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাষ্ট্র ও সমাজের চিন্তামানসে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে এবং এর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা ছিল লেখক-কবিদের চিন্তার ভেতরেও। ষাট সেটা থেকে প্রথম বেরিয়ে আসে। কেন বেরিয়ে আসে সেটা অনেকে লিখেছেন। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানীরা সেটা ভালো করে লিখতে পারেন বলে আমার ধারণা। লেখকরাও লিখেছেন। আমার মতে, ষাটের লেখকরা প্রথম আমাদের সমাজে পাকিস্তানের খোঁয়ারি থেকে বেরিয়ে আসেন। পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁদের আর কোনোরকম ভালোবাসা বা আবেগ কাজ করে না। কারণ, ততোদিনে, ৬২র ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে বিশেষ করে, আমাদের সমাজে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে পরিহার করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তখনও বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুরু হয়নি কিন্তু কবি-সাহিত্যিকরা পাকিস্তান আদর্শ থেকে বেরিয়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন। এটা এক নাম্বার কারণ। দ্বিতীয় আরেকটা কারণ আছে যেটা অনেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আমিও মনে করি। সেটা হলো – বোদলেয়ারের অনুবাদ। পঞ্চাশের শেষদিকে, ষাটের শুরুতে বিশেষ করে কবিদের ওপর বুদ্ধদেব বসুর করা বোদলেয়ারের অনুবাদ ভীষণ প্রভাব ফেলে। আধুনিক কবিতা কেমন হবে, আধুনিক কবির জীবন কেমন হবে এই বিষয়ে এই একটি বই যতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, সম্ভবতঃ আর কোনো বই এতটা প্রভাব বিস্তার করেনি। যদিও তিরিশের কবিদের মধ্যে যাঁরা বাংলা সাহিত্য করতেন তাঁদের ভেতরে অনেকেই তখনো পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে ষাটের একঝাঁক কবিকে অনেকেই বলেন তিরিশের আধুনিক কবিদের বর্ধিত সংস্করণ। সেটা বলার একমাত্র কারণ, এঁরা সবাই পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে গ্রহণ করেন।
ষাটের কবিতা কেন সমাজে সবচেয়ে উজ্জ্বল সেই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্নভাবে দেওয়া যায়। আমি দেখি সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে, সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে। সেটা হলো, সাহিত্যকে ধর্ম থেকে বের করে নিয়ে আসা বা কোনরকম কুপমুণ্ডুকতা থেকে বের করে নিয়ে আসা। কিন্তু এর একটা অসুবিধা আছে। এতে মৃত্তিকা সংলগ্নতা কমে যায়। আমরা যখন “আধুনিকতা” শব্দটিকে ব্যবহার করি, তখন আসলে আমরা পশ্চিম দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। পশ্চিমের কাছ থেকে কোনরকম তত্ত¡ ধার না-করেও মানুষ আধুনিক হতে পারে এটা বহুদিন পর্যন্ত আমাদের কবি লেখক বা সমাজবিজ্ঞানীরা গ্রহণই করতে চাননি। কিন্তু আমি মনে করি, একজন মানুষ খুব ভালো আধুনিক চিন্তার হতে পারেন পশ্চিমা যে কোনরকম জিনিস পরিহার করে। নিজেদের সমাজ থেকে উদ্ভূত চিন্তা দ্বারা শিক্ষিত হয়েই পারেন। কিন্তু আরেকটি দিক আছে যেটা সাহিত্যের নয়, সমাজবিজ্ঞানের। সেটা হলো, আধুনিকতা তো আসলে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গী বা শিল্প বিপ্লবের ফসল। সুতরাং যখন শিল্প বিপ্লব হয়েছে ইউরোপে, তারপর থেকে দুটো জিনিস সমাজে এসেছে। একটি হলো, শিল্পসাহিত্যে আধুনিক চিন্তা। দুই নাম্বার হলো, কোনো সংগঠনকে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে চালানোর যে পদ্ধতি তা নৈর্ব্যক্তিক ব্যুরোক্রেটিক বা আমরা যাকে বলি আজকের দিনের একেবারেই নির্মোহ নৈর্ব্যক্তিক আইনভিত্তিক ব্যুরোক্রেসি। এই দুটো জিনিস আসার ফলে সাহিত্যেও এর প্রভাব খুব দীর্ঘ পরিসরে বড়োভাবে পড়ে। কিন্তু ষাটের কবিরা, তিরিশের কবিরা প্রথম বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথকে পরিহার করার নামে ইউরোপীয় দর্শনকে গ্রহণ করে আধুনিকতার নামে। কিন্তু আধুনিকতাবাদ মনে রাখতে হবে খুব নেতিবাচক। নেতিবাচক এই অর্থে, প্রথমত নাস্তিক্য, দ্বিতীয়ত সমাজের যে কোন জিনিসকে রিজেক্ট করার ভেতরে আধুনিকতার সারাৎসার। এই নেতিবাচকতা আসলে সমালোচকদের মধ্যে প্রথম বুদ্ধদেব বা অন্যান্যরা বলেন। কিন্তু যে বইটি ষাটের কবিদেরকে খুবই প্রভাবিত করে বলে আমার ধারণা, সেটা বুদ্ধদেবের একটি প্রবন্ধ সংকলন, আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একজন গবেষকের একটি বই, সেটি হলো, ত্রিপাঠীর বই “আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়” (১৯৬০ সালে বা ৫৮ সালের)। বইটি সম্ভবত লেখা হয়েছিল বুদ্ধদেবের তত্ত¡াবধানে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ডক্টর অমরেশ ত্রিপাঠী ল্যান্ডমার্ক গবেষণা করেন আধুনিক কবিতা নিয়ে। তাতে তিনি দেখান, আধুনিক কবিতা বস্তুটি আসলে কী। কিন্তু এই বইটি নিয়ে সাহিত্যিকদের মহলে খুব প্রশংসা থাকলেও অনেকে এটাকে রিচার্ড বা এ সি ব্র?্যাডলির বইয়েরই প্রতিধ্বনি মনে করেন। এটাও সত্য, বাংলা ভাষায় তো এরকম বই আগে ছিল না! সে কারণে প্রতিধ্বনি হলেও মূল্যবান বই নিঃসন্দেহে। এই বইতেই প্রথম আমরা জানতে পারি, আধুনিক কবিতা কেন পঞ্চাশের কবিদের কবিতা থেকে আলাদা। এ সি ব্র্যাডলির ‘লেকচারস অন মডার্ন পোয়েট্রি’ বইতে ১৫-১৬টা উপাদানকে বোঝানো হয় যে এগুলো আধুনিক কবিতায় থাকতে হয়। সেই একইধরনের জিনিসকেই আসলে ত্রিপাঠী নিয়েছেন। তিনি নিয়েছেন ১৩টি। প্রথম কথা হলো, আধুনিক কবিতা নগরের কবিতা, আধুনিক মন নগরের মন। তবে এ নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক আছে। আমি নিজেও মনে করি, নগরের বাইরেও আধুনিকতা সম্ভব। তারপর ফ্রয়েডিয় চিন্তা প্রথম কবিতায় আনেন কিন্তু আগে কবিতায় ফ্রয়েডিয় উপাদান ছিল না তা নয়, অবশ্যই ছিল। এমনকি মধ্যযুগের বাংলা কবিতায়ও ফ্রয়েডিয় উপাদান ছিল এবং খুব ভালোভাবেই ছিল। কাজেই ফ্রয়েড যে আধুনিক কবিতার একটা অন্যতম ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এটা ভাববার কোনো কারণ নেই। সুতরাং দেখা যায় যে, ত্রিপাঠী বা রিচার্ড ব্র্যাডলিরা তাত্তি¡কভাবে আধুনিক কবিতাকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেন তার প্রত্যেকটাকেই খণ্ডন করা যায় চাইলে। কিন্তু খণ্ডন বা গ্রহণ করা আমি বড়ো কোনো কিছু বলে মনে করি না।
আমি বলতে চাইছি, ষাট কেন আমাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং উজ্জ্বল। কারণ হলো, ষাটের কবিরাই আমাদের প্রথম শিখিয়েছেন, কবিতা ধর্ম থেকে আলাদা। কবিতা ব্যক্তির মনোজাগতিক চিন্তার ফসল প্রাথমিকভাবে, দ্বিতীয়ত অবশ্যই অনেকেই বলছেন যে সমাজ বা মৃত্তিকা সংলগ্ন বিষয়ও কবিতার মধ্যে জরুরি। ১৯৩২ সালে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল যা পৃথিবীর কবিতাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেয়। সেই বইটি ক্রিস্টোফার কডওয়েলের “ইলিউশন এন্ড রিয়েলিটি।” এই প্রথম সাহিত্য এবং শিল্পকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। তবে এটা আরো আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। বিশের দশকেই আসলে শিল্পে আর্ট ফর আর্ট সেইক অথবা কলাকৈবল্যবাদীরা তাঁদের কথা বলেন। আর আরেকধরনের কবিরা আসেন যাঁরা সাধারণ মানুষের জীবন নির্ভর কবিতাকেই বা এই ধরনের অনুসঙ্গগুলোকে নিয়েই কবিতা বা শিল্পের জন্ম দিতে চান। যা জীবন বর্জিত, যা প্রতিদিনের জিজ্ঞাসা বর্জিত, যা প্রতিদিনের ক্ষুধা বর্জিত তা কখনো শিল্প হতে পারে না। তা আসলে যে কোনো বিচ্ছিন্ন মানুষের দ্বীপের মতো যে কোনো গুহাবাসী মানুষের চিন্তার ফসল হতে পারে। সমাজের সঙ্গে যে শিল্পের সম্পর্ক নেই তাঁরা তাকে বিচ্ছিন্ন বলেন। ওদিকে ইউরোপের, বিশেষ করে ফরাসি কবিদের ভেতরে অনেকে প্রথম কবিতাকে বললেন, খনির ভাস্কর্য। ইংরেজিতে তাঁরা বলছেন ‘’স্কাল্পটিং উইথ মিউজিক।” তাঁরা ভাষা দিয়ে কবিতা লিখতে চান না। এর আগের খুব বিখ্যাত বাক্য আমরা সবাই জানি। সেটা হলো, পোয়েট্রি ইজ রিটেন উইথ ওয়ার্ডস, নট উইথ আইডিয়াস।” দর্শন কবিতায় কীভাবে উপস্থিত, সেটাকে খণ্ডন করার জন্য এই কথাটা আসে কিন্তু এখানে যে বলা হচ্ছে “পোয়েট্রি ইজ রিটেন উইথ ওয়ার্ডস,” এই ওয়ার্ডসকে খণ্ডন করেন আধুনিক কবিরা, বিশেষ করে সুধীন দত্ত যেটাকে বলছেন কবিতা সাউন্ড দ্বারা লিখিত হয়। এখন কবিতা সাউন্ড দ্বারা লিখিত হয় নাকি আইডিয়া দ্বারা লিখিত হয় – এই বিতর্ক অনেকদিন ছিল। ত্রিশের কবিরা তার কিছুটা মীমাংসা করেন এবং ষাটের কবিরা হুবুহু সেটাই অনুসরণ করতে চান। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক দেখেছি আমাদের দেশে। তবে আমি মনে করি – ষাটের কবিরা সবাই একরকম কবি নন। ষাটের কবিরা অনেকেই আলাদা আলাদারকম কবি। আমাদের আড্ডায় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি বাক্য সবসময় আমরা উদ্ধৃত করি – “কবিতা অনেকরকম।” সেটা সত্যি। ভালো কবিতা তো আরও বেশি অনেকরকম।
ষাটের কবিরা কেন উজ্জ্বল সেটা বলতে গিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের ব্যাপারটাই আমি বলব না। আমি আরেকটা জিনিস বলব, সেটা হলো, ষাটের কবিরা সবচেয়ে সমাজ সচেতন কবি। ষাটের শেষদিকে কিছু কবি এসেছেন – মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান এঁরা। গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে বেশি আবুল হাসান। এঁরা একদিকে সমাজ থেকে কবিতার বিষয় নিয়েছেন, অন্যদিকে আবার ব্যক্তিগত মনোজাগতিক অনুষঙ্গকেও খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাহলে আসাদ চৌধুরীকে আমরা কোন জায়গায় রাখব? আসাদ চৌধুরী ষাটের কবিদের ভেতরে কেমন কবি? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। কিন্তু তাঁর “তবক দেওয়া পান” থেকে শুরু করে সর্বশেষ কবিতার বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কবিতাগুলো পড়লে মনে হয়, আসাদ চৌধুরী শুধুমাত্র মনোজাগতিক বা সমাজের বিভিন্ন উপাদানের কবি নন। আসাদ চৌধুরীর আরেকটি বিষয় খুব পরিষ্কার। আমি বলব, আসাদ চৌধুরী “বিয়ন্ড সোসাইটি।” “বিয়ন্ড সোসাইটি” সমাজ বহির্ভূত অর্থে নয়, সমাজউত্তীর্ণ অর্থে বলা যায়? সমাজ উত্তীর্ণ অনেক ধরনের উপাদান তাঁর কবিতায় ছিল, আমি যেটাকে মনে করি কিছুটা স্পিরিচুয়ালিটির দিকে। বিশেষ করে ৮০-৮২-৮৩ সালের দিকে যখন তিনি খুব বেশি প্যালেস্টাইনি কবিতা এবং আরবি বা উর্দু কবিতা নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েন এবং অনুবাদও অনেক করেন তখন আমাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় বলতেনও তিনি, গদ্যও লিখেছেন দু’এক জায়গায় যে, ব্যক্তিমানুষের জীবনে ধর্ম অর্গানাইজড ধর্ম হিসেবে নয় কিন্তু ইন্টেলেকচুয়াল ক্ষুধা থাকে সৃষ্টির রহস্য নিয়ে। এই সৃষ্টির রহস্য কবিতায় কখনো কখনো আসে। এবং সেটাকেই আমি বলি, ল্যাঙ্গুয়েজ উইদিন ল্যাঙ্গুয়েজ। শব্দের আড়ালে শব্দ। বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কখনো তিনি বলতেন না। আমি দু’একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি উত্তরে বলেছেন, “আমি ঐ ঝুঁকিতে যাই না, যাতে কেউ ব্র্যান্ড করতে চায় যে আমি স্পিরিচুয়াল মানুষ। আমার ভেতরে স্পিরিচুয়ালিটি আছে, আমি সেটাকে প্রকাশ করতে চাই শিল্পে।” এইদিক থেকে আসাদ চৌধুরী আব্দুল মান্নান সৈয়দ এবং রফিক আজাদ এই দুইজন গুরুত্বপূর্ণ কবির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ৬৫-৬৬র পরে যে কবিরা আসেন, তাঁদের কবিতার চারিত্র্য থেকেও আসাদ চৌধুরীর কবিতার চারিত্র্য অনেকটা ভিন্ন। তাঁরা যেমন খুব লাউড, নির্মলেন্দু গুণ এবং মহাদেব সাহা। মহাদেব সাহা অতটা লাউড নন। রাজনীতি সম্পৃক্ততা ও মৃত্তিকা সংলগ্নতাকে সামনে এনে কবিতাকে গুরুত্ব দেওয়া, সেটা আসাদ চৌধুরী এতটা চাননি। আমি তাঁর কয়েকটি কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করব। কবির খুব গুরুত্বপূর্ণ কবিতা “রিপোর্ট ১৯৭১” এর সবচেয়ে সৌন্দর্যের জায়গাটা দেশপ্রেম বা যুদ্ধ এসব নয়। সাফারিংস অফ হোল নেশন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে যা তিনি ইনজেক্ট করতে চেয়েছেন সেটা হলো প্রেম এবং প্রেমের সঙ্গে এক ধরনের জাতীয় অসহায়ত্ব। যেমন একটা লাইন আছে – বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন। এতটা তীব্র স্যাটায়ার আমি আসাদ চৌধুরীর কবিতায় খুব কম দেখেছি। আসাদ চৌধুরী উইট করেন কবিতায়, কিছু কিছু কবিতায় খোঁচা থাকে, স্যাটায়ার থাকে কিন্তু এইরকম তীব্র স্যাটায়ার ধর্মের একটা বিষয়কে নিয়ে কমই দেখা যায়, যদিও সেটা মাইনরিটিদের ধর্মের বিষয়ে। দ্বিতীয় যেই কবিতাটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেটি হচ্ছে – “শহীদের প্রতি।” এই কবিতায় যেমন জাতীয়তাবোধের তীব্রতা আছে, সেই সঙ্গে শিল্পের প্রতি অন্য এক অনুভব আছে যা আমরা সচরাচর আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে এলাইন করি না। এই কবিতায় ৩-৪টা লাইন আছে যেটা আমি উদ্ধৃত করছি – সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে/কার্নিশে কি ধূসর শাখে/বারুদেরই গন্ধস্মৃতিৃ। প্রথম লাইনে একদম বিপরীত মেরুর দুই উপাদানকে পাশাপাশি স্থাপন করেছেন কবি। “সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে”র মতো লাইন পঞ্চাশের এমনকি চল্লিশেরও অনেক কবিতায় পাওয়া যাবে, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের কবিতায়। কিন্তু দ্বিতীয় লাইনেই “কার্নিশে কি ধূসর শাখে বারুদের এই গন্ধস্মৃতি” – এটা ৭১ এর কথা। এইরকম জাক্সটাপোজ খুব বেশি কবিতায় তিনি করেছেন তা আমার মনে হয়নি, এটা বেশ তীব্র। রাজনৈতিকভাবে আসাদ চৌধুরীকে আমরা কখনো বিশ্লেষণ করি না। আমরা মনে করি, তিনি রোম্যান্টিক কবি। তাঁর সমাজ সচেতনতা বা রাজনীতির বিষয় সবই সাহিত্য ঘেরা। মার্ক্সীয় দর্শন বা এন্টি মার্ক্সীয় দর্শনের ভিত্তিতে চিন্তা তাঁর কবিতায় আছে। সেইদিকে খুব বেশি যাননি তিনি। কিন্তু এই কয়েকটি কবিতা একেবারে ভিন্নরকম ধারণা দেয়।
আসাদ চৌধুরীর আরেকটি কবিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই কবিতাটি আসাদ চৌধুরীকে চেনার জন্য খুব উল্লেখযোগ্য – “আমার বাবা।” এই কবিতাটা প্রথম কাব্যগ্রন্থ “তবক দেওয়া পান”-এ আছে। নিজের বাবাকে কবিদের ভেতরে অনেকেই পোর্ট্রেট করেছেন। “মাই ফাদার” নামে খুব বিখ্যাত এক ইংরেজ কবির কবিতা আছে। আসাদ চৌধুরীর বাবাকে আমরা জানি। কারণ তিনি সামাজিক মানুষ, রাজনৈতিক মানুষ। তিনি আমাদের লেজিসলেটিভ এসেম্বলির সদস্য ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। ছিলেন র?্যাডিকেল আওয়ামি লিগার। এই বাবার চরিত্র দেখলে মনে হয় না তিনি রাজনীতি করেন, তিনি কোনো তীব্র মানুষ। এই বাবা একেবারেই ব্যক্তিগত বাবা। এই বাবা একেবারেই সন্তানের বাবা। সন্তানের জগতের বাইরে এই বাবাকে খুব একটা আঁকেননি কবি। এই বাবা সন্তানের জামা ভালোবাসেন, জামার গন্ধ ভালোবাসেন। তাঁকে ঘিরে তাঁর বাবার যে পোর্ট্রেট সেটাই আসাদ চৌধুরী আঁকতে চেষ্টা করেছেন। আমার কাছে এই কবিতাটি বাবাকে নয় বরং কবির মনকে চেনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এছাড়া আরেকটা কবিতাও গুরুত্বপূর্ণ – “আত্মজীবনী।” এর সাথে “আমার বাবা” কবিতাটিকে অনেক অর্থে মেলানো যায়। নিজের জীবনকে আসাদ চৌধুরী নির্মোহভাবে তো দেখেনই, তার সঙ্গে আছে নিজেকে কোনোকিছু মনে না-করার প্রবণতা। এই কবিতার পুরোটা জুড়েই, “আত্মজীবনী দুই”-এবিশেষ করে, এই অনুসঙ্গ পাওয়া যায়? আর এর সঙ্গে টোনাল সিমিলারিটি সবচেয়ে বেশি আছে “স্বীকারোক্তি”তে। সম্ভবত উনি কনফেশনাল পোয়েট্রি নিয়ে ৮০র দশকে আমার মনে হয় দুএকবার বলেছেনও সিলভিয়া প্লাথ নিয়ে কথা বলার সময়। পশ্চিমের কনফেশনাল পোয়েট্রি হলো যৌনজীবন কেমন, নিজেকে উলঙ্গ করা, উলঙ্গ করা সবকিছু খুলে বলা অর্থে। আমাদের প্রাচ্যের সংস্কৃতিতে সেটা নেই। বাংলা সংস্কৃতিতে একেবারেই নেই। তার কারণ বিভিন্ন। প্রথমত বাঙালি শুধু বাঙালি নয়, বাঙালি মুসলমানের আবার একটা আলাদা সংস্কৃতি আছে। সেখানে আব্রু খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সেখানে আমাদের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা বা কনফেশনাল পোয়েট্রি আসলে ঐ অর্থে নেই কিন্তু আসাদ চৌধুরী আমি বলব, ভীষণ ভীষণ দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে এখানে উন্মোচিত করেছেন। এবং যাঁরা কবিতা পাঠক, যাঁরা বিটউইন দ্য লাইন কবিতা বুঝতে পারেন, যাঁরা ল্যাঙ্গুয়েজ উইদিন দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ ডিসাইফার করতে পারেন, তাঁরা এই কবিতাটিকে খুব এপ্রিশিয়েট করবেন বলে আমার ধারণা।
আমি তাই ষাটের কবিদের যেভাবে বিশ্লেষণ করি, তাতে আসাদ চৌধুরীকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি শুধুমাত্র কাব্য প্রতিভার কারণে নয়। কাব্য প্রতিভায় নিশ্চিতভাবেই তাঁর সমকালীন কয়েকজন কবি বন্ধুর মধ্যেই তিনি ছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আসাদ চৌধুরীর মনটা তাঁর কবিতায় সাংঘাতিকভাবে মিরর। আমাদের অধিকাংশ কবি তাঁদের কবিতায় স্কেপড। তাঁরা তাঁদের কবিতার ভেতরে নেই। আমি বলব, তাঁরা যেই কবিতা লিখেছেন, সেই কবিতার ভেতরে কবিকে পাওয়া যায় না। কিন্তু আসাদ চৌধুরীর অধিকাংশ কবিতায় তিনি স্বশরীরে উপস্থিত। মানুষটির মন যা, ঠিক সেটিই প্রকাশ পেয়েছে। এখানে আমি এই অর্থে আসাদ চৌধুরীকে অবশ্যই সৎ বলব কিন্তু তারচেয়েও বড়ো কথা, আসাদ চৌধুরী কোনোরকম রাখঢাক বা গোপনতা করেননি। কয়েকজন মানুষের জীবনযাপনের কবি তিনি নন। অধিকাংশ কবি একাধিক জীবনযাপন করেন কিন্তু আসাদ চৌধুরীর কবিতা পড়লে বোঝা যায়, আসাদ চৌধুরী মানুষটাকে যাঁদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তাঁরা তাঁর কবিতা পড়লে সেই মানুষটাকেই পাবেন। সেই সততা খুব বেশি কবির মধ্যে থাকে না। তিরিশের অধিকাংশ কবিদের ভেতরেই সেটা ছিল। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে সেটা একটু কম।
আসাদ চৌধুরীর সমকালীন কবিদের সঙ্গে তাঁকে যদি তুলনা করি, বিশেষ করে মান্নান সৈয়দের সঙ্গে, মান্নান সৈয়দ একেবারে কলাকৈবল্যবাদী মানুষ। কিন্তু আসাদ চৌধুরী শুধু কলাকৈবল্যবাদকে প্রশ্রয় দেননি, তিনি নিশ্চিত এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন যদিও। আসাদ চৌধুরীর জিনের ভেতরে রাজনীতি বা সমাজচিন্তা ছিল। এবং আমার কাছে মনে হয়, ষাটের শেষদিকের বিশেষ করে ৭০ এর শুরুর দিকে আমাদের সমাজের রাজনৈতিক টানাপোড়েনগুলো আসাদ চৌধুরীর কবিতায় খুব ভালোভাবে এসেছে। এর সঙ্গে আরো একটি জিনিস আসাদ চৌধুরী জুড়ে দিয়েছেন, সেটা হলো আমাদের ভার্নেকুলার। আমাদের ভার্নেকুলার বা আমাদের কলেকুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের অনেক উপাদান তাঁর কাব্যভাষায় এসেছে। যেমন তাঁর প্রথম কবিতার বইয়ের একটি শব্দ নিয়েই অনেকে বলতে পারেন। তবক শব্দটি এখন খুব বেশি ব্যবহার করা হয় না। এখনকার পাঠকরা চিনবেও না তবক জিনিসটা কী। “তবক দেওয়া পান” কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় আসাদ চৌধুরীর কলেকুয়াল শব্দের ব্যবহার এত বেশি যে কখনো কখনো মনে হয়, তিনি নগরের অনুসঙ্গ থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন, সেটা হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই। আমার ধারণা, আসাদ চৌধুরী দেশেই থাকেন আর বিদেশেই থাকেন, বহুবছর তিনি বিদেশে, এমনকি যৌবনেও যখন তিনি ৩ বছর ইউরোপে থেকে এসেছেন, তখনও তাঁর কবিতা, জার্মানিতে বসেও লেখা কবিতা একেবারেই গ্রামীণ অনুসঙ্গ দিয়ে ভরা। এই কারণে আমি আসাদ চৌধুরীকে বলব, শেষবিচারে তিনি আধুনিক কিন্তু কলাকৈবল্যবাদীদের মতো তিরিশের বা ষাটের অন্যান্য কবিদের আধুনিকতা থেকে অনেকটাই আলাদা তাঁর কবিতা।
ফারহানা আজিম শিউলী: আবেদীন ভাইয়ের আলোচনার সূত্র ধরেই বলতে চাই, সত্যিই আসাদ চৌধুরী সমসাময়িক কাব্যে অব্যবহৃত, অপ্রচলিত কিন্তু মুখের স্থানীয় ভাষায় একসময় বহুল প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁর অনেক কবিতায়। যেমন: কাহাত, ছিদ্দত, চোপা, নসিব, সবক, মঞ্জিল, কোপনি, কেয়াশ, ক্বাসিদা, পয়ার, ঠ্যাঁটা, লোদ, ভেদর, ইঁদারা, জেওর, সুলুক, গতর, ডর, শরম, তেলই, বাঞ্চহা, মজলিশ, কুয়ারা, জল্লা, রিশ্তা, সোন্দা, ছই, দাখিলা, বেছন, দান্দালি, ত্যানা, বাত্তি, আমানী, তণ্ডুল ইত্যাদি।
এ পর্যায়ে আবেদীন কাদেরের আলোচনায় রেফারেন্স হিসেবে আসা কবিতার মধ্য থেকে ৩টি কবিতার অডিওক্লিপ বাজিয়ে শোনানো হয়। “রিপোর্ট ১৯৭১” স্বয়ং কবি আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠে, “শহীদের প্রতি” আবৃত্তিশিল্পী খসরু চৌধুরীর কণ্ঠে এবং “আমার বাবা” আসাদ চৌধুরীর কন্যা নুসরাত জাহান চৌধুরী শাঁওলীর কণ্ঠে।
ফারহানা আজিম শিউলী: মাযহার ভাই, আসাদ চৌধুরীর কাব্য নিয়ে, বিশেষত “তবক দেওয়া পান” নিয়ে তাঁর সহপাঠী-বন্ধু কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের মূল্যায়ন আছে। “আসাদীয় স্বমুদ্রা” বা “আত্মমুদ্রা” এ ধরনের শব্দ-বন্ধ ব্যবহার করেছেন তিনি। আপনি নিজেও লিখেছেন কবিকে নিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে। একটু শুনি।
আহমাদ মাযহার: কবি আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে আলোচনাগুলোতে সারকথা যা প্রকাশ পেয়েছে তাতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যতম প্রতিনিধি ধরা হলেও তাঁকে ষাটীয় ধারার অগ্রগণ্য বিবেচনা করতে দেখা যায়নি। অবশ্য এমনটি ঘটবার জন্য আসাদ চৌধুরীর কবিতার সামর্থ্যের ঊনতা বা অধিকতা যতটা দায়ী তার চেয়ে বড় কারণ আমাদের রসিকতা-সংস্কৃতির দারিদ্র্য। আসাদ চৌধুরী যখন কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, ততদিনে, অর্থাৎ বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে আধুনিকবাদের ধারাকেই বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসের জন্য একমাত্র বিবেচ্য মনে করা শুরু হয়ে গেছে। ফলে বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই সুদীর্ঘ কাল ধরে বহমান জীবনবোধ বাংলা কবিতার অন্য যেসব ধারাগুলোকে সচল রেখেছিল তার চেয়ে পাশ্চাত্যের শিল্পবিপ্লব ও বিশ্বযুদ্ধত্তোর জীবনবোধ প্রাধান্য পেতে থাকে। আসাদ চৌধুরীর কবিতাও ঊনতা সত্তে¡ও মোটের ওপর দ্বিতীয়োক্ত ধারারই প্রতিনিধিত্ব করেছে। তবে তিনি সমগ্র বাংলা অঞ্চলের অপসৃয়মাণ পূর্বতন ধারাগুলোকেও তাঁর কবিতারচনার পরিমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত রেখে দিয়েছিলেন। আর এই গুণই তাঁকে কবি হিসেবে প্রধানত স্বতন্ত্র করে তুলেছিল সহযাত্রীদের তুলনায়।
প্রথম বইয়ের নামকরণ থেকে যেমন তেমনি প্রথম বইয়ে সংকলিত কবিতা থেকেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য বেরিয়ে এসেছিল। নামকরণগুলো একসঙ্গে পড়লে লক্ষ্য করা যাবে বইয়ের, এতেও রয়েছে আসাদীয় আত্মতা। তাঁর স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম ও উল্লেখযোগ্য নির্ণায়ক হচ্ছে, আধুনিকতা-অভিমুখি সময়ে যখন বাংলা কবিতার লোকজতা ক্ষীণ হতে চাইছে সে সময়ে লোকজীবনবোধকে নিজের মর্মলোকে সমানুভ‚তিতে রাখতে পারা। তাঁর প্রথম কবিতা-সংকলন ‘তবক দেওয়া পান’ এই গুণেই গুণান্বিত। আবদুল মান্নান সৈয়দেরও শনাক্তি: ‘তবক দেয়া পানে’র কবিতায় ‘লোকসাহিত্য’, ‘বৈষ্ণব পদ’ কিংবা ‘লালন শাহ’ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন আসাদ চৌধুরী। গ্রামীণ নারীদের বাকভঙ্গি, গ্রামীণ ‘আন্তরিকতা’, ‘অকপটতা ও অকৃত্রিমতা’কে [আবদুল মান্নান সৈয়দের অভিধা] এমন ভাবে বিন্যস্ত করেছেন তিনি যে তা-ই তাঁর কবিতাকে আধুনিকতার দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তাঁর সক্রিয়তার কালে বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি ছিল উত্তাল। সেই সংবেদনাও ছিল প্রবল ও প্রবহমান। আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার বিপ্রতীপে এ-ও ছিল অন্যতম প্রভাবক। সবমিলিয়ে বলা চলে, কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন লোকায়তিক ও আধুনিক কবি একইসঙ্গে।
ফারহানা আজিম শিউলী: “তবক দেওয়া পান” এ আবার একটু যাই। কবি আসাদ চৌধুরী নিজে উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ করেছেন কবি রফিক আজাদের প্রথম কবিতার বই “অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস” এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ”, অথচ নিজের প্রথম বই “তবক দেওয়া পান” প্রকাশিত হয় বেশ পরে, ১৯৭৫ এর ডিসেম্বরে। বইটির প্রচ্ছদে কবির পছন্দের পান আর জামদানির মোটিফই ব্যবহার করেছেন শিল্পী আবুল বারাক আলভী।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, “তবক দেওয়া পান” এ এই নামে কোনো কবিতাই নেই। শুধু “প্রতীক্ষা” কবিতার প্রথম লাইনে আছে – রুপালি তবক দেয়া পান নিয়ে বসে আছি জানালায় গালে হাত দিয়ে/ সারারাত/ তিন দিন। “তবক দেওয়া পান” ছাড়া আর কেবল একটি বই “দু:খীরা গল্প করে”তে শিরোনাম কবিতা নেই।
কবি “সত্য ফেরারি” নামটি দিতে চেয়েছিলেন প্রথম কবিতার বইয়ের, তবক দেওয়া পান নয়। কারণ, “সত্য ফেরারি” কবিতাটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু মান্নান সৈয়দ বলেন, এটা না গদ্য না পদ্য হয়েছে, শেষেও গোঁজামিল আছে ইত্যাদি। একই কথা ছিল কবি অরুণাভ সরকারেরও। রফিক আজাদেরও ছিল মৌন সমর্থন। ফলে নাম তো দূরের কথা, কবিতাটাই রাখা হবে না বলে স্থির করেন বন্ধুরা। পরে রফিক আজাদ প্রস্তাব করেন, ভেতরের একটা কবিতা (স্ত্রীকে নিয়ে লেখা ছিল) সরিয়ে সেখানে “সত্য ফেরারি” দিতে, আর ভেতরের কবিতাটা উৎসর্গে নিয়ে আসতে। কবির ইচ্ছে ছিল যদিও মা’কে উৎসর্গ করার।
পরে “রুপালি তবক দেওয়া পান” থেকে ছোট করে “তবক দেওয়া পান” নামকরণ করা হয়।
মজার ব্যাপার, কবি কিন্তু তখন মোটেও পান খেতেন না। তিনি পান খাওয়া শুরু করেন ৯০ এর দশকে সিগারেট ছাড়তে গিয়ে। তাহলে পান কেন? আসলে কবি পানকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স¤প্রীতির প্রতীক হিসেবে এনেছেন।
এই কাব্যগ্রন্থের “সত্য ফেরারি” তিনি টিভিতে অনেকবার আবৃত্তি করেছেন। সেটির সুরারোপও হয়েছে। এ কাব্যগ্রন্থের আরেকটি ভিন্ন স্বাদের কবিতা “সন্দেহ”তে সুরারোপ করেন এবং গান শঙ্কর সাঁওজাল। তাঁর আরো কয়েকটি কবিতায় সুরারোপ হয়েছে। যেমন – “ফাগুন এলেই” গানটি গেয়েছেন শাম্মী আক্তার, “একটি শালিক” গেয়েছেন রওশন আরা মুস্তাফিজ, “বারবারা বিডলারকে” নিয়ে হয়েছে নিরীক্ষাধর্মী থিয়েট্রিক্যাল রক। কবি বলেন, এসব পুরোপুরি সুরকারদের কৃতিত্ব। তিনি ঐ অর্থে গান লেখেননি।
“সত্য ফেরারি” কবিতায় ফিরি। কবিতাটি ১৯৭০ সালে লেখা। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভয়াল জলোচ্ছ¡াসে দক্ষিণ বঙ্গে মানুষের লাশ আর লাশ। এর মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন তুঙ্গে। কবি তখন হতাশ। এত লাশ কিন্তু রিলিফ যাচ্ছে না। তখনই এই কবিতা লেখা।
উল্লেখ্য, সত্য নিয়ে “প্রশ্ন নেই” শিরোনামে উপহাসমূলক আরো একটি কবিতা “প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়” কাব্যগ্রন্থেও আছে। এই পর্যায়ে “সত্য ফেরারি” কবিতার কবিকণ্ঠে প্রথম কিছু অংশ ও শাম্মী আখতারের কণ্ঠে গানটি বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘কবিতা থেকে গান’-এর একটি ভিডিওক্লিপ থেকে দেখানো হয়। গানটির সুরকার নজরুল ইসলাম। সংগীত পরিচালনায় সত্য সাহা।
আসাদ চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ও সেই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু কবিতায় তাঁর অভিষেক ঘটে যে কবিতাটির মধ্য দিয়ে সেটি প্যাট্রিস লুমুম্বাকে নিয়ে লেখা। এটি কোনো বইয়ে নেই। তখন কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলে থাকেন, ১৯৬০ সালে। কঙ্গোতে প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা এবং প্রথা অনুযায়ী পলিন লুমুম্বার নগ্নবক্ষে আহাজারি কবিকে খুব আহত করে, স্পর্শ করে। তখন আজাদ সুলতানের অনুরোধে পুরোনো ঢাকার এক রেস্টুরেন্টে বসে কবিতাটি লেখেন। সেই বিকেলেই স্টেডিয়ামে খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের “বুক্স এন্ড ম্যাগাজিনস” দোকানে (আজাদ সুলতান ওখানেই কাজ করতেন) রণেশ দাশগুপ্ত এসে কবিতাটি নিয়ে গিয়ে ছাপেন পরদিন সংবাদের সম্পাদকীয় পাতায়। রাজকীয় অভিষেক ঘটে আসাদ চৌধুরীর বলা যায়। এই কবিতা ছাপা হবার পর! কারাগারের কমিউনিস্ট বন্দি, রাজবন্দির কাছ থেকে অভিনন্দন পান তিনি, পান খুব দ্রæত পরিচিতি।
তখন কবির পুরো নাম – আশিক-ই ওয়াহেদ-ই মোহাম্মদ আসাদ-উল ইসলাম চৌধুরী – মেট্রিক সার্টিফিকেটের নাম। সংবাদে নাম ছাপা হয় সংক্ষেপে আসাদুল ইসলাম চৌধুরী। তারপর স্বাক্ষর এর প্রথম সংখ্যায় কবি রফিক আজাদ নামটি আসাদুল ইসলাম চৌধুরীই রাখেন। দ্বিতীয় সংখ্যায় আল ইসলাম সংক্ষেপিত হয়ে ছাপা হয় আসাদ চৌধুরী।
এ পর্যায়ে কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতা, যার মাধ্যমে তাঁর রাজ্যাভিষেক ঘটে সেই কবিতাটি কবির কণ্ঠে অডিওক্লিপের মাধ্যমে শোনানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধ কবি আসাদ চৌধুরীর জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়। তিনি জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করতেন। একইসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে “মোদের গরব মোদের আশা”, “মৃত্যুহীন প্রাণ” নামে কথিকা নিয়মিতভাবে পড়তেন। মৃত্যুহীন প্রাণ শহীদদের নিয়ে লেখা। এর প্রথমটি তিনি লিখেছিলেন ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় তাঁর এক ছাত্র শহীদকে নিয়ে।
সেইসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কবিতাও পাঠ করেছেন। এর মধ্যে ছিল- জঙ্গনামা, ওগো বিদেশিনী, রিপোর্ট ১৯৭১। জঙ্গনামা, শহীদী কারবালা এক ধরনের পুঁথি। জঙ্গনামা নামটি পরে পালটে হয় – তখন সত্যি মানুষ ছিলাম। ১৯৭১ এ শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশের চোখের কোটরে সূর্যের আলো এসে পড়ছিল। তা দেখে এই কবিতা লিখেন তিনি। আর “ওগো বিদেশিনী” পালটে হয় “বারবারা বিডলারকে”। শামসুল হুদা চৌধুরী, বেলাল মোহাম্মদ কবিকে কবিতা পড়তে অনুরোধ করলে ঐ মুহূর্তে তাঁর তৈরি কবিতা ছিল না। ওদিকে আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধে বারবারা বিডলার নামে এক মার্কিন তরুণী একটা কবিতা লিখেন ভিয়েতনামের পক্ষে। ১৯৬৫ সালে বারবারার কবিতাটির তর্জমা ছাপা হয় ‘ভেলা’ নামের ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত এক লিটলম্যাগাজিনে। সেটি কবিকে খুব স্পর্শ করেছিল। সেটি মাথায় রেখেই ৭১ এর প্রেক্ষাপটে লিখেন “ওগো বিদেশিনী/বারবারা বিডলারকে।” “তখন সত্যি মানুষ ছিলাম” পরে “তবক দেওয়া পান”-এ, আর “বারবারা বিডলারকে” ও “রিপোর্ট ১৯৭১” স্থান পায় “যে পারে পারুক” কাব্যগ্রন্থে।
এ পর্যায়ে, “তখন সত্যি মানুষ ছিলাম” খসরু চৌধুরীর কণ্ঠে ও “বারবারা বিডলারকে” আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অডিওক্লিপে বাজিয়ে শোনানো হয়।
কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতায় সার্বিকভাবে শোষিতের পক্ষে অবস্থান ছিল। স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তর, একাত্তরে ঘর ছাড়া সংখ্যালঘু, শরণার্থী জীবন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বধ্যভ‚মি, একুশ ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়।
অভুক্ত শিশুর কান্না, অসহায় মানবতা, অস্ত্র ব্যবসায়ী, আদমজির বন্ধ জুটমিল, আফ্রিকা, আলকাপ, উন্নয়ন প্রহসন, উপনিবেশের দাসত্ব, উর্দুকবি, এসিড সন্ত্রাস, কানসাট, ক্রিকেট, কীর্তনখোলা, খরা, ক্ষমতা ও দাপটের বেপরোয়া প্রদর্শনী, ক্ষমতার রাজনীতি, গম্ভীরা, গার্মেন্টসের মেয়েরা, গ্রামবাংলার পদাবলী, গৃহী-বাউল দ›দ্ব, চরের জীবন, জলোচ্ছ¡াস, জ্বালানীর চাপে শূন্য বন, তথাগত, তোষামোদ, দক্ষিণের মানুষ, নদীর ভাঙন, পারমাণবিক বোমা, পাহাড়ের ভ‚মি দখল, বায়ু দূষণ, বার্ধক্য, বিপন্ন স¤প্রীতি, বেপরোয়া লালসা, ভাটিয়ালি, ভুখা মানুষ, ভোটের রাজনীতি, মারনাস্ত্র, মুমূর্ষু আদর্শ, মুমূর্ষু বুড়িগঙ্গা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মেকি জীবন, শৈশব, সংগঠনের ভাগাভাগি, সন্ত্রাস পীড়িত দেশে মাৎস্যন্যায়, সভ্যতা নামে কলঙ্ক, সহপাঠী, সুখের লালসা, রমনা বটমূলে গ্রেনেড ইত্যাদি পাই তাঁর কবিতায়।
তরুণদের নিয়ে লিখেছেন বরাবর আশা-জাগানিয়া কবিতা। স্মৃতি-স্বপ্ন বিষয়ক কবিতা আছে বেশকিছু।
আসাদ চৌধুরী প্রবাস নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তবে ঠিক “প্রবাসী” হিসেবে নয়, প্রবাসকে একরকম বাইরে থেকে দেখার জায়গা থেকে লিখেছেন। এর মধ্যে “এ মাটি আমাকে ছাড়ে না” অন্যতম। এই কবিতাটি ঞযরং ঝড়রষ নামে অনুবাদ করেছেন তপন জ্যোতি বড়ুয়া।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন অনেক কবিতা। তিনি নেই, তিনি আজ অনেক বেশি আছেন, তোমার শেষ ছায়াটি, বজ্রকণ্ঠ থেমে গেলে, চির মনোরম চির মধুর, এমন দিনে তুমি যে নেই পাশে, মৃত্যুও পারেনি ছুঁতে, সহিষ্ণু প্রতীক্ষা, সাইকেল পর্যায় : দুই, নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির, এ কেমন জন্মদিন, আজ কী বাঁধনে বেঁধে গেলে, নয় মাসের বিবরণ, তিন কন্যার অসমাপ্ত গল্প, সব তোমাদের জন্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আসাদ চৌধুরীর শহীদ মিনার-একুশকে নিয়ে লেখা কবিতা যেন কবিকেই সনাক্ত করে একরকম। যেমন – “আমি কি পাতক?” কবিতায় লিখছেন, শহীদ মিনার আমার একমাত্র বিচারমঞ্চ। “উচ্চারণ” কবিতায় লিখছেন বর্ণমালার কাছেই আমার আনুগত্য। “ভাই, আমি তো বাজি না” কবিতায় লিখছেন, হে আমার বর্ণমালা, রক্তাক্ত কুসুম, কেবল তুমিই বারুদের ঘ্রাণ আর প্রতিবাদ ধরে রাখতে জানো। “ভুলে যাই” কবিতায় তিনি সব ভুলে যান, কেবল ভোলেন না ফাল্গুনের কোনো একটি দিনের স্মৃতি।
এ পর্যায়ে কবি আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠে “বজ্রকণ্ঠ থেমে গেলে,” “এ মাটি আমাকে ছাড়ে না” ও খসরু চৌধুরীর কণ্ঠে “ভুলে যাই” কবিতার অডিওক্লিপ বাজিয়ে শোনানো হয়।
সংস্কৃতশ্লোক অনুসরণে কবি আসাদ চৌধুরী কবিতা লিখেছেন। নিজে বাংলায় শ্লোক লিখেছেন। “তবক দেওয়া পান” এর “সন্দেহ” কবিতাটি লিখেছেন সংস্কৃতশ্লোক অনুসরণে। আবার শ্লোক অনুসরণে না, নিজেই শ্লোক লিখেছেন। তবক দেওয়া পান, বিত্ত নাই বেসাত নাই, প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়-এ আছে এরকম কবিতা।
আলোকচিত্র, চোখ, প্রেম, শ্লোক, স্বীকারোক্তি, প্রশ্ন, পর্যবেক্ষণ, গালিবের অনুসরণে এলেবেলে, চিত্র, বাস্তবতা, এলোমেলো ইত্যাদি নামে আসাদ চৌধুরী সিরিজ লিখেছেন বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে। চোখ ও প্রেম সিরিজের কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ ঝবষবপঃবফ চড়বসং ড়ভ অংধফ ঈযড়ফিযঁৎু বইয়ে আছে।
কবি ১ লাইনের কবিতাও লিখেছেন কয়েকটি। যেমন – “কেন?,” “সর্বশেষ বিবৃতি” ইত্যাদি। এই দুটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আছে “Selected Poems of Asad Chowdhury” বইয়ে।
আসাদ চৌধুরী চমৎকার ননসেন্স রাইমও লিখেছেন বেশ কয়েকটি।
সাধুভাষায় লিখেছেন কবিতা। “তবক দেওয়া পান” এর সুপ্রাচীন গল্প ও তর্কাতীত একদম অন্য ধরনের, গদ্যের মতো। সাধু ভাষায় লিখেছেন। কবিতা “বয়াতি ও ভক্তের কথা”ও লিখেছেন সাধু ভাষায়।
এ পর্যায়ে একটি শ্লোক, “প্রেম” ও চোখ সিরিজের কয়েকটি ছোট কবিতা ও ননসেন্স বেবিফুড পাঠ করে শোনানো হয়।
ফারহানা আজিম শিউলী: একটা জায়গায় আসাদ চৌধুরীকে আমরা বিশেষভাবে পাই কিন্তু খুব কম জানি এই ব্যাপারে। সেই বিষয়টা নিয়েই জাভেদ ভাই আপনার কাছে আসছি।
বাংলাদেশের উর্দু কবিতার প্রকাশে-বিকাশে-প্রসারে আসাদ চৌধুরীর একটা বড় ভ‚মিকা ছিল। বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। ছিলেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি। নওশাদ নূরী, আহমেদ ইলিয়াস, শামীম জামানভীদের মতো শুধু বাংলাদেশ না, উপমহাদেশের প্রথিতযশা উর্দু কবিদের বাংলা অঞ্চলে পরিচিতির ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা নিয়েছেন তিনি। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় কবির বাধ্যতামূলক বিষয়ের একটি ছিল উর্দু। তিনি নিজে অনুবাদ কবিতার বই লিখেছেন “বাড়ির কাছে আরশিনগর: বাংলাদেশের উর্দু কবিতা” যাতে ঠাঁই পেয়েছে ৪৭ জন বাংলাদেশের উর্দু কবির কবিতা। ২০০০ সালে বের হয় বইটি শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে। বাংলাদেশের ঢাকা সহ নানান জায়গায় মুশায়েরায় অংশ নিয়েছেন, পরিচালনা করেছেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেও মুশায়েরার আয়োজন করেছেন কবি আসাদ চৌধুরী নিয়মিতভাবে।
জাভেদ ভাই, আপনি উর্দু কবিতার অনুবাদ করেছেন প্রচুর। নওশাদ নূরী নিয়ে আপনি এবং মাযহার জীবন আসাদ চৌধুরীর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাহিত্য ম্যাগাজিন মননরেখায় আহমেদ ইলিয়াস ও নওশাদ নূরীর ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আপনার করা আহমদ ইলিয়াসের কবিতার তর্জমার বইও প্রকাশ করেছে প্রথমা, যেটি আপনি নিজহাতে অশীতিপর কবির হাতে তুলে দিয়েছেন। অর্থাৎ নানাভাবেই আসাদ চৌধুরী, উর্দু কবিতা এবং বাংলাদেশের উর্দু কবিতার সঙ্গে আপনি জড়িয়ে আছেন। আপনার কাছ থেকেই শুনি।
জাভেদ হুসেন: ব্যাপারটা আসলে একটু ভিন্নরকম। যাঁরা আসাদ চৌধুরীকে চেনেন আবার যাঁরা হয়তো আমাকেও চেনেন, তাঁরা একটু বিস্মিতই হতে পারেন আজকের আয়োজনের মধ্যে আমার যোগসূত্রটা কীরকম। সঞ্চালক স্পষ্ট করলেন ব্যাপারটা। আমি একটু ধারাবাহিকভাবে বলি যে কেমন করে তাঁর সঙ্গে যোগসূত্রটা গড়ে উঠল। এই পুরো প্রক্রিয়াটার মধ্যেই আসাদ চৌধুরী নামে একজন কবির একটা একদম অন্যরকম চরিত্রও প্রকাশ পাবে। কবিতা যে শুধুমাত্র মগজে রাখবার বিষয় নয়, মননে রাখবার বিষয় নয়, এটা একইসঙ্গে যে মানুষের সঙ্গে জড়িত একটা ব্যাপার, যার সঙ্গে জীবিত মানুষের সম্পর্ক, বেঁচে থাকা-জীবিত মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে তার সম্পর্ক, এটা আমি স্পষ্টভাবে টের পেয়েছি এবং টের পেতে আমাকে সহযোগিতা করেছেন আসাদ চৌধুরী খুব ঘনিষ্ঠভাবে। গোড়া থেকে যদি বলি, একেবারে অনেক আগে আমি তখন একটা সংগঠন করতাম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলাম। কুমিল্লা থেকে। আমরা একটা কাগজ করলাম। বিখ্যাত সব উর্দু কবিদের বাছাই কিছু কবিতার সংকলন। এটার নাম দিয়েছিলাম “অনেক ভোরের আলো।” রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতার একটা লাইন। তো শহর থেকে করেছি। আমরা নিজেরাই করেছি, নিজেরাই পড়ি। আমরা ভাবিনি যে এটা অন্য কোথাও কারো কাছে যাবে। আমরা নিজেরাই ছাপি, নিজেরাই পড়ি, বন্ধুবান্ধবদের দেই। আর উর্দু কবিতার মতো বিষয় খুব একটা ছড়িয়ে দেবার মতো অনুক‚ল কোনো বিষয়ও নয়। হঠাৎ করে একদিন আমার কাছে একটা চিঠি এলো। আমার এক বন্ধু চিঠিটা পৌঁছে দিলেন। আমি প্রথমত প্রত্যাশাই করিনি যে এটা থেকে কারো কাছ থেকে কোনরকম ইতিবাচক সাড়া পাব। চিঠিটা হাতে নেবার পর খুলে দেখি, আসাদ চৌধুরীর চিঠি। আমি তখন নিতান্ত অনার্সে পড়া একটা ছেলে। চিঠিটা দেখে বিস্মিত এবং একইসঙ্গে অভিভ‚ত হলাম। চিঠিটার মধ্যে তিনি প্রচণ্ডরকমের ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন, আশীর্বচন জানিয়েছেন। বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছেন যে, এরকম চর্চা কোথাও হচ্ছে এটা তাঁর কাছে অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা ঘটনা, বিস্ময়কর ব্যাপার। এরপর দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। ২০১১ সন। তখন আমি ঢাকায় থাকি। ১১ সনে আমি আবার একটা নিমন্ত্রণ পাই। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, বিখ্যাত উর্দু কবি, প্রগতিশীল উর্দু কবি কমিউনিস্ট কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, প্রগতিশীল সর্বভারতীয় লেখক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের জন্মদিন, শততম জন্মদিন ২০১১তে। সেখানে আমি ডাক পেলাম কথা বলার। এখন যাঁরা ঢাকার তাজমহল রোড দেখেন তাঁরা একটু মনে করতে পারবেন, ২০১১ সালে তাজমহল রোডটা মোটামুটি শান্ত, অনেকগুলো ছোট ছোট দোতালা তিনতলা বাড়ি রাস্তার পাশে, দোকানপাট ছিল না, প্রায় অন্ধকার সন্ধ্যা। এইরকমই একটা বাড়ি রাস্তার পাশে, একজন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার বাড়ির মালিক। সে বাড়ির সামনে মোটামুটি আশি থেকে একশোটা চেয়ার পাতার ব্যবস্থা ছিল। সেই জায়গাতে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের শততম জন্মদিন পালন করা হচ্ছে এবং সেখানে এটা পালন করছে বাংলা-উর্দু ফাউন্ডেশন নামে একটা সংগঠন। এটা সম্পর্কে আমার তখন পুরোপুরি জানা হয়নি। সেই অনুষ্ঠানে অন্যতম আলোচক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক এবং সেখানে আসাদ চৌধুরীকে সরাসরি প্রথমবারের মতো কাছ থেকে দেখা। দেখলাম যে, তিনি কী গভীরভাবে ভালোবেসে অন্য আরেকটা ভাষা, যদি আরো ভালোভাবে বলি, আমাদের জন্য “অপর” একটা ভাষার প্রতি কী গভীর উপলব্ধি, গভীর ভালোবাসা নিজের বুকের ভেতর পুষে রাখেন। পরবর্তীকালে আমি দেখলাম, বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা যদি কেউ করে থাকেন নিজের উদ্যোগে, গভীর মমতা নিয়ে, সেটা আসাদ চৌধুরী নিজে। এবং এই বাংলাদেশে যে অল্পকয়েকজন উর্দু কবি এখনো বেঁচে আছেন, উর্দু সাহিত্যিক এখনো বেঁচে আছেন এবং ছোট ছোট ক্যাম্পের মধ্যে দশ ফুট বাই দশ ফুট একেকটা কক্ষের মধ্যে অনেকগুলো লোক এখনো একসঙ্গে থাকেন, এই মানুষগুলোর প্রতি একটা গভীর মমতাবোধ তিনি পোষণ করেন। যিনি এটা পোষণ করছেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত একজন ব্যক্তি। এটা আমার কাছে একটা গভীর উপলব্ধির বিষয় হয়ে উঠল, যে ভাষাটা “অপর” হয়ে উঠেছিল, যে ভাষাকে আরেকটা কাতারে দাঁড় করিয়ে বাংলা নিজে দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করেছিল এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র হয়ে উঠল, সেই স্বাধীন দেশটাতেই আসাদ চৌধুরী ঐ ভাষার মানুষগুলোর কাঁধে হাত দিয়ে রাখলেন। একটা ভাষা, একটা সংস্কৃতি, যে ভাষায় গালিব, মীর ত্বকী মীর, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ইকবালের মতো কবিরা কবিতা লিখেছেন, সেই ভাষার প্রতি তাঁর গভীর মমতাবোধ ছিল এবং সেই ভাষায় যাঁরা কবিতা লিখছেন বাংলাদেশে, সেই মানুষগুলোর প্রতিও তাঁর গভীর মমতাবোধ ছিল। এবং আমি দেখলাম, এই মানুষটা কবিতা এবং একইসঙ্গে মানুষের প্রতি অসাধারণ একটা সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পারতেন। গড়ে তুলেছিলেনও তিনি। বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের একটামাত্র পরিচয় আমরা জানি, কিন্তু আসাদ চৌধুরী বের করে এনেছিলেন সেই মানুষগুলোকে। নওশাদ নূরী, আহমেদ ইলিয়াস এই মানুষগুলোকে তিনি বের করে আনতে পেরেছিলেন, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৯ থেকে নওশাদ নূরীরা একটা পত্রিকা বের করেছেন “জারিদা” নামে। এই পত্রিকাটা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উর্দু মুখপাত্র। এই উর্দু মুখপাত্রটার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। একেবারে আট কলামে বড়ো করে লেখা সেই উর্দু পত্রিকায় ১৯৭১ সালে “তেরি আজাদ মেরি আজাদ, ছে নু কাদ, ছে নু কাদ।” “তোমার মুক্তি আমার মুক্তি, ছয় দফা, ছয় দফা।” ঐ পত্রিকার যিনি কবি নওশাদ নূরী, তিনি আসাদ চৌধুরীর খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। আসাদ চৌধুরীর পান খাওয়ার ঘটনা নিয়ে মনে পড়ল, আমি তাঁকে যখন দেখেছি তিনি তখন পান খেতেন। একটা ঝোলা বহন করতেন তিনি। যখন একটু আয়েশ করে বসতেন খাবারের পর, তখন তিনি মোটামুটি সামনে একের পর এক ডিব্বা বের করতেন, একটার পর একটা বিভিন্ন প্রকার মশলা। সেসব একটা একটা করে পানের মধ্য দিয়ে চিবুতেন। নওশাদ নূরীর স্ত্রী এইরকম একবার আসাদ চৌধুরীকে দেখছেন যে, একের পর এক কৌটো বেরোয়, বিভিন্ন রকমের মশলা একের পর এক বের হচ্ছে এবং পানের ওপর জড়ো হচ্ছে। নওশাদ নূরীর স্ত্রী তখন হেসে বললেন যে, এতো মশলা যখন হয়েই গেছে, একটু মাংস দিয়ে রান্না করে ফেলো। এত মশলা দিয়ে পান খেতে কাউকে দেখেননি তিনি।
তো আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার এই যোগাযোগ বা সখ্য গড়ে উঠলে পরবর্তীকালে আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে, বাংলাদেশে বিলীয়মান এই উর্দু কবিদের জগতকে গভীর মমতাবোধের জায়গা থেকে তিনি তাঁদেরকে এক করে রাখতে চাইতেন। ছোট ছোট মুশায়রা হতো। একেকটা মুশায়রাতে হয়তো ঢাকা শহরের বা ঢাকার বাইরে থেকে আসা ৫০-৬০ জন জড়ো হলো। তার মধ্যে ৮-১০জন কবি জড়ো হতেন। কোন একজন স্বচ্ছল ব্যক্তি যার বাড়িতে অনেকখানি জায়গা আছে, এমন কোনো একজন সদস্যের বাড়িতে সংগঠনের মুশায়রার আয়োজন হতো এবং মুশায়রার আয়োজন যেরকমই হোক, তার মধ্যে খাবারের আয়োজনটা খুব ভালো থাকতেই হতো। একবার মনে আছে, দিল্লী শহরে কাবাবের আয়োজন দেখে একজন বলেছিলেন, দিল্লীর কাবার দেখলে এইটুকু অন্তত বোঝা যায়, কেমন করে আসলে মোঘলদের হাত থেকে সাম্রাজ্যটা খসে পড়েছে। দিল্লীর কাবাবের, খাবারের আয়োজন দেখলে সেটা বোঝা যায়। আমিও বাংলাদেশে বসে এই বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশনের মুশায়রার আয়োজনগুলোতে দেখেছি খাবারের কী প্রবল আয়োজন থাকতো। খাবারের আয়োজনে যথেষ্ট পরিমাণে কী না কী থাকবে তা নিয়ে অনেকসময় মুশায়রা পিছিয়ে যেতেও দেখেছি। মোগলাইয়ের একটা কালচার এর মধ্যে বরাবরই ছিল। মুশায়রাগুলোর প্রত্যেকটাতে আসাদ চৌধুরী অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সংযুক্ত থাকতেন। নিজে ফোন করে উর্দু কবিদেরকে আনতেন এবং চেষ্টা করতেন বাংলা ভাষায় যাঁরা ভালোভাবে, প্রত্যক্ষভাবে প্রতিষ্ঠিত জায়গা থেকে কাব্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সঙ্গে এই মুশায়রাগুলোর সম্পৃক্ততা ঘটিয়ে দিয়ে তাঁদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে। আমি অনেককে সেখানে দেখেছি। কামাল লোহানী প্রায়ই আসতেন মুশায়রাগুলোর মধ্যে। বাংলা একাডেমির সাবেক সদ্য প্রয়াত পরিচালক আসতেন। উর্দু কবি জাহিদ ভাই আসতেন। আসাদ চৌধুরী কবি হিসেবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীকালে উর্দুভাষী কবিদের আত্মসত্তাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবার একটা ফ্রন্টের মধ্যে আসাদ চৌধুরীকে আমি আরেকবার সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি সরাসরি। আমার কাছে তখন মনে হয়েছে, এটা একটা বিচিত্র ব্যাপার বটে যে, কবিদের জগৎ কবিদের পরিসর কতো বড়ো হতে পারে! যা দুদিন আগে ছিল “অপর” এক ভাষা, স্বাধীনতার পরপরই তিনি সেই “অপর” ভাষাকে আপন করে নিচ্ছেন। অর্থাৎ বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটার পরিসর এবং এই রাষ্ট্রটার ব্যাপ্তির যে স্বপ্ন তিনি লালন করতেন তাঁর চোখের মধ্যে, তাঁর মননে, তাঁর স্বপ্নের মধ্যে, তাঁর ভাবনার মধ্যে – সেটা এতো বড়ো ছিল যে, এখানে একাত্তর সনে বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করলেন, আবার তার পরপরই উর্দু ভাষাভাষী গোষ্ঠীর বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অধিকার রক্ষার জন্য সরাসরি বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশন গড়ে তুলে প্রথম সারির সংগঠক হিসেবে নিজে কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল? দেখেছি বারবার, বাংলা কবিতার মধ্যে, তাঁর ভাবনার মধ্যে, কবিতার জগতের মধ্যে তিনি কেমন করে উর্দু কবিতাকে ধারণ করার চেষ্টা করতেন। তিনি অনেকসময় বলতেন যে, উর্দু কবিতার মধ্যে কীভাবে মজার ঘটনা ঘটে। উর্দুওয়ালারা খুব সহজে নাউনকে ভার্ব করে ফেলতে পারে। একটা মজার উদাহরণও দিয়েছিলেন। ইউসুফ জুলেখার কাহিনিতে আছে, ইউসুফের প্রেমে পড়লেন জুলেখা এবং তাঁকে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করলেন। ইউসুফ তাতে প্রলোভিত হলেন না। পরে ইউসুফ যখন ফিরে যেতে চাচ্ছিলেন তখন জুলেখা তাঁর জামা টেনে ধরলেন। সে জামা ছিড়ে গেল। পরবর্তীকালে জুলেখা বললেন যে, ইউসুফ আমাকে লাঞ্চ্ছিত করার জন্য আক্রমণ করেছিল? সবাই বলল, তা কেমন করে হবে! জামার ছেড়া অংশটা পেছনের অংশ। যদি তোমাকে আক্রমণ করতো, তাহলে তো জামার সামনের অংশ ছিড়ে যাবার কথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যে জামা ধরে টানাটানি করার ব্যাপারটা, বাস কাউন্টারে হেল্পাররা যেভাবে টানাটানি করেন, উর্দুওয়ালারা এইটাকে বলে “জুলেখাই করনা।” কবে সেই জুলেখা ইউসুফের জামা ধরে টানাটানি করেছিলেন, এখন কেউ জামা ধরে টানাটানি করলেই উর্দুওয়ালারা বলে, জুলেখাই করনা। কেমন করে নাউনটা ভার্ব হয়ে গেল!
আসাদ চৌধুরীর কবিতার মধ্যে আমি মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো আবেশ যেন টের পেয়ে যাই। যেমন ধরুন, ছোট্ট একটা কবিতা ১ লাইনের – আমার সর্বাঙ্গে পাপ, দৃষ্টিতে অধিক। এইটুকুই কিন্তু। কী সুন্দর কথা!
আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকার বাইরে রাজশাহী, সৈয়দপুরে মুশায়রার যাবার সুযোগ হয়েছে। সে গল্পগুলোও করলে আসাদ চৌধুরীর অন্য আরেকটা পরিচয়ও তাতে জানা যাবে।
এ পর্যায়ে “বাড়ির কাছে আরশিনগর: বাংলাদেশের উর্দু কবিতা” থেকে আসাদ চৌধুরী অনূদিত আহমদ ইলিয়াসের “আমার অপর যমজ ভাইয়ের প্রতি” ও শামীম জামানভীর “ভাষা” কবিতাদুটোর পাঠ শোনানো হয়।
ফারহানা আজিম শিউলী: একটি দেশের সংখ্যাগুরুর ভাষা শুধু না, অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষার/সাহিত্যের প্রসার – যেটি বৃহদার্থে একুশেরই চেতনা। তাঁর বাংলাদেশের অন্য ভাষার সাহিত্য/কবিতা নিয়ে আগ্রহ ছিল। চাকমা ভাষা, মান্দি ভাষা, ত্রিপুরা ভাষা সহ নানা নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে আগ্রহ ছিল। উর্দু কবিতার প্রসারে যেমন ভ‚মিকা নিয়েছিলেন, তেমনি তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল নানা নৃগোষ্ঠীর ভাষায় লেখা কবিতার সঙ্গে বাংলাভাষীদের বিনিময়ের। সেটি তিনি আর করে যেতে পারেননি। একুশের স্পিরিটকে আসাদ চৌধুরী কীভাবে মনে প্রাণে ধারণ করতেন সেটি আপনার আলোচনায় এসেছে চমৎকারভাবে।
আরেকটি বিষয় বলতে চাই, পার্টিশন লিটারেচার কথাসাহিত্যে যতটা এসেছে, কবিতায় একেবারেই তা আসেনি। কিন্তু বাংলাদেশের উর্দু কবিতা তার ব্যতিক্রম। সেখানে এই বিষয়টা দারুণভাবে এসেছে। কাজেই বাংলাদেশের উর্দু কবিদের কবিতা অনুবাদের মাধ্যমে আসাদ চৌধুরী খুব অনন্য ভ‚মিকা রেখেছিলেন তা বলাই যায়। “বাড়ির কাছে আরশিনগর” বইটায় আসাদ চৌধুরীর অনুবাদ এবং উর্দু কবিদের নিয়ে শুনতে চাই, জাভেদ ভাই।
জাভেদ হুসেন: মূল কথাটা আমি আগেই বলে দিয়েছি যে, আসাদ চৌধুরী ভিন্ন ভাষার কবিদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র টের পেতেন, অনুভব করতেন। আমার মনে আছে, এই ভালোবাসাটা গড়ে উঠেছিল আরো আগে থেকে। তাঁর ঘনিষ্ঠতম বাংলাদেশের উর্দু কবি বন্ধু নওশাদ নূরীর ১৯৫২ সনে লেখা কবিতা, মতান্তরে সেটি ১৯৫২তে লেখা প্রথম কবিতাগুলোর মধ্যে একটা, ৫২র মার্চের পরপরই করাচীর “আফকার” নামে একটি উর্দু পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল। কবিতার নাম ছিল “মহেঞ্জোদারো”। এই উর্দু কবিতাটিতে ৫২ সনেই নূরী বাঙালিদেরকে ডেকে বলছেন – তোমাদের ভাষা, তোমাদের উপকথা, তোমাদের লোকগাথা, তোমাদের প্রবাদ প্রবচন, কবিতা যা আছে সবকিছু কাগজে পুঁথিতে কাদায় প্যাপিরাসে পাথরে লোহায় কাঠে খোদাই করে রাখো। কারণ মহেঞ্জোদারো, হাজার বছর আগে কোন এক দুর্যোগে যে হারিয়ে গেছে সভ্যতা, যেখানকার লেখা ভাষা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কী জানি, তোমাদের ভাষার ওপরেও, তোমাদের দেশেও এরকম কোনো বালা, এরকম কোনো দুর্যোগ, এমন কোনো বিপদ হয়তো আবার ঘনিয়ে আসতে যাচ্ছে। এই কবিতাটি লেখবার পর নওশাদ নূরী ভারত থেকে পালিয়ে বর্তমানের বাংলাদেশে এসেছিলেন কারণ যখন জওহরলাল নেহরু আমেরিকা যাচ্ছেন তখন জোট নিরপেক্ষতার নীতি ছাপার কারণে জওহরলাল নেহেরুকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটার নাম ছিল – দে দে রাম, দে লা দে রাম। দেনেওয়ালা সীতারাম। ভিক্ষুকরা যেভাবে ভিক্ষা চায়, সেইভাবে একখানি কবিতা লিখেছিলেন নেহরুকে নিয়ে বিদ্রুপ করে। এত জনপ্রিয় হয়ে গেছিল কবিতাটি যে তখনকার সময়ে ট্রেনের মধ্যে, বাসস্ট্যান্ডে, পথে পথে বাউলরা, ভিক্ষুকরা সেই গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করতো। এবং এ কবিতাটি সরাসরি নওশাদ নূরী পাঠ করেছিলেন সম্ভবতঃ ৪৮-৪৯ এ বিহারের পাটনাতে সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘের একটা সমাবেশের মধ্যে। পরবর্তীতে এই কবিতাটি লেখার দায়ে হুলিয়া জারি হয়। তখন তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। এইখানে এসে ১৯৫২ সনে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কবিতা লেখার অপরাধে তাঁকে পুনরায় দেশ ছেড়ে পালাতে হয় কোলকাতায়। যেখান থেকে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন এখানে, এখান থেকে আবার পালিয়ে সেখানে যেতে হলো তাঁকে, সরকারি চাকরিও তিনি হারালেন। এই কবি নওশাদ নূরী ছিলেন আসাদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে একজন। কবির আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শামীম জামানভী। ৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের পক্ষে এই নওশাদ নূরীরা সরাসরি ৬ দফা উর্দুতে অনুবাদ করে ছাপিয়ে লিফলেট বিলি করেছেন। লিফলেট বিলি করার দায়ে কয়েকজনকে জেলও খাটতে হয়েছে। আসাদ চৌধুরী জানতেন যে, শুধুমাত্র একটা ভাষাকে, কোনো একটা জনগোষ্ঠীকে ঢালাও বিচার করার জন্য কোনো একটা ঘটনা দিয়ে সেটাকে বিচার করা যায় না। এবং তিনি এও জানতেন, যখন একটা জাতিগোষ্ঠী একটা ভাষাগোষ্ঠী একটা রাষ্ট্রের মালিক হয়, সেই রাষ্ট্রের মালিক হওয়া মানে দায় বেশি হয়ে যায় ঐ রাষ্ট্রে যারা সংখ্যালঘু থাকে তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা? অর্থাৎ মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে যদি কিছু বোঝেন, প্রথমত যাচাই করতে হবে আপনার মতের বিরুদ্ধে যাঁরা বলছেন তাঁদের মতকে। ঠিক তেমনি ভাষার স্বাধীনতা যদি আপনি নিশ্চিত করতে চান, তাহলে প্রথমেই আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে আপনার ভাষায় আপনার দেশে যাঁরা কথা বলেন না, তাঁদের ভাষা নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে। আমি আসাদ চৌধুরী ছাড়া আমার আশপাশে আর কাউকে, অন্য কোনো কবিকে দেখিনি এমনভাবে বিষয়টা ধারণ করতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সরাসরি যিনি যুক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত স্পিরিট ৫২র প্রকৃত স্পিরিট যাকে বলে সেটাকেই তিনি প্রকৃত অর্থে বহন করে গেছেন ঠিক তাদের ভাষা, নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার নিশ্চিত করবার প্রয়াসে সরাসরি যুক্ত থেকে। এবং সেই যুক্ত থাকার প্রয়াস হিসেবেই তিনি করেছিলেন, বাংলাদেশের উর্দু কবিদের কবিতার সংকলন “বাড়ির কাছে আরশিনগর।” সেই বইটির মুদ্রন বহু আগেই নি:শেষিত। শামীম জামানভীকে বাংলাদেশের প্রধান বড়ো কবিদের একজন বলে আমি মনে করি। উনি বেঁচে আছেন, ইকবাল রোডে থাকেন। শামীম জামানভী ছিলেন আসাদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। “বাড়ির কাছ্র আরশিনগর” অনুবাদের সময় শামীম ভীষণভাবে অনুবাদ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এবং আসাদ চৌধুরীর ইচ্ছে ছিল পরবর্তী সংস্করণের সময় আমি তাঁর সাথে কাজ করি, যাতে তিনি আগেরবার বাদ পড়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কবিতার অনুবাদও যুক্ত করবেন। সেটি আর করা গেল না। তবে আমার মনে হয়, বইটাকে পুনরায় প্রকাশ করবার একটা উদ্যোগ আমাদের নেওয়া উচিত। কারণ আসাদ চৌধুরীর যে পরিচয় আমরা সবচেয়ে কম জানি, কিন্তু তাঁর কবিতার ভালোবাসার উঠোনের মধ্যে যে মানুষের যে কবিতার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঠাঁই ছিল, একটা আসন ছিল তাঁর কবিতার জগতের আঙিনায় সেই উঠোনে নওশাদ নূরীদের, শামীম জামানভীদের অনেক বড়ো একটা জায়গা ছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মানুষগুলো। ঐ কবিতার জগতটাতে তিনি প্রবল আনন্দের সঙ্গে বিচরণ করে বেড়াতেন। ফলে এই বইটা আরেকবার মুদ্রিত হওয়া খুব জরুরি বলে আমি মনে করি। যখনই মনে হয় বইটার কথা, আসাদ চৌধুরীর কথা এবং আমি যখন দেখি বাংলাদেশে আর ৪-৫ জন উর্দু কবি বাকি আছেন এখনো নিষ্ঠা এবং যোগ্যতার সঙ্গে উর্দু কবিতা লেখেন, এবং আমি যখন দেখতে পাই ঐ ৪-৫জন কবি চলে যাবার পর বাংলাদেশে উর্দু ভাষায় আর কেউ কবিতা লিখবে না, চোখের সামনে আমাদের একটা ভাষা, সে ভাষার কবিতার মৃত্যু ঘটবে, আমরা সাক্ষী থাকব। তখন আমার মনে হয় আসাদ চৌধুরীর প্রয়োজনের কথা। উনি বেঁচে থাকলে এই মানুষগুলোকে আরেকটু উৎসাহ দিয়ে একটা ভাষার মৃত্যুকে আরো কিছুদিন বোধহয় ঠেকিয়ে রাখতে পারতেন? তখন আমার মনে পড়ে মীর ত্বকী মীরের বিখ্যাত একটা শের – “আয়ি বাহার গুলশান গুলসে ভরা হ্যায় লেকিন হার গোশায়ে চমন খালি হ্যায় যায়ে বুলবুল।” “বসন্ত এসে গেছে। ফুলবাগান ফুলে ফুলে ভরে গেছে। তবু প্রতিটা ফুলবাগানের প্রতিটা কলি বলছে একটা গানের পাখির জায়গা ফাঁকা রয়ে গেল।”
ফারহানা আজিম শিউলী: আসাদ চৌধুরী অনূদিত “ফিলিস্তিন ও প্রতিবেশী দেশের প্রতিবাদী আরবী কবিতা”য় আছে ২১জন কবির কবিতার অনুবাদ। এর মধ্যে আছেন মাহমুদ দারবিশ, ফাদওয়া তুকানের মতো কবির কবিতা। ইজরাইলের সেনাপ্রধান মোশে দায়ান বলেছিলেন, ফাদওয়া তুকানের এক একটি কবিতা বিশটি কমান্ডোর মতো কাজ করে।
আরবকবি আবদুল্লাহ আল আজহারির ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত “The Modern Poetry of the Arab World” ও আরব-আমেরিকান কবি ও সম্পাদক নাওমি শিহাব নাই’র (দু’বার বাংলাদেশে এসেছিলেন) ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত ঞযব ঝধসব ঝশু এই দুটি বই থেকে অধিকাংশ কবিতা নেওয়া।
মজার ব্যাপার, কবি সাত্তার (আরবি থেকে) অনূদিত মধ্য ৬০-এ প্রকাশিত “আরবী কবিতা”র কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন প্রকাশক।
এ পর্যায়ে আসাদ চৌধুরী অনূদিত মাহমুদ দারবিশের “নৃশংসতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি” ও ফাদওয়া তুকানের “দেশের ডাক” পাঠ করে শোনানো হয়।
Selected Poems of Asad Chowdhury বইয়ে আছে কবির ১১৮টা কবিতা বিভিন্ন অনুবাদকের অনুবাদে। কবীর চৌধুরী অনুবাদ করেছেন রিপোর্ট ১৯৭১, বারবারা বিডলারকে, Glimpses নামে চোখ সিরিজের কবিতাসহ আরো বেশ কয়েকটি কবিতা। “ফাগুন এলেই” 21st February নামে অনুবাদ করেছেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। আফ্রিকা কবিতাটি Africa, My Soul Brother নামে অনুবাদ করেছেন আফসান চৌধুরী। কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা, সুরেশ রঞ্জন বসাক অনুবাদ করেছেন বেশ কয়েকটি কবিতা। মিজারুল কায়েস করেছেন। তাজ বৃষ্টিতে ভিজছে কবিতাটি The Taj is Getting Soacked in Rain নামে অনুবাদ করেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক মো: হারুনুর রশীদ বইটির ভ‚মিকা লিখেছেন ও বেশ কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেছেন।
আলোচনার এ পর্যায়ে আসাদ চৌধুরীর লেখা শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বইগুলোর প্রচ্ছদ ভিডিওক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়। বইগুলো হচ্ছে – ১) গ্রামবাংলার গল্প ২) গ্রামবাংলার আরো গল্প ৩) মুচি ভ‚তের গল্প ৪) সোনার খড়ম ৫) চান্দু চোর ও রাজা চকোর ৬) গল্প থেকে গল্প ৭) তিন রসরাজের আড্ডা ৮) দুখিয়ার গল্প ৯) কথার মধ্যে অন্য কথা ১০) বুট জুতো পায়ে বিড়াল ১১) কাক পানি নিয়ে ফিরে এল ১২) মাকড়সার জন্মবৃত্তান্ত ১৩) মায়ের ভালোবাসা ১৪) কৌতুকরাজ তেনালিরামের গল্প ১৫) গালগল্প ১৬) লম্বা লেজঅলা পাখি ১৭) রাজা বাদশার গল্প ১৮) এককা দোককা ১৯) গর্ব আমার অনেক কিছুর ২০) বিলেতি ছড়া ২১) শতদলের মাঝখানে ২২) কেশবতী রাজকন্যা ২৩) এন্ডারসনের কয়েকটি রূপকথার গল্প ২৪) তুষার কণা ২৫) ডাইনির খপ্পরে রাপুনজেল ২৬) রাজার নতুন জামা ২৭) ভিনদেশের মজার মজার লোককাহিনী ২৮) রসরাজ বীরবলের গল্প ২৯) মোল্লা নাসিরুদ্দীন ও গুলজান বিবির কিসসা ৩০) কাছিম ও দুটি হাঁসের কথা ৩১) সাহসী এক রাজকন্যার গল্প ৩২) তোমাদের প্রিয় চার শিল্পী ৩৩) মিকালেঞ্জেলো ৩৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোককাহিনী ৩৫) জোয়ান অব আর্ক ৩৬) মাদাম কুরির শৈশব ৩৭) সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪। বাংলা একাডেমি। সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু আবার মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি থেকে ছাপা হয়। ৩৮) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৮৩। বাংলা একাডেমি। ৩৯) ছোট্ট রাজপুত্র ৪০) অন্য দেশের লোককাহিনি ৪১) ছোটদের মজার গল্প ৪২) উত্তরের বাতাস ৪৩) রাজকন্যা ও একটি মটরশুঁটি ৪৪) এ শুধু গল্প নয় ৪৫) তোমাদের জন্য আমার প্রিয় পাঁচটি গল্প ৪৬) সোনালি পাখির গল্প ৪৭) তোমাদের প্রিয় গল্প ৪৮) তিন রসরাজের রাজ-দরবারে প্রবেশের গল্প ৪৯) চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন ৫০) চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো ৫১) চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৫২) চিত্রশিল্পী রাফায়েল সেনজিও দ্য আরবিনো ৫৩) কিশোরসমগ্র ৩ খণ্ড। অনিন্দ্য প্রকাশনী। তরুণ কবিবন্ধু পিয়াস মজিদের বইটি প্রকাশে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেছেন কবি সাফাইতে।
সব বইয়ের ছবি সংগ্রহ করা যায়নি। এর বাইরেও বই আছে। তবে অধিকাংশ বইগুলোর রচনা একসঙ্গে আছে সমগ্রতে।
ফারহানা আজিম শিউলী: আসাদ চৌধুরীর কবিতার পাশাপাশি প্রচুর শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, অবন ঠাকুর, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারকে একরকম আদর্শই মেনেছেন। তাঁর জীবনের প্রথম প্রবন্ধও সুকুমার রায়কে নিয়ে লেখা।
আসাদ চৌধুরীর প্রথম বই কিন্তু “তবক দেওয়া পান” নয়। ১৯৭৪ সালে তাঁর প্রথম বই “সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু” ছোটদের জন্য লেখা।
তিনি এন্ডারসন, গ্রিম ব্রাদার্স এর শতবর্ষে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছোটদের জন্য বই লিখেছেন। বীরবল, মোল্লাকে নিয়ে আগেই লিখেছেন মোহাম্মদ নাসির আলী, কিন্তু আফেন্দীর গল্প (ইংরেজি থেকে অনুবাদ) ও দক্ষিণ ভারতের তেনালী রামের গল্প অনুবাদ প্রথম করেন আসাদ চৌধুরী? বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচলিত গল্প থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানান দেশের নানান অঞ্চলের লোককাহিনি, রূপকথা, গ্রীস সহ আরো নানান দেশের পুরাণের গল্প, ভারতের লেপচা নৃগোষ্ঠী আফ্রিকার ডাগোম্বা ভাষাগোষ্ঠীর লোককাহিনি থেকে বার্মিজ ফোক টেলস – কী না লিখেছেন!
কবিতার মতো শিশু সাহিত্যেও প্রচুর স্থানীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেমন – অতিথ-বিতিথ, আগু জামানা, কাৎরা, ঘেরান, ছাও, জুত, জেব, ঠোনা, ডাঙর, তকলি, তজদিগ, তাজিম, তামাম, তালাশ, দান-দেহাজ, দোনা, নওশা, নলা, মুরগির পর, পিন্ধ, পোলা, ফাল, বদনসিব, বিজলি-ঠাডা, বেহতর, ব্যানা, ময়াল, মঞ্জিল, মেহনত, শুলুক ইত্যাদি।
মাযহার ভাই, আপনার কাছ থেকে আসাদ চৌধুরী শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে শুনতে চাই।
আহমাদ মাযহার: ঠিকই বলেছেন। আসাদ চৌধুরী শুধু কবি ছিলেন না, তিনি বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ শিশু সাহিত্যিক এ কথাটা বলতে হবে। যেভাবে জাভেদ হুসেন বললেন, বাংলা ভাষা বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্য চর্চায় কবি তাঁর শরীর মন এবং সমস্ত সত্তা দিয়ে ছিলেন, ঠিক একইভাবে শিশু সাহিত্য চর্চায়ও ছিলেন। যেভাবে তিনি কবিতায় ছিলেন, যেভাবে কবি-প্রাণ মানুষের সঙ্গে তিনি মিশতেন সারা বাংলাদেশে, ঠিক একইভাবে ছিলেন শিশু-কিশোর সাহিত্যেও। আমি এইকথাগুলো বলে নিচ্ছি এই কারণে যে, একটা মানুষের সমগ্র সত্তা দেখা যায় যখন তাঁর জীবনবৃত্ত শেষ হয়। আর কবি আসাদ চৌধুরী এতো বিস্তৃত ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে কর্ম দিয়ে নানানভাবে যে, তাঁর বিস্তারের মধ্যে অনেকটা আমরা অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো একেকজন একেক দিক দেখেছি। সমগ্র আসাদ চৌধুরীকে কিন্তু আমরা দেখিনি। দেখার জন্য যে মন লাগে, সেই মন দিয়ে দেখা হয়নি। তিনি নিজে খুব বিনয়ী মানুষ ছিলেন। উর্দু সংস্কৃতিতে “তাহজিব” একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেটি তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল। “লোকজ” জীবন কথাটা বলার মধ্যে একধরনের “অপর” করে দেওয়ার ব্যাপার থাকে, প্রান্তিক করে দেওয়ার ব্যাপার থাকে। আমি সেই দিক থেকে দেখতে চাচ্ছি না, আমি বলতে চাচ্ছি যে আমাদের আবহমান বাংলাদেশের জীবন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যে হৃদয়বাদীতা তৈরি হয়েছে, তার যে প্রতিনিধিত্ব সেই অর্থে আমি লোকজ কথাটা ব্যবহার করছি। আবদুল মান্নান সৈয়দ যেই অর্থে বলেছিলেন দেশজ। অর্থাৎ আমি দেশজ অর্থে লোকজ কথাটা ব্যবহার করছি। সুতরাং ফোকলোর যে অর্থে বলা হয়, সেভাবে না-বলে এটাকে একটা আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হিসেবে দেখতে চাচ্ছি। আসাদ চৌধুরীর ব্যক্তিত্বের মধ্যে এই দেশজ হৃদয়ের আধুনিক পরিশীলনের ছবি পাওয়া যায়। এই কথাটা আমি আবেদীন কাদেরের আধুনিকতা নিয়ে যেই দীর্ঘ আলোচনা তার সঙ্গে যোগ হিসেবে শুধু দিচ্ছি। আমি ঐ কথাগুলোকে মনে রাখতে বলছি আসাদ চৌধুরীর শিশু সাহিত্য চর্চার সঙ্গে। কারণ আমরা যদি আবহমান বাংলা কবিতা বা বাংলা ভাষার সাহিত্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আগের যুগ থেকে বহন করে নিয়ে আসা অর্থে দেখি, তাহলে আসাদ চৌধুরী বাংলা শিশু সাহিত্যেও একইভাবে আমাদের আবহমান জীবনের মধ্য থেকে রস গ্রহণ করে, জীবনদৃষ্টি গ্রহণ করে আবহমানতার সঙ্গে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিত করতে পেরেছেন। মনে রাখতে হবে, আসাদ চৌধুরী কিছু সময় ইউরোপেও বসবাস করেছেন। তিনি শুধু বসবাস করেননি, সেখানকার জনজীবনের সার তিনি গ্রহণ করেছেন এবং সেই গ্রহণ তাঁর শুধু গ্রহণই থাকেনি, তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে সেসবের চিহ্ন আছে। আমাদের যেহেতু ঐ ধরনের সৎ সাহিত্য গবেষণা হয় না, এই কারণে আমরা এগুলো পাই না। যেমন আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর প্রচুর লেখা হয়েছে, কিন্তু অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো। তাঁকে সামগ্রিকভাবে দেখার চেষ্টা খুব বেশি আমরা পাইনি। তার কারণ, আমাদের চলার পথের যে অর্জনগুলো, সেই অর্জনগুলোর কথা আমরা সৎভাবে বলি না। কোথাও যেন একটা আনুষ্ঠানিকতা করতে চাই।
মুশায়রাতে আসাদ চৌধুরী থাকতেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আশির দশকে যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তন মাত্র শুরু হয়েছে, সেইসময় পরপর বেশ কিছুদিন অনেকগুলো মুশায়রার আয়োজনে থাকবার। আমার সঙ্গে আহমদ ইলিয়াসের পরিচয় ছিল? নওশাদ নূরীকেও আমি দেখেছি। উর্দু সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটা যোগ কিন্তু আগে থেকেই ছিল। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন জাগরণ চিন্তার দিকে বিকশিত হচ্ছে, তখন তার সঙ্গে উর্দু সাহিত্যের একটা যোগ ছিল। এটাও আমার মনে হয় পরীক্ষা করে দেখার বিষয় আছে। ইকবাল খুবই প্রাসঙ্গিক ছিলেন এবং আমরা এখনও বাংলা ভাষায় ইকবাল নিয়ে, গালিব নিয়ে চর্চা প্রচুর দেখব। তাতে বোঝা যায় যে, এটি এমনি এমনি হয়নি। আমাদের অন্ত:শীল ধারায় এটি আছে। আমি এই জিনিসগুলোকে যোগ করে নিতে চাচ্ছি এই কারণে, আসাদ চৌধুরীর শিশু সাহিত্যিক সত্তাটাকে বুঝতে গেলে এই জায়গাটাকেও মনে রাখতে হবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আসাদ চৌধুরীর শিশুসাহিত্যে বিষয় বৈচিত্র্য আছে। যেমন একদম প্রথমদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।” আশির দশকে যখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইপত্র প্রায় পাওয়া যায় না এবং আমি একটা তালিকা করতে গিয়ে হাতে গোনা মাত্র ১০-১২টা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই পেয়েছি, আর ছোটদের বইতো প্রায় নাইই বলতে গেলে সেরকম। সেখানে কিন্তু তিনি লিখেছেন। এবং সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু বইটাও কিন্তু তাঁর অনেক আগের লেখা। এই বইটার কথা আমরা প্রচারিত হতে তেমন দেখিনি। এই বইগুলোতেও আধুনিক পরিশীলিত দেশজ হৃদয়বাদীতা, ছোট ছোট বাক্য এবং কথকের ভঙ্গিতে বলা দেখতে পাই।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, আমাদের সাহিত্যের যাঁরা তত্ত¡ বিচার করতে চেয়েছেন তাঁরা হয় নন্দনবাদীতা দিয়ে বিচার করতে চেয়েছেন, না হয় দর্শন দিয়ে বিচার করতে চেয়েছেন। আমার ধারণা ধারাবাহিকভাবে প্রাচীন বাংলা কবিতা থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা কবিতা পর্যন্ত একটা নন্দনবোধ, একটা নন্দনতত্ত¡ হাজির করা যায়। এইসব নন্দন বোধের অনুসঙ্গ যাঁদের সৃজনশীলতায় আছে আসাদ চৌধুরী তাঁদের মধ্যে বিশিষ্টতম এবং একটু বেদনার সঙ্গেই আমি লক্ষ্য করেছি, আমাদের আধুনিক সাহিত্যিক সমাজ তাঁকে মূল্য দেননি। তাঁকে একজন উপস্থাপক হিসেবে কেউ হয়তো কদর করেছেন, অতিথি হিসেবে তিনি সমাদরণীয়। তাঁকে পাওয়া যায় এটাও তুচ্ছার্থে, এলিটিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়েছে।
তাঁর লেখায় খেয়াল করলে দেখা যায়, তিনি সকলের উদ্দেশ্যে কথা বলছেন, লক্ষ্য ছোটরা কিন্তু শুধু ছোটরাই নয়। তাঁর জীবনবোধকেই তিনি লেখায় তুলে ধরেছেন। আমাদের শিশু সাহিত্যেকেরা যথার্থ সামগ্রিক জীবনবোধের তাত্তি¡ক চোখ দিয়ে আসাদ চৌধুরীকে না-দেখা পর্যন্ত আসাদ চৌধুরীকে চেনা যাবে না। সাহিত্যের রসগ্রাহিতার দিকটিও ঠিকভাবে ধরা যাবে না।
ছোটরা ভালোবেসেছে তাঁর রচনা। ছোটদের জন্য তিনি প্রায় ৫০টির মতো বই লিখেছেন। এর মধ্যে সংকলনও আছে। আমি এর মধ্যে জসিমউদদীনকে স্মরণ করব। তাঁর ধারা আমাদের আধুনিক সাহিত্য চর্চায় অঙ্গীভ‚ত করে নিয়ে যে আধুনিক করে তোলা সেটি আমরা জসিমউদদীনের শিশু সাহিত্যের পরে আসাদ চৌধুরীকে দেখেছি। আরেকটা জিনিসও দেখতে পাই। সেটা হচ্ছে বিশ্ব চেতনার সঙ্গে আমাদের জীবনকে যুক্ত করা।
এই যে তিনি শিল্পীদের সম্পর্কে লিখেছেন, অনেকে হয়তো বলবেন তিনি অনুরোধে লিখে দিয়েছেন। আমি তা মনে করি না। তাঁর মধ্যে তৃষ্ণাটা ছিল, সেই তৃষ্ণা প্রকাশে আহবান এলে তিনি এই মাধ্যমে সৎভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
আসাদ চৌধুরীর সাহিত্যকর্মকে ঠিকমতো বোঝার জন্য যে সমাজ দরকার, আমাদের সাহিত্য সমাজ সেই পর্যায়ের উত্তীর্ণ সাহিত্য সমাজ হয়ে ওঠেনি। যে কারণে আসাদ চৌধুরীর শিশু সাহিত্যকে খুব একটা সুচিন্তিত রচনা বলে মনে করা হয় না।
৩ খণ্ডের সমগ্রে কবি হাসান হাফিজের ভ‚মিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং আসাদ চৌধুরীর আরেকটা গুণ বলতে হবে। তিনি তাঁর প্রত্যেকটা সৃজন পদক্ষেপে জড়িত প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। কিন্তু অন্যরা তাঁর প্রত্যক্ষ ও বিপুল সহযোগিতা পেয়েও তাঁকে স্মরণ করেননি। তার কারণ পূর্বসূরীদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এগিয়ে যাওয়া থেকে আমাদের আধুনিকতার বোধ আমাদেরকে বিযুক্ত করেছে। তিনি সেতুর মতো এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করেছেন। এই কথাগুলো বলার কারণ তাঁর লেখা জীবনীগুলো।
যে ভাষা থেকে আমরা রূপান্তরিত হয়েছি, সেই ভাষা কিন্তু আমাদের জীবনের সঙ্গে আছে। সেটাকে যুক্ত করা না-গেলে আমরা আমাদের ভাষার ঐতিহ্যকে ঠিকমতো চিহ্নিত করতে পারব না। সেদিক থেকেই আমি মনে করি আসাদ চৌধুরীর শিশুসাহিত্য বিবেচনা করে দেখা দরকার। আমার ইচ্ছে আছে আসাদ চৌধুরীর শিশু সাহিত্য নিয়ে লেখালেখি করার। প্রসঙ্গত বলে রাখি, হাসান হাফিজ একটা লেখা লিখেছেন। তিনি কিছুটা আসাদ চৌধুরীর লেখার অনুপুঙখহে গেছেন। এছাড়া আসাদ চৌধুরীর শিশু সাহিত্য সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্যিভঙ্গির কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি।
ফারহানা আজিম শিউলী: মিলান কুন্ডেরা বলেন সাহিত্য হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। আসাদ চৌধুরী ঠিক তেমনি তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে জারি রাখেন সে সংগ্রাম। পিয়াস মজিদ তাঁকে স্মৃতিসূত্রের কবি বলে লিখেছেন – তাঁর স্মৃতিসূত্র শনাক্তকরণের মধ্য দিয়ে হয়তো সামগ্রিকভাবে আমাদের কবিতার এক গতিমুখেরও সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে পিয়াস উল্লেখ করেন শহীদের প্রতি, মফস্বল, হায় দুয়োরানী, স্মরণের মীড়ে ধীরেন ইত্যাদি কবিতা।
আসাদ চৌধুরী কবিতা উৎসর্গ করেছেন অনেকের নামে। আবার কবিতা লিখেছেন অনেককে নিয়ে। এঁদের মধ্যে আছেন, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আজাদ সুলতান, আবদুল আলীম, আবদুল লতিফ, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল বারাক আলভী, আবুল হাসান, আব্বাসউদ্দীন, অধ্যাপক রাজ্জাক, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আলতাফ মাহমুদ, আহমদ ছফা, ইমদাদুল হক মিলন, ইলা মিত্র, উদীচীর কর্মী, ওয়াহিদুল হক, কমরেড আসাদুজ্জামান, কলিম শরাফী, কাননবালা, কানাইলাল শীল, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, জসীম উদ্দীন, জাহানারা ইমাম, জীবনানন্দ, মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার জুয়েল, টিপু শাহ, ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, তারামন বিবি, তিতুমির, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, দ্বিজেন শর্মা, দেশবন্ধু, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, নির্মলেন্দু গুণ, নূর হোসেন, পান্না লাল, পাবলো নেরুদা, পূর্নেন্দু পত্রী, বুদ্ধদেব বসু, বেগম সুফিয়া কামাল, বেবী মওদুদ, বেলাল চৌধুরী, বেহাল শাহ, মওলানা ভাসানী, মজনু শা, মাস্টার দা, মনোমোহন দত্ত, মহাদেব সাহা, মাসুক হেলাল, মির্জা গালিব, মীর ত্বকী মীর, মুকুন্দ দাস, মুনীর চৌধুরী, মোকসেদ আলি সাঁই, রফিক আজাদ, রমেশ শীল, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শঙখ ঘোষ, শহীদ কাদরী, শেরে বাংলা, সমুদ্র গুপ্ত, সুচিত্রা সেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হক, হরিপদ কাপালী, হেলাল হাফিজ সহ আরো অনেকে।
এ পর্যায়ে কবির অত্যন্ত প্রীতিভাজন আহমদ ছফাকে নিয়ে লেখা “যার গৈ” কবিতাটি খসরু চৌধুরীর কণ্ঠে অডিওক্লিপ বাজিয়ে শোনানো হয়।
এরপর কবিতা, কিশোর সাহিত্য ছাড়া আসাদ চৌধুরীর অন্যান্য রচনার প্রচ্ছদ ভিডিওক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়। বইগুলো হচ্ছে:
প্রবন্ধ – ১) কোন অলকার ফুল । মে ১৯৮২। বাংলা একাডেমি। প্রচ্ছদ – কাইয়ুম চৌধুরী। এই বই মুজতবা আলী, বুদ্ধদেব বসু, ফররুখ আহমেদ, আলাউদ্দিন খাঁ, জসীমউদ্দিন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ, সংস্কৃতির বিকাশধারা, এস এম সুলতান, আব্বাসউদ্দীন – এঁদের নিয়ে লেখা। ২) স্মৃতি-সত্তার যুগলবন্দী। ২০০১। বাংলা একাডেমি। বিবিধ বিষয়ক প্রবন্ধ। ৩) সিংহাসন জেগে ওঠে। ২০০৪। বিবিধ বিষয়ক প্রবন্ধ। সূচীপত্র প্রকাশনী। ৪) মনে পড়ে যায়। অক্টোবর ২০১৫। ৫) হরেক রকম প্রবন্ধ। ২০২২। দ্যু প্রকাশন।
গল্প – ৬) মধ্যবিত্ত ও অন্যান্য গল্প। ফেব্রæয়ারি ২০০৬। মিজান পাবলিশার্স। শিরোনাম গল্পটি লেখেন ষাটের মাঝামাঝি সময়ে। পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “শ্রেষ্ঠ বাংলা ছোট গল্প” বইয়ে স্থান পায়।
জীবনী – ৭) রজনীকান্ত সেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯। বাংলা একাডেমি। প্রচ্ছদশিল্পী সমর মজুমদার। ৮) আবুল হাশিম – বাউণ্ডুলে পাবলিকেশন্স। ২০২২। ত্রিদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একজন অবিস্মরনীয় রাজনৈতিক নেতা আবুল হাশিমকে নিয়ে লেখা বই। এদেশের রাজনীতির গতিপথ, মুসলীম লীগের ইতিহাস, স্বাধীনতার রূপরেখা, রবুবিয়াতের প্রসার ও প্রচার বুঝতে বইটি একান্ত পাঠ্য। ৯) নৃত্যশিল্পের বিস্ময় বুলবুল চৌধুরী। বইমেলা ২০২২।
১০) আবদুল গাফফার চৌধুরী: একুশের গান ও আড্ডা। ২০১৫। প্রিয়মুখ প্রকাশনা।
সংকলন – ১১) বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক নির্বাচিত কবিতা ও গদ্যের সংকলন। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রকাশনা সিরিজ। ঐতিহ্য। ১২) আমার বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা উল্লেখযোগ্য স্মৃতিগদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ নিয়ে সংকলন। ২০২০। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রকাশনা সিরিজ। য়ারোয়া বুক কর্ণার।
স্মৃতিগদ্য – ১৩) চুম্বন করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে। একুশে বাংলা প্রকাশন, বইমেলা ২০০৬। বইয়ের নামটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার চরণ। বিভিন্ন বিষয়ে, প্রিয় প্রসঙ্গে লেখা। ১৪) নয়ন সমুখে তুমি নাই। ম প্রকাশন, বইমেলা ২০১৫। কাছের কিছু বড়ো মানুষের প্রস্থানে শ্রদ্ধাঞ্জলি। মনোমোহন দত্ত, আহমাদ ফারাজ, আবদুল লতিফ, সেলিনা বানু, শামসুর রাহমান – এঁদের নিয়ে লেখা। ১৫) স্মৃতির শেকড় ও ডানা। অক্ষরপত্র প্রকাশনী। ২০১৬। উল্লেখযোগ্য বাঙালি ব্যক্তিত্বদের নিয়ে। ১৬) স্মৃতিগুলো সুখের ছিল। ২০১৮। সুবর্ণ প্রকাশনী।
ভ্রমণ গদ্য – ১৭) এ ভ্রমন আর কিছু নয়। উৎস প্রকাশন। ২০১০। এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া – আবুল হাসানের কবিতার লাইন ছোট করে কবি হেলাল হাফিজ এই নাম দেন। লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ‘’দৈনিক দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য পাতায়।
আসাদ চৌধুরীকে নিয়ে লেখা বই – “আসাদ চৌধুরী কহেন।” ফেব্রæয়ারি ২০২৩। নির্বাচিত সাক্ষাৎকার, আলাপচারিতা নিয়ে। সংকলন ও সম্পাদনা: রাকিবুজ্জামান লিয়াদ।
ফারহানা আজিম শিউলী: কবিতা, অনুবাদ কবিতা, শিশু-কিশোর সাহিত্য ছাড়াও আসাদ চৌধুরী ধারাবাহিকভাবে লিখে গেছেন গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতি গদ্য, ভ্রমণ গদ্য, জীবনী ইত্যাদি। মাযহার ভাই, এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
আহমাদ মাযহার: আসাদ ভাই আমাদের চলমান সাহিত্য ধারার প্রতিনিধি, আর কারা কোথায় সাহিত্যচর্চা করছেন এরকম সাহিত্যসমাজের অনেক প্রান্তিক মানুষদের নিয়েও তিনি লিখেছেন এবং বহু জায়গায় তিনি গিয়েছেন। সেইসব কথা তিনি লিখেছেন। এই ধরনের লেখা যে তিনি এতো লিখেছেন তা কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারিনি। আমার মনে হয়, আসাদ চৌধুরীর গল্প ছাড়াই শুধুমাত্র যদি বিচিত্র ধরনের গদ্যের একটি সংকলন করা হয়, তাহলে আমাদের সাহিত্য সমাজ আমাদের সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যাঁরা হয়তো গনমাধ্যমে একটা সময় পরিচিত ছিলেন কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে বিশদভাবে জানা যায় না তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারবে। এমন মানুষদের সম্পর্কে তিনি ব্যক্তিগতভাবে জানতেন। তিনি যেভাবে জানতেন সেভাবে কথাগুলো বলা হলে আমরা সেই ব্যক্তিদের জীবনের সুবাস পাব। তাঁর বিবিধ গদ্যের ব্যাপারটা কিন্তু তাই। আমি একটা বিষয়ের অভাব অনুভব করি। আমাদের সাহিত্যিকদের জীবনযাত্রা নিয়ে কিন্তু আমরা বলতে খুব একটা পছন্দ করি না। অথচ আমেরিকাতে বসবাস করতে এসে আমি যখন লেখকদের সঙ্গে কথা বলি, তখন আমি দেখি যে, প্রত্যেকেই প্রায় কোনো না কোনো সূত্রে মেমোয়ার লেখেন। কী কারণে? মেমোয়ার লেখেন চিন্তা এবং জীবনের সম্পর্ককে প্রকাশ করবার জন্য। যার ফলে আমাদের জীবনের বোধ একটা উত্তরাধিকারের কাছে পৌঁছে দেবার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। আবার একইরকমভাবে আমাদের পূর্বসূরী যাঁরা কথা বলেছেন, সেইসব কথা থেকে আমরা সার গ্রহণ করতে পারি। এই দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব বেশি নাই। এর একটা কারণ আমার মনে হয় আমাদের আধুনিকতাবোধ বিশেষ করে আমাদের ৬০-৭০ দশকের আধুনিকতাবোধে শুধু নির্বাচিত বাছাইকৃত এবং শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ অংশটুকু রাখব এমন একটা মানসিকতা আমাদের নন্দন ভাবনার মধ্যে, আমাদের জীবন ভাবনার মধ্যে আছে। যেমন ধরা যাক আমাদের বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্বের জীবনের নানান ঘটনা থাকে যেগুলোকে আমরা তাঁদের যে ইতিবাচক ভ‚মিকা তার সঙ্গে অনেকসময় মেলাতে পারি না। আবার অনেকসময় তাঁদের ইতিবাচক ভ‚মিকা দিয়ে তাঁদের অনেক নেতিবাচক ভ‚মিকাও মেলাতে পারি না। উভয়দিকগুলোকেই যে মেলানো দরকার পরবর্তী জীবনের জীবনবোধের সংস্কারের জন্য এই সচেতনতার অভাব আমাদের। আসাদ চৌধুরীর মধ্যে অন্তর্গতভাবে, বিন্যাসিতভাবে তাঁর জীবনবোধ প্রোথিত ছিল। যে কারণে তিনি যখনই কোনোকিছু লিখেছেন, যেগুলো তুচ্ছতা করে লিখেছেন বলতেন, সেগুলোর মধ্যেও তাঁর যে জীবনবোধ, তাঁর মানুষকে শ্রদ্ধা করার যে মনোভঙ্গি সেটি পাওয়া যায় এবং সহৃদয়ভাবেই তিনি এই লেখাগুলো লিখতেন। অনেক লেখাই আছে আয়তনে খুব একটা বড়ো না এবং হয়তো খুব বেশি তথ্যও নাই। কিন্তু ঐ লেখাগুলোর মধ্য থেকে আমরা ঐ সময়ে যে ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছে তাঁর মনোভঙ্গি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। তেমনি তিনি যখন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন, কোনো জায়গার বর্ণনা যখন দিচ্ছেন, তার একটা সাংস্কৃতিক আভাস লেখাগুলোয় দিচ্ছেন। আমি মনে করি তাঁর এই লেখাগুলোকেও কেউ যদি মনোযোগ দিয়ে পড়ে সেখান থেকেও তাঁর যে জীবনদৃষ্টি কবিতায় শিশুসাহিত্যে উর্দু সাহিত্যে পেয়েছি, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে পেয়েছি, তা পাওয়া যাবে।
আরেকটা প্রসঙ্গ বলতে চাচ্ছি। অনেকগুলো বইয়ে তিনি লিখেছেন (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত) আর কোনো মানুষকে না-পেয়ে তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যেরা দায়িত্ব নেয়নি, নেয় না। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তিনি যখন লিখছেন, অন্যেরা তখন মুক্তিযুদ্ধ উদযাপন করছেন। তাঁর মধ্যবিত্ত গল্পটি আমি পড়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত অন্তত দু-তিনটি সংকলনে তাঁর এই গল্প মুদ্রিত হয়েছে। তখন যাঁরা গল্প সংকলন করতে চাইতেন, তাঁদের কাছে এই গল্পটি নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল – আমাদের সমাজ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিকাশমান মধ্যবিত্তের যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটি জানার জন্য।
অনেক রচনা শুধুমাত্র নান্দনিক সৌষ্ঠবের জায়গা থেকে দেখলে চলে না। আসাদ চৌধুরীর রচনা সেইদিক থেকেও দেখা উচিত। আমি “শ্রেষ্ঠ আসাদ চৌধুরী”র পক্ষপাতি না। এবং তাঁর অন্যধরনের লেখাগুলোকে সেইভাবে, সামগ্রিকতা দিয়ে দেখা যায়।
ফারহানা আজিম শিউলী: আড্ডা বা সাহিত্য আড্ডা সাহিত্যিকের/কবির সাহিত্য ভাবনাকে অনেকটা মৌল্ড করে, আমরা জানি। এবং আসাদ চৌধুরী নিজেও খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন।
“প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়” বইয়ের “স্বীকারোক্তি: এক” কবিতায় কবি আসাদ চৌধুরী তাঁর বারেবারে বিভিন্ন জেলা শহরে ছুটে যাওয়া নিয়ে লিখেছেন। “এ ভ্রমণ আর কিছু নয়” বইতে ‘’এলেম নতুন দেশে’ লেখার এক জায়গায় কবি লিখেছেন, “৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের যেখান থেকেই আমন্ত্রণ আসতো, বাছ-বিচার না-করেই ছুটে যেতাম। উদ্যোক্তাদের আন্তরিক ভালোবাসা ও সমাদরের স্বীকৃতি হিসেবে নয়। যে মানুষগুলোকে আমরা খুঁজে এসেছিলাম, সংখ্যায় যত অল্পই তাঁরা হন, তাঁদেরকে সনাক্ত করার লোভেই।” তাঁর একটি কবিতাই আছে – মফস্বল হায় দুয়োরানী।
তরুণ-নবীন লেখকদের প্রতি কবির বাৎসল্যের কথা সর্বজনবিদিত। সেটি তাঁর কবিতাতেও দেখা যায়। বইমেলায় লেখক ও প্রকাশকদের স্টলে ঘুরে ঘুরে একটু কম পরিচিত ভাল লেখকদের বইয়ের খোঁজ করতেন তিনি।
আবেদীন ভাই, আসাদ চৌধুরীর ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সাহিত্য আড্ডা, তরুণদেরকে সহযোগিতা এসব নিয়ে আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।
আবেদীন কাদের: আড্ডা বাংলাদেশের সাহিত্যে খুব পুরোনো জিনিস। আধুনিক সাহিত্যিকদের ভেতর এটা কোলকাতা থেকেই এসেছে। কোলকাতায় দুইটা তিনটা পত্রিকাকে ঘিরে খুব আড্ডা হতো। পরিচয়, কবিতা, দেশকে ঘিরে। এ নিয়ে লেখা হয়েছে প্রচুর বই। বড় লেখকরাও লিখেছেন? পরিচয়ের আড্ডা নিয়ে হীরেন সান্যাল লিখেছেন। দেশের আড্ডা নিয়ে সাগরময় ঘোষ নিজেই লিখেছেন। বিউটি বোর্ডিং এসব জায়গা থেকে ঢাকার আড্ডা শুরু হয় এবং ৬০ এর আড্ডা স্বাক্ষর, কণ্ঠস্বর ও অন্যান্য পত্রিকাকে কেন্দ্র করে হয়েছে। বাংলা একাডেমিতে ৭২ সনের পরে চাকরিতে যোগ দেওয়া একঝাঁক কবি সাহিত্যিক সবাই ষাটের মানুষ। আমি ঐ আড্ডায় প্রায় সর্বকনিষ্ঠই বলা যায়। চারতলায় রফিক আজাদের রুমে আড্ডা হতো। বলা যায়, বাংলা একাডেমির সবচেয়ে বড়ো আড্ডাটা সেখানেই হতো। আসাদ ভাই নিয়মিত যোগ দিতেন। আসাদ ভাই আড্ডাকে মজলিশি ধরনের করতেন। ঢাকায় আড্ডা দুই তিন ধরনের হতো। একেকটা আড্ডায় একেকটা জিনিস প্রাধান্য পেতো। কোনোটায় ছবি, কোনটায় খেলা ক্রিকেট বা ফুটবল, অধিকাংশগুলোতে রাজনীতি। আসাদ ভাই যেইসব আড্ডায় থাকতেন, তাতে রাজনীতি থাকলেও সাহিত্য থাকত মূলত। রফিক ভাই, আসাদ ভাইয়ের পৌরহিত্যে যেসব আড্ডা হতো সেগুলো মূলত সাহিত্য-শিল্প নির্ভরই বেশি হতো। অন্য আড্ডার সদস্যদের থেকে আসাদ ভাইয়ের চরিত্রের ভেতরে একটা দরদী-মমতাপূর্ণ মানুষের মন বেশি পাওয়া যেতো। তিনি শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক আড্ডাগুলোতেই থাকতেন তা না, তিনি আমাদের সমস্ত জেলা শহরের আড্ডাতে যেতেন। আমি নিজে ৮০র দশকের গোড়ায় ৭০এর শেষদিকে আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে কয়েকটা জেলাশহর ভ্রমণ করেছি সাহিত্য সম্মেলনে। তার ভেতরে ছিল রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, যশোহর, ফরিদপুর। আলাওলের একটা পুরষ্কার বিতরনীতে গেছি। রংপুর, দিনাজপুরে কয়েকবার গেছি। সেখানে সাহিত্যের চেয়ে মানুষ আসাদ ভাইয়ের মনটা দেখায় আমার উৎসাহ ছিল অনেক বেশি। আসাদ চৌধুরী তরুণ লেখকদের প্রতি কতটা মমতাপূর্ণ সেটা তখন দেখেছি। একেবারে প্রান্তিক মফস্বল শহরের লিটল ম্যাগাজিন বের করা একেবারে অর্থ এবং লেখা দুটোতেই খুব সংগ্রামী, দুটো সংগ্রহ করতেই যাঁদের খুব কষ্ট হতো, এমন মানুষদেরকে মানসিকভাবে আসাদ ভাই যেভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন এবং খরচ যোগাতেন, গিয়ে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন, চিঠি লিখতেন নিয়মিত, সেটা আমাদের বেশি কবি সাহিত্যিকদের ভেতর দেখা যায় না। সেদিক থেকে আসাদ ভাই অনন্য আমি বলব। খুলনা বা যশোরের তরুণ লেখক, রংপুরের তরুণ লেখকদের সঙ্গে আসাদ ভাইয়ের ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ থাকত এবং ঢাকায় তাঁরা এলেও যেমন দেখেছি, আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে রংপুর দিনাজপুর যশোর ফরিদপুরে গিয়েও দেখেছি। ফরিদপুরের বহু লেখক আমার ছেলেবেলার চেনা। আমি দেখেছি আসাদ ভাই তাঁদের সঙ্গেও খুব আন্তরিকভাবে মিশতেন এবং সাহস দিতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন। এটার কারণ আমি একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করি। সেটা হলো, আমাদের সমাজে লেখকরা রাজনীতি বিবর্জিত আমি তা বলব না কিন্তু রাজনীতি সোচ্চার খুব বেশি লোক ছিল না। আসাদ ভাই সমস্তকিছু সামাজিক দায় থেকে দেখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তিনি আবার বামপন্থী বা মার্ক্সিস্ট লেখকদের মতো সাহিত্যের ভেতরে রাজনীতিকে খুব উচ্চার্য করতেন না। খুব নীরবে করতেন কিন্তু বোঝা যেত যে তাঁর উদ্দেশ্য সমাজের এমনকিছু জিনিসকে সাহিত্যে তুলে আনা যেটা খুব অবহেলিত। এটার একটা কারণ আমি নিজে ভেবেছি। এর ব্যাখ্যা কোথাও দেখিনি যদিও। আমাদের দেশের সাহিত্যকর্মী বা লেখক সাহিত্যিকদের ভেতরে খুব পরিষ্কার ধারা ছিল। একটা ধারা ইংরেজি এবং পশ্চিমা সাহিত্য-দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। আরেকটি ধারা ইংরেজিটা জানেন, পশ্চিমা সাহিত্য সব জানেন, কিন্তু সেটাকে সামনের সারিতে এনে উচ্চকণ্ঠে বলে সাহিত্যকে বিচার করতেন না। আসাদ ভাই ছিলেন দ্বিতীয় ধারার। প্রথম ধারার মানুষদের দেখা যাবে তাঁরা ইংরেজিতে শিক্ষিত, কথাবার্তা বা আড্ডায় ইংরেজিতেই বেশি বলেন। কিন্তু তাঁরা আমাদের জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যের অনুসঙ্গের সঙ্গে পরিচিত না। ষাটের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য, অধিকাংশ ষাটের বিখ্যাত কবি এবং গদ্যকাররা খুব ভালো ইংরেজি জানতেন কিন্তু ইংরেজিতে খুব একটা কথাবার্তা বলতেন না। এঁদের মধ্যে আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, মান্নান সৈয়দ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ইলিয়াস ভাই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ভালো ইংরেজি বলতেন কিন্তু তাঁর জীবন সম্পূর্ণ বাংলা ঘনিষ্ঠ ছিল। অন্যদিকে আরেকটি ধারা ছিল। যেই ধারায় ইংরেজি অর্থনীতি সমাজবিজ্ঞান পড়া, ইংরেজি দ্বারা প্রভাবিত এবং ইংরেজিকেই আধুনিকতার বাহন মনে করতেন কিন্তু তাঁদের শিল্পবোধ খুব দুর্বল। এবং তাঁরা বাংলাদেশের বা বাঙালি জাতির জীবনের অনুসঙ্গ থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা। এর কারণ সম্ভবত আমার ধারণা, যাঁর সাথে কেওই একমত নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পরে ইংরেজি বিভাগ এবং ইংরেজি শিক্ষায় কিছু অতিরিক্ত এংলোফিল বা ইংরেজি অনুকারক ছিলেন যাঁদের প্রভাব আমাদের সমাজে একটা উচ্চ মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণি তৈরিতে সাহায্য করেছে। সাজ্জাদ হোসেন এবং গং এর পুরোধা। কিন্তু আরেকটি ধারা ছিল যাঁরা বাংলাই পড়ুন বা ইতিহাস বা অর্থনীতি পড়ুন, সমাজবিজ্ঞান পড়ুন, ইংরেজিটা খুব ভালো জানতেন কিন্তু প্রকাশ করতেন না। তাঁরা ইংরেজের ভালো ভারচ্যুগুলোকে, পশ্চিমা ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদের ভার্চুর দিকগুলোকে গ্রহণ করেছেন কিন্তু তাঁদের মূল চিন্তার বিষয় ছিল বাঙালি জীবন। ষাটের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকরা সেই ধারার। পঞ্চাশে তাঁদের পূর্বসূরীদের মধ্যে দুইজন আমি জানি ইংরেজিটা খুবই ভালো জানতেন কিন্তু তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি পড়েননি। একজিন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর ইংরেজি লেখা পড়লেই তা বোঝা যায়। তিনি জীবনাচারে কখনো পশ্চিমা ধাঁচকে গুরুত্ব দিতেন না কিন্তু এর পুরোটাই তিনি জানেন। তার বিপরীতে তাঁরই সমকালীন অনেক লেখক আমাদের সমাজে আছেন যাঁরা বাঙালি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, বাঙালি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন, বাঙালি জীবনাদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু ধার করা উপরিস্তরের কিছু জিনিস নিয়ে সমাজে বিচরণ করেন। এবং সেটা ঘটেছে সমাজবিজ্ঞানের কতগুলো মৌলিক কারণে। পঞ্চাশে এটা ছিল। ষাটে তার বিরুদ্ধ একধরনের রাজনৈতিক প্রবণতা ও সাহিত্যিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
আড্ডা বাংলাদেশের সাহিত্যকে পুষ্ট করেছে। অনেকে বলেন যে, আড্ডা কবিদের জন্য খুব জরুরি আবার অনেকে বলেন আড্ডা ক্ষতিকর। আমি মনে করি, আড্ডা বিভিন্নভাবেই বাংলা সাহিত্যকে সম্বৃদ্ধ করেছে। ৩-৪টা জায়গায় বিশেষ করে আড্ডা হতো। বিউটি বোর্ডিং থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি পাড়া, শাহবাগে রেখায়নে ছিল, নিউমার্কেটে ছিল। এই আড্ডার জায়গা এবং আড্ডার ফলাফলগুলো, তরুণ যাঁরা আসতেন তাঁদেরকে পড়ায় উদবুদ্ধ করেছে, বইয়ের জগতের খবর দিয়েছে।
আসাদ ভাইয়ের মনটা অন্য কবি সাহিত্যিকদের থেকে আলাদা ছিল। একদিকে তাঁর মনটা ছিল রাজনীতি দ্বারা ভীষণভাবে শেইপড বা মৌল্ড, অন্যদিকে খুবই মমতাপূর্ণ। এই দুই জিনিস একসঙ্গে আমাদের লেখকদের মধ্যে কম ছিল। ৫০-৭০ এর যে সব লেখকরা খুব ইকুইপড, খুব স্কিলড, ওয়েল প্রিপেয়ার্ড, সাহিত্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছেন তাঁদের মধ্যে এটা কম দেখা যায় কারণ তাঁদের মৃত্তিকা সংলগ্নতা কম। এর অন্যতম কারণ, সমাজের সঙ্গে তাঁদের যুক্ততা ছিল না বা কম ছিল। অন্যদিকে যে মানুষগুলোর সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বেশি সেই মানুষগুলোর সাহিত্য বা শিল্পবোধের দরদ লক্ষ্য করা যায়। আসাদ চৌধুরী দ্বিতীয় দলের মানুষ। আমি ৭৩ থেকে ৯৩ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আড্ডায় যুক্ত ছিলাম এবং আমি তাঁর দুই ধরনের রূপই দেখতে পেয়েছি? এক, বাইরে বাংলা একাডেমিতে বা বাইরের ভ্রমণে আর দুই, জিগাতলা তাঁর বাসায়? বাসায় তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। অসম্ভব অতিথিপরায়ণ। তরুণদেরকে বইপত্র দেবার ব্যাপারেও ছিলেন খুব উদার। অন্য লেখকরা কাউকে বই দিতে চাইতেন না। কারণ বইয়ের দুষ্প্রাপ্যতা ছিল। আসাদ ভাই ছিলেন একদম বিপরীত।
আরেকটা কথা এই পরিসরে বলে রাখি, আসাদ ভাই রাজনীতিপরায়ণ ছিলেন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত কারণে নয়, সাহিত্যেও তার প্রকাশ ছিল একেবারে ক্ষীণ। আসাদ চৌধুরীই প্রথম আমাকে ক্রিস্টোফার কর্ডওয়েলের “ইলিউশন এন্ড রিয়েলিটি” বইটি পড়ান। তিনি সামাজিক মানুষ কিন্তু তারচে বড়ো কথা রাজনৈতিকভাবে খুব আলোড়িত ছিলেন তিনি কিন্তু নীরবে। সেটা তাঁর আড্ডা এবং ব্যক্তিজীবনে খুব প্রকাশ পেতো। তরুণ লেখকদের প্যাট্রোনাইজ করার ব্যাপারে, অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারে এটা ভীষণভাবে প্রকাশ পেত এবং তিনি বেছে নিতেন প্রান্তিক, শহর থেকে অনেক দূরের তরুণ লেখকদের। এটা আমি সাধারণত ঢাকায় লেখকদের মধ্যে খুব কম দেখেছি। আমাদের পরিচিত পঞ্চাশ-ষাটের লেখকদের মধ্যে এটা প্রায় দেখিইনি। আসাদ ভাইয়ের মধ্যে এটা বেশি ছিল। এর কারণ সম্ভবত তিনি রাজনৈতিক পরিবারের, তাঁর রক্তে রাজনীতির ব্যাপার ছিল, সমাজ চিন্তা ছিল কিন্তু তাঁর মনটা ছিল শিল্পীর। সুতরাং এই দুটোর মিশ্রণ তাঁর ভেতর ছিল। এক, শিল্পের প্রতি মমতা দুই, সমাজটাকে অন্যভাবে দেখা আর দশজন কবি-লেখকদের থেকে বা নগরে জন্ম নেওয়া ও বড় হওয়াদের থেকে। সেদিক থেকে আমি মনে করি আসাদ ভাই আমাদের তরুণ লেখকদেরকে বিভিন্ন আড্ডা, যোগাযোগ, চিঠির মাধ্যমে সম্বৃদ্ধ করেছেন এবং এই ভ‚মিকাটা আমাদের ভেতর খুব বেশি মানুষের নেই।
এ পর্যায়ে “যে পারে পারুক” কাব্যগ্রন্থের “ফাগুন এলেই” কবিতাটি শারমিন লাকীর কণ্ঠে, স্বপ্নটাতো ভালোই ছিল, জলের মধ্যে লেখাজোখা বইয়ের কবিতা “লোকটা” ও “প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়” এর প্রশ্ন কবিতাটি খসরু চৌধুরীর কণ্ঠে বাজিয়ে শোনানো হয়।
ফারহানা আজিম শিউলী: আসাদ চৌধুরী কবি হিসেবে কিন্তু যথাযথ মনোযোগ পাননি, মর্যাদা পাননি। কেন? এর সঙ্গে সাহিত্যের রাজনীতির একটা যোগসূত্র আছে বটেই। একটু শুনতে চাই আবেদীন ভাই।
আবেদীন কাদের: আমি মনে করি, আমাদের সাহিত্যের রাজনীতি খুব পঙ্কিল। আমি ক্ষমা চেয়েই এই শব্দটা ব্যবহার করছি। পঞ্চাশ ষাটে ব্যাপারটা থাকলেও এটা শুরু হয়েছে মূলত পাকিস্তান সৃষ্টির পরপর। পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ববঙ্গে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে লেখকদের মনটাকে একধরনের হেজিমনিক স্টাইলেই কলোনাইজ করতে চাইতেন। সেটা করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বা টুলস ব্যবহার করে ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা মাফিক এবং তাতে আমাদের লেখক সাহিত্যিকরা জেনে না-জেনে, বুঝে না-বুঝে প্রচুর ধরা দিয়েছেন। তার একটা কারণ আর্থিক দীনতা। কারণ প্রচুর পরিমাণে টাকা এসেছিল আর তখন আমাদের লেখকেরা সত্যিকার অর্থেই খুব আর্থিক অনটনে ছিলেন। চাকরিও খুব একটা সহজলভ্য ছিল না। ছিল মাত্র কয়েকটা খবরের কাগজ। সে কারণে তাঁরা পাকিস্তানের লোভে পা দেন। এটা দু:খজনক হলেও সত্যি। ৬০ এর গোড়ায় ৬২র ছাত্র আন্দোলন থেকে যে নব জাতীয়তাবাদ বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান শুরু হয়, সেটা হয় তরুণ গোষ্ঠী থেকে, ছাত্র সমাজ থেকে, পরে রাজনৈতিক দলগুলোর যাঁরা তরুণ নেতা তারা সেটাকে লুফে নেন এবং এই জাতীয়তাবাদী উত্থানের সময়ে পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্ট এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন আর্থিক ও পাকিস্তানের সহায়তায় পুষ্ট লেখক সাহিত্যিকরাই তখন ছিলেন শক্তিশালী। তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের ষাটের মৃত্তিকা সংলগ্ন লেখকরা খুব একটা আসতে পারেননি। সেই কারণে বিচারের ভারটা তখনও পঞ্চাশের দশকের বা তারও আগের ৪০ এর লেখকদের হাতে ছিল। তাঁরা ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী শিবিরের মানুষ? শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ভাগ্যবান কারণ তাঁদের কবিতাকে একটু ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হয় ষাটের শুরুতে।
আসাদ চৌধুরী সামাজিক মানুষ হিসেবে এতো বেশি সামনে আসেন লেখকদের ভেতরে যে, তাঁর শিল্প সম্পর্কে ঐভাবে কেউ গুরুত্ব দিতে চায়নি বা গুরুত্ব দেয়নি। শুধু সমাজই এর জন্য দায়ি তা নয়, আসাদ ভাই নিজেও ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য দায়ি। দায়ি এই অর্থে, আসাদ ভাই কখনো নিজের লেখা বা সাহিত্যকে সামনে নিয়ে আসেননি। তিনি যেহেতু অতিরিক্ত বিনয়ী মানুষ ছিলেন সাহিত্যের ব্যাপারে, সে কারণে তিনি ভাবতেন, সমাজ বা আমাদের দেশের সাহিত্য বিচারকরাই ডিসেন্ট ওয়েতে তাঁর সাহিত্যকর্ম গ্রহণ করবেন, বিচার করবেন। উনি কেন নিজে বলতে যাবেন? কিন্তু দেখা যায় আমাদের সাহিত্যের রাজনীতির লোকরা সত্যিকার অর্থে খুব একটা উদার মানুষ নয়। তাঁরা শিল্প বা সাহিত্যকর্মকে সামনে এনে নিজেদের থেকে বিচার করার কাজটি করেননি। তিনি যদিও বাংলা একাডেমিতে চাকরি করতেন এবং বাংলা একাডেমি লেখকদেরকে বই প্রকাশ থেকে শুরু করে সব ব্যাপারেই খুব বড়ো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে কিন্তু আসাদ চৌধুরী ঐ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও খুব ফোরফ্রন্টে সাহিত্যের বিচারে বা সাহিত্যকর্মী হিসেবে সামনে দাঁড়াননি। সমস্ত সাহিত্যিক মোড়লরাই তাঁর বন্ধু ছিল কিন্তু নিজের ব্যাপারে তিনি কখনো কাউকে কিছু বলেছেন বলে আমি অন্তত শুনিনি। এ ব্যাপারে তিনি একটু নীরব। সে কারণেই হয়তো অন্যরা মনে করতেন, আসাদ যতোটা সামাজিক মানুষ, যতটা সাহিত্যের সংগঠক সে তুলনায় শিল্পকর্মে ওঁর গুণাগুণ হয়তো অনেক কম। এই অনেক কমের ধারণাটা জন্মেছে একদিকে তিনি নিজেকে অতটা প্রমোট করেননি, নিজের কথা মানুষকে বলেননি, বা সাহিত্যের রাজনীতিতে নিজের স্বার্থ খোঁজেননি। আরেকটা কারণ হলো আমাদের সমাজও খুঁজে খুঁজে শিল্পমূল্য দেওয়ার সমাজ নয়। আমাদের সমাজ এমনকি আজকের দিনেও, এই যে নব্বই এবং শূন্য দশকের পরে এতো সচেতন ছেলেমেয়েরা আমাদের সাহিত্যে এসেছেন, সাহিত্যিক তত্ত¡ এতো ভালোভাবে পড়েছেন, তারপরও দেখা যায় শিল্পমূল্য বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের সাহিত্য এখনও একদেশদর্শী। নৈর্ব্যক্তিক নয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক নাই তেমন লেখকের লেখা নিজে থেকে পড়ে তার শিল্পমূল্য বিচার করার জন্য যে সমাজ গড়ে ওঠে, পশ্চিমা সমাজগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই। এমনকি আমাদের বাড়ির পাশের পশ্চিমবঙ্গও আমাদের চেয়ে বেশি নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে সাহিত্যের বিচার করে। এটা খুবই ত্রæটিপূর্ণ, খুবই খারাপ এবং এই “পঙ্কিলতা” আমাদের সমাজকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। আসাদ চৌধুরী তারই শিকার। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এখন থেকে ২০ বা ৫০ বছর পর তাঁর কবিতার ভাষা নিয়ে কথা হবে, ছন্দ নিয়ে কথা হবে। এবং আমার ধারণা তাঁকে পুনর্মূল্যায়ন করবেই আমাদের সমাজ, যখন এই সমাজ আরেকটু সত্যভাষী হবে।
আরেকটি বিষয় আমি বলতে চাই, আমাদের সাহিত্যিক সমাজে একটা ব্যাপার হয়তোবা বৃটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। তবে ৫০ তার জন্য সবচে বেশি দায়ি। শিল্পের মূল্য বা শিল্পের বিচারটা কলাকৈবল্যবাদীদের দ্বারা প্রধানত ডমিনেটেড। শিল্পীকে বা শিল্প বিচার করতে গিয়ে একজন বিচারকের, সাহিত্যিকের, সমালোচকের সমাজ সম্পর্কে আগে জানতে হয়, তারপর শিল্প অথবা দুটো একসঙ্গে। সেটা আমাদের সমাজে খুব কম ছিল। আসাদ চৌধুরীকে বুঝতে গেলে দুটো বিষয়ই বুঝতে হবে। আসাদ চৌধুরীর মনটা একদিকে শিল্পীর আরেকদিকে রাজনৈতিক সচেতন চিন্তাশীল মানুষের। কিন্তু একটাকে উনি সবসময়ই আড়ালে রাখার চেষ্টা করতেন। সেটা ছিল তাঁর সমাজভাবনার জায়গাটা। কিন্তু তাঁর লেখার অধিকাংশ জায়গায় এবং তাঁর জীবনের সাহিত্য বিষয়ক যে সমস্ত কাজ তরুণদেরকে সাহায্য করা, তার ভেতরে কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক উৎকর্ষের একটা জায়গা, একটা সামাজিক চিন্তা কাজ করতো? সেটা অন্য সাহিত্যিকদের ছিল না। আমাদের অধিকাংশ নগরভিত্তিক নাগরিক চেতনার সাহিত্যিকেরা হয়তো কবি হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, হয়তো মানুষ হিসেবেও খারাপ না কিন্তু রাষ্ট্রের বা সমাজের সাহিত্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে ভ্যানগার্ডের দায়িত্ব পালন করা সেটা অনেকের ভেতরেই কম ছিল। এই জায়গা থেকে আসাদ চৌধুরীকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে হবে বলে আমার ধারণা। তাঁর আড্ডা এবং তরুণদেরকে উৎসাহিত করা তাঁর এই মন থেকে আসা। তাঁর মনটা যেহেতু এদিকে ছিল, সেই কারণেই তিনি এটাকে একটা দায়িত্ব হিসেবে নিতেন। কখনো প্রকাশ করতেন না। আমার মনে হয় তরুণদেরকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে তাঁর যেই সময়ক্ষেপণ, তাতে তাঁর নিজের একটু ক্ষতিই হয়েছে। নিজের প্রাপ্যটা ঠিকমতো পাননি কিন্তু তাতে তাঁর তেমন দুঃখ ছিল বলে আমার মনে হয় না। কারণ উনি এসব ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন ছিলেন। এসব বললে হেসে উড়িয়ে দিতেন। আজ তাঁর মৃত্যুর পরে হিসেব করলে দেখা যায়, আমাদের খুব কম সাহিত্যিকই এতো বিপুল পরিমাণে এবং এতো বিচিত্র ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ, উর্দু কবিতা – এই যে এতো বিষয়ে কাজ করা সেটার অন্ত:স্রোতে একটা সমাজ সংস্কারকের ভ‚মিকাও তাঁর ছিল। সাহিত্য সংস্কারকের ভ‚মিকাও তাঁর ছিল।
ফারহানা আজিম শিউলী: কবি আসাদ চৌধুরী বিনয় করে বলতেন, তাঁর কবিতায় কাঁচা ভাবটা রয়ে যায়, ক্র্যাফটসম্যানশিপ নেই ঐ অর্থে। এও বলতেন, পাকেচক্রে পড়ে তিনি লিখেছেন। কিন্তু সাংগঠনিক সত্তা ছাড়াও তাঁর বিপুল এবং গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম তো সেই সাক্ষ্য দেয় না একদমই। আবেদীন ভাই, কবি আসাদ চৌধুরীকে নিয়ে আপনার মূল্যায়ন শুনতে চাই।
আবেদীন কাদের: অনেকে বলেন আসাদ চৌধুরী সুচিন্তিত কিছু করেননি কিন্তু একেবারে হেলাফেলাভাবেও করেননি এটা নিশ্চিত। উনি অপরিকল্পিতভাবে হয়তো করেছেন কিন্তু উনার ভেতরে বরাবরই করার প্রনোদনাটা ছিল।
আমাদের সাহিত্যে আসাদ চৌধুরীর অবদান বিচার করলে বলতে হয়, শুধু সাংগঠনিক জিনিসগুলো নয়, শিল্পের দিকটাতেও তিনি সাংঘাতিক অনালোচিত। আমাদের খুব উন্যাসিক সমাজ তো! ভুলভাবে উন্নাসিক যদিও। আমাদের সমাজে দুটো ভাগ হয়েছে ৫০ থেকেই। একটা দল ইংরেজি ভাষাটা না জেনে বা ভাষাটা সামান্য একটু শিখে সাহিত্য বিচার করার একধরনের ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। আরেকটা দল একেবারে লোকজ নয়, ইংরেজি ভাষাটা পোক্তভাবে জানে কিন্তু সেটাকে কখনো বাইরে না-এনে শুধু সাহিত্য বিচার করতেন। বিশেষ করে আসাদ চৌধুরী, মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এঁরা ছিলেন সেই ঘরানার। কিন্তু অন্যদিকে দেখা যায় যে, সাহিত্য বিচার করার ক্ষমতাটা যাঁদের খুব কম কিংবা অর্জনই করেননি কিন্তু ইংরেজি বা এলিট শ্রেণিতে থাকার ফলে সমাজে একটু স্থান পেয়েছেন মূল্য পেয়েছেন, তাঁরাই সাহিত্য মোড়লগিরি করার দায়িত্ব পেয়ে গেছেন পাকেচক্রে। এই মানুষগুলোর কারণেই আমাদের সত্যিকারের শিল্প বিচারে কিছুটা ভুল হয়েছে। আমরা আমাদের মাটি থেকে উঠে আসা সাহিত্যকে কখনোই খুব মূল্য দিতে শিখিনি। এটা না-শেখার একটা বড়ো কারণ, আমাদের শিল্পীদের ভেতরে সমাজ-চিন্তা কম ছিল। আসাদ ভাই সেই দিক থেকে অনেক অগ্রসর মানুষ।
ফারহানা আজিম শিউলী: আসাদ চৌধুরীর করা বেতারের অনুষ্ঠানের সঙ্গে সাহিত্যের ও তরুণ লেখকদের যোগ – এই বিষয়ে শুনতে চাই, মাযহার ভাই।
আহমাদ মাযহার: বাংলাদেশ বেতারে আসাদ চৌধুরী “কথাকলি” নামে একটা সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন বেশ কয়েক বছর ধরে। সাধারণ সাহিত্য আসর নয় সেটা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাঠানো অখ্যাত লেখকদের গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি লেখা পাঠ ও তা নিয়ে আলোচনা করা হতো সে আসরে। পঠিত লেখাগুলো নিয়ে তাঁর অনুকম্পায়ী ও মমতাময় আলোচনার জন্য তখনই তিনি আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কণ্ঠের যুগপৎ মন্দ্রতা ও মিষ্টতা আমাকে একটু বেশিই আকৃষ্ট করেছিল। এখন যে আমি সমালোচনা লিখি, তার প্রাথমিক অনুপ্রেরণা আসাদ চৌধুরীর বেতারের সেই অনুষ্ঠানের সমালোচনার ধরন। সেই অনুষ্ঠানে প্রান্তিক সাহিত্যকদের সাহিত্য ভাবনা, জীবনানুভ‚তি জানা যেতো। এটি সেই অর্থে ছিল ব্যতিক্রমী এক অনুষ্ঠান। অনেকে এটাকে তুচ্ছ করে দেখলেও একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের যে এমন ভ‚মিকা থাকা দরকার, এখন তো আমরা এসব ভুলতেই বসেছি। আমরা সংস্কৃতির যে একটা অংশ উৎকর্ষের আকাঙখা এবং তার যে চর্চা সেটা আসাদ চৌধুরীর জীবনব্যাপী ছিল।
ফারহানা আজিম শিউলী: বাংলাদেশ টেলিভিশনে আসাদ চৌধুরী সাহিত্য ও সংস্কৃতিধর্মী বিখ্যাত “প্রচ্ছদ” অনুষ্ঠানের আগে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই সাহিত্য নিয়ে লাইভ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করেছিলেন “শিল্প ও সাহিত্য” নামে। এতে কোনো নির্বাচিত বই থেকে তিনি চিত্রনাট্য লিখতেন, যাতে অভিনয় শিল্পীরা অভিনয় করতেন এবং বোদ্ধা সাহিত্যিকেরা আলোচনা করতেন। সেই অনুষ্ঠানে আবু জাফর শামসুদ্দীনের পদ্মা মেঘনা যমুনা, হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে সহ আরো বহু বইয়ের ওপর ভিত্তি করে চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। এ বিষয়ে আমরা খুব কমই শুনেছি। তবে প্রচ্ছদ ছিল সর্বঅর্থেই মন্যুমেন্টাল। আপনার কাছ থেকে শুনব, মাযহার ভাই।
আহমাদ মাযহার: প্রচ্ছদ সম্পর্কে সবাই জানেন। কারণ আমাদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখার একটা সংস্কৃতি আছে। কিন্তু “সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের” সংজ্ঞায় প্রচ্ছদকে দেখলে খুব ভুল হবে। কারণ আসাদ চৌধুরীর ব্যক্তিত্বের যে পরিচয় তাঁর কবিতায়, শিশুসাহিত্যে, অন্য রচনায় প্রচ্ছদও তারই একটি প্রতিরূপ। তিনি বাংলাদেশের গায়কদের ভালো চিনতেন এবং শুধু জনপ্রিয় নাগরিক গায়ক নয়, বাংলাদেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা শিল্পীদের অনেককে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। প্রচ্ছদ? ছিল সেইসমস্ত শিল্পীদেরও উপস্থিত হবার একটা মাধ্যম। সম্ভবত তিনিই প্রথম আরজ আলী মাতুব্বরকে দীর্ঘ সময় ধরে টেলিভিশনে উপস্থাপন করেন। এর আগে গুটিকয় মানুষ ছাড়া আরজ আলী মাতুব্বরকে ব্যাপক অর্থে মানুষজন চিনতো না। ১৯৮৩ সালে আমি সবে লিখছি, গণমাধ্যমে যাবার মতো অবস্থায় একেবারেই পৌঁছাইনি। সেইসময় তিনি আমাকে প্রচ্ছদে ছড়া পড়তে ডেকেছিলেন। প্রচ্ছদে তখন কিছুদিন নিয়মিত একটা পর্ব রেখেছিলেন তিনি স্বরচিত ছড়া পাঠের। সে সময় এরকম সুযোগ আমাকে সাহিত্য চর্চায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। দেশজ সংস্কৃতির সংগ্রন্থন, একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্তিকরণ – সেটিই ছিল প্রচ্ছদ অনুষ্ঠানের মূল ভাবগত স্বরূপ।
ফারহানা আজিম শিউলী: আসাদ চৌধুরীর বিভিন্ন কবিতার শুরুতে উদ্ধৃতি থাকে। কবিতাতে সেই ভাবেরই স¤প্রসারণ পাওয়া যায় অনেকসময়। যেমন: স্বীকারোক্তি কবিতায় প্রাচীন লোকসাহিত্যের বচন, আয়না কবিতায় জ্ঞানদাসের, বৃক্ষের স্বভাবচরিত কবিতায় লালন শাহের, বিলাপ কবিতায় সুরাতুন নবা থেকে, রূপালি তৃষ্ণার নদী কবিতায় হরলাল রায়ের, এ কেমন জন্মদিন কবিতায় ময়মনসিংহের হাইট্টারা গানের উদ্ধৃতি ইত্যাদি। তবে তিনি অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশিসংখ্যক কবিতার শুরুতে লালনের কথা উদ্ধৃত করেছেন। কবিতার ভেতরেও তারই একরকম স¤প্রসারণ। আবার কয়েকটা কবিতার নামই যেমন: তত্ত¡জ্ঞান, দেহতত্ত¡ ইত্যাদি। লালনের লেখার মতো তিনি কবিতায় নিজের নাম ব্যবহার করতেন। এক্ষেত্রে “মানাবে, তবু মানাবে” কবিতার কথা বলা যায়:
আমার মাকে সাদা থানেই মানায়, বোনকে রঙ্গিন শাড়ি।
আসাদ, তোকে কোনখানেতে মানায়, হোটেল নাকি বাড়ি?
আবার কবি আসাদ চৌধুরীর লেখা একদম শেষ কবিতায়, তাঁর জীবনসায়াহ্নে লেখা কবিতায় ফার্সি ভাষার অন্যতম কবি হাফিজ যে বাতাসে, জলে শরাবের অন্বেষণ করতেন, তার ছায়া দেখতে পাই। আসাদ চৌধুরীর কবিতায় এই মরমী দিকটা নিয়ে আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
তার আগে, আমি কবির লেখা সবশেষ কবিতা “সুরায় ভরা বসুন্ধরা” পড়ে শোনাচ্ছি।
বসুন্ধরা সুরায় ভরা, জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে/ দেখে শুনে বুঝে-সুঝে, পেয়েছি এই দারুণ শিক্ষে।
সুরায় ভরা পুকুর কী গাঙ, বিল-হাওড় আর সুনীল সায়র/ তাইতো মাছের অমন বাহার, ছাড়তে চায় না জলের নহর।
বায়ু বলো পবন বলো, কিম্বা সেই-যে আদিম বাতাস/ মানুষ প্রাণি বৃক্ষরাজি, না’ পেলে তার বন্ধ যে শ্বাস।
আকাশ জানে কতোটুকু, সুরায়-ভরা অঙ্গ যে তার?/ পাখি কেন ডালের মায়া, মাটির টানকে ফেলে সে তার
নাড়ায় ডানা উড়াল কেবল, মাটি ছেড়ে, বাসা ছেড়ে/ শরাব আছে ঐ আকাশে? প্রশ্নগুলো আসছে তেড়ে।
জাভেদ হুসেন: সুষ্পষ্টভাবে কবি আসাদ চৌধুরীর উর্দু-ফার্সি কাব্যপ্রীতির একটা প্রভাব, কোনো সন্দেহ নেই।
আসাদ তুই আসলে কোথায় সবচাইতে ভালো – এই প্রসঙ্গে বলছি। শাহ হুসেইন নামে এক সাধক সিন্ধী কবি ছিলেন। আমরা জানি মনসুর হাল্লাজের “আনাল হক” “আমিই সত্য।” ঐ হক মানে শুধুই সত্য নয়, ঐ হক হচ্ছে সৃজনশীল সত্য যে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে। এই প্রকাশ হওয়ার যে ধরন এবং তার মধ্যে যে সত্য বিরাজমান, তাকে বলা হয় হক। মনসুর হাল্লাজ বলছেন, আনাল হক, আমি সেই সত্য। সেই সৃজনশীল সত্য। সিন্ধী কবি শাহ হুসেনের এক ব্রাহ্মণ বন্ধু ছিলেন মাধো লাল। এতই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শাহ হুসেইনের যে শাহ হুসেইন নিজের নাম বলতেন শাহ হুসেইন মাধো লাল। নিজের নাম বন্ধুর নামের সঙ্গে জড়িয়ে দুটো নাম একসাথে করে নিজের একটা নাম করেন তিনি। শাহ হুসেইনের সিন্ধীতে এরকম একটা পদ আছে – “তু কিদ বাগলি মুলি হুসেইনা, মনসুরে কি তু সুলি হুসেইনা।” মনসুর হাল্লাজকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তো শাহ হুসেইন বলছেন, তুই কোন বাগানের মুলো বল দেখি শাহ হুসেইন? মুলো তো বাগানে হয় না। নিজেকে নিয়ে বিদ্রুপ করছেন শাহ হুসেইন। মনসুর তো শূলের আগায় ফুল হয়ে ফুটেছিল। তুই কোন বাগানের মুলো? ঠিক তেমনি – আসাদ তুই হোটেলের না বাইরের না ঘরের? সুস্পষ্টভাবে সেই ব্যাঞ্জনাটা এখানে পাওয়া যাচ্ছে।
আর শেষ কবিতাটা প্রকৃত অর্থেই মনোমুগ্ধকর। উর্দু ফার্সি কবিতার মধ্যে শরাব বারবার আসছে। জগতের সৃষ্টির মধ্যে রহস্য লুকিয়ে আছে। সেই রহস্যের মধ্যে যখন মানব নিজেকে খুঁজে দেখতে চায়, খুঁজে পেতে চায়, এবং এই যে ক্ষণিকের মধ্যে অসীমের বার্তা লুকিয়ে থাকে, এই দুটোকে যখন সে সমন্বয় করতে চায় এবং নিজে বুঝতে পারে ক্ষণিক অস্তিত্বের মধ্যে অসীম অস্তিত্বের বীজ লুকিয়ে আছে, তখন ঐ যে ক্ষণের মধ্যে অসীমের নেশা ঐটাই উর্দু ফার্সি কবিতার মধ্যে বারবার এসেছে শরাব রূপে। একটা শের দিয়ে আমি কথাটা শেষ করি। আকবর ইলাহাবাদী বলছিলেন যে, “উস ম্যায় সে নেহি মতলব, দিল জিসসে হো বেগানা। মাকসুদ হু ম্যায়সে খিজতি হ্যায়।” যে মদিরা পান করলে হৃদয় উদভ্রান্ত হয়ে যায়, আমি সেই মদিরার কথা বলিনি। বলছি সেই মদিরার কথা যা পান না করলেও সমানরূপে টেনে নিয়ে যায়, আকৃষ্ট করে। আসাদ চৌধুরীর শেষ কবিতাটার মধ্যেও বিস্ময়কররূপে সেই মদিরার কথাই বলছেন জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। ক্ষণিক জীবসত্তা যে অসীম পরমসত্তার মধ্যে নিজেকে ঘনিষ্ঠরূপে দেখতে পায়, আবিষ্কার করে এবং একসময় অনুভব করে নিজের ক্ষণিক সত্তা আসলে বৃহৎ সত্তারই অংশÑ এই অনুভব, অনুভ‚তি কবি আসাদ চৌধুরীর শেষ কবিতাটায় যে এতো অসাধারণভাবে উঠে এসেছে, বিস্ময়কর! বিস্ময়কর!
আলোচক আবেদীন কাদের, জাভেদ হুসেন ও আহমাদ মাযহারের প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী বিশেষায়িত ও জ্ঞানঋদ্ধ আলোচনা ও এর ফাঁকে ফাঁকে কবি আসাদ চৌধুরীর বিভিন্ন কবিতার অডিও ও তাঁর লেখা বইয়ের প্রচ্ছদের ভিডিও প্রদর্শন ভার্চুয়ালি যুক্ত দর্শক-শ্রোতারা নিবিষ্টমনে উপভোগ করেন ও মন্তব্য করে সক্রিয় থাকেন।
কবির সমাধিস্থলের ছবি দেখিয়ে, তাঁকে স্মরণ করে তাঁর সন্তান আসিফের কণ্ঠে কবীর সুমনের “সে চলে গেলেও” গানটির দুটি চরণ শুনিয়ে, আলোচক সহ এ আসরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে, পাঠশালার আজন্ম-সুহৃদ কবি আসাদ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানিয়ে এ আসরের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা হয়।