মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
তেষট্টি.
আমি যখন অটোয়ার সেই কনভেনশন এ বসে কানাডার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বৃদ্ধ-যুবা সবার সেই স্বপ্ন আর উদ্যমের কথা শুনছিলাম, তখন আমি অনুধাবন করেছিলাম, এই সুন্দর মানুষগুলোর দেশ গড়ার স্বপ্নের সৌন্দর্য। তাদের সেই সুন্দর স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল, এই সব মানুষদের এক করে আমি যদি নেতৃত্ব দিতে পারতাম! তবে ক্ষণিকের জন্য মাথায় আসা এমন চিন্তাটা সেই মুহূর্তে আমার কাছে কিছুটা হাস্যকর লেগেছিল। কারণ তখন পর্যন্ত আমি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের কথা ভাবিনি। তবে সেই পরিস্থিতি আমাকে অনেক কিছুই ভাবতে আমার ভিতরকে উস্কে দিয়েছিল। সেই সময়টাই আমি নিজের সাথে নিজের বুঝাপড়ার একটা সময়ও পেয়েছিলাম। তারপর সবকিছু থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে গভীর নীরবতার মধ্য দিয়ে আমি দেখতে চেয়েছিলাম আগামী দিনের লিবারেল পার্টি ও এর কাজকর্ম কেমন হওয়া প্রয়োজন। তবে অবশ্যই আমি নিজে থেকে কখনও লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য এর প্ররাচণায় নামবো, এমনটা তখনও ভাবিনি। তবে ২০১১ সালেই যদি পার্টির নেতৃত্ব পাওয়ার দৌড়ে শামিল হয়ে ঐ পথে চলা শুরু করতাম, তাহলে আমার মনে হয়, আজকে যে আমি এই পার্টি’টাকে নেতৃত্ব দিচ্ছি, সেটা কখনোই সম্ভব হত না।
সেই সময় থেকেই আমার ভিতরে সেই নেতৃত্বের চিন্তাটা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। তবে সে সময় আমি এমন কিছু ভাবিনি যে, যারা উচ্চ পর্যায়ে আছেন তারা নেতৃত্বের ব্যাপারে আমার কথা চিন্তা করবেন। কনভেনশন শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরই আমি আমার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু গ্যারী বাটস এর সাথে দীর্ঘক্ষণ এক আলাপে বসেছিলাম। সে দীর্ঘদিন অন্টারিও প্রিমিয়ারের মূখ্য সচিব হিসেবে কাজ করেছিল। তারপর ২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড কানাডা’র সিইও হয়ে সে রাজনীতি ছেড়ে দেয়। আমি তাকে সেই কনভেনশন সম্পর্কে বলেছিলাম এবং তাকে জানিয়েছিলাম, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা লিবারেল পার্টির স্বপ্ন দেখা সব কর্মীরা আমাকে কিভাবে হতবাক করে দিয়েছে এবং কিভাবে আমাকে এক নতুন ভাবনার মধ্য ঠেলে দিয়েছে। আমি তাকে আরো বলেছিলাম, তাদের কথা ও চিন্তা চেতনা আমাকে গভীরভাবে উজ্জীবিত করেছে এবং নেতৃত্বের পথে হাঁটতে আমি এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমি গ্যারীকে এটাও জানিয়েছিলাম, এই প্রথম আমি কারো সাথে আমার নেতৃত্ব বিষয়ক কোন কথা বলছি এবং তারপর আমি তার কাছ থেকেই জানতে চেয়েছিলাম, আমি যদি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে যেতে চাই তাহলে এর প্রচারণার ধরনটা কেমন হবে। আমি তাকে পরিষ্কারভাবে এটাও বলেছিলাম, আমি এ বিষয়ে কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই নি, আমি শুধু এর এপিঠ ওপিঠ নিয়ে একটু ভাবছি।
তার কিছুদিন পরই আমি কেটি টেলফোর্ড এর সাথে দেখা করেছিলাম। ২০০৬ সালে সে যখন জেরাড কেনেডীর ক্যাম্পেইন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিল, তখন থেকেই আমি তাকে চিনি। সে আবার স্টিফেনী ডিওন এর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হিসেবেও কাজ করেছিল। তাকে কেন জানি আমি প্রথম থেকেই পছন্দ আর বিশ্বাস করা শুরু করি। কেটি খুবই পরিশ্রমী, সৎ আর নির্ভীক প্রকৃতির একজন মানুষ। সেই সাথে ফেডারেল এর নেতৃত্বের প্রচারণা চালানোর মত সে যথেষ্ট স্মার্ট ছিল। আমার সামনে এগুনোর পথে সে আমার সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছিল, সেটা আমার খুবই ভালো লেগেছিল।
গ্যারী, কেটি এবং ড্যানিয়েল গ্যাগনিয়ারকে আমি কয়েক মাস পরেই আমার সাথে কাজ করার জন্য নিয়োগ দিয়েছিলাম, তারপর থেকে তারা এখনো আমার কাজের মূখ্য ভূমিকায় আছে। ড্যান হচ্ছে একজন মনে প্রাণে গর্বীত কুইবেক এর ফেডারেলিস্ট, সম্ভবত কানাডার ইতিহাসে সে হচ্ছে এমন একজন যে কুইবেক ও অন্টারিও দুই প্রভিন্স’এরই প্রিমিয়ারের চীফ অব স্টাফ হিসেবে কাজ করেছে। আমি যখন মন্ট্রিয়লের পরিবেশ নিয়ে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম, তখনই প্রথম তার সাথে আমার কথা হয়, কিন্তু সে আমাকে প্রথম দেখে আশির দশকে যখন একজন সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে সে সংবিধান সংক্রান্ত কোন এক কাজে আমার বাবার সাথে কাজ করছিল।
তারপর প্রায় ছয় মাস তার সাথে অনেক আলাপ আলোচনার পর আমার মনে হয়েছিল, একজন ভাল নেতার অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্য অন্যতম হচ্ছে, তার কাজগুলো ভালভাবে সম্পন্ন করার জন্য খুবই যোগ্য কিছু লোকজনকে নিয়োগ দেয়া। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত, তুমি যদি তোমার দলে সত্যিকারের যোগ্য মানুষকে স্থান দাও, তাহলে তুমি যে কোন কাজ সফলতার সাথেই করতে পারবে। আমার নেতৃত্বের প্রচারণায় আমি যে বিষয়টার ওপর সবচেয়ে বেশী জোর দিয়েছিলাম তা হচ্ছে, যোগ্য প্রার্থীকে বাছাই করা এবং সকল কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। অনেক নেতা আবার মনে করে, তাদের দলে খুবই যোগ্য সদস্যদের উপস্থিতি অনেক সময় তাদের অযোগ্যতাকেই প্রমাণ করে। এমন ধারণাটা সেই সব নেতাদের ক্ষেত্রে খাটে যারা এক স্বৈরাচারী নেতৃত্বের দিকে নিজেদের নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমি মনে করি, এটা একটা নেতৃত্বের দূর্বলতা আর ত্রæটি, এটা কখনও কোন শক্তি হতে পারে না। আমি এও মনে করি, যদি কেউ তার দলে কোন যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়, তবে সেই ব্যক্তিটির মধ্য দিয়েই সেই নেতা প্রতিদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যাচাই বাছাই করার একটা সুযোগ পেয়ে থাকতে পারে। আমি যদি কখনও প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ সেবা করার সুযোগ পেয়ে থাকি, তখন নিশ্চয় সারা কানাডা জুড়ে আমি কি কাজ করছি সেই নিরিখেই আমার সফলতা বা ব্যর্থতা বিচার সবাই করবে।
বলা হয়, মাঝে মধ্যে তোমার সেই ধরনের বুকের পাটা থাকতে হবে যার সাহায্যে তুমি তোমার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবে না, এমনকি তোমার আশেপাশের সবাই যদি ভেবেও থাকে তুমি ভুল কিছু করছ। সিনেটর প্যাট্রিক ব্রাজিও’য়ের সাথে আমার যে চ্যারিটি বক্সিং এর আয়োজন চলছিল, সেটা ছিল এমন ধরনের এক ঘটনা। আমার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সবাই বলেছিল, ওটা আমার জন্য ঠিক উচিৎ হচ্ছে না এবং এর ফলটা আমার জন্য ভাল হবে না, অর্থাৎ তারা বুঝাতে চেয়েছিল, এই বক্সিং এ আমার পক্ষে কখনও জেতা সম্ভব নয়।
বক্সিং রিং এর এই ঘটনাটার সূত্রপাত হয়েছিল ২০১১ সালের জুন মাসে, যখন কেউ একজন এসে বলেছিল, ‘ফাইট ফর কিওর’ এর জন্য অটোয়ায় এক অপেশাদারী বক্সিং এর আয়োজন করা যেতে পারে এবং এখানে তারাই অংশ নিবে যারা বক্সিং’কে পেশা হিসেবে নেয় নি এবং যারা অফিসে চাকরী করছে বা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে পার্লামেন্ট আছে। আর এই বক্সিং থেকে যা আয় হবে তার সবটুকুই অটোয়া রিজিওনাল ক্যানসার ফাউন্ডেশন এ দান করা হবে। সেই সময় এই মহতী আহ্বানকে আমার জীবনের এক সুযোগ বলেই মনে হয়েছিল।
এই বক্সিং এর ধারণাটার পেছনের মূল কারণ ছিল, যারা বিভিন্ন অফিসে সাহেবী কাজ করে এবং যারা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সাথে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে তারা ছয় মাসের জন্য অপেশাদার বক্সিং এ লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ নিবে এবং তাদের মতই একজনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়ে লড়াই করবে। লড়াইয়ের আগে তারা তাদের আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে টিকিট বিক্রি করবে। সবার সামনে এই মুষ্টিযুদ্ধে অংশ নেওয়াটা এক অন্যরকম আনন্দের হবে, আর এর মাধ্যমে সেই চ্যারিটির জন্য প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
আমি আমার সেই কুড়ি বছরের শুরুতে বেশ কিছু সময় অপেশাদারী বক্সিং এ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, এবং আমি সব সময়ই চাইতাম অন্তত একবার হলেও আমি সত্যিকারের বক্সিং এ অংশ নিয়ে বক্সিং রিং এ উঠি। তখন আমার এটাও মনে হয়েছিল, আমি যদি কখনও রাজনীতির জগতে ঢুকে পড়ি তাহলে আমার এই ভাবনাটা ভাবনায় থেকে যাবে। সত্যি বলতে কি, রাজনীতির সাথে জড়িত হবার পর আমার জীবনে এমনটাই হয়েছিল। কিন্তু একটা ভালো কাজে যখন এমন একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল এর যথার্থ সদ্ব্যবহার করা উচিৎ। সেই সাথে আমার মনে হয়েছিল, আমি এমন একজন গোঁড়া কনজারভেটিভকে আমার প্রতিপক্ষ হিসেবে খুঁজে বের করব এবং যেভাবেই হোক সবার সামনে আমি তাকে মুষ্টিযুদ্ধে ধরাশায়ী করব। সেই সময় কোন এক কনজারভেটিভকে সবার সামনে বক্সিং রিং এ কুপোকাত করার জন্য আমার ভিতরে এক প্রবল উত্তেজনা কাজ করছিল।
অক্টোবরে আমি যখন অফিসিয়ালী এই বক্সিং এ লড়াই করার জন্য স্বাক্ষর করলাম, তখন পার্টি আমার এই কাজকে খুব ভালভাবে নেয় নি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, লিবারেলরা এটাকে খুব ভালভাবে নিতে পারতো এবং ধরেই নিতে পারতো, এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দলগত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার একটা প্রচেষ্টা চালাতে পারি, যখন পার্লামেন্টের এনডিপি এবং কনজারভেটিভরা একের পর এক এক সময়ের শক্তিশালী লিবারেলদের ধরাশায়ী করে চলেছিল। আমার এটাও মনে হয়েছিল, যদি কেউ এর পক্ষে সমর্থন নাও করে, আমি অবশ্যই বক্সিং রিং এ লড়বো এবং সবাইকে দেখিয়ে দিব, লিবারেল পার্টি এখনও শেষ হয়ে যায় নি।
কিছু দিন পর এমন একটা অবস্থা হল যে, সেই মুষ্টিযুদ্ধের আয়োজনটাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তবে যখন ঠিক হল যে লড়াই হবে, তখন আমি নিজে নিজে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। কনজারভেটিভরা যতই গা জ্বলানো কথা আর বড়াই করুক না কেন, আমি কিন্তু এই মুষ্টিযুদ্ধে অংশ নেবার মত কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি বেশ কিছু এমপি’কে প্রস্তাব জানিয়েছিলাম। এদের মধ্য অন্যতম ছিলেন, ক্যালগেরীর সেই মুখে খই ফোটানো এমপি রব এনডারস এবং সেই সময়ের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিটার ম্যাককে, কিন্তু দুজনেই লড়তে রাজি হল না। আমি তখন ডম লিবøাঙ্ক এর সামনে কিছুটা হাসির ছলেই বলেছিলাম, ‘কে জানতো একজন কনজারভেটিককে পেতে আমার এত বেশী বেগ পেতে হবে, যে কিনা বক্সিং রিং এ আমার মুখমন্ডলে একটা ঘুষি দিয়ে আমাকে কুপোকাত করে ফেলবে।’
শেষ পর্যন্ত প্যাট্রিক ব্র্যাজিউ আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। এই প্যাট্রিক ব্র্যাজিউ পরবর্তীতে সিনেট এর খরচাপাতির কেলেংকারীতে ধরা খেয়েছিল। সবারই জানা ছিল মি. ব্রাজিউ ছিলেন এমন এক লম্বাচড়া পেশীবহুল শরীরের মানুষ যিনি সব সময় এক বড়াই আর ভাবের মধ্যে থাকে। তবে আমার মনে হয়েছিল, তার সাথে লড়াইটা আমার ভালোই জমবে। লম্বাই আমি তার থেকে একটু উঁচু ছিলাম এবং এর ফলে একটু দূর থেকেই তাকে আঘাত করা আমার সম্ভব ছিল, অন্যদিকে সে ছিল খুবই সুঠাম দেহের একজন, তার বুক আর হাতের পেশীগুলো ছিল খুবই বলিষ্ঠ। সে কানাডিয়ান আর্মিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, সেই সাথে কারাতে সে বø্যাক বেল্ট পেয়েছিল। তার শারীরিক কাঠামোটা এত শক্তিশালী ও দেখার মত ছিল যে, যখন আমাদের এই লড়াইয়ের ঘোষণাটা দেয়া হল, তখন কারো মাথাই এমন চিন্তা আসেনি যে ‘এই লড়াইয়ে কে জিতবে?’ বরং সবার মাথায় এমন চিন্তাই এসেছিল, ‘কত সেকেন্ড এর মধ্যে ধরাশায়ী হয়ে ট্রæডো ক্যানভাসের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়বে।’ (চলবে)