ডঃ বাহারুল হক : প্রজাপতির মতই দেখতে তবে প্রজাপতি নয়। এই পতঙ্গটির নাম মথ। মথকে প্রজাপতি থেকে আলাদা করে চেনার মানুষ কম। দুটোর বসার ঢং আলাদা। ওটা দেখে বোঝা যায় কোনটা মথ আর কোনটা প্রজাপতি। মথ যখন স্থির হয়ে বসে তখন তার পাখা দুটো মেলা থাকে, পা পেট দেখা যায় না। অন্যদিকে প্রজাপতি যখন স্থির হয়ে বসে তখন পাখা দুটোকে সে সাইড থেকে সরিয়ে পিঠের উপর খাড়া করে রাখে। পুরো বডি উন্মুক্ত। কবি তাই দেখে গান লিখেন- “প্রজাপতি প্রজাপতি পাখনা মেলো…”। মথের মেলে ধরা পাখা নিয়ে কবির কোন লেখা নাই। আসলে মথের পাখা প্রজাপতির পাখার মত অত রঙ মাখানো নয়। প্রজাপতির পাখা অনেক বেশি রঙিন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ভালো কথা, প্রজাপতি আর মথ চেনার একটা সহজ উপায় হলো তাদের এন্ট্যানা পরখ করা। প্রজাপতির এন্ট্যানা বেতের মত আর এগুলোর শেষ প্রান্ত বাল্বাকৃতির। অন্যদিকে মথের এন্ট্যানা পালকের মত।
ফুল আর প্রজাপতির দেশ কানাডা। প্রথম সারির পাঁচটি প্রজাপতি হলো- মোনার্ক, সিলভার স্পটেড স্কিপার, টাইগার সোয়ালো টেইল, মাস্টার্ড হোয়াইট, আর সিলভারী ব্লও।
কানাডিয়ানদের সবচেয়ে প্রিয় প্রজাপতি হলো মোনার্ক প্রজাপতি। এটি নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে দুনিয়ার আর কোন পতঙ্গ নিয়ে অত হয়নি। অনিন্দ সুন্দর এই প্রজাপতি মোনার্ক শরীরে বহন করে একটা বিষাক্ত কম্পাউন্ড। ফলে একে যারা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মোনার্ক ক্যাটারপিলার অবস্থা থেকে বড় হয় যে গাছের (মিল্কউইড গাছ) পাতা খেয়ে সে গাছের পাতায় থাকে এই বিষ। মোনার্কের মাইগ্র্যাশন নিয়ে হয়েছে মেলা কাজ, বেরিয়ে এসেছে অনেক তথ্য। এক সাথে এত বিপুল সংখ্যায় এত লম্বা পথ দুনিয়ার আর কোন পতঙ্গ পাড়ি দেয় না। মোনার্কের এই মাইগ্র্যাশনকে তাই আখ্যায়িত করা হয় দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ। মোনার্ক প্রতি বছর শীতের আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কানাডা থেকে দক্ষিণে পথ ধরে এবং দুই মাসে ৩০০০ মাইল পার হয়ে মেক্সিকোর পার্বত্য জঙ্গলে হাজির হয়। সেখানে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির গাছে গাদাগাদি করে বসে পড়ে। অনেক গাছের কিছুই দেখা যায় না মোনার্কের জন্য। পথ চলতে এরা সাগর – উঁচু পর্বত এড়িয়ে চলে। ১১০০০ ফুটের অধিক উচ্চতায় এদের কখনো দেখা যায়নি। মার্চে এরা আবার কানাডার পথে নামে এবং ফের ৩০০০ মাইল পার হয়ে যখন কানাডা প্রবেশ করে তখন কানাডায় বসন্ত কাল। ফুলের কাঁপন, পাখির গায়নের সাথে যোগ হয় প্রজাপতির নাচন। শীত বন্দি কানাডিয়ানরা হয় ঘর ছাড়া। মন ভরে উপভোগ করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রফেসর কামাল উদ্দীন স্যার আমাদের ক্লাস নিতেন। স্যার রোল করতেন না। ছাত্রছাত্রীদের নাম ধরে ডাকতেন। আমার বন্ধু মনজুরের নামের শেষ অংশ হলো চৌধুরী। স্যার কোনদিনও শুদ্ধ করে শেষ অংশটা উচ্চারণ করতেন না। স্যার বলতেন- “কাউডরী”। আমাদের রাগ হলেও ভয়ে কিছু বলতাম না আমরা। স্যার বাঙালি, বাংলাদেশের মানুষ, তিনি চৌধুরী নামটা শুনেননি, উচ্চারণ করতে পারেন না এটা আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করিনি। চৌধুরী, ভুঁইয়া ইত্যাদি পারিবারিক বা বংশ পরিচায়ক নামের প্রতি স্যারের যে কোন কারণে চরম অপ্রীতি ছিল। সে জন্য এসব নাম দেখলে তাচ্ছিল্য ভরে বিকৃত করে স্যার এসব নাম উচ্চারণ করতেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
কর্ণাটক ইউনিভার্সিটির মেইন ক্যাম্পাস ঢার্ভাডে। ঢার্ভাড থেকে প্রায় ১৯০ কিঃ মিঃ দূরে আরব সাগরের তীরের বন্দর নগরী কারোয়ারে কঃ ইউনিভার্সিটির মেরিন সাইন্স ডিপার্টমেন্ট অবস্থিত। চবির মেরিন সায়েন্স বিভাগের মত সাগর থেকে দূরে পাহাড় ঘেরা কোন উচ্চ ভ‚মিতে এ মেরিন সায়েন্স বিভাগের অবস্থান নয়। আমার কাজ ছিল। গেলাম। তিন দিন থাকলাম। সারাক্ষণ আমাকে সঙ্গ দিয়েছে সে বিভাগের এক ছাত্র, হুলি। হুলি অর্থ বাঘ। ওর সাথে থেকে বুঝলাম তার বাবা বৃথাই তার নাম রেখেছে হুলি। ও হরিণের মত নিরিহ একটা ছেলে। বাধ্য, ভদ্র, আর প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। হলে মাছ খেতে পাই না বলে তার আফসোসের অন্ত নাই। বলে রাখি কঃ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে মাছ, মাংস নিষিদ্ধ। মাস দুয়েক পর হুলির চিঠি পেলাম। সে আসছে আমি যেন হলে থাকি। সে আসলো সময় মত। আমার রুমে, আমার মেহমান। এসেই ব্যাগ খুললো। একটা পোটলা বের করে বললো- তোমার জন্য মাছ এনেছি; মা ভেজে দিয়েছেন। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর বললাম- আমি মাছ খেকো এ কথা মাকে বলেছ? হুলির উত্তর- হাঁ, মাকে বলেছি। মা শুনে খুব দুঃখ করলেন তোমার জন্য। মনে মনে ভাবলাম- হাঁ, এমন মায়ের ঘরে এমন ছেলে জন্ম নেয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে গেল শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস আছে। সে সব বাস শহরে বসবাসকারী শিক্ষকদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা নেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। আমি পাঁচলাইশ থাকতাম। বাসা থেকে বের হয়ে বাসের জন্য মেডিক্যালের সামনে দাঁড়াতাম। শিক্ষক লেখা বাস আসলে হাত তুলতাম। ড্রাইভার থামার মুডে। আমি দৌড়ে দরজায় যেতাম। কিন্তু হাইলি স্কিল্ড হেলপার হাত দিয়ে আমাকে ঠেলে বলতো- “শিক্ষক বাস, শিক্ষক বাস”। আর বাসে জোরে জোরে থাপ্পড় দিত। ড্রাইভার দ্রুত গতি বাড়িয়ে চলে যেত আমাকে ফেলে। আমি যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম না। ফলে বাসের মধ্যে বসা কোন শিক্ষক আমাকে চিনতো না এবং হেলপারকে কেউ কিছু বলতো না। কী করবো! আমি নিজ ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। অবশ্য এ দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠতে বেশি দিন লাগেনি। আমার সমস্যার কথা বললে আমার শহরবাসী সহকর্মীরা বললেন- “তুমি পাঁচলাইশে যে স্পট থেকে বেশি শিক্ষক উঠে সেখানে দাঁড়াবে এবং শিক্ষকদের সাথে উঠে যাবে”। সেখানেও দেখি ঐ হাইলি স্কিল্ড হেলপার স্ক্রিনিং করে এবং আমি উঠতে চাইলে বলে- “ন ঐবো, ইবা শিক্ষক বাস”। তখন সাথী শিক্ষকরা বলতেন- “না উনি শিক্ষক, উঠতে দাও”। হেলপার তখন উঠতে দিত।
মুর্তজা বশীর, এখন এটা একজন প্রয়াত অধ্যাপকের নাম। যে কাউকে সহজে আপন করে নেওয়ার দুর্লভ গুণের অধিকারী মুর্তজা ভাইর কাছে আমিও ছিলাম একজন স্নেহভাজন মানুষ। অন্য ফ্যাকাল্টির বলে দেখা-সাক্ষাত কম হতো। তবে আমি ওনার দেখা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম এবং দেখা হলে খুব আনন্দ অনুভাব করতাম। ১৯৯১ সনে একদিন লাউঞ্জে দেখা মিললো মুর্তজা ভাইর। হেসে বললেন- “তোমাকে দেখিনা কেন? কোথায় থাক”? আমি বললাম- “আমিতো দেশে নেই ভাই। আমি ভারতের কর্ণাটক ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছি। গত বছর গেলাম”। ভাই বললেন- “পত্রিকায় দাওনি? পত্রিকায় দিতে হয়। শোন, এটা প্রচার নয়। পত্রিকায় দিলে সবাই জানতো যে তুমি দেশে নাই”। তারপর দুইজন আরো কথা বললাম। এক ফাঁকে তিনি বললেন- “তুমি পরেরবার আসতে সাউথ ইন্ডিয়ান চারটা ল্যাঙ্গুয়েজের (কর্ণাটকী, তেলেগু, তামিল আর মালায়ালাম) বর্ণমালা আমার জন্য নিয়ে আসবে। এক মাস দেশে ছিলাম। তারপর আবার কর্ণাটক। সেখানে গিয়ে ঐ সকল ভাষাভাষী ফ্রেন্ডদের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ ভাষার বর্ণমালা সংগ্রহ করলাম। ১৯৯২ সনে ছুটি নিয়ে দেশে আসলাম। মুর্তজা ভাইর সাথে দেখা হলো। আমি সব তুলে দিলাম মুর্তজা ভাইর হাতে। মুর্তজা ভাই যে কী খুশি হলেন! মুর্তজা ভাইর সেদিনের খুশির হাসি আমার মনের চোখে এখনো অতি উজ্জল হয়ে ভাসছে।
মনের সব কথা আমি কি করে লিখবো? কেউ কী লিখে রেখে যেতে পেরেছে? পারেনি। সবাই শুধু চেষ্টাই করে গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। পারা সম্ভব না। মনের অকুল সাগরে সাঁতার কাটা যায় কিন্তু গহিন অতলে ডুব দিলে কী আর ফিরে আশা যায়? যায় না। আমিও তাই লক্ষহীনভাবে এদিক ওদিক সাঁতার কেটে যাচ্ছি। ডুব দেবার সাহস আর পাচ্ছি না। ভেবে রেখেছি একেবারে হারিয়ে যাবার, নিঃশেষ হবার অনাবিল এক সাহসি সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই শুধু ডুব দেব। তার আগে নয়।
দুই বিথী। একজন নাজনীন বিথী আরেক জন ফেরদৌস বিথী। আমার দুই ছোট বোন। একজন আমার পক্ষের অন্য জন আমার স্ত্রীর পক্ষের। দুই জনেরই বসবাস ঢাকায়। দুই জনই গুণী মানুষ। খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারে। দুই জনই তাদের পিতৃকুল এবং স্বামীকুলের সকলের অত্যান্ত প্রিয়ভাজন। নাজনীন বিথীর বিয়ে হয়েছে কাজী পরিবারে; অপরদিকে ফেরদৌস বিথীর হয়েছে ভূঁইয়া পরিবারে। কাজী সাহেব ভূঁইয়া সাহেব দুইজনই নিজ নিজ কর্ম ক্ষেত্রে উজ্জল; একজন সংখ্যা বিশেষজ্ঞ (অডিটর) অন্যজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (ডাক্তার)। দুজনই খুব প্রিয় মানুষ সকলের। দুই জনই খুব হাসি-খুশি, আলাপি আর অতিথি আপ্যায়নে সর্বদা অক্লান্ত। দুই বিথীর মধ্যে অন্যতম প্রধান মিল হলো দুই বিথীর কারোই কন্যা সন্তান নাই; প্রত্যেকের আছে দুইটা করে পুত্র সন্তান। নাজনীন বিথীর দুই ছেলের একজন সাইন্সের আরেকজন কমার্সের; ফেরদৌস বিথীর ছেলেদেরও একই অবস্থা- একজন সাইন্সের আরেকজন কমার্সের ছাত্র। আমি বেজায় খুশি এই জন্য যে আমি বিনা কারণে তাদের সকলের প্রিয়ভাজন একজন মানুষ। ছোট্ট একটা সমস্যা – বাসায় বিথী বললে স্ত্রীর অবধারিত প্রশ্ন- কোন বিথী?
শ্বশুর-শাশুড়ী: সেদিন আমার একটা লেখা পড়লো আমার মিসেস। পড়ে বললো- “শ্বাশুড়ী বানান হয়নি। শ্বাশুড়ী লিখতে ‘শ’-র সাথে ‘ব’ লাগাতে হয় না। বানান ঠিক কর”। আমি বললাম- “ঠিক আছে। শ্বশুর লিখতে যদি ‘শ’-র সাথে ‘ব’ লাগিয়ে দিতে হয় শ্বাশুড়ীর ‘শ’ কেন একা থাকবে”? শ্বাশুড়ীর বেলায়ও আমি ‘শ’-কে একা রাখিনি। ‘শ’-র পায়ের কাছে ‘ব’-কে বসিয়ে রেখেছি এবং বলে দিয়েছি চুপ করে শ্বাশুড়ী আম্মার পায়ের কাছে বসে থাক। কোথাও যাবি না। শ্বশুরের চাপরাশি লাগে, শ্বাশুড়ীর লাগে না?
আমরা জানি ছোট-বড়, ধনী-গরীব, মূর্খ-বিদ্যান প্রত্যেকেরই একটা আত্ম সম্মানবোধ আছে। আমরা ছোটকে ছোট, গরীবকে গরীব, মূর্খকে মুর্খ, জ্ঞান করে অসম্মান করতে পারি না। আমরা কারো সাথে দ্বিমত করতে পারি কিন্তু দুর্ব্যবহার করতে পারি না। পারি না বলেই আমরা ভিক্ষুককে “মাফ কর” বলি, গালি দেই না। ভিক্ষুকের চেয়ে এ দুনিয়ায় দুর্বল আর কে আছে? অথচ আমরা সেই দুর্বলকেও বলি- “মাফ কর”। সমাজে মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করে তার ধন-সম্পত্তি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত ডিগ্রী দিয়ে নয়। মানুষের মান-স্থান নির্ধারিত হয় তার রুচিবোধ আর ব্যবহারের নিরিখে।