ডঃ বাহারুল হক : অংকশাস্ত্র, একটা শাস্ত্র বটে! চিরকালই আমার কাছে দুরাধর্য – দুষ্পাচ্য একটা বিষয়। আমার থিওরী হলো- পড়ে যাবো; পড়তে পড়তে বুঝে নেবো। কী সমস্যা তা বর্ণে বাক্যে তুলে ধরা হবে, বর্ণে বাক্যে সে সমস্যার সমাধানও বলে দেয়া হবে। চিহ্ন কেন? + – দ্ধ স্ট ? ( ) ঢ় ? ? ী চিহ্নগুলো দেখলে আমার কেন যেন মনে হয় আমি গোরস্থানে কবরের উপর বেঁধে রাখা এপিটাফ দেখছি। মানব চরিত্রের যে কোন দিক নিয়ে যে কোন সময় দু চার পৃষ্ঠা লিখে দিতে আমি একটুও ক্লান্তি অনুভব করবো না কিন্তু এই চিহ্নগুলো ব্যবহার করে একটা সরল অংক করতেও আমার খারাপ লাগে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি কেন যেন চিহ্নগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে পারি না। পরীক্ষায় ৪০ পেলে আমি খুশি; ৫০ পেলে মহাখুশি। কিন্তু আমার ছোট ভাই ৯৯ পেলে কান্না আর ৯৮ পেলে বিলাপ। একবার সে কান্না জুড়ে দিল। আমি কাছে টেনে এনে বললাম- “কী হয়েছে”? সে বললো- “আমি অংকে ৯৯ পেয়েছি”। আমি বললাম- “তো এতে কান্নার কী আছে”? এবার সে তার ভিতরের রাগ অভিমান দুঃখ সব এক সাথে করে একটু আছাড় দিয়ে প্রশ্নের ঢংয়ে বললো- “আমি যে ১ নম্বর কম পেলাম”? আমি বললাম- আরে খোদা, তুইতো ১ নম্বর কম পেয়েছিস; আমি যে ৫১ নম্বর কম পেয়েছি; আমি কাঁদছি? সে তারপরও কাঁদে। আমার সে ভাই পড়েছে বুয়েটে। আর আমি? আমি বুয়েটের দিকে তাকাতেও পারিনি। আমি পড়েছি ঢাকা (আমজনতা) বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এমন এক বিভাগে যে বিভাগে ভর্তি হতে অংক শাস্ত্র আমি কতটুকু জানি সে কথা উঠেনি।
শাঁখা। শঙ্খ দিয়ে তৈরি গোলাকার সাদা এক জড় বস্তু। এ বস্তু দু’হাতে দু’টি পরলেই হলো। ব্যস। আর কিছু বলতে হবে না। যিনি হাতে পরবেন তার নিখুঁত পরিচয় তুলে ধরবে এ দুটি শাঁখা। তিনি দেখতে যেমনই হোন, তার বেশ-ভুষা যেমনই হোক, তার হাতে পরা সাদা শাঁখা দুটি বলে দেবে- তিনি একজন নারী, তিনি জাতিতে বাঙালি, ধর্মে হিন্দু- সে বর্ণের হিন্দু যে বর্ণের হিন্দুদের কাছে প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো দুর্গা পূজা উৎসব; বলে দেবে- তিনি কথা বলেন বাংলা ভাষায়, তিনি বিবাহিতা এবং তার স্বামী বর্তমান অর্থাৎ তিনি সধবা। আর কী দরকার? সবইতো বলা হয়ে গেলো। এ বস্তুটি এভাবে ব্যবহারের প্রথা কখন কে শুরু করেছেন আমি জানি না। তবে যিনি এ প্রথার প্রবর্তন করেছেন তিনি নিশ্চয়ই অনেক ধী শক্তির অধিকারী কারণ তিনি একটা মানুষের অনেক রকম পরিচয়কে দুটি শাঁখার মধ্যে বন্দী করে দিয়েছেন। মানবাত্মার সব কথা যেমন অক্ষরের শৃঙ্খলে বইয়ের পাতায় বাঁধা পড়ে আছে ঠিক তেমন। আমেরিকা কানাডার যেখানেই গিয়েছি এই শাঁখার দেখা পেয়েছি। দেখলেই ইচ্ছা হয়- কাছে যাই, মায়ের ভাষায় একটু কথা বলি। বিশ্ব দুরাত্মা রবার্ট ক্লাইবের ভাষায় কথা বলে যে কোন আনন্দ পাই না।
১৯৮০ সন। আমি ভিক্টোরিয়া কলেজের লেকচারার। বহিঃ পরীক্ষক হয়ে কুমিল্লা থেকে গেলাম গ্রামের এক কলেজে (নাম মনে নাই)। রাতে আমি আরসে কলেজের দুজন শিক্ষক সহ তিনজন ঘুমাচ্ছিলাম একটা ঘরে, যে ঘরের আশে পাশে আর কোন ঘর-বাড়িছিল না। বিদ্যুত ছিল না। গায়ে যাতে বাহিরের বাতাস লাগেসে জন্য ঘরের একটা জানালা (গ্রিল বা রড বিহীন) খোলা রেখে আমরা ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। অন্ধকার হলেও বুঝা যাচ্ছে দুজন মানুষ ধস্তাধস্তি করছে, কিন্তু কোন কথা নাই। প্রচন্ড ভয় পেয়ে আমি ঢুকে গেলাম খাটের নিচে। কিছুক্ষণ পর ধস্তাধস্তিবন্ধ হলো; আলো জললো। দুজনের কথা শুনলাম। আমাকে খুঁজছে। আমি নিশ্চিত হলাম এ দুজন সেদুজন। আমি বের হয়ে তাদের সামনে বসলাম। সব শুনলাম। তারপর আবার সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। আসলে হয়েছে কি- গভীর রাতে ঠান্ডা লাগছে দেখে একজনউঠে মাত্র জানালা বন্ধ করলো। ঠিক তক্ষণি তাকে চোর মনে করে অন্যজন তার উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলো। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, এতে যার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেও যে ঝাঁপিয়ে পড়লো তাকে মনেকরলো চোর। এবার কোন কথা না, শুধু ধস্তাধস্তি। কিছুক্ষণ পর দুজনের ভুল ভাঙ্গলে পরিবেশশান্ত হলো। ব্যাপারটা সে দুজন শিক্ষক বেশ উপভোগ করলেও আমার ভালো লাগেনি। এমন রাত আমার জীবনে আর আসেনি। ৪০ বছর আগের ঘটনা, কিন্তুআমার স্মৃতিতে এত উজ্জল হয়ে আছে যে মনে হয় গত কালের ঘটনা।
নিরপেক্ষতার ভান করে তথাকথিত সুবিচারের লক্ষ্যে কেউকেউ বলে বসেন- “হাঁ, বুঝেছি; একহাতেতো আর তালি বাজে না”। হাঁ, ঠিক বলেছেন। তালিদিতে দুই হাত লাগে। কিন্তু সে দুই হাত যে দুই জনের সে ব্যাপারে আপনি কিভাবে নিশ্চিতহলেন? সে দুই হাততো একজনেরও হতে পারে। কারণ প্রত্যেকেরই দুইটা হাত আছে। যারা কুটিল-জটিল-অতিচালাক তারা নিজের দুই হাত দিয়ে তালিটা দেওয়ার পর একটা হাত সরিয়ে বলেন- “এই যে আমারতো শুধু এক হাত, অপর হাত আমার ছিল না”। অপর হাত কার ছিল? চালাকেরা এবং তাদের পক্ষের লোকজন তখন বলে- “অপর হাত ওর ছিল। এক হাতেতো তালি বাজে না”। এভাবে ওকে জড়িয়ে ওকে ফাঁসানোরচেস্টা করা হয়। মনে পড়ে: ১৯৮৬ সনে ফুটবলের বিশ্বকাপ খেলার সময় মাঠে বিশ্বখ্যাত ফুটবল তারকাম্যারাডোনা হাত দিয়ে হঠাৎ বিপক্ষের জালে বল ঢুকিয়ে দেন। পরে তাকে বলা হলো – “ওটা তোমারহাত”। ম্যারাডোনা বললো- “না, ওটা আমার হাত ছিল না। ওটা ছিল ঈশ্বরের হাত”। বাপরে,কী আশ্চার্য্য কথা! বাঁচার প্রয়োজনে নিজের অপকর্মকে ঈশ্বরের কর্ম বলে চালিয়ে দেওয়া।