ড : বাহারুল হক : সেই শিশু কাল থেকে ফুল আমার খুব প্রিয়। ফুল দেখলেই আমার ভিতরটা চনমনে হয়ে উঠে। আমাদের বাড়ির কাছেই একটি বর্ডার আউট পোষ্ট ছিল। সেখানে ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) নামে পুর্ব পাকিস্তান সীমান্ত রক্ষীরা থাকতো। দেশ স্বাধীন হলে ইপিআর নামটা মুছে দিয়ে নাম রাখা হলো বিডিআর। এখন সীমান্ত রক্ষীরা আর সে নামেও নাই। তাদের পরিচয় এখন বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)। আমাদের বাড়ির কাছের সেই বর্ডার আউট পোষ্টে ইপিআরদের তৈরি করা একটা ফুলের বাগান ছিল। ফুলের বাগানটা খুব সুন্দর; নানা রকম ফুল গাছে ভরা। আমি ফুল বাগান দেখতে মাঝে মাঝে যেতাম সেখানে। ফুলের প্রতি আমার দুর্বার আকর্ষণ দেখে ইপিআর সদস্যরাও খুব খুশি হতেন। বর্ডার আউট পোস্টের সেই ফুল বাগানটি দেখে একটা ফুল বাগান করার প্রচন্ড ইচ্ছা আমার মনে জাগলো। আমাদের বাড়িটা বেশ বড়। বাড়িতে অনেক যায়গা খালি পড়ে আছে। আমাদের ঘরের এক পাশে ঘর থেকে বাড়ির বাউন্ডারী ওয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত একটা যায়গা আমার পছন্দ হয়ে গেল। সে যায়গায় কয়েকটা কাগজী লেবু গাছ ছাড়া আর কিছু নাই। আব্বাকে একদিন আমার বাগান করার ইচ্ছার কথা বললাম। আব্বা সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। আব্বা কাগজী লেবু গাছগুলো কেটে ফেলে দিলেন এবং জায়গাটা ফুল বাগান করার জন্য আমাকে দিয়ে দিলেন। আমাদের বাড়িতে আবাসিক কাজের ছেলে ছিল। আমার ইচ্ছায় আর তাদের শ্রমে কয়েক দিনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল বাগানের প্রাথমিক অবকাঠামো। বাগানের চৌদিকে বাঁশের বেড়া দেয়া হলো মজবুত করে। একদিকে রাখা হলো একটা গেট বাগানে প্রবেশ এবং নির্গমনের জন্য।
এবার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রকমের ফুল গাছের চারা সংগ্রহ করে আমার বাগানে লাগাতে শুরু করলাম। ফুল গাছের চারা সংগ্রহ করলাম প্রথমে বর্ডার আউট পোষ্টে ইপিআরদের বাগান থেকে। তারপর কিছু চারা আনলাম আমাদের পাশের গ্রামের কুমার পাড়ার হিন্দুদের বাড়ি থেকে। হিন্দু ধর্মে পুজো অর্চনার জন্য নানা রকম সামগ্রী ব্যবহারের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী হলো ফুল। ফুল ছাড়া কোন পুজো সম্পুর্ণ হয় না। পুজোর জন্য আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ সামগ্রী হলো তুলসী পাতা। তুলসী গাছকে ‘হিন্দুয়ানী’র প্রতীক ধরা হয় (বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভ প্রতিম কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লার কালজয়ী সৃস্টি ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ থেকে আহৃত)।
প্রত্যেক হিন্দু বাড়ির প্রবেশদ্বারের একদিকে কলা গাছ অন্যদিকে থাকে তুলসী গাছ। হিন্দুদের বিশ্বাস এতে বাড়ির সমস্ত নেতিবাচক শক্তি দুর হয়ে যায়। বাড়িতে বসবাসকারী মানুষ জনের মঙ্গল হয়। সে বয়সেতো এত কিছু বুঝতাম না। আমার হিন্দু বন্ধুদের মুখে তুলসী গাছের ঔষধি গুনের কথা শুনলাম। তারা বলেছিল তুলসী পাতার রস খেলে কাশি ভালো হয়। একদিন আমি এক হিন্দু বাড়ি থেকে এনে আমার বাগানের এক কোনায় একটি তুলসী গাছের চারাও লাগালাম। ফুল গাছের কিছু চারা আমি এনেছিলাম আমাদের থানা কমপ্লেক্স থেকে। আমার যত্নে কিছুদিনের মধ্যে আমার বাগানটা একটা সুন্দর রুপ ধারন করলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাগানে। দেখতাম নতুন কি কি ফুল ফুটেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরো দেখতাম কিভাবে পাপড়িগুলো প্রজাপতির মত পাখনা মেলে ধরলো। স্কুল থেকে এসে আবার বাগানে। দেখতাম কোন ফুলটা শ্রীহীন হয়ে ঝরে পড়ার অপেক্ষায় আছে। সে সব ফুলের দিকে তাকাতে আমার কষ্ট হতো। পাতা বাহারের সৌন্দর্যও আমার মনকে ঊর্মিল করে তুলতো। পাতা বাহার নিয়ে আমার বেশ স্বস্তিবোধ ছিল। কারণ পাতা বাহার সিজনাল ছিল না; সারা বছরই পাতা বাহার গাছ তার রঙিন পাতা মেলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। পাতা বাহার মানে কম যত্নে অধিক সৌন্দর্য। বাঁশ দিয়ে বানানো বাগানের গেটটা ছিল বেশ উঁচা এবং বালামি নৌকার ছৈ আকৃতির। আব্বা কোথা থেকে যেন নিয়ে আসলেন স্বর্ণলতা গাছ এবং সেগুলো লাগালেন। স্বর্ণলতা দ্রæত বাড়তে লাগলো। আব্বা সে গুলোকে গেটের উপর তুলে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যে পুরো গেট স্বর্ণলতায় ঢেকে গেল। গেটটা দেখতে কি যে সুন্দর লাগতো! আব্বা বলতেন আমি নাকি আমার আব্বার আব্বার মত হয়েছি। আমার দাদারও নাকি শখ ছিল ফুলের বাগান করা। আমাদের পুরান বাড়িতে আমার দাদার করা একটা ফুলের বাগান ছিল। সে বাগানেও এরকম গেট ছিল এবং গেটের উপর স্বর্ণলতা ঝুলে থাকতো। সে বাগানের কথা মনে করে নাকি আব্বা আমার বাগানের গেটে স্বর্ণলতা লাগিয়েছেন।
১৯৪৭ সনে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হলো। পাকিস্তানের আবার দুইটা অংশ- ভারতের পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান আর পুর্বের পুর্ব বাংলা হলো পুর্ব পাকিস্তান। আমরা পুর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা। আমাদের পাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। আমাদের বাড়িটা পড়ে গেল একেবারে ত্রিপুরা সিমান্তে। বিভক্ত ভারতে আমরা পুর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি ঠিক, তবে আমাদের অনেক জমি ভারতের জমি হয়ে গেছে। আমাদের সম্পত্তির পরিমাণ কমে গেছে। যাই হোক, সীমান্ত এলাকায় ভারতের একেবারে গা ঘেষা সেরকম একটা বাড়িতে বসবাস করা অসম্ভব ভেবে আমার আব্বা সিমান্ত থেকে দুরে ভিতরের দিকে একটা বাড়ি করলেন। সেটাই এখন আমাদের বাড়ি। ঘর আর বাগান ছাড়া আর সবই এখনো পুরান সে বাড়িতে আছে। সে বাড়িকে আমরা এখনো আমরা পুরান বাড়ি বলি। সেই পুরান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে আমাদের পুর্ব পুরুষদের পাশে আমার আব্বা আম্মাও শেষ সয্যায় শায়িত আছেন। নতুন বাড়িতেই আমার জন্ম। ফলে দাদার বাড়ি, দাদার ফুল বাগান কিছু আমার দেখার সুযোগ হয় নাই।
আমাদের বাড়ির পাশে যে প্রাইমারী স্কুলে আমি পড়েছি সে স্কুলটাতেও ছিল একটা ফুলের বাগান। স্কুলের অভ্যান্তরীণ পরিবেশ বা লেখা পড়া নয় বস্তুত বাগানের টানেই আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকতাম। প্রাইমারীর পর ভর্তি হলাম হাই স্কুলে। সে স্কুলে কোন ফুল বাগান তো দুরের কথা একটা ফুল গাছও ছিল না। ফলে, আমার দৃস্টিতে, ফুল বা ফুল বাগানহীন আমাদের হাই স্কুলটাকে শ্রীযুক্ত বলে আমার মনে হতো না। বাড়িতে আমার ফুল বাগান নিয়েই আমার যত ব্যাস্ততা। এবার আমি বই পড়া শুরু করলাম। বাগান করাতো শখ ছিলই, এবার নতুন শখ হলো বই পড়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটা ছোট গল্পের নাম বলাই। সে বইতে রবীন্দ্রনাথ তার ভাইপোর নাম বলাই বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলাইকে নিয়ে গল্প লিখেছেন। বলাইকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছু লিখেছেন। লিখেছেন বলাইয়ের স্বভাব প্রকৃতির কথা। লিখেছেন বলাই কি পছন্দ করে আর কি পছন্দ করে না সে সব কথা। বলাইকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবের পুর্ণতা ফুটে উঠেছে বলাই গল্পের বাক্যে বাক্যে। শ্রাবনের বৃস্টির ঝমঝম ধ্বনি যে বলাই শুধু কান দিয়ে নয় সমস্ত গা দিয়ে শুনতো, পড়ন্ত বিকেলে ছাদে গা খোলা বলাই একা একা বসে ড্যাবা ড্যাবা চোখ মেলে উন্মুক্ত আকাশের দিকে নির্ণিমেষ দৃস্টিতে তাকিয়ে থেকে কি দেখতো তা সবই রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন। কিন্তু বলাইকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ যে একটা বাক্য লিখেছেন সে বাক্যটি আমার হৃদয়ে আজীবন বিঁধে থাকবে। তিনি লিখেছেন- “আমার ভাইপো বলাই- তার প্রকৃতিতে কেমন করে গাছপালার মূল সুরগুলোই হয়েছে প্রবল”। রবীন্দ্রনাথের বলাই পড়ে আমি মৃদু হাসলাম আর মনে মনে বললাম- আরে আমিওতো বলাই। আহা! যদি রবীন্দ্রনাথের ভাইপো হতাম তাহলে রবীন্দ্রনাথ তো আমাকে নিয়েও হয়তো একটা চমৎকার গল্প লিখতেন।
হাই স্কুল শেষ হলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম প্রথমে কুমিল্লা তারপর ঢাকা। আমার ফুল বাগানটা অযত্নে শেষ হয়ে এক সময় একেবারে নাই হয়ে গেল। আমি ছাড়া আর কেহ এ জন্য তেমন ব্যাথা অনুভব করে নাই। প্রাইমারী স্কুলের পর ফুলেল যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমি পেয়েছিলাম সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কার্জন হলের এবং ফজলুল হক হলের ফুলের বাগানের সৌন্দর্যের কথা এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জল হয়ে আছে। নানা রকমের ফুলে ভরে থাকতো কার্জন আর ফজলুল হক হলের ফুল বাগান।মালীদের কঠোর পরিশ্রমের ফসল ছিল এসব ফুল বাগান। কেউ ফুল ছিঁড়লে আমার খুব কষ্ট লাগতো। শুধু ছেলেদের ফজলুল হক হল নয় ফুলে ফুলে ভরা ছিল মেয়েদের রোকেয়া হলও। রোকেয়া হলের ফুল নিয়ে এবার এক মজার ঘটনার বিবরন দিব। হলের ভিতর ছোট ছোট বাগান। বাহারি ফুল ফুটে আছে সে সব বাগানে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে যায়। মেয়েরা যাতে ফুল না ছিঁড়ে সে জন্য বাগানে স্ট্যান্ডে বোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে আর সে সব বোর্ডে স্পস্ট করে বাংলায় লিখে রাখা হয়েছে- “ফুল ছিঁড়া নিষেধ”।
এক মেয়ে নিষেধ মানলো না। সে বাগানে গিয়ে ছিঁড়ে নিলো দুটো ফুল। কর্তব্যরত হাউজ টিউটর অফিস থেকে দেখলেন, দৌড়ে গেলেন মেয়েটার কাছে এবং বললেন- “ফুল ছিঁড়া নিষেধ” লেখা দেখার পর ও তুমি কেন ফুল ছিঁড়লে? মেয়েটি বললো- ম্যাডাম, আমি মেয়েতো তাই নিষেধ মানিনি। ম্যাডাম এবার রাগ হয়ে বললেন- বুঝিয়ে বল কি বলতে চাও। মেয়েটি বললো- “ম্যাডাম, মেয়েরাতো নিষেধ মানে না। এটা মেয়েদের স্বভাব। আদম হাওয়া বেহেশতে ছিলেন। আল্লাহ বলে দিয়েছিলেন- গন্ধম ফল খাবে না। গন্ধম ফল খাওয়া নিষেধ। কিন্তু হাওয়া কি করেছেন? তিনি নিষেধ মানেন নি। তিনি গন্ধম ফল খেয়েছেন। এতে তো বুঝা গেল মেয়েরা নিষেধ মানে না। আমিও তো মেয়ে, আমিও মানি নি। আমার ভুল হয়ে গেছে, ম্যাডাম”। ম্যাডাম মেয়েটার কথা শুনে না হেসে পারলেন না। তারপরও বললেন- “দেখ, হাওয়াকে নিষেধ অমান্য করার জন্য সাজা পেতে হয়েছে। আদম হাওয়ার বেহেশত জীবনের ইতি টানা হয়েছে। তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে”। মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতী। সে ম্যাডামের কথা শুনে ঝটপট বললো- “ম্যাডাম আমাকেও সাজা দেন। আমাকে দোতলায় একটা সিট দেন। দোতলায় থাকলে রুমের সামনে বাগান ও পাবোনা, ফুল ও আর ছিঁড়বো না”। আল্লাহ হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ম্যাডাম দোতলায় একটা সিট দিয়ে মেয়েটাকে দোতলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি।