অনলাইন ডেস্ক : রমজানে আঙুর-আপেলের পরিবর্তে দেশি ফল বরই-পেয়ারা দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দিয়ে সম্প্রতি সমালোচনার মুখে পড়েন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। কিন্তু বাজারে সেই দেশি ফলও সাধারণের নাগালের বাইরে।

রমজানের ইফতারে যেকোনো একটি ফল রাখার চেষ্টা থাকে সব শ্রেণির মানুষের। কিন্তু বাজারে দেশি ও আমদানি করা সব ধরনের ফলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ফলে এবার বেশিরভাগ মানুষকে ফল ছাড়াই ইফতার করতে হতে পারে।

রাজধানী ঢাকায় ফলের সবচেয়ে বড় পাইকারি আড়ৎ বাদামতলী ও কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজান সামনে রেখে দেশি ও আমদানি করা সব ধরনের ফলের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে
সাধারণ মানুষ বলছেন, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বাজারে সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইফতারে বেশি দামের ফল রাখার উপায় নেই। কেউ যদি ফল রাখেনও সেটি হবে ‘বিলাসিতা’।

ডলারের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি আমদানি করা আপেল, কমলা ও আঙুরের ওপর গত বছরের মে মাস থেকে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কারোপ করায় প্রায় এক বছর ধরেই এসব ফলের দাম বাড়তি। রমজানে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে আবার দাম বেড়েছে।

ফল ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার আমদানি করা ফলকে বিলাসী পণ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ২০ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে। সম্প্রতি আরও দুটি ফলে নতুন করে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া রমজানের কারণে ফলের চাহিদাও বেড়েছে। এ কারণে ফলের বাজার কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছে।

বাদামতলী ফলের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, রমজান সামনে রেখে সব ধরনের ফলের সরবরাহ বেড়েছে। গত ১৫ দিনে প্রচুর ফল আমদানি হলেও দাম কমার কোনো লক্ষন নেই। বরং ক্ষেত্র বিশেষে দাম আরও বেড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে বেশিরভাগ ফল আমদানি করতে হয়। কিন্তু গত বছর থেকে সরকার এসব ফলকে ‘বিলাসী পণ্য’ তকমা দেওয়ায় নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। রাজস্ব বোর্ড ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে। এর সঙ্গে ডলার সংকট, তেল ও জাহাজের কনটেইনারের ভাড়া বাড়ায় ফলের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তবে রমজান উপলক্ষ্যে সরকার ফল আমদানিতে এলসি খোলার পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়ায় বাজারে ফলের কোনো সংকট নেই। দাম কমানোর উপায় আমাদের হাতে নেই। সরকার চাইলে কিছু করা সম্ভব।

শুধু রমজান মাসের জন্য হলেও ফলের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করার দাবি জানান তিনি।

ফলের দামের তুলনামূলক চিত্র তুলে আনতে রাজধানীর বাদামতলী, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, শান্তিনগর, ঝিগাতলা পরিদর্শন করেন প্রতিবেদক। দেখা যায়, সব বাজারেই কাছাকাছি মূল্যে পাইকারি ও খুচরায় ফল বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি বাজারে ক্রাউন আপেল ২০ কেজির বক্স বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার টাকায়। ফলে পাইকারিতে প্রতি কেজি আপেলের দাম পড়ছে ১৯০-২০০ টাকা। খুচরা বাজারে এটি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা।

ফুজি আপেলের ২০ কেজির বক্স ৪৫০০-৪৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে প্রতি কেজি ফুজি আপেলের দাম পাইকারিতে পড়ছে ২২৫-২৩৫ টাকা। খুচরা বাজারে এই আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা।

মিশরের মাল্টা ১৫ কেজির বক্স পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ থেকে ২৯০০ টাকায় (প্রতি কেজি ১৮৬-১৯০ টাকা)। খুচরা বাজারে এটি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা।

ভারতের সাদা আঙুর ছোট ক্যারেট (৯ কেজি) ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা, বড় ক্যারেট (৯ কেজি) ৩৮০০ থেকে ৩৯০০ টাকা এবং দেশটির কালো আঙুর ছোট ক্যারেট ৩ হাজার থেকে ৩২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব আঙুর প্রকারভেদে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজিতে।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে আনার ও আঙুর কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। মাঝারি আকারের আনারের কেজি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা, কালো আঙুরের কেজি ৩০০ থেকে ৩২০ এবং সাদা আঙুরের কেজি ২১০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

চায়না কমলা (৯ কেজি) ১ কার্টন পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৮৫০ থেকে ১৯০০-২০০০ টাকায়, কেজি ২০০-২১০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রকারভেদে এ কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। গ্রিন কমলা পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে কেজি ১৫৭ টাকা, খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায়।

রোজায় ইফতারের আরেকটি জনপ্রিয় ফল আনারস। অন্যান্য বছর রসালো এ ফলটি মোটামুটি ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকলেও এবার এটিরও দাম বেশি। বড় সাইজের একটি আনারস খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি দামে। একই আনারস এক বছর আগে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মাঝারি ও ছোট আকারের আনারসের পিস বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়।

এদিকে দেশি ফল পাকা কলার ডজন আট-দশ দিন আগেও কেনা গেছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, এখন ডজনে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। চম্পা কলা ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। সবরি কলা ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকার মতো বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

গ্রীষ্মের ফল তরমুজের বেচাকেনাও শুরু হয়েছে অল্প পরিসরে। বিক্রেতারা প্রতি কেজির দর রাখছেন ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। সেই হিসাবে মাঝারি আকারের একটি তরমুজের দাম পড়ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
পেয়ারার কেজি সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। আগে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। বেদানা ৩৫০-৪০০ টাকা, সফেদা/আতাফল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড বরই বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০০ থেকে ১৩০ টাকা দরে।

শান্তিনগর বাজারের ফলের ব্যবসায়ী সাদিকুল বলেন, এবার আমদানি করা সব ফলের দাম বেশি। শুধু রমজান সামনে রেখে সব ধরনের ফলে দাম বেড়েছে। আমাদের যেহেতু কিনতে হয় বেশি দিয়ে তাই কিছু করার নেই।
তিনি বলেন, ফলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। এই দুর্মূল্যের বাজারে তারা সংসার চালাবে নাকি বিলাসিতা করে ইফতারে ফল খাবে?

রোজায় ফলের শুল্ক প্রত্যাহার করার দাবি জানান তিনি।

এ ব্যাপারে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ফলের বাজার এখন নিম্নমধ্যবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্তদেরও নাগালের মধ্যে নেই। এর কারণ সরকারের শুল্কারোপের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় মুনাফা অর্জন। রমজানকে ব্যবসায়ীরা সুযোগ হিসেবে নেন এবং কারণ ছাড়াই ফলের দাম বাড়ান। অন্যান্য পণ্য কিছুটা মনিটরিং করা হলেও ফলের বাজারে কোনো মনিটরিং নেই।