সাইফুল ওয়াদুদ : ১৯৯৪ সাল, আমাদের বড় মেয়ে মুনিয়া গল্প জন্মের পর কামাল ভাই মেয়ের জন্য একটা ছড়া লিখে ছিলেন,
এক, দুই, তিন
নাচে ধিন ধিন
সবার আশীষ নিয়া
মোমের পুতুল মুনিয়া।

লেখাটা আমি অনেক দিন যত্ন করে রেখে দিয়ে ছিলাম। পুরোনো দিনের স্মৃতি চিহ্ন। মানুষ চলে যায়। স্মৃতি চিহ্ন রেখে যায়। এক বছর আগে ডিসেম্বর মাসে নবু ভাবি পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। আজ চলে গেলেন কামাল ভাই নিজেও। অদ্ভুত এক পড়ুয়া ছিলেন কামাল ভাই নবু ভাবি দু’জনাই। আমার মনে হতো ছাপার অক্ষরে যা যা ওনাদের চোখের সামনে আসত তাই দুজনেই বিপুল আগ্রহে পড়ে ফেলতেন। আসরে, মিটিং, ঘরে, বাহিরে কিংবা দূরালাপনে লাগামহীন কথার ফুল্ঝুড়ি ছোটাতেন কামাল ভাই। একটা সময় এমন হলো আমি আর কামাল ভাইয়ের এসব কথার ফাঁকে ফোকরে অসঙ্গতি ধরতে আগ্রহ বোধ না করে বরং অবাক হয়ে ভাবতাম, কামাল ভাই যেনোবা ইতিহাসের অদ্ভুত এক ফিকশনাল ক্যারেক্টর! সুনীল গাঙ্গুলীর সেই সময়ের ভেতর ঢুকে পরা অতীত ইতিহাসে গল্পের খাতিরে লেখকের তৈরি করে নেয়া এক যুতসই চরিত্র বা সুত্রধর। কামাল ভাই এর নিরলস ইতিহাস, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম গো-গ্রাস পাঠ উনাকে পৌঁছে দিতে পারত এক কাল্পনিক বাস্তবতায়। যার কারণে উনি পারতেন – বর্তমান থেকে ইতিহাসের অলিগলিতে অনায়াসে ঢুকে পরতে, যখন তখন, যেমন চাইতো তেমন করে। কখনো কাছে থেকে কখনো দূরে থেকে গত প্রায় তিরিশ বছর ধরে কামাল ভাইকে জানি, জীবন গল্পের অদ্ভুত এক চরিত্র ছিলেন তিনি! যার যতটুকুন সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি কর্তা তার ততটুকুনই সৃষ্টি করেছেন তিনি নিজেকে নিজেই। বড়ো অদ্ভুত এক মানুষ ছিলেন কামাল আহমেদ।

প্রায় ষোল, সতেরো বছর আগের কথা। আমি তখন মন্ট্রিয়লে টরন্টো থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজের হকারী করি, সাথে ওই পত্রিকার মন্ট্রিয়ল পাতাটি এক প্রকার সম্পাদনা করি। কামাল ভাই বাংলা কাগজের জন্য প্রায় নিয়মিত লিখতেন। লেখা লিখে কামাল ভাই ফোন করে ডাকতেন। মন্ট্রিয়ল পার্ক-এক্সটেনশনের কার্বস্ রোডের একটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর তিন তলায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনে থাকতেন। প্রতি সপ্তাহে উনাদের জন্য দু’কপি বাংলা কাগজ নিয়ে গিয়ে তিন তলায় উঠে দিয়ে আসতাম। ফিরবার সময় ভাবি হাতে গুজে দিতেন এক/দুইটা চকলেট। কখনো অজুহাত দিতে না পেরে কখনো বা ইচ্ছে করেই বসে বসে এক চেটিয়া কামাল ভাইয়ের কথা শুনে আসতাম। কখনো কাবুলি ওয়ালার বাঙালি বৌয়ের চিঠির গল্প তো কখনো তাঁর প্রিয় পাত্র গোবিন্দ হালদারের একটি ফুলের গান! কখনো উনার ঋত্বিক দা আর মানিক’দার গল্প। যুক্তিও নয়, তক্কোও নয়। উনার গপ্পোটাই শুনতাম। শুনতে ভালো লাগতো। ষোল সতেরো বছর আগের সেই সময়ের কোন এক দিন, মন্ট্রিয়লে ওনাদের এপার্টমেন্টে একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকারটি (https://youtu.be/qZmmdBVvPFw) নিয়ে ছিলাম। কোন আলোতে বসতে হবে, কেমন করে বলতে হবে যেমন বলেছি খুশি মনে করেছেন। উনার লেখা ছাপা হলে নিয়ে গিয়ে হাতে দিলে খুশি হতেন খুব।

শেষবারে ২০১৮-তে টরন্টোতে এক দুবার যখনই দেখা হয়েছে, আগ্রহ নিয়ে কাছে ডেকে নিয়ে কথা বলতেন। অনেক অনেক কথা। কথার মাঝে বলতেন, তোমার প্রতিভা ছিল কিন্তু কিছু করতে পারলে না। আমাকে উপদেশ দিয়ে বলতেন, তুমি বিষয় নির্বাচন করতে জানো না। কি সব বানিয়েছো, ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি। আমি হাসি মুখে শুনে আসতাম সে সব। কখনো পাল্টা করে কিছু বলিনি উনাকে। গত কয় মাস আগে হঠাৎ এক দিন ফেইসবুকে কামাল ভাই এর ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পেয়ে সাথে সাথেই এক্সেপ্ট করে নেই। কামাল ভাইয়ের প্রোফাইলে দেয়া ছবিটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। তিরিশ বছর আগের কথা মনে করে বিষহ্ন হয়েছি। হায় সময়, কেমন করে জীবনের কতটা সময় পেরিয়ে গেল, না কি ফুরিয়েই গেল!

ফেইসবুকে আমাকে শেষ কমেন্টটি কামাল ভাই করে ছিলেন মাসখানেক আগের এক ভোরে। তিনি ইরেজী হরফে লিখেছিলেন, Murthy vangarbiruddhe gonoakroser film docu,etihaser dolil,hoye thakbe.chutey jao dhaka.jholmoliar kono abèdon nei. (মূর্তি ভাঙ্গার বিরুদ্ধে গণআক্রোশের ফিল্ম ডকু, ইতিহাসের দলিল, হয়ে থাকবে। ছুটে যাও ঢাকায়। ঝলমলিয়ার কোন আবেদন নেই।) কামাল ভাইয়ের এই কথার জবাবে আমি আর লিখি নাই যে দশ বছর আগে আমি একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছিলাম যার নাম অপরাজেয় বাংলা। বিষয়টা অনেকটাই আপনি যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে বলছেন সেটাই ছিল। জানি না আপনি জানতেন কি, না! কামাল ভাই আর কোন দিন দেখা হবে না। আর কখনো বলবেন না, তোমার প্রতিভা ছিল কিন্তু কিছু করতে পারলে না।
আহা, জীবন এতো ছোট কেন!