হাসান গোর্কি : এক দুরন্ত বালককে পড়ার টেবিলে বসানো যায় না। তার জন্য গৃহ শিক্ষক নিয়োগ করা হলো। শিক্ষকদের বলা হলো তারা যেন খেলার ছলে বালককে শিক্ষা দেন। প্রকল্পটা শুরুর প্রথম দিন শিক্ষক একটা কাগজে অজগরের ছবি এঁকে বললেন, “এটা অজগর। ভয়ানক সাপ। মানুষকেও খেয়ে ফেলতে পারে।” সাথে যোগ করে দিলেন, “অজগর লিখতে ‘অ’ লাগে।” তিনি অন্যমনস্কভাবে অজগর আকৃতির একটা ‘অ’ লিখলেন এবং বললেন, “এটা হলো ‘অ’।” বালকের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। পরদিন একটা স্কেল নিয়ে অন্য শিক্ষক এলেন। বললেন, “এই স্কেলটা এক ফিট লম্বা। বলো তো এর এক মাথা থেকে অন্য মাথার দূরত্ব কত?” বালক বুদ্ধিটা ধরে ফেলল; সে শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ঢুকতে রাজি নয়। বলল, “এই দূরত্বটা কেউ জানে না।” তারপর মাদুর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ও, তুমি অংকের শিক্ষক, তাই না!” গল্পটা আমরা সবাই জানি। নতুন করে বলার কারণ উত্তরটা ঠিক ছিল কিনা সেটা বুঝতে চেষ্টা করা।

একের পরের সংখ্যা ১.৯। এর পরেরটা ১.৯৯। এভাবে পরবর্তীগুলো ১.৯৯৯, ১.৯৯৯৯, ১.৯৯৯৯৯। এভাবে লিখতে থাকলে দুই এ পৌঁছার আগে আমরা অনন্ত সংখ্যক সংখ্যা লিখতে পারব। এর অর্থ আমরা কখনও দুই এ পৌঁছাতে পারব না। অন্য কথায় এক ও দুইÑ এই দুটি সংখ্যার মধ্যে অনন্ত সংখ্যক সংখ্যা লেখা সম্ভব যাদের যোগফল এক এর চেয়ে কম হবে। কিন্তু আমরা এটা নিশ্চিত করে জানি অনন্ত সংখ্যক সংখ্যার যোগফল অনন্ত হবে। যেমন অনন্ত সংখ্যক ধূলিকণা দিয়ে যদি একটা গ্রহ বানানো হয় তার আকৃতিও অনন্ত হবে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়!

আনুমানিক ৪৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জেনো এরকম একটা সমস্যার কথা বলেছিলেন। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের পর এথেন্সে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে তর্ক হতো। জেনো একটা গল্প ফাঁদলেন। গল্পটা এরকম: বীর একিলিস সমুদ্রের পাড়ে হাঁটছেন। এক কচ্ছপ তাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জ করল। শুধু একটা শর্ত- তাকে কিছুদূর সামনে থেকে দৌড় শুরু করতে দিতে হবে। একিলিস (যিনি সদ্য অলিম্পিক দৌড় প্রতিযোগিতায়ও বিজয়ী হয়েছেন) রাজি হলেন। দৌড় শুরু হবে এমন সময় কচ্ছপ বলল, “আচ্ছা ভায়া, আমি যদি যুক্তি দিয়ে প্রমান করে দিতে পারি যে তুমি আমাকে হারাতে পারবে না তাহলে কি তুমি হার মেনে নেবে?” একিলিস বললেন, “হ্যাঁ, তুমি যদি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারো তাহলে আর দৌড়ে লাভ কী !” একিলিস যুক্তিতে হেরে আর দৌড়াননি। এটা জেনোর প্যারাডক্স হিসেবে পরিচিত।

(এই লিংক থেকে পড়তে পারেন :
https://www.osamanno.com/%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A1%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B8/ )

কচ্ছপের যুক্তিটা বলি। কচ্ছপ বালিতে একটা ছবি (নিচের ছবিটা) এঁকে বলল, “দেখো তুমি আমাকে যে স্থানটিতে স্পর্শ করতে যাবে সেই মুহূর্তে আমি আরও কিছুটা এগিয়ে যাবো। তুমি পরের লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে আমি আবার কিছুটা এগিয়ে যাবো। কারণ স্থান হলো অসীম সংখ্যক বিন্দুর সমষ্টি এবং সময় হলো অসীম সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষণের সমষ্টি। ফলে তুমি আমার সাথে দুরত্বের ব্যবধান শূন্যে নিয়ে আসতে পারবে না। তাই আমাকে কখনও অতিক্রমও করতে পারবে না।” যদিও বাস্তবে একিলিস কচ্ছপকে অতিক্রম করে যাবেন, কিন্তু অংক দিয়ে ঐ সময়টা বের করা যায় না যেখানে কচ্ছপের সাথে একিলিসের দূরত্ব শূন্য হয়। যে সংখ্যাটা বের হয় তার দশমিকের পর অনন্ত সংখ্যক সংখ্যা বসতে থাকে।

ত্রিশ লাখ বছর আগের অস্ট্রালোপিথেকাস মানবের তুলনায় আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি অনেক বেড়েছে। এই বৃদ্ধিকে সংখ্যা দিয়ে মাপার সূচক নাই। ধরে নেওয়া যাক আমাদের জ্ঞান তাদের তুলনায় দশ হাজার গুণ বেশি। এই পার্থক্যটা আসলে কেমন সেটা বোঝা যাবে ব্রহ্মাণ্ডের অসীম তথ্য ও জ্ঞানের সাথে উভয় গোষ্ঠীর জানার পরিধিকে তুলনা করলে। একটা অসীম লম্বা সুতা থেকে এক ইঞ্চি আর এক ট্রিলিয়ন লাইট ইয়ার দীর্ঘ অংশ কেটে নিলে এই দুই খন্ডের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পাওয়া যাবে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে ঐ অসীম দীর্ঘ সুতার দৈর্ঘ্য একই থাকবে। একটুও কমবে না। আমরা যদি এই দুই খন্ড সুতার সাথে ঐ অসীম দীর্ঘ সুতার দৈর্ঘ্যের অনুপাত বের করি তাহলে একই সংখ্যা পাবো। এক এর সাথে অসীমের যে অনুপাত, এক লাখ কোটি ট্রিলিয়নের অনুপাতও একই। তাই কাঁচা মাংস ভুক গুহাবাসী ঐ মানব গোষ্ঠীর তুলনায় আমাদের অগ্রগতির পার্থক্য নিয়ে গর্বিত হবার সুযোগ কম।

ভৌত জগত বুঝতে পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি জ্যামিতিকেও অপরিহার্য মনে করা হয়। (দর্শনও যে এর বড় উপাদান এই অদ্ভুত কথাটা বিশ্বাস করতে হয় হকিং ও বারট্রান্ড রাসেলের রচনাবলী পড়লে। অন্য কোন দিন এই প্রসঙ্গটা বলা যাবে।) বৃত্ত ও সরলরেখা ভৌত জগতের দুটি মৌলিক ধারণা। পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্র, কক্ষপথ, অক্ষ- এসব বৃত্তাকার বা উপ-বৃত্তাকার। ঘূর্ণনের সাথে সম্পর্ক আছে বৃত্তের। আর ইউক্লিডীয় জ্যামিতি অনুসারে সরলরেখা হলো দুটি বিন্দুর সর্বনিম্ন দূরত্ব। কেন্দ্র দিয়ে আঁকা বৃত্তের দুটি বিন্দুর সংযোগ রেখাকে আমরা বলি ব্যাস। বৃত্তের চারদিকের সীমান্ত বরাবর দুরত্বকে বলি পরিধি। বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে তারা নাম দিলের পাই (গ্রীক ভাষায় এই ধ্রুবককে p দ্বারা প্রকাশ করা হয়।)। ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে মিশরীয় এবং গ্রীক দার্শনিকগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে পরিধির সাথে ব্যাসের গানিতিক অনুপাত বা পাই এর মান বের করা গেলে ব্রহ্মাণ্ডের গঠন প্রকৃতির গানিতিক সূত্র বের করা যাবে।

তারা হিসাব করে দেখলেন বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে এর ব্যাসার্ধের বর্গের অনুপাত সমান। কিন্তু ব্যাস দিয়ে পরিধিকে ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটা একটা অমূলদ সংখ্যা, এটিকে দুটি পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা যায় না। অর্থাৎ এটিকে দশমিক আকারেও সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রাপ্ত সংখ্যাটিতে অঙ্কগুলো পর্যাবৃত্ত বা পৌনঃপুনিক আকারে আসে না। বরং দশমিকের পরের অঙ্কগুলো দৈবভাবেই পাওয়া যায়। পাই যে কেবল অমূলদ তা নয়, এটি একই সঙ্গে একটি তুরীয় সংখ্যা, অর্থাৎ এটিকে কোনও বহুপদী সমীকরণের মূল হিসাবেও গণনা করা যায় না। গণিতের ইতিহাস জুড়ে, নির্ভুলভাবে পাইয়ের মান নির্ণয়ের ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত দশমিকের পর ট্রিলিয়নের বেশি ঘর পর্যন্ত পাই এর মান বের করা হয়েছে। এখনও মিলে যাবার কোন লক্ষণ নাই।

p=3.14159265358979323846264338327950288419716939937510582097494459230781640628620 এভাবে চলতে থাকে। এখন পর্যন্ত পাওয়া অংশটা ছাপতে গেলে ৪৮ পৃষ্ঠার এই বাংলা কাগজ পত্রিকার ২ লাখ ৬০ হাজার কপি লাগবে।
ধরে নেওয়া যাক আজ থেকে এক হাজার বছর পর নির্ভুল অনুপাতটি পাওয়া গেল। তাহলে কি আমরা ব্রহ্মাণ্ডের সূত্র বুঝে ফেলব? না সে সম্ভাবনা কম। কারণ এই বিশাল দীর্ঘ ভগ্নাংশের হিসাব করতে যে সুপার কম্পিউটার দরকার হবে সেটা পেতে হয়তো পরবর্তী পাঁচ হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। আবার সেই সুতা থেকে অংশ কেটে নেওয়ার কথা বলি। বিজ্ঞানী-গণিতবিদরা অসীমতার যে অংশটুকু জেনেছেন সেটা আমাদের কল্পনার অনেক বাইরে। তবে গরীব জ্ঞান নিয়ে আমাদের যে হতাশা সেটা কাটানোর উপায় আছে। নিচের ঘটনাটাতে সমাধান পাওয়া যাবে।

এক সম্রাট সদ্য সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা পূর্ববর্তী সম্রাট এত সুচারুরূপে সাজিয়ে গেছেন যে নতুন সম্রাটের কোন কাজ থাকে না। কিন্তু তাকে প্রথা মেনে দরবারে বসতে হয়। সিংহাসনে কর্মহীন বসে থেকে তিনি ক্লান্ত। তার পায়ের কাছে পেয়াদা বসে থাকে। সম্রাট তাকে বললেন,
– আয়, আমরা জ্ঞানের খেলা খেলি। আমি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো উত্তর দিতে পারলে আমি তোকে একশ স্বর্ণ মুদ্রা দেবো; আর না পারলে তুই আমাকে একশ স্বর্ণ মুদ্রা দিবি। আবার তুই আমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবি। সেটাও একইভাবে সমাধান হবে।
পেয়াদা বলল,
– মহাত্মন, আমার জ্ঞান কম। এই খেলায় হেরে আমি ফকির হয়ে যাবো। অনুমতি দিলে আমি দুটি শর্তে খেলতে রাজি আছি। ১. প্রত্যেকবার আমাকে আগে প্রশ্ন করতে দিতে হবে। ২. আমি হেরে গেলে আপনাকে এক স্বর্ণমুদ্রা দেবো। আর আমি জিতে গেলে আপনি আমাকে ১০০ স্বর্ণমুদ্রা দেবেন।
সম্রাট রাজি হলেন। পেয়াদা প্রশ্ন করল,
– এমন একটা পাখির নাম বলুন যেটা ওড়ার সময় পাখা বন্ধ করে রাখে।
সম্রাট অনেক ভেবে উত্তর দিতে পারলেন না এবং পেয়াদাকে একশ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দিলেন। বললেন-
– এবার তুই এমন একটা পাখির নাম বল যেটা ওড়ার সময় পাখা বন্ধ করে রাখে।
পেয়াদা বলল,
– আমিও পারলাম না। এই নিন এক স্বর্ণমুদ্রা।
এ খেলাটা আমরা স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে মার্কিন ডলারে নিউটন, হকিং বা আইনস্টাইনের সাথে খেলতে পারি। নমুনা প্রশ্ন : সবচেয়ে বড় সংখ্যার পরের সংখ্যাটা কী?
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।