Home কলাম প্রান্তরে তেপান্তরে-৪৫ – কথোপকথন: ২৫০০ খ্রিস্টাব্দের পৃথিবী

প্রান্তরে তেপান্তরে-৪৫ – কথোপকথন: ২৫০০ খ্রিস্টাব্দের পৃথিবী

হাসান গোর্কি : সিদ্ধার্থ ঋষিন: একটা ভিন্ন বিষয়ে জানতে চাই- কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের পৃথিবী? আজ থেকে ৫০০ বছর পর পৃথিবিটা কেমন হবে বলে আপনি ধারণা করেন?
সঞ্জিব পুরোহিত: এটা অনুমান করা খুব কঠিন। আমরা যা ধারণা করবো তার সাথে অনেকটা মিল থাকতে পারে, আবার ১ শতাংশেরও কম মিল থাকতে পারে। ১৭ শতকের কথা কল্পনা করুন। ভারতবর্ষে তখন মোঘল শাসন চলছে। সেসময় কৃষি কাজ ছিল একশ’ ভাগ প্রাকৃতিক। পরিধেয় ছিল তাঁতে বোনা কাপড়। সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে দূর-দূরান্তে চলাফেরা করতো। পরিবহণ বলতে ছিল গরুর গাড়ি, ঘোড়া গাড়ি, পালকি, হাতি, ঘোড়া। চিকিৎসা বলতে ছিল ঝাড়-ফুঁক, গাছ-লতা-পাতা। ধরুন সেসময় আমি আপনাকে এই একই প্রশ্ন করছি। তখন আপনার উত্তর কী হতে পারতো?

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি বলতাম, ৫০০ বছর পর মোঘলরা চীনের প্রাচীর অতিক্রম করবে, পুরো মধ্য এশিয়ার দখল নেবে, কৃষিকাজের জন্য সারা ভারতবর্ষে শত শত জলাধার নির্মাণ করা হবে, পথচারীদের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য রাস্তার পাশে সহস্র ক‚প খনন করা হবে, প্রত্যেক জনপদে তাঁত শিল্প গড়ে উঠবে, প্রত্যেকের বাড়িতে একটা গরুর গাড়ি, একটা পালকি এবং একটা ঘোড়া থাকবে, হস্তি আরোহণ সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের সীমায় চলে আসবে, ঔষধি বৃক্ষের চাষ এবং এর গুনাগুণ জানা হেকিমের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে, প্রত্যেক গ্রামে লিখতে ও পড়তে পারা লোকের সন্ধান পাওয়া যাবে, মানুষ কাঁসার পাত্রে আহার করবে, অনেকে পাদুকা বা চটি পায়ে চলাফেরা করবে, ধান-চাল সংরক্ষণের জন্য বিশাল আকৃতির মাটির পাত্র তৈরি হবে, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রাপ্যতা এতো বেড়ে যাবে যে পণ্য বিনিময় প্রথার বিলুপ্তি ঘটবে, এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে যেতে অশ্ব ও হস্তি সার্ভিস চালু হবে, মানুষ হাতি বা ঘোড়া ভাড়া করে হজে যেতে পারবে, ঘোড়ার ডাক পত্র পৌঁছে দেবে প্রত্যেক গ্রামেৃ এরকম আরো কিছু।
সঞ্জিব পুরোহিত: খেয়াল করে দেখুন বর্তমান সময়ের কোনোকিছু-ই আপনি কল্পনায় আনতে পারেননি। একইভাবে ২৫০০ সাল নিয়ে এখন আমরা যা কল্পনা করবো তার সবটুকুই শিশুতোষ হতে পারে। সভ্যতার আদি উপাদানের একটা হলো ‘আগুন’। ১৭ শতকে এসেও মানুষ কার্যত আগুন জ্বালাতে শেখেনি। মাটির হাঁড়িতে তুষ, চারকোল বা এধরণের ধীর-দাহ্য (স্লো বার্নিং) কোনো উপাদান ব্যবহার করে আগুন সংরক্ষণ করতো। দেয়াশলাই এসেছে আজ থেকে মাত্র দুইশ’ বছর আগে। খেয়াল করে দেখুন, দেয়াশলাই এর মতো এতো প্রাথমিক প্রযুক্তির জিনিসের কথাও আপনার কল্পনায় কিন্তু আসেনি। আপনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কল্পনা শক্তির একজন মানুষও কিন্তু তখন কল্পনা করতে পারতেন না যে মানুষ একদিন আগুনের উৎস (দেয়াশলাই) তার বুক পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারবে। তিনি একটু বেশি কল্পনা শক্তির অধিকারী হলে হয়তো ভাবতে পারতেন, মানুষ মন্ত্র দিয়ে জীনকে বশ মানিয়ে তার পিঠে করে আকাশ ভ্রমণ করবে, কাঠের জাহাজে করে পৃথিবীর শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে, নিজেদের আবাস হিসেবে চুন-সুরকির বাড়ি তৈরি করবে। কারো পক্ষে-ই এটা কল্পনা করা সম্ভব ছিল না যে বিদ্যুৎ শক্তি নামে একটা কিছুর আবিষ্কার হবে, মানুষ তারবিহীন টেলিফোনে কথা বলবে, টেলিভিশনে দূরের ছবি দেখবে, প্লেন তৈরি করে আকাশে উড়বে, মহাকাশযানে করে চাঁদে যাবে। আমাদের অবস্থাও তাদের মতো। আজ থেকে ৫ শ’ বছর পর কী ঘটবে সে বিষয়ে অনুমান করা অনেকটা অমূলক হবে।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: শুরু থেকে হিসাবটা মেলাতে গেলে অগ্রগতির চিত্রটা আমাদের কাছে খুব হতাশাব্যঞ্জক ঠেকবে। হোমো সেপিয়েন্সদের আবির্ভাব ২ লাখ বছর আগে। মস্তিষ্কের গঠন বিবেচনায় নিলে তখন-ই তারা প্রায় আমাদের সমান বুদ্ধিমান প্রাণী। কিন্তু জীবন যাপনে তাদের সাথে আমাদের আকাশ -পাতাল পার্থক্য দেখা যায়। Evolution: The First Four Billion Years বইয়ের “Human Evolution” চ্যাপ্টারে McHenry লিখেছেন, “প্রায় আমাদের সমান বুদ্ধিমান হয়েও প্রাকৃতিক জীবন প্রণালী পাড়ি দিয়ে অল্প কিছু প্রযুক্তির (যেমন, লিভার, চাকা, কাঠের ভেলা, পাথরের হাতুড়ি) ব্যবহার শিখতে তারা ব্যয় করেছে দেড় লাখ বছর।” বৈদিক বা মিশরীর সভ্যতাকে যদি আমরা বর্তমান সভ্যতার শুরুর বিন্দু ধরি তাহলে দেখতে পাবো শুরু থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রযুক্তি ও সভ্যতা এগিয়েছে খুব ধীর গতিতে। গত একশ’ বছরে পৃথিবীতে উদ্ভাবন ও অগ্রগতির গতি এতো বেশি ছিল যে সেটাকে প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর বিপ্লব বলা চলে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে আগামী পাঁচশ’ বছরে মানুষ কোনো বিস্ময়কর প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারলো না, তাহলে সেসময় পৃথিবীর চিত্রটা কেমন হতে পারে?
সঞ্জিব পুরোহিত: এরকম ধরে নিয়ে কল্পনা সাজানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। একটু আগেই আমরা বলেছি, আজ থেকে পাঁচশ’ বছর আগে পৃথিবীর সকল মানুষের মেধাকে একত্রিত করে এটা কল্পনা করা সম্ভব ছিল না যে ‘বিদ্যুৎ’ নামে একটা শক্তি তৈরি করা যাবে। শক্তির এরকম কোনো অজ্ঞাত আকার যদি থেকে থাকে তাহলে তা কেবল আবিষ্কৃত হবার সময়-ই জানা যাবে। সেই পৃথিবীর চিত্রটা আমরা কল্পনা করতে পারবো না। প্রস্তর যুগের প্রাগৈতিহাসিক গুহা মানবের জীবন যাপনের সাথে আজকের সভ্যতার যে পার্থক্য, আজকের সভ্যতার সাথে ৫০০ বছর পরের সভ্যতার পার্থক্য হয়তো একইরকম হবে। আজকের যুগের চেনা কোনো জীবনোপকরণ-ই হয়তো সেখানে থাকবে বা। যেমন বিজ্ঞানীরা যদি এমন কোনো সর্বংসহা জিন তৈরি করে ফেলেন যা সকল রোগ প্রতিরোধ করতে পারে তাহলে মানুষের শরীরে সেটা প্রয়োগ করবে। এই জিন বংশ পরম্পরায় বাহিত হতে থাকলে চিকিৎসা চালু থাকবে শুধু দুর্ঘটনায় আহত মানুষদের জন্য। এখন ইউরেনিয়াম ভেঙে শক্তি উৎপাদন করা যায়। ধরা যাক এক লিটার পানি বা এক কেজি পাথর ভেঙে এক বছর ব্যাপী এক হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ তৈরির বুদ্ধি বের করা গেলো।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: হ্যাঁ, এরকম অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তবে শুধু এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত শক্তি ও প্রযুক্তির নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ ব্যবহার চলতে থাকলেও ২৫০০ সালে একটা অচেনা পৃথিবী দেখতে পাওয়া যাবে। পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য উন্নত আবাস, প্রয়োজনীয় খাদ্য, পরিধেয়, চিকিৎসা, শিক্ষা নিশ্চিত হবে। বায়ুশূন্য আন্তমহাদেশীয় টানেলে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে পাড়ি দেওয়া যাবে এক বা দুই ঘন্টায়। বিমান বিলুপ্ত হবে, এখন যেমন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে পালকি বা মহিষের গাড়ি। পৃথিবীর সব গাড়ি-ই হবে চালকবিহীন। (কিছুদিন আগে গুগলের একটা চালকবিহীন গাড়ি একাই পুরো উত্তর আমেরিকা ঘুরে এসেছে। পাড়ি দিয়েছে আড়াই লাখ কিলোমিটার পথ।) মুদি দোকান থেকে শুরু করে, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল- সব-ই হবে বিক্রেতাশূন্য। প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রে হোম সার্ভিস চালু হবে। ধরুন আপনি পার্কে বেড়াতে গেছেন। তখন কোনো বিশেষ দোকানের কফি খেতে ইচ্ছা করলো। আপনি ‘ডাবল ক্রিম-ট্রিপল সুগার-মিডিয়াম ক্যাপাচিনো’ লিখে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলেন। আপনার লোকেশন ট্র্যাক করে একটা ড্রোন এসে আপনাকে কফি দিয়ে চলে যাবে। ইউএসএ ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে এখন-ই স্বল্প পরিসরে এই সার্ভিস চালু হয়েছে। এভাবে কায়িক শ্রম প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছাবে। দেড় মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে জনসংখ্যা ছিল এক লক্ষ। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা ১১ শ’ কোটিতে পৌঁছার পর তা আবার কমতে শুরু করবে। পরিবার গঠনের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান অনীহা সচল থাকলে ২৫০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা যদি একশ’ কোটিতে নেমে আসে তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। যুদ্ধ-হিংসা-হানাহানি শূন্যে নেমে আসবেÑ স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে এখন যেমন দেখা যায় তার চেয়েও শতগুণ সহিষ্ণু, কালসহ ও বদান্যতাপূর্ণ একটা বিশ্ব সমাজ গড়ে উঠবে। তখন হয়তো অকল্পনীয় সুন্দরভাবে গোছানো একটা পৃথিবীতে মানুষ বাস করবে। বৃক্ষ, পশুপাখি, বন-বনানী, বায়ু, সমুদ্র-নদী, হ্রদ, গোচারণ ভূমি, বাসগৃহ, সড়ক, শস্যক্ষেত- সবকিছু নির্মল- নিরঁজন হবে। মানুষ তখন খেলাধুলা, সঙ্গীত, শিল্পকলা, ঈশ্বর আরাধনার জন্য অফুরন্ত সময় ব্যয় করবে।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনার বৈদগ্ধ্য, ধৃতি ও বর্ণনা ভঙ্গির তারিফ না করে পারছি না জনাব ঋষিন! যদি পৃথিবী কোনো বিশ্বযুদ্ধের মুখে না পড়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান ঝুঁকি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ না হয়, অতি দুরারোগ্য কোনো মরন ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত না হয় এবং বড় কোনো গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী কক্ষচ্যূত বা ধ্বংস না হয়ে যায়, তাহলে আপনার অনুমানের অনুরূপ একটা পৃথিবীতে হয়তো মানুষ ২৫০০ সালে বাস করবে। তবে অতি ক্ষুদ্র একটা দ্বিমত আছে। ঈশ্বর আরাধনার জন্য মানুষ কতোটা সময় ব্যয় করবে বা আদৌ করবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। মধ্যযুগের ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্ম মানুষের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। সমাজের সকল রীতিনীতির নিয়ন্তা ছিল ঈশ্বরের বাণী। এখন আপনি পুরো ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে দেখুন মানুষের ব্যক্তি জীবনে ঈশ্বরের সম্পৃক্তি খুব-ই কম। চার্চগুলো টিকে আছে পাড়ার ক্লাবের মতো। অল্প কিছু মানুষ সপ্তাহান্তে সেখানে হাজির হয়। প্রার্থনা শেষে ফিরে গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই আরাধনার প্রভাব সমাজে প্রায় শূন্য। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ধর্মকে মিথের মর্যাদায় শ্রদ্ধা করে। যেমন সরকার প্রধানের অভিষেক, যুদ্ধ শুরু করা বা এধরণের বড় কোনো কাজে তারা বাইবেল থেকে শ্লোক পাঠ করে। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানেইজেশন (ওঝজঙ) মহাকাশে যান পাঠানোর তারিখ নির্ধারণ করে কোষ্ঠী-নামা থেকে শুভ দিন দেখে। তার অর্থ এটা নয় যে ঐ বিজ্ঞানীরা ঠিকুজিতে বিশ্বাস করেন। হিটলার প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে রাশিফল দেখতেন। মানুষের সামনের সময়টা অনিশ্চিত ও দুর্জ্ঞেয়। তাই দৈবজ্ঞ কেউ বা কিছুর অস্তিত্ত¡ কল্পনা করতে আমাদের ভালো লাগে। আর আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সেই কল্পিত শক্তির পূর্বানুমান জানতে ইচ্ছা করে। দিনশেষে এসব এক ধরণের আত্ম-প্রবোধ জেনেও আমরা কাজটা করতে পারি। আপনি লেকে মাছ ধরতে যাবেন। আপনার তিন বছরের কন্যা যদি বলে আজ তুমি একটা বড় মাছ পাবে তাহলে সেটা আপনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করবে। এরকম কিছু কারণে পৃথিবী জুড়ে উপকথার আকারে ২৫০০ সালের সেই কল্পিত পৃথিবীতে ধর্ম টিকে থাকবে। অতিপ্রাকৃত কিছুতে বিশ্বাস করার উপাদান ধীরে ধীরে কমে আসছে। যেমন ডিএনএ সিকোয়েন্স থেকে প্রাণের উপাদান বিষয়ে মানুষ জেনেছে। স¤প্রতি ইজরায়েলের ‘উইজমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’ এর বিজ্ঞানীরা ‘অ্যাসিসটেড রিপ্রোডাকশন টেকনোলজি’ ব্যবহার করে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ছাড়াই ইঁদুরের স্টেম সেল থেকে ভ্রূণ তৈরি করেছেন। বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সেল’-এর চলতি সংখ্যায় (জুলাই, ২০২২) এ বিষয়ে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি সম্ভবত বলতে চাচ্ছেন বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ধর্ম বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে। ধর্মকে আপনি ঐশ্বরিক কিছু ভাবছেন না। যুক্তির খাতিরে আপনার ধারণা মেনে নিয়ে বলছি, ধর্মীয় বিশ্বাস বিলুপ্ত হয়ে যাবার কারণ নেই। আপনার দেওয়া ওঝজঙ-র উদাহরণ থেকেই সেটা স্পষ্ট হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো প্রযুক্তি নেই যা দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে শূন্য করে। সবচেয়ে উন্নত বিমানে করে ঢাকা থেকে টরোন্ট, ১৭ ঘন্টার যাত্রাপথে আমরা শঙ্কাহীন বসে থাকি না। তাই নির্বিঘেœ গন্তব্যে পৌঁছার জন্য মাঝে মাঝে ঈশ্বরের সাহায্য চাইতে থাকি। এতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমে যায় না। ভুল করে যদি বিমানে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ভরা না হয়ে থাকে তাহলে সেটা আছড়ে পড়বে। ঈশ্বর দেবদূত পাঠিয়ে জ্বালানিবিহীন বিমানটিকে টরোন্ট পৌঁছে দেবেন না। কিন্তু আমরা যাত্রাপথের ১৬ ঘণ্টা এটা ভেবে শান্তিতে থাকবো যে ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন। যে কোনো বিপদের সময় আপনি ঈশ্বরকে স্মরণ করতে থাকুন; দেখবেন আপনি শান্তিতে আছেন, মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত আছেন এবং আত্মবিশ্বাসী আছেন। ধর্ম যদি দুর্জ্ঞেয়তা বিষয়ে মানুষের সন্মিলিত ঐক্যমত্য এবং তা থেকে উদ্ভূত কাল্পনিক মহাশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ হয়ে থাকে তাহলেও তা টিকে থাকবে- আমি বলতে চাই বর্তমান সময়ের মতো-ই বৃহদায়তন, ওজস্বী ও ক্রিয়াশীল থাকবে। আপনার কথামতো যদি ধর্ম মানুষের স্বেচ্ছা ঐক্যমত্যের ফসল হয়ে থাকে তাহলে মানুষ তা কখন-ই পরিত্যাগ করবে না।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি দুই দশক উত্তর আমেরিকায় বসবাস করেছেন। নিশ্চয়-ই লক্ষ করেছেন, মানুষ নিজেদের সঙ্গ পরিত্যাগ করে একা বাস করতে শুরু করেছে। তাদের একটা বড় অংশ কুকুরের সাথে বাস করে। ২৫০০ সালে ‘অ্যাসিসটেড রিপ্রোডাকশন টেকনোলজি’ বা তার চেয়ে অগ্রসর কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি মানুষ পাওয়া যায় তাহলে পরিবার প্রথা ভেঙে যাবে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমরা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম চায়ের স্টলে। এখন নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে বা সেলফোনে আড্ডা দেই। ৫০০ বছরের পরিক্রমাটা আপনি বিবেচনায় নিচ্ছেন না। সেসময় সশরীর একত্রিত হবার কারণ থাকবে না।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: কোনো ধারণা বা বিশ্বাস টিকে থাকার জন্য মানুষের সশরীর একত্রিত হওয়া-ই একমাত্র শর্ত নয়। ‘ভার্চুয়াল ইন্টারকমিউনিয়ন’ এর চেয়ে অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আপনি খেয়াল করে দেখুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার একটা বড় বিষয় ধর্ম। আপনার ধারণা সত্যি হলে তো শিল্প- সাহিত্যের সব শাখা-ই তখন বিলুপ্ত হয়ে যাবার কথা।
সঞ্জিব পুরোহিত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মের আলোচনা হচ্ছে পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে। যাহোক, আপনি অন্তত এতটুকু কাছাকাছি আসতে রাজি হয়েছেন যে শিল্প-সাহিত্যের মতো ধর্মও একটা মানবিক শাখা। আমি অনুমান করতে চেয়েছি এই শাখাটা যেসব কারণে এখন শক্তিশালী ২৫০০ সালে সেই কারণগুলোর একটা বড় অংশ বিলুপ্ত হবে। পৃথিবীতে যেসব কারণে সঙ্গীত টিকে আছে তার সাথে ধর্মের টিকে থাকার কারণগুলোর বড় পার্থক্য আছে।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: সেটা মানছি। তবে স্বর্গের লোভ, নরকের ভীতি, মৃত্যু সম্পর্কে অজ্ঞতা, জীবনের আকাক্সক্ষা- এরকম অনেক কিছু আছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে যার কোনো পরিবর্তন হবে না। ফলে ধর্ম বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আপনি যদি তাকে রূপকথা বলেন তাহলেও আপনাকে মানতে হবে এটা মানুষের মনে উৎকীর্ণ এমন একটা আখ্যান যা বৌদ্ধিক অনুভূতি দিয়ে চালিত মানবগোষ্ঠীর পক্ষে কখন-ই পরিহার করা সম্ভব হবে না।
সঞ্জিব পুরোহিত: শুরুতেই আমার ধারণা ছিল আমাদের আলোচনা আপনার এমন একটা সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে যার ভিত্তি পূর্বানুমান ও বিশ্বাস।

hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।

Exit mobile version