হাসান গোর্কি : বিবর্তনবাদ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো বানর থেকে মানুষের উৎপত্তি। প্রকৃতপক্ষে কোথাও একথাটি বলা হয়নি। তবে এর কাছাকাছি ধারণাটি হলো মানুষ, শিম্পাঞ্জি, ওরাং ওটাং এবং গরিলা এসেছে একই পূর্বপুরুষ ‘প্রাইমেট’ থেকে। প্রাইমেটদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলোপায়ের নিচের অংশ এবং হাতের সামনের অংশে দুটি দীর্ঘ ও শক্ত হাড়ের উপস্থিতি। কাঁধের সাথে বক্ষপিঞ্জর আটকে রাখার জন্য দুই দিকে দুটি অস্থি, যাকে আমরা এখন কলারবোন বলি। কোন বস্তুকে ধরে রাখার মতো হাতের আঙুলের গঠন। স্টেরিওস্কোপিক ভিসন- বাংলায় ঘনছকীয় দৃষ্টি: সহজ কথায় থ্রি ডাইমেনশনাল বা ত্রিমাত্রিক দৃষ্টি। জীব বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রাইমেটদের বিবর্তনের শুরুতেই ((সিমিফর্মিস স্তরে) ক্ষুদ্র নরবানর আলাদা হয়ে যায়। ১.৪ কোটি বছর আগে হোমিনিডাই এবং হোমিনিনাই স্তরে আলাদা হয় ওরাং ওটাং ও গরিলা। প্রায় ৯০ লক্ষ বছর আগে হোমিনিনি থেকে আলাদা হয়ে যায় শিম্পাঞ্জি ও মানুষ। আর মোটামুটি ৬০ লাখ বছর আগে এই প্রজাতির একটা অংশে গুরুত্বপূর্ণ জিনগত পরিবর্তনের ফলে মানুষের যাত্রা শুরু হয়। হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি বা হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স উপপ্রজাতি আনুমানিক এক লাখ বছর আগে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ায়, ৪০ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় এবং ১৫ হাজার বছর পূর্বে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা ও মহাসাগরের বড় দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয় ককেশীয় মানবরা বেরিং প্রণালী পার হয়ে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছেছিল। প্রণালীটির সবচেয়ে সরু অংশ রাশিয়ার দেজনিয়ভ অন্তরীপ এবং আলাস্কার প্রিন্স অব ওয়েলস অন্তরীপের মধ্যে অবস্থিত। শীতকালে এটা বরফে ঢেকে থাকে।
শিম্পাঞ্জি জিনগতভাবে মানুষের নিকটতম প্রাণী; ডিএনএর মিল প্রায় ৯৮%। তাহলে শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের জীবন যাপনের এই বিশাল পার্থক্য কেনো? তাহলে কি হোমনিনি স্তরে থাকার সময় ঐ বৃহৎ নরবানর জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেয়েছিল? বিজ্ঞানীরা তা মনে করেন না। তাদের দাবি পরিবর্তনটা ঘটেছে ধীর গতিতে। আকস্মিক বা যুগান্তকারী কোন পরিবর্তন এর জন্য দায়ী নয়। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, প্রায় দুই লাখ বছর আগে আফ্রিকায় আধুনিক মানুষ হিসেবে হোমো সেপিয়েন্সদের আবির্ভাব ঘটে। সে সময় তাদের শরীরে এমন একটা জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে যা ভাষা ব্যবহারের সক্ষমতার জন্য দায়ী। কিন্তু সেপিয়েন্সরা আগুন জ্বালানো, পাথরের অস্ত্র তৈরি, কৌশলগত শিকার পদ্ধতি, গুহা নির্মাণ- এসব রপ্ত করার পরও ভাষা ব্যবহার করতে সময় নেয় পরবর্তী দেড় লাখ বছর। অর্থাৎ তারা ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে এখন থেকে মোটামুটি ৫০ হাজার বছর আগে। জার্মানির আণবিক জিন তত্ত¡বিদ এসভ্যাস্টে পাবো গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মানুষের শরীরে থাকা FOXP2 নামের জিনটি শিম্পাঞ্জির শরীরে থাকলেও সেখানে দুটি এমাইনো এসিডের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন।
বিবর্তনে পরোক্ষ হলেও ভাষার একটা ভূমিকা আছে। ধরুন আমরা ৪ বন্ধু হোমো সেপিয়েন্স এর প্রথম দিকের কোনো এক গোত্রের সদস্য। আপনি দলপতি। আমরা ক্ষুধিত। একটা হরিণ শিকার করতে চাই। আপনার হাতে বর্শা বা এধরণের একটা অস্ত্র আছে। আমরা একসাথে ৫টা হরিণের দেখা পেলাম। আপনি আমাদের বলতে চান আমাদের থেকে তৃতীয় নিকটতম দূরত্বে থাকা হরিণটিকে প্রথম সদস্য তাড়া করে লেকের দিকে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় সদস্যতাকে লেকের পাড় বরাবর তাড়িয়ে নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে যাবে। তৃতীয় সদস্য নিশ্চিত করবে যে হরিণটা যেন জঙ্গলের দিকে যেতে না পারে। আপনি পাহাড়ের খাঁজে আগে থেকেই লুকিয়ে থাকবেন এবং অবরুদ্ধ হরিণটাকে বর্শা বিদ্ধ করবেন। এই পরিকল্পনাটা প্রকাশ করার জন্য যে ভাষা দরকার সেটা তৈরি করা বেশ জটিল একটা কাজ। এটা মানুষ যতো বেশি রপ্ত করেছে তার বিকাশ ততো দ্রুত ঘটেছে।
তবে শুধু ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা মানুষকে অন্য প্রাইমেট থেকে এগিয়ে নিয়েছে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং মস্তিষ্কের ধারণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভাষার উদ্ভব ছিল একটা অনিবার্যতা। মানুষের মস্তিষ্কের কোষের সংখ্যা যেমন বেশি তার সুপিরিয়র টেম্পোরাল জাইরাস এবং মিডিয়াল ফ্রন্টাল লোবও তেমনি অনন্য- যা বিশাল সংখ্যক তথ্যকে ধারণ ও বিশ্লেষণ করতে পারে। বৃহৎ নবানরদের সাথে আমাদের অনেক মিল আছে। তাদের মস্তিষ্কে আমাদের মতো পরিবর্তন ঘটে গেলে চিত্রটা পাল্টে যেতে পারতো। তারা এই পৃথিবীতে আমাদের প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠতো। গত মাসে ক্যালগ্যারি বেড়াতে গিয়ে চিরিয়াখানায় গিয়েছিলাম। দেখলাম একটা গরিলা গাছের গুঁড়িতে মাথা রেখে শুয়ে আছে। দুই একবার ডাকাডাকি করার পর সে আমার দিকে তাকালো। দৃষ্টিটা প্রায় মানুষের মতো। ভাবলাম, যা তাকে আমার থেকে পৃথক করে রেখেছে তা দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া একটা জেনেটিক পরিবর্তন ছাড়া কিছুই নয়। তার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। বানরকে ছোট খাটো ম্যাজিক দেখালে সে প্রায় মানুষের মতো বিনোদন অনুভব করে। এখানে দেখুন https://www.youtube.com/watch?v=FIxYCDbRGJ।
আমাদের মনে প্রশ্ন দেখা দেয় শুধু মানুষের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক এই পরিবর্তনটা ঘটলো কেনো? আসলে সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে-ই একই মাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। কোনোটা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনোটা শারীরবৃত্তিক। এক কোষী প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে বিশাল আকৃতির তিমি, হিংস্র বাঘ- সিংহ, নিরীহ হরিণ, আকাশচারী পক্ষীকুল, গাধা, পিঁপড়া, মশার উদ্ভব ঘটেছে। প্রত্যেক প্রাজাতির প্রাণী অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। মানুষ যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসরতার কারণে অনন্য তেমনি তিমি শক্তিমত্তার কারণে, পিঁপড়া প্রাকৃতিক সহিষ্ণুতার কারণে, পাখি আকাশে উড়তে পারার কারণে, কেঁচো মাটির গভীরে বাস করতে পারার কারণে, মাছেরা জলে ডুবে বেঁচে থাকার ক্ষমতার কারণে অনন্য। অন্য প্রাণীরাও ভাবতে পারে তাদের বিবর্তনটাই সবচেয়ে ভালোভাবে ঘটেছে এবং তারাই সবচেয়ে উত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী। বানর, গুবরে পোকা, বাঘ বা শকুনকে যদি মানব জীবন বরণের প্রস্তাব দেওয়া হয় তাহলে সম্ভবত তারা সেটা মানবে না; যেমন আমাদের যদি অরণ্যচারী স্বাধীন টিয়া পাখি হবার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে আমরাও সেটা পছন্দ করবো না।
আর একটা প্রশ্ন প্রায়ই আমাদের মাথায় আসে- বিবর্তন যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তা আমরা দেখতে পাই না কেনো? উত্তর হলো- বিবর্তন দেখতে হলে যতদিন বেঁচে থাকতে হবে আমরা ততোদিন বাঁচি না। প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে সাড়ে তিনশ’ কোটি বছর আগে। আর যে সভ্যতা তথ্য সংরক্ষণ করতে শিখেছে তার বয়স সর্বাধিক ১০ হাজার বছর। ৪৪৬ কিলোমিটার লম্বা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গড় গভীরতা এক মাইলের বেশ। ভূতত্ত¡বিদদের ধারণা কলোরাডো নদী মোগোলান হাইল্যান্ডস এর সমভূমির উপর প্রবাহিত হতে শুরু করে এখন থেকে দুই কোটি বছর আগে। জলের প্রবাহের কারণে পাথর কেটে তা এক মাইল নিচে চলে গেছে। এই ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করতে আমাদের দুই কোটি বছর আগে জন্মগ্রহণ করে এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হতো। একইভাবে প্রাইমেট থেকে আধুনিক মানুষে বিবর্তন দেখতে প্রায় সমান সময় বেঁচে থাকতে হতো। আমরা যদি টাইম মেশিনে গিয়েহোমো স্যাপিয়েন্সদের আদি পুরুষদের জীবন দেখতে পেতাম তাহলে তাদের আজকের যুগের গরিলা বা শিম্পাঞ্জির থেকে অল্প অগ্রসর একটা প্রাণী হিসেবে দেখতাম। আর আমাদের আদি পিতা প্রাইমেটদের দেখতাম গরিলা বা শিম্পাঞ্জির থেকেও পশ্চাৎপদ। কারণ তারা তখন সোজা হয়ে দাঁড়াতেও শেখেনি।
বিবর্তন যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তা থেমে আছে কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর উপরের দুই অণুচ্ছেদে দেওয়া গেছে। আরও কিছুটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করা যাক। সমুদ্রে এক কোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণীতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলেছে কয়েক কোটি বছর। এরপর জলচর প্রাণী, উভচর প্রাণী, স্থলচর প্রাণী হয়ে আজকের অবস্থায় আসতে প্রত্যেক দশায় কয়েক কোটি বছর করে ব্যয় হয়েছে। সে সময়, এর প্রত্যেক দশায় প্রাণীদের মনে হয়েছে অনন্তকাল ধরে তারা একই আকৃতি নিয়ে বাস করে যাচ্ছে। আসলে বিবর্তন কখনই থেমে ছিল না; এখনও সেটা চলছে। দশ হাজার বছর আগের তুলনায় আমাদের মস্তিষ্ক এখন অনেক বেশি তথ্য ধারণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। আমাদের মস্তিষ্কের নিউরন ও গিøয়াল সেলের সংখ্যা যথাক্রমে ১০% এবং ৯০%। আমরা যা কিছু করি তা নিয়ন্ত্রণ করে নিউরন সেল। সেকারণে বলা হয়ে থাকে মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র ১০% ব্যবহার করে। বিবর্তনের কোনো দশায় এই গিøয়াল সেলগুলো সক্রিয় হলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা হয়তো ট্রিলিয়ন গুণ বৃদ্ধি পাবে।
হোমিনিনি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক এই বিবর্তন ঘটেনি কেনো? আসলে এরকম হবার জন্য ‘কারণ’ থাকা জরুরি নয়। এটা একটা দৈব-চয়ন। এক্ষেত্রে অল্পবিভ্রান্ত হবার সুযোগ আছে। ‘দৈব-চয়ন’ টার্মটি দিয়ে বুঝানো হয় প্রকৃতিতে সব ঘটনাই এলোপাথাড়ি চলতে থাকে। এর মধ্যে ভৌত বা রাসায়নিক আসক্তি বেশি আছে এমন দুটি (বা তার অধিক হতে পারে) পদার্থ বা জৈবযৌগের সংশ্লেষণ ঘটে। এখানে কোন পূর্ব নির্ধারিত উদ্দেশ্য থাকে না। শিম্পাঞ্জি পৃথিবীতে দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা ভোগ করছে। এটা ঘটেছে দৈবক্রমে। FOXP2 নামের জিনটি যদি ঐ বিশেষ দুটি এমাইনো এসিডসহ শিম্পাঞ্জির শরীরে সক্রিয় হতো তাহলে তারাই এখন পৃথিবী শাসন করতো এবং প্রশ্ন করতো, “হোমিনিনি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক এই বিবর্তন ঘটেনি কেনো?” এরকম প্রশ্ন তিমিরও করার সুযোগ আছে। তারা বলতে পারে, “হায়! মানুষ কতো দুর্ভাগা। একই সময় যাত্রা শুরু করে আমরা কত বিশাল দেহের অধাকারী হলাম। আর মানুষ কেনো বামনের আকৃতিতেই রয়ে গেলো? তারা পানিতে শ্বাস নিতে পারে না। জীবন্ত মাছ খেতে পারে না!”
বিবর্তনের যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। যেমন জীবাশ্ম রেকর্ড এবং ডিএনএ সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ থেকে বিবর্তনের ধারাবাহিকতার সমর্থন পাওয়া যায়। নিরান্ডারথাল মানবের হাড় ও দাঁতের ডিএনএ থেকে বুঝতে পারা যায় আধুনিক মানুষ এবং তারা একই পূর্ব পুরুষ থেকে এসেছে। বিবর্তনবাদ বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্য এবং তাদের পুর্বপুরুষকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাখ্যা করে। এটা নিঃসন্দেহে উচ্চতর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। কিন্তু বিবর্তনবাদকে তত্ত¡ হিসেবে মেনে নিলেও অনেকে এটাকে ফ্যাক্ট হিসেবে মানতে রাজি নন। কারণ অন্য আর দশটা তত্তে¡র (যেমন মাধ্যাকর্ষণ) মতো বিবর্তনবাদকে ফ্যাক্ট হিসেবে দাবি করার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো এটাকে পুনঃপরীক্ষা করা যায় না। এক কোষী প্রাণী থেকে যে মানুষ এসেছে সেটা প্রমাণ করতে গেলে সাড়ে তিনশ’ কোটি বছরব্যাপী একটা পরীক্ষা চালাতে হবে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো এরকম একটা পরীক্ষার জন্য প্রকৃতিকেও রাজি করাতে হবে। কারণ প্রকৃতি নিজেই এখানে পরীক্ষাগার।
পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব বা আগমন নিয়ে সকল প্রাচীন দর্শনে বিস্তর মতবাদ আছে। সেগুলো খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। যেমন, খ্রিস্ট জন্মের সাড়ে ছয়শ’ বছর আগে গ্রীক দার্শনিক অ্যানাক্সিমান্দার অব মিলেটাসধারণা প্রকাশ করেছিলেন যে পৃথিবীর পুরোটাই এক সময় জলমগ্ন ছিল। সেসময় মানুষের পূর্ব পুরুষের উদ্ভব ঘটে জলে। তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন, মানুষ অন্য কোনো প্রাণী-প্রজাতির সন্তান। আর খুব সম্ভবত সেটা মাছ। আধুনিক বিবর্তনবাদে সাগরকেই প্রথম প্রাণের উদ্ভবের স্থান হিসেবে মনে করা হয়। আমরা জানি বিবর্তনবাদের উৎস ডারউইনের অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস গ্রন্থটি। সেখানে তিনি বলেছেন, জীবন বৃক্ষের শাখা ধরে পেছন দিকে যেতে থাকলে প্রজাতিগুলোর একটা সাধারণ উৎপত্তিস্থল পাওয়া যাবে। প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া; পশুপালন, জীবভূগোল, ও ভ্রæন বিদ্যাবিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বিবর্তিত হয়ে প্রাণীরা নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়। শুরু থেকেই চার্চের অবস্থান ছিল এই মতবাদের বিপক্ষে। কারণ, বাইবেলের সৃষ্টিতত্তে¡র সাথে এই তত্তে¡র কোন মিল নেই। তবে এর কিছু ব্যতিক্রমও ছিল।
যেমন, তৃতীয় শতাব্দীর খ্রীস্টান দার্শনিক চার্চ ফাদার অরিগেন অব আলেকজান্দ্রিয়া বাইবেলের সৃষ্টি সম্পর্কিত কাহিনীগুলোকে রূপক হিসাবে গ্রহণ করা উচিত বলে ধারণা দিয়েছিলেন : “কোনও বোধসম্পন্ন মানুষ কীভাবে ভাবতে পারেন যে প্রথম, দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় দিনেও, সকাল থেকে সন্ধ্যা, কোনো চন্দ্র, সূর্য, বা তারা ছিলই না? আর প্রথম দিনে নাকি আকাশই ছিল না? মানুষ কি এতই নির্বোধ যে ভাববে ভগবান যেন এক কৃষক, স্বর্গোদ্যানটা বপন করে দিলেন পূর্বদিকে, তার মধ্যে জীবনবৃক্ষটা এমন ভাবে রেখে দিলেন যাতে কেউ সহজেই সেটা হাতের কাছে পেয়ে যায় আর ফলটা পেড়ে নিয়ে কামড়েও ফেলতে পারে? আবার সেই ফলটা চিবিয়ে ফেলে যাবতীয় ভালমন্দের ভাগীদারও হয়ে যায়? আর যদি ভগবান সন্ধ্যাবেলা স্বর্গে বেড়াতে বের হন আর আদমকে তাই গাছের তলায় লুকিয়ে পড়তে হয়, তাহলে এ নিয়ে কোনো সন্দেহই থাকা উচিত নয় যে এ সবই আসলে আলঙ্কারিক অর্থে, একটু ধাঁধার মত করে বলা, একে ইতিহাস হিসাবে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া অনুচিত।”
আমরা যদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ফাদার অরিগেনের মতো শ্রদ্ধার সাথে পাশে সরিয়ে রেখে বিবর্তনবাদকে বিশ্বাস করতে যাই তাহলে সমস্যা দেখা দেয় আমাদের অহম, স্বাতন্ত্র্যবোধ বা ইগোর। একটা শালিক, রুই মাছ, তেলাপোকা, বানর, হাতি এবং আমি প্রাণী হিসেবে সমান এটা ভাবতে পারা কঠিন। পৃথিবীতে মানুষের অবিসংবাদিত ও সুস্পষ্ট আধিপত্য আমাদের এটা ভাবতে অনুপ্রাণিত করে যে আমরা অন্য সকল প্রাণী থেকে আলাদা; ফলে আমাদের সৃষ্টিরও আলাদা ইতিহাস থাকতে হবে। এটা ভাবতে আমাদের ভালো লাগে যে প্রাণী হিসেবে পিঁপড়া এবং ইলিশ মাছের থেকে আমাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন এবং মহত্তর। দ্বিতীয় সমস্যার কথা আগেই বলেছি- আমরা বিবর্তন দেখতে পাই না। তাহলে সভ্যতা বিকাশের একটা অনুকল্প তৈরি করা যাক যা থেকে বিবর্তনের পক্ষে ক্ষুদ্র একটা সমর্থন পাওয়া যেতে পারে। শর্ত হলো ভাষার শিক্ষণ ও প্রয়োগ যে বিবর্তনের একটা অনুসঙ্গ সেটা আগে মানতে হবে।
দুই বছর বয়সী এক হাজার শিশুকে একটা অনুক‚ল আবহাওয়ার জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে বৃষ্টি হলে আশ্রয় নেওয়ার মতো গুহা আছে। শীত নিবারনের জন্য তুলার স্তুপ আছে। পান করার মতো সাদু পানির নহর আছে। সেখানে এমন কোনো জীবানু নেই যা তাদের রোগ তৈরি করতে পারে। এমন কোনো প্রাণী নেই যা তাদের আক্রমণ করতে পারে। অদৃশ্য কিছু মানুষ তাদের খাবার সরবরাহ করে। এ অবস্থায় কুড়ি বছর তাদের রেখে দিলে তারা একটা ভাষার প্রাথমিক আদল তৈরি করে ফেলবে যাতে কয়েকশ’ শব্দ থাকতে পারে। এভাবে হাজার বছর কেটে গেলে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো একটা পূর্ণাঙ্গ ভাষার জন্ম দিয়ে ফেলবে। ধীরে ধীরে এই জনগোষ্ঠী একটা সভ্যতায় রূপ নেবে।
hassangorkii@yahoo.com
জুলাই ১১, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।