Home কলাম প্রান্তরে তেপান্তরে-৩৮ – কথোপকথন: ওয়াচমেকার এনালোজি

প্রান্তরে তেপান্তরে-৩৮ – কথোপকথন: ওয়াচমেকার এনালোজি

হাসান গোর্কি : সিদ্ধার্থ ঋষিন: এই মহাবিশ্বের যে একজন স্রষ্টা আছে সেটা বিশ্বাস করেন?
সঞ্জিব পুরোহিত: সেরকম বিশ্বাস করতে-ই পছন্দ করি।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: ‘পছন্দ করি’ বলছেন কেনো? আপনি নিশ্চিত নন?
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি নিশ্চিত কীভাবে সেটা বলুন।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: কল্পনা করুন, মাঠের মধ্যে একটা বড় বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। কুড়ি মিনিট পর পর ঐ বিল্ডিং থেকে একটা করে গাড়ি বের হয়ে আসছে। তার অর্থ গাড়ি তৈরি করতে পারে এরকম কেউ সেখানে আছে। সেরকম মহাবিশ্বের এই বিশাল প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন গ্রহ-নক্ষত্র, সমুদ্র-নদী, পাহাড়- অরণ্য, মানুষ-বৃক্ষরাজি, প্রাণীকুলের একজন স্রষ্টা না থাকলে এগুলো বানালো কে?
সঞ্জিব পুরোহিত: এটা অসম তুলনা। তৈরি করা এবং সৃষ্টি করা বা হওয়া এক নয়। আপনার ঐ কল্পিত গাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে; সৃষ্টি করা হয়নি। আমরা যদি ঐ বিল্ডিং এ গিয়ে খোঁজ করি তাহলে ঐ গাড়ির প্রস্তুতকারককে দেখতে পাবো। দেখবো বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়া দিয়ে তিনি গাড়ি বানাচ্ছেন। শূন্যে ফুঁ দিয়ে তিনি গাড়ি সৃষ্টি করছেন না। কিন্তু মহাবিশ্ব যদি সৃষ্টি বা উদ্ভূত হয়ে থাকে তাহলে তা শূন্য থেকে হয়েছে। আগে থেকে অস্তিত্বে থাকা পদার্থ সম্ভারকে জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়নি। আবার মহাবিশ্ব যদি স্বয়ম্ভূ হয়ে থাকে তাহলে তাকে কেউ সৃষ্টি করেনি; নিজের থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আর যদি তা অনন্তকাল ধরে অস্তিত্বে থেকে থাকে তাহলে তৈরি করা এবং সৃষ্টি করা বা হওয়া- এর কোনোটির-ই দরকার পড়েনি। যদি আমরা ধরে নেই, ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন তাহলে ঐ গাড়ি নির্মাতার মতো তাকে আমরা খুঁজে পাবো না। তার অস্তিত্ব ও ভূমিকা আমাদের বিশ্বাস বা কল্পনা করে নিতে হবে।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: তাকে আমরা খুঁজে পাবো না আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে। আমাদের খুঁজে না পাওয়া তার অস্তিত্ব অপ্রমাণ করে না। আর আপনি ‘কল্পনা’ বলছেন কেন! আমরা তো না দেখে অনেক কিছুই বিশ্বাস করি। এই যে বায়ুর মধ্যে আমরা বাস করছি, যা থেকে অক্সিজেন নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি, তাকে তো আমরা দেখি না।
সঞ্জিব পুরোহিত: কোনো কিছুর অস্তিত্বের প্রমাণ পেতে তাকে দেখা-ই একমাত্র শর্ত নয়। অনুধাবনযোগ্য প্রমাণ পেলেও চলে। যে বস্তুগুলোকে আমরা দেখি না সেগুলোরও প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। যেমন আপনি বললেন বায়ু থেকে আমরা অক্সিজেন নেই। চোখে না দেখলেও ল্যাবরেটরিতে আমরা অক্সিজেনের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি। আবার অণু-পরমাণুকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু ইউরেনিয়ামের পরমাণুকে ব্যবহার করে আমরা পরমাণু বোমা বানাতে পারি।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: হ্যাঁ। কোনো বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে প্রমাণ পাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক বিষয়, যেমন, মত, সংকল্প, অভিপ্রায়, ধারণা, ভাব, কল্পনা, চিন্তা, ধ্যান, যুক্তি, ভাবনা, বিবেচনা, চিন্তন, মনন – এসবের অস্তিত্ব আমরা বুঝতে পারি; কিন্তু প্রমাণ করতে পারি না।
সঞ্জিব পুরোহিত: আশা করি ‘নৈর্ব্যক্তিক’ বলতে আপনি ‘স্পিরিচুয়াল’ বা আধিদৈবিক কিছু বুঝাননি। এক সময় ভাবা হতো মানুষের হৃদয় বা মন থাকে হৃৎপিণ্ডে। এখন আমরা জানি মন বাস করে মাথায়। আমাদের মস্তিষ্কে গড়ে ১০০০ কোটি স্নায়ুকোষ বা নিউরন থাকে, যারা জৈব বৈদ্যুতিক সংকেতের (bioelectricity) আকারে অনুভূতি পরিবহন করে থাকে। আমাদের সব অনুভূতি-ই কোনো না কোনো হরমোন নিঃসরণের ফল। হার্ভার্ড স্কুল অব মেডিসিন স¤প্রতি ভালবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করে যে হরমোন তার মলিকুলার ফরমুলা বা রাসায়নিক গঠন বের করেছেন– C43 H66 N12 O12 S2

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমাদের সৌরজগতের আটটি গ্রহ সূর্যকে অব্যর্থ ও নিখুঁত উপবৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করছে। আমাদের পৃথিবী সেকেন্ডে ১৫৮ মাইল (বুলেটের গতির প্রায় ২০০ গুণ) গতিতে ছুটন্ত সূর্যের সাথে ছুটছে এবং নিজে তাকে সেকেন্ডে ১৮.৫ মাইল গতিতে প্রদক্ষিণ করছে। আবার অপসুর ও অনুসুর দশায় সূর্য থেকে যথাক্রমে ১৫ কোটি ২০ লাখ ও ১৪ কোটি ৭০ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব বজায় রাখছে। এই দূরত্ব বা গতিতে যদি ০.০১% হেরফের হয় তাহলে পৃথিবী কক্ষচ্যুত হয়ে যাবে। কিন্তু সৃষ্টির আদি থেকে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া এই নিখুঁত নিয়মগুলো টিকে আছে কেনো? কোনো মহাশক্তিধর বুদ্ধিমান সত্ত¡ার একনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এরকম অনাদি নিয়মানুবর্তিতা কি টিকে থাকা সম্ভব?
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি বলছেন, সৃষ্টির আদি থেকে বিধিগুলো টিকে আছে। আপনি সেটা জানলেন কী করে? মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় কি আমরা সেখানে ছিলাম! ধরুন সৃষ্টির সময় সৌরজগতের গ্রহ ছিল ৫০টি। এর ৪২টির ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে এবং সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এক হাজার বছর আগেও যদি পৃথিবীর মতো উন্নত সভ্যতাসহ কোনো গ্রহ কক্ষচ্যুত হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেটা আমাদের জানার কথা নয়। প্রশ্ন করেছেন নিয়মগুলো টিকে আছে কেন? নিয়ম তো টিকে থাকার-ই কথা। এগুলো পদার্থের নিয়ম। পুরো প্রকৃতি জুড়ে এই বিধিগুলো কাজ করে। যে অঞ্চলে বিধিগুলো টিকে আছে সেখানে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো গ্রহের প্রাণীদের কিন্তু এই প্রশ্ন করার সুযোগ নাই — “আমরা টিকে নাই কেনো?”

সিদ্ধার্থ ঋষিন: ধরে নিলাম, মহাকর্ষ, অভিকর্ষ, আন্ত-আনবিক বল, তড়িৎ চুম্বকীয় বল বিধিগুলোকে তৈরি করেছে। কিন্তু এই বলগুলোকে তৈরি করলো কে অথবা (আপনার ভাষায়) কী? আদি কোনো ‘উৎস’ বা দর্শনের ভাষায় ‘কারণ’ না থাকলে তো এই বলগুলোর ব্যাখ্যা থাকে না। আপনার নিশ্চয়-ই এরিস্টটলের আনমুভড মুভার থিওরির কথা মনে আছে- “কোনো কিছুই ততক্ষণ নড়বে না যতক্ষণ না নড়াচড়া করা কিছু তাকে নড়াবে।“
সঞ্জিব পুরোহিত: এরিস্টটলের সময় এই ধারণা খুব মূল্যবান ছিল। তার সময়ের তুলনায় শুধু বিজ্ঞান এগিয়েছে এমন নয়, দর্শনও এগিয়েছে। আমি সেদিকে যেতে চাই না; আপাতত আমরা বিজ্ঞানেই-ই থাকি। বিগ ব্যাং মেনে নিলে ‘আনমুভড মুভার’ তত্ত¡ টিকে থাকে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে শূন্য অবস্থা থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে। উদ্ভূত পদার্থগুলোর গুণাবলীর সাথে পারিপার্শ্বিক পদার্থগুলোর গুণাবলীর মিথস্ক্রিয়ায় নিয়মের উদ্ভব ঘটেছে। যেমন পানির আনবিক গঠন এমন যে সূর্যের আলো পড়লে তা বাস্পীভুত হয়। বাস্পের ঘনত্ব ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বায়ুর চেয়ে কম হওয়ায় তা উপরে উঠে যায়। পরে ঠাণ্ডা বায়ুর সংস্পর্শে এসে ঘনীভূত হয়। এসময় তার আয়তনের তুলনায় ভর বেড়ে যায়। ফলে পৃথিবীর তাকে ভূপৃষ্ঠে টেনে নামায়। এটাই বৃষ্টিপাত। এখানে দেখুন নিয়মগুলো পূর্ণ অর্থে-ই আত্ম-ব্যাখ্যামূলক।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি পানিচক্রের আলোচনাটা শুরু করলেন আনবিক গঠনের পর থেকে, অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা যে পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে পারেন আপনি সেই বিন্দুটা বেছে নিলেন। কিন্তু পদার্থের আনবিক গঠনেও ব্যাখ্যাতীত বিশাল অংশ আছে। আমরা যে ব্যাখ্যাযোগ্য বিধিগুলো দেখছি তার পেছনে ক্রিয়াশীল অসংখ্য ব্যাখ্যাতীত কারণের অস্তিত্ব বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন। এক সময় প্রোটন ও নিউট্রনকে অবিভাজ্য মৌলিক কণা মনে করা হতো। পরে জানা গেলো এরা কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। এখন কোয়ার্ক ও ইলেকট্রনের মতো কিছু অতি পারমাণবিক কণাকে অবিভাজ্য মনে করা হয়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নীতি অনুযায়ী এদের কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই, শুধু স্থানে বিস্তৃতি আছে, যাকে নাম দেওয়া হয়েছে কোয়ান্টামীয় ক্ষেত্র। সেই অর্থে মহাবিশ্ব অসীম সংখ্যক তরঙ্গের সমাবেশ ছাড়া কিছু নয়। আমরা যে বিধিগুলো দেখছি সেগুলো হয়তো সেই তরঙ্গ থেকে উৎসারিত বলের বিধি, যা ঈশ্বরের ধারণার খুব কাছাকাছি।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি বলতে চাচ্ছেন পদার্থ বলে আসলে কিছু নেই। ফলে তার বিধিও নেই। আপনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে বার্কলির আত্মগত ভাববাদের সাথে (মনে মনে) মিলিয়ে দিয়ে একটা উপসংহারেও পৌঁছে গেলেন। খেয়াল করে দেখুন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বারবার আপনাকে দর্শনের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দর্শন না হলেও দর্শনের কাছাকাছি কিছু তো বটেই।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: বিজ্ঞানে তো সব প্রশ্নের উত্তর নেই। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবের কথা-ই ধরুন; প্রাণের শুরু হয়েছে কীভাবে তা নিয়ে এখনও কোনো বৈজ্ঞানিক ঐক্যমত্য নেই। তারা বলছেন এক কোষী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে। কিন্তু এই ট্রান্সফরমেশনের ব্যাখ্যায় অনেক ঘাটতি আছে।
সঞ্জিব পুরোহিত: ঘাটতি আছে সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ঐ ঘাটতির জায়গায় ঈশ্বরের ভূমিকাকে বসিয়ে দিচ্ছেন কেন! আমরা যদি কোনো ঘটনার কারণ না জানি তার অর্থ এটা নয় যে সেটা কোনো ঐশ্বরিক শক্তি এসে করে দিয়ে গেছে। সাগর ও রুনিকে কে/কারা হত্যা করেছে সেটা আমরা জানি না। এই সুযোগ ব্যবহার করে কেউ যদি দাবী করে এক রাক্ষস এসে তাদের হত্যা করে গেছে তাহলে কি আমরা সেটাই মেনে নেবো! এক সময় মানুষ জানতো না বৃষ্টিপাত কেনো হয়। তারা বিশ্বাস করতো দেবতারা আকাশ থেকে জল ছিটিয়ে দেন। আমরাও তো একই কাজ করছি। আমি একটু আগে বৃষ্টিপাতের কারণ ব্যাখ্যা করেছি। আপনি কিন্তু সেখানে ঈশ্বরের ভূমিকা ঢুকাতে যাননি! যে ঘটনা আমরা ব্যাখ্যা করতে পারছি না তার পেছনে ঈশ্বরকে বসিয়ে দিচ্ছি। মিলার-উরি পরীক্ষণে দেখানো হয়েছে যে আদি পৃথিবী অ্যামিনো অ্যাসিড এবং বিভিন্ন জৈব যৌগের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটার জন্য উপযুক্ত ছিলো। পরীক্ষণে দেখা যায় কোনো অনুঘটকের সাহায্য ছাড়া ফসফোলিপিডগুলি লিপিড বাইলেয়ার গঠন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে-ই, যা একটি কোষীয় ঝিল্লির মৌলিক কাঠামো। এই ব্যাখ্যায় যদি আমরা সন্তুষ্ট না হতে পারি তাহলে আরও ভালো ব্যাখ্যা খোঁজা যেতে পারে। যদি কোনো দিন-ই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পাওয়া যায় তাহলেও সেটা প্রমাণ করে না যে ঈশ্বর-ই সেটা করেছেন। মানুষ তার সীমিত জ্ঞান দিয়ে নিগূঢ়, বোধাতীত প্রকৃতির অসীম রহস্য বুঝতে চেষ্টা করছে এবং প্রতি পদে ব্যর্থ হয়ে সীমাহীন ক্ষমতাবান কোনো সত্তার অস্তিত্ব কল্পনা করছে।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: ড. পুরোহিত, কোনো একদিন কথা বলার সময় আপনি-ই প্লেটো বা অন্য কাউকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, “দর্শন হলো সকল জ্ঞানের মা।” কিন্তু আজ আপনি আলোচনায় দর্শন আনতে চাচ্ছেন না। যাহোক, ঈশ্বর বলে যে কেউ নেই আপনার এই দাবির স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ পেশ করুন। জ্ঞানার্জন করে কৃতার্থ হই।
সঞ্জিব পুরোহিত: ঈশ্বর নেই – আমি এরকম কোনো দাবি করিনি। আমি বলতে চেয়েছি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রত্যয়যোগ্য (convincing) প্রমাণ আমি পাইনি। তার অর্থ এটা নয় যে ঈশ্বরের থাকার সম্ভাবনাকে আমি অস্বীকার করছি। স্টিফেন হকিং এর কথা স্মরণ করুন। তিনি বলেছেন, “মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের ভূমিকা থাকা অপরিহার্য নয়।“ অর্থাৎ ঈশ্বরের ভূমিকা থাকার সম্ভাবনাকে তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করেননি।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি সম্ভবত ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ থেকে বলছেন। পরবর্তীতে তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। লিওনার্ড স্লোডিনোর সাথে লেখা ‘গ্রান্ড ডিজাইন’ এ তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্তে¡র প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি বাতিল করেছেন। বলেছেন: ‘অভিকর্ষ শক্তির সূত্রের মতো পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র কার্যকর রয়েছে, তাই একদম শূন্যতা থেকেও মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্ভব এবং সেটি অবশ্যম্ভাবী। ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি’ হওয়ার কারণ ও প্রবণতা থেকে-ই আমরা মহাশূন্যে অনেক কিছুর অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি। মহাবিশ্ব এ কারণেই টিকে আছে।” এবং শেষে স্পষ্ট করে বলেছেন “মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই।”
বরং আইনস্টাইনের অবস্থান-ই কিছুটা অস্পষ্ট। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছেন, বাইবেলকে ‘শিশুতোষ গল্প’ বলেছেন। আবার দ্য রিজন ফর লাইফ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, “যা কিছু আমাদের জন্য অপ্রবেশ্য বা অজ্ঞাত তা বাস্তবে অস্তিত্বময়, যা নিজেকে সর্বোচ্চ জ্ঞান ও সবচেয়ে দীপ্তিময় সৌন্দর্যরূপে অভিব্যক্ত করে, যাকে আমাদের ভোঁতা বোধশক্তি কেবলমাত্র তার সবচেয়ে আদিম রূপ দিয়ে অনুভব করতে পারে — এটা জানা, এই জ্ঞান ও এই অনুভূতি সকল ধার্মিকতার কেন্দ্রে আছে। এই অর্থে এবং কেবলমাত্র এই অর্থে আমি সেই সকল মানুষের দলে আছি যারা ভক্তিভরে ধর্মপরায়ণ।”
সঞ্জিব পুরোহিত: এ বইটি আমি পড়েছি। অনেকবার পড়েও আপনার উদ্ধৃত করা এই বাক্যটার অর্থ আমি বুঝিনি। “যাকে আমাদের ভোঁতা বোধশক্তি কেবলমাত্র তার সবচেয়ে আদিম রূপ দিয়ে অনুভব করতে পারে” বলে তিনি মানুষের অজ্ঞতাকে বিদ্রæপ করেছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। মূল প্রসঙ্গে আসি। কেউ যখন কোনো পজিটিভ ক্লেইম করে, যুক্তিবিদ্যার শর্ত অনুযায়ী তখন তা প্রমাণের দায়িত্ব তার ওপরে-ই বর্তায়। ধরুন, আমি দাবি করলাম, গতকাল আমি রাজশাহী থেকে আমার পোষা ছাগলের পিঠে চেপে গ্রান্ড ক্যানিয়ন ভ্রমণ করে এসেছি। এই দাবির সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাকে-ই প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। আমি যদি বলি আমার এই দাবি মিথ্যা প্রতিপন্ন করুন; না পারলে আমার দাবি-ই সত্য বলে প্রমাণিত হবে, তাহলে তা অযৌক্তিক হবে। আপনি দাবি করেছেন, ঈশ্বর আছেন। আপনার দায়িত্ব হলো, এই দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ দেওয়া। ঈশ্বর নেই এটা আমি প্রমাণ করতে পারবো না, যেমন পেতœী বা শাকচুন্নী নেই সেটা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনাকে এটা স্বীকার করতে হবে সব দাবি প্রমাণ নির্ভর নয়। কিছু দাবির ভিত্তি হলো বিশ্বাস, অনুভূতি, চেতনা, উপলব্ধি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস যখন এক রকম হয় তখন বুঝতে হবে তার একটা যথার্থতা আছে। ঈশ্বরের ধারণা শূন্য থেকে জন্ম নেয়নি। আপনার জন্য আমার শেষ প্রকল্প- ধরুন, জন্মের পর থেকে আপনি ও আপনার ভাই একটা ঘরে বন্দী আছেন। আপনি ভাবছেন এই ঘরটা-ই মহাজগৎ। আপনার ভাই ভাবছে ঘরের বাইরেই আসল জগৎ আছে। সেখানে জন্মদাতা বাবা-মা থাকেন। এই দুই বিশ্বাসের মধ্যে আপনার ভাইয়েরটা সঠিক। অতএব বিশ্বাসকে আমরা খাটো করে দেখতে পারি না।

সঞ্জিব পুরোহিত: আপনার যুক্তির দুর্বল দিক হলো আপনি ঘর এবং বাইরের যে দুটি জগতের কথা বলছেন দুটি- ই আপনার চেনা এবং প্রমানিত জগৎ। জন্মদাতা বলে যে কিছু থাকতে হয় সেটা আপনি জানেন। ঘরে বন্দী দুই ভাই জানে না। সমীকরণ মেলানোর জন্য আপনার অভিজ্ঞতা আপনি তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের দিয়ে সেটা বলিয়ে নিচ্ছেন। তারা অনেক কিছুই ভাবতে পারে। যেমন—বাইরের জগতে এরকম অসংখ্য ঘর ছাড়া কিছু নেই, প্রত্যেক ঘরে দুজন করে মানুষ বাস করে, বাইরের জগতের মানুষ আকৃতিতে বিশাল, তাদের মাথায় ১০ টা করে চোখ আছে অথবা এই ঘরের বাইরে আর কিছু নেই। ঐ ঘরের মধ্যে তারা যা দেখবে তার-ই পারমুটেশন- কম্বিনেশন করে ভাবনা সাজাবে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: এই কম্বিনেশনগুলোর একটা যে ‘বাবা-মা’-র কল্পনা হবেই না সেটা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। যাহোক, তাহলে আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না?
সঞ্জিব পুরোহিত: দেখুন সৃষ্টিকর্তা বলে যদি কেউ থেকে থাকেন তাহলে তাঁরও একজন সৃষ্টিকর্তা থাকতে হবে। সেই সৃষ্টিকর্তারও আবার সৃষ্টিকর্তা থাকতে হবে। এভাবে অনন্ত অতীত পর্যন্ত যেতে হবে। মহাবিশ্ব উদ্ভূত হয়েছে- এটা বিশ্বাস করলে এই সমস্যাটা থাকে না।

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘সবচেয়ে বড় সংখ্যার পরের সংখ্যা কী’ তাহলে কিন্তু আপনি উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ, প্রশ্নটাতে একটা প্যারাডক্স আছে। প্রশ্নটা ঘোষণা করছে ‘সবচেয়ে বড়’ বলে একটা সংখ্যা আছে। আবার জিজ্ঞেস করছে তারচেয়ে বড় কী? সংজ্ঞা অনুযায়ী সবচেয়ে ‘বড়’-র চেয়ে বড় কিছু থাকতে পারে না। আপনি বলছেন, “সৃষ্টিকর্তা বলে যদি কেউ থেকে থাকেন তাহলে তাঁরও একজন সৃষ্টিকর্তা থাকতে হবে।“ আপনি যখন সৃষ্টিকর্তা শব্দটা বলছেন তখন আসলে স্বীকার করে নিচ্ছেন তাঁর কোন স্রষ্টা নেই (সংজ্ঞা অনুযায়ী এটা-ই সত্য)। তারপর আবার জিজ্ঞেস করেছেন, “তাকে কে সৃষ্টি করেছে?” প্রশ্নটা প্যারাডক্সিক্যাল এবং বিভ্রান্তিকর। আমি সৃষ্টিকর্তাকে অন্ধভাবে নিঃশর্ত বিশ্বাস করি। কোনো যুক্তি খুঁজতে যাই না।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনার দুটি অন্তিম বাক্য তর্কযুদ্ধের প্রারম্ভে উচ্চারিত হলে আমার কিছু বলার থাকতো না। জয় গুরু!
সিদ্ধার্থ ঋষিন: ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন!
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।

Exit mobile version