হাসান গোর্কি : সবকিছু ঠিক চলছে কেন!
পৃথিবীতে প্রাণী, উদ্ভিদ, প্রকৃতি, মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্র যে এত সুশৃঙ্খলভাবে চলছে সেটা ভেবে আমরা বিস্মিত হই। কিন্তু সব কিছু যত সুশৃঙ্খল আমরা দেখতে পাই আসলে তা সেরকম নয়। পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এ নিয়মটি আমরা জন্মের পর থেকে দেখে আসছি। আমাদের আগে পৃথিবীতে যত মানুষ এসেছে তারাও এর কম দেখেছে। এটাকে আমরা চিরন্তন সত্যের উদাহরণ হিসেবে মানি। এটা সত্য, তবে চিরন্তন সত্য নয়, আংশিক বা খন্ডকালীণ সত্য। আজ থেকে সাড়ে পাঁচশ কোটি বছর আগে সূর্য ছিল না, পৃথিবী ছিল না। অতএব “পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে” কথাটিও সত্য ছিল না। আজ থেকে সাড়ে চারশ কোটি বছর পর সূর্য বিলুপ্ত হবে, পৃথিবীর প্রাণী-উদ্ভিদ বিলুপ্ত হবে। ইতিহাস লেখার জন্য কেউ বেঁচে থাকলে সে লিখবে, ‘‘এক সময় পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতো’’। আমদের কাছে মনে হয়, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, শীত-গ্রীস্ম-বর্ষার আগমন সবকিছুই স্মরণাতীত কাল থেকে ঘটছে অমোঘ পৌনঃপুনিকতায়, অনুপুঙ্খ নিয়ম মেনে। কিন্তু আমাদের কাছে যা ‘স্মরণাতীতকাল’ আসলে তা এতই ক্ষুদ্র সময় যে তাকে একটা মুহূর্তের ভগ্নাংশ বললেও বেশি বলা হবে।
মহাকালের তুলনায় আমরা বেঁচে থাকি খুব কম সময়। এর বিশাল ব্যাপ্তিতে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ আমরা দেখি। আর সবকিছু নিয়ম মাফিক ঘটতে দেখি অন্যযে কারণে সেটি হলো ক্ষণস্থায়ী যে বিধান আমাদের তৈরি করে সেটি ভেঙে যাবার পর আমরা থাকি না। যে অনিয়ম আমাদের অস্তিত্বকে অসম্ভব করে তোলে তা দেখা আমাদেরপক্ষে সম্ভব হলেও পরবর্তীতে এই ইতিহাস কোথাও টিকে থাকবে না। যেমন এখন যদি কোন উল্কাপাতে পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায় অথবা পৃথিবী কক্ষচ্যূত হয়ে সূর্যের অগ্নিগাঙে ডুবে যায় তাহলে মরে যেতে যেতে সে ধ্বংসযজ্ঞ আমরা দেখে যাবো। কিন্তু পুরো বিষয়টা অপার বিস্মরণে ডুবে যাবে।
হয়তো আজ থেকে একশ কোটি বছর আগে সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশটি। কালক্রমে তার ৪২টি কক্ষচ্যূত হয়ে সূর্যের লেলিহান অগ্নিগাঙে ডুবে গিয়ে নিঃচিহ্ন হয়ে গেছে। সেগুলোর কোন কোনটি হয়তো মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণীসহ ঝাঁপ দিয়েছে সূর্যের বুকে। পৃথিবীর মানুষকে এখবরটি তারা জানিয়ে যেতে পারেনি। মঙ্গল গ্রহের মানুষরা যদি ১০০ কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেটা আমাদের জানার কথা নয়। কারন সে ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটেছে আমাদের পৃথিবীতে আগমনের ৯৯ কোটি ৭০ লক্ষ বছর আগে।
কোন মানুষের বয়স যদি তেরশ কোটি বছর হতো তাহলে সে পুরো ঘটনাটা বলতে পারতো। তার কাছে মহাজগৎকে এক চরম অরাজকতাপূর্ণ ও বিশৃঙ্খল ঘটনাবলীর সমাহার ছাড়া কিছুই মনে হতো না। সে দেখতো, একটা বিন্দুতে অকল্পনীয় বৃহৎ একটা বিস্ফোরণের পর গ্যাসের পাঁজা, ধুলিকণা, প্রস্তর খন্ড, অগ্নিগোলক- সবকিছু প্রায় আলোর গতিতে দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করেছে। ছুটন্ত অবস্থায়-ই এদের মধ্যে জোট (গ্যালাক্সি) তৈরি হচ্ছে। বিস্ফোরণকালীন শক্তি ধারণ করে জোটগুলো নিজ অক্ষে আবর্তিত হতে শুরু করেছে। সেগুলো পরস্পরের মধ্যে ঢুকে পড়ে প্রবল সংঘর্ষে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে। মহাকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে কোটি কোটি মাইল দীর্ঘ আগুনের শিখা। কোথাও পুঞ্জীভূত গ্যাসীয় মেঘমালা থেকে তৈরি হচ্ছে নক্ষত্র; উপজাত হিসেবে গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু। কোন কোন গ্রহে প্রাণের উম্মেষ ঘটছে এবং মুহূতের্ তা বিলুপ্ত হচ্ছে। মুহূর্তে বলা হচ্ছে একারণে যে সেই কল্পিত ব্যক্তির বয়স যদি আমরা পঁচাত্তর বছরে সঙ্কুচিত করে হিসেব করি তাহলে সে আফ্রিকার গুহাবাসী মানুষের পূর্ব প্রজাতির আবির্ভাব (মোটামুটি ত্রিশ লাখ বছর আগে ঘটেছে বলে ধরা হয়) থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের বিবর্তনকে দেখবে পনেরো দিনে; ক্রোমেনিয়ন মানব থেকে বর্তমান মানবে বিবর্তন দেখবে এক ঘন্টায়; ইউরোপের শিল্প বিপ্লব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে দেখবে এক সেকেন্ডে।
তাহলে আমাদের কাছে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে বলে মনে হচ্ছে কেন? ধরে নেওয়া যাক পাহাড়ের চূড়া থেকে ভূমিকম্পে একটা বড় পাথর খন্ড মাটিতে খসে পড়ে একটা গর্ত তৈরি করল। সেখানে বৃষ্টির পানি জমল। ব্যাঙাচিবাহী একটা ট্রাক উল্টে ঐ ডোবায় কিছু ব্যাঙের জন্ম হলো। একশ বছর পর ঐ ব্যাঙরা ভাবতে শুরু করবে তারা এখানে অনন্তকাল ধরে বাস করছে। তাদের ঈশ্বর এই অনাদি আবাসকে সাজিয়েছেন তা-ই দিয়ে ঠিক যা যা তাদের দরকার ছিল। তিনি নিয়মিত বৃষ্টিপাত দিচ্ছেন। খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়, শ্যাওলার জোগান নিশ্চিত করছেন। পরিমিত সূর্যালোক, অক্সিজেন সরবরাহ করছেন। এই ডোবার বাইরে যে কোন জগৎ আছে সেটা তারা ভাবতে পারবে না। তাদের মনে হবে সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্ররাজি, বায়ু, বৃষ্টি সব তাদের জন্য আছে। আমাদের ভাবনাগুলোও হয়তো সেরকম।
এখন আমরা আমাদের শরীরটাকে পরিপূর্ণ ভাবছি। কিন্তু আমাদের মাথার পেছন দিকে একটা চোখ থাকলে সেটাকেই আমরা নিয়ম মনে করতাম। শত্রæর হাত থেকে বাঁচার জন্য ঐ চোখের কার্যকারিতা নিয়ে খুশি থাকতাম। জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখতেন, “তোমার পেছন চোখ পেঁচার ডানার মত উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে- অনিমেষ।” পেছনের চোখ ছাড়া কোন শিশুর জন্ম হলে পত্রিকায় শিরোনাম হতো, “বরগুনায় দুই চোখ বিশিষ্ট শিশুর জন্ম- নবজাতকসুস্থআছে।” মানুষ যদি আকাশে উড়তে পারত তাহলে আমরা সেটাকেই নিয়ম মনে করে নিজেদের আশীর্বাদপুষ্ট মনে করতাম। তিন বছর বয়সে কোন শিশু ওড়া না শিখলে বাবা মা চিন্তিত হয়ে পড়তেন। সবকিছু যে ঠিক চলছে না সেটা তারা ভাবতেন তখনকার মানদণ্ডে।
কিছুটা পেছন ফিরে দেখা যাক। বিবর্তনবাদকে যদি আমরা নির্ভুল বলে মেনে নেই তাহলে সকল প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে সমুদ্রে- এক কোষী প্রাণী থেকে। আমাদের বহুকোষী পূর্ব পুরুষরাও সমুদ্রের পানিতে বাস করতো। তাদের হাত-পা ছিল না। চোখ-মাথা কিছুই আমাদের মত ছিল না। সেসময় তারা ভাবত তারা সব অর্থে পরিপূর্ণ (ইলিশ মাছ যেমন নিজেকে ভাবে!)। এক সময় তারা ডাঙায় উঠে আসে। বিবর্তনের ধারায় এপ জাতীয় প্রাণী থেকে হোমো হেবিলিস, হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান ডার্থাল হয়ে আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স। আরও একশ কোটি বছর বেঁচে থাকলে বিবর্তনের অনিবার্য পথ বেয়ে মানুষ যে আকৃতি ধারণ করবে (সে আকৃতিটা যদি ডিম বা সুপারি গাছের মত হয় তাহলেও এখনকার মতই) সেটাকেই তারা পরিপূর্ণ এবং ত্রুটিহীন মনে করবে এবং অবাক হয়ে ভাববে- সবকিছু এত ঠিকঠাক চলছে কেমন করে!
সুশৃঙ্খল বা বিশৃঙ্খল যা-ই হোক মহাবিশ্বের এই মহাযজ্ঞ চলছে কোন বিধিতে? সুব্রাম্নিয়াম চন্দ্রশেখর মনে করেছেন, বিগব্যাং এর পর যে সকল পারমুটেশন কম্বিনেশনের ওপর ভিত্তি করে এই যজ্ঞটা শুরু হতে পারতো তা সংখ্যাতীত। তাহলে ঠিক এরকম ঘটল কেন? পদার্থ কণা, গ্রহ-নক্ষত্র, প্রাণী-উদ্ভিদ, মাধ্যাকর্ষণ- এসব তৈরি হলো কেন? এরকম ঘটেছে একারণে যে, যে কোন একটা ঘটনা ঘটতে হতো। যেমন দশ তলা একটা বিল্ডিঙয়ের ছাদ থেকে রাস্তা লক্ষ্য করে মার্বেল ছুঁড়ে দিলে সেটা পথচারীর মাথায় পড়তে পারে, চলমান গাড়ির ছাদে পড়তে পারে, রাস্তায় পড়তে পারে, সবজির ভ্যানে পড়ে হারিয়ে যেতে পারে। কারো মাথায় পড়লে আমরা বলব, “মাথায় পড়ল কেন?”
অন্য যেকোন ঘটনার ক্ষেত্রেও আমরা একই রকম প্রশ্ন করবো। একইভাবে এখন আমরা যা দেখছি তা সংখ্যাতীত সম্ভাব্য ঘটনার একটা। আর এই ঘটনাটা যেহেতু আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে তাই অন্য সম্ভাব্য ঘটনাগুলো কেন ঘটেনি তা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছি।
বিষয়টা স্পষ্ট করতে স্টিফেন হকিংএর “এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম” বই থেকে একটা রূপকল্প ধার করা যাক। অশিক্ষিত বানরদের একটা দলের সবাইকে একটা করে ল্যাপটপ দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো। তাদের বলা হলো ইচ্ছা মত টাইপ করতে। আধা ঘন্টা পর পর তাদের কৃতকর্মের একটা করে প্রিন্ট নিতে থাকা হলো। দেখা গেল এর বেশির ভাগই অর্থহীন শব্দ সম্ভার। এই কাজ অনন্ত সময় ধরে চলতে থাকলে এদের কেউ সেক্সপিয়রের একটা সনেট লিখে ফেলতে পারে। আমাদের বুদ্ধিতে এর সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কিন্তু অংকের বিধিতে সেটা শূন্য নয়।
কোন বানর সনেট টাইপ করে ফেললে সেটা হতো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উৎপাদন। কিন্তু সেটা না করে কোন বানর যদি ঘটনাক্রমে একটা বাক্য বা কমপক্ষে পরপর দুটি অর্থপূর্ণ শব্দ টাইপ করে ফেলে তাহলে একটা কার্যকর কিছু ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া চলে। আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করছি সেটা অনেকটা সেরকম, সনেটের পরিবর্তে একটা বাক্য বা দুটি অর্থপূর্ণ শব্দের মতো। আর এলোপাথাড়ি পারমুটেশন কম্বিনেশনের কোন পর্যায়ে প্রকৃতি যদি সনেট লেখা ঐ বানরের মত একটা নির্ভুল বিধিমালা লিখে ফেলে তাহলে আমরা এমন একটা বৈচিত্র্যহীন অসীম শৃঙ্খলা দেখতে পাবো যাকে দেখতে জেলখানার মত লাগবে।
hassangorkii@yahoo.com
হাসান গোর্কি : রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশকলম্বিয়া