Home কলাম প্রান্তরে তেপান্তরে-২৯ : দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে

প্রান্তরে তেপান্তরে-২৯ : দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে

হাসান গোর্কি : ‘আমি’ শব্দটা আমাদের সবচেয়ে কাছের শব্দ। একই সাথে এটা অনেক দূরেরও। আমি সবচেয়ে বেশি আমাকেই চিনি; আবার আমার সবচেয়ে অচেনাদের তালিকা করলে তার শীর্ষে আমার জায়গা হতে পারে। ‘আমি কে’থ এটা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো প্রশ্নগুলোর একটা। এ বিশ্বাসটাই সবচেয়ে জোড়ালো যে আমরা মাতৃগর্ভে আমাদের শরীরে আসি। দ্বৈত বেদান্ত বা ভেদবাদ অনুসারে মাতৃগর্ভে আমাদের শরীরে প্রথমে জীবাত্মা আসীন হয়; এরপর তাতে ব্রহ্মার চিত্ত পরমাত্মা ভর করে। ভেদবাদ হিন্দু দর্শনের বেদান্ত শাখার একটি উপশাখা। এই দর্শনে ভাবা হয় পরমাত্মা প্রতিটি পৃথক জীবের মূল অংশে অবস্থিত। অন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোতেও এই ধারণার আংশিক অনুমোদন আছে। তাহলে আমরা আমাদের উন্মেষের মুহূর্তকে মনে করতে পারি না কেন? জীবাত্মা-পরমাত্মার যৌথ অবস্থান আমাদের চেতনাকে মাতৃগর্ভেই সজীব ও পরিপক্ক করে না কেন? আমরা খেয়াল করলে দেখবো নবজাতকদের প্রতিক্রিয়া অনেকটা বৃক্ষের মতো, যারা আলো-বাতাস, শব্দ-নৈঃশব্দ্য, অনুক‚লতা-প্রতিক‚লতায় অপরিণত সাড়া দেয়। তাতে কোন চিন্তা বা পরিকল্পনার লক্ষণ দেখা যায় না। দেহের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার প্রতিক্রিয়ার ধরণ বদলে যায়। তাহলে কি আত্মার পরিপক্কতার জন্য দেহের পরিপক্কতার দরকার হয়? হ্যাঁ, আমাদের সীমিত বুদ্ধিতে আমরা সেরকম-ই দেখতে পাই।

বিবর্তনবাদীরা বলছেন সকল প্রাণী এসেছে ব্যাকটেরিয়া থেকে (আমাদের আদি পিতা, প্রান্তরে তেপান্তরে-৭)। অর্থাত আমাদের আদিপিতাদের একজন সমুদ্রে এক কোষী জীবন শুরু করেছিল। জীবনের জন্য আত্মা অপরিহার্য হলে তার ওপরও সেটি ভর করেছিল। আমরা জানি এক কোষী প্রাণীর বুদ্ধির স্তর খুবই নগণ্য। তারা চলে প্রবৃত্তি দিয়ে; কোন কোন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা নিজেদের বাঁচাতে পারলেও নিজের থেকে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে না। যেমন আমরা এন্টিবায়োটিক খেলে আমাদের শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়ারা নিজেদের শরীর বেষ্টন করে সিস্ট তৈরি করে। জীব বিজ্ঞানীরা এটাকে বুদ্ধিমত্তা না বলে প্রবৃত্তি বলছেন। বিবর্তনবাদের সাথে আত্মার ধারণাকে মেলাতে গেলে এক কোষী প্রাণীদেরও মানুষের সমান বুদ্ধিমান মানতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদেরও সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম-চিন্তা, আবেগ, ক্ষোভ, অভিমান, হিংসা, বিনোদন, হতাশা থাকার কথা। এসব তাদের আছে কিনা সেটা অনুমান করা শক্ত।

বেদান্ত দার্শনিকদের ধারণা আত্মা একটা স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক সত্তা। সাংখ্য, মীমাংসা, যোগ ও ন্যায় বৈশেষিক দার্শনিকরা মনে করেন আত্মা দেহ-মনে ঈশ্বরের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়; কিন্তু তা নিস্ক্রিয়। এ ধারণা সত্য হলে সেটাও জীববিদ্যার সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক হয়; জীববিদ্যা প্রাণীর অস্তিত্তে¡র জন্য একটা স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক সত্তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে না। বৌদ্ধ দর্শনের অনাত্মা মতবাদ অ-বস্তুগত কোনো সত্তার অস্বিত্ব অস্বীকার না করলেও দৈহিক বস্তু ও মানসিক বস্তুকে পৃথক মনে করে। মূলত তিনটি আব্রাহামিক ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা এবং লেখালেখি করলেও দার্শনিক হিউমের জীব-দর্শন বা জীবন-মতবাদ বিস্ময়করভাবে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে মিলে যায়। তিনি মনে করতেন আত্মা থেকে থাকলেও তা বোঝার উপায় নেই। আমরা যে ইন্দ্রিয় ছাপ অনুভব করি তা এক ধরণের প্রত্যক্ষণ; এর বাইরে কিছু নয়। যেমন ভালবাসা, ক্রোধ, আলো, অন্ধকার, শীতলতা, আনন্দ প্রত্যক্ষগোচরীভূত। এই প্রত্যক্ষণপুঞ্জের সাথে বৌদ্ধদর্শনের ‘মানসিক প্রবাহধারা’র খুব মিল আছে।

নবজাতকের কথায় ফিরে আসি। Ode: Intimations of Immortality from Recollections of Early Childhood’ কবিতায় উইলিয়াল ওয়ার্ডসওয়ার্থ ধারণা দিয়েছেন, পৃথিবীতে আসার পর শিশু তার অতীতের স্বর্গীয় জীবন স্মরণ করতে পারে এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে তার সেই স্মৃতি বিলুপ্ত হয়। এই ধারণাকে অতিমাত্রিক কল্পনাবিলাস বলে মনে করেন বেশিরভাগ সাহিত্য সমালোচক। বিপরীতপক্ষে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
“প্রথম মানুষ কবে
এসেছিল এই সবুজ মাঠের ফসলের উত্সবে!
দেহ তাহাদের এই শস্যের মতো উঠেছিল। ফলে,
এই পৃথিবীর ক্ষেতের কিনারে, সবজির কোলে কোলে
এসেছিল তারা ভোরের বেলায় রৌদ্র পোহাবে ব’লে-”
(আদিম- জীবনানন্দ দাশ)

বীজ থেকে অংকুর এবং তা থেকে একটা উদ্ভিদ শিশুর বেড়ে ওঠা, আলো, হাওয়া, তাপমাত্রার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, এক সময় পত্র-পল্লব বিস্তার করে গুল্ম, বিটপ, বৃক্ষে রূপ নেওয়া এবং সবশেষে ফুল ফলের জন্ম দিয়ে পূর্ণতায় পৌঁছার সাথে নবজাতকের যাত্রা শুরুর মিল খুঁজে পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশ- “দেহ তাহাদের এই শস্যের মতো উঠেছিল।“ আমাদের বাসার পেছনে একখণ্ড জমিতে আমার কৈশোরে বাবা বেগুন, টমেটো, গাজর, ফুলকপি চাষ করতেন। প্রতিদিন স্কুলে যাবার আগে আমার কাজ ছিল বাগানে পানি দেওয়া। শ্রমসাধ্য হলেও কাজটি করতে আমার খারাপ লাগতো না। ফুল থেকে যখন টমেটো-বেগুণের বাবুরা মাথা বের করে বড় হতে থাকতো তখন আমি এক অদ্ভুত, অপার্থিব উত্তেজনা অনুভব করতাম। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে বাগানে গিয়ে দেখতাম কে কতটা বড় হয়েছে। আমার খুব মনে আছে এই শস্যদের প্রাণের একটা অদৃশ্য স্পন্দনে বাঁধা থাকতো আমার কৈশোরের শীতকাল। এর অনেক বছর পর আমার একমাত্র ছেলে গোর্কির বেড়ে ওঠা কিছুদিন আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি- প্রতিদিন একটা করে নতুন হাসি, একটা নতুন উত্তেজনা, একটা নতুন হাত-পা ছোঁড়া । তখন আমার বারবার করে আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে ঐ শীতকালীন সবজিগুলোর বেড়ে ওঠার কথা মনে পড়তো।

আমি কে অথবা কী- সেটা এই সীমিত বুদ্ধিতে আমাদের বোঝার আশা নেই। আমরা যদি এই অনুমান বা প্রেষণ নির্ভর বিশ্বাসে স্থির থাকি যে আমি কোথাও একটা ছিলাম, এখন এই দেহকে ভর করে আছি এবং পরে অন্য কিছুতে/কোথাও থাকবো তাহলে এই আধ্যাত্মিক প্রশ্নের একটা আপাত সমাধান হয়। সেক্ষেত্রে এটা যে শুধুই একটা অনুমান তা-ও মেনে নিতে হবে। কারণ প্রত্যক্ষণ থেকে আমাদের দেহে আত্মার উপস্থিতি বুঝতে পারা যায় না। আবার এমন হতে পারে যে আমাদের দেহের জটিল জৈব যৌগিক মিথস্ক্রিয়া যে চেতনার জন্ম দেয় সেটাই ‘আমি’। তাহলে আবেগ, সৌন্দর্যবোধ, ভালবাসা এসব কোথায় থেকে আসে? প্রকৃতিবাদীরা বলছেন, এগুলোও জৈব-যৌগিক মিথস্ক্রিয়া। ধরা যাক আমার ওয়াইফ (আসলে নেই, কাল্পনিক) অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে। কিন্তু সেদিন তার মাথা নেই; কেউ কেটে নিয়েছে। তখন আমার মস্তিষ্কের কোষগুলো তার আগের চেহারার সাথে আজকের চেহারার পার্থক্য দ্রুত মিলিয়ে দেখবে। যে অসঙ্গতি পাবে সেটা সুখকর নয়। মস্তিষ্কের কোষগুলো তাদের ভান্ডারে থাকা সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে তাকে অনিরাপদ ও বিপদজনক মনে করবে এবং স্বর-যন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত স্নায়ুতন্ত্রে ‘বিপদ বার্তা’ পাঠাবে। স্বর-যন্ত্র থেকে সেটা ধ্বনিত হবে (আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে?) এবং প্রতিবেশীরা জড়ো হয়ে যাবে আমার বাসার সামনে। এটা একটা প্রত্যক্ষণের ফল। এখানে আত্মার কোন উপস্থিতির দরকার পড়েছে কিনা সেটা আমাদের সাধারণ প্রত্যক্ষণ দিয়ে বোঝার উপায় নেই।
আরও দুই একটা উদাহরণ দেখা যাক। আমাদের সকলের পছন্দের কিছু গান আছে। আমরা খেয়াল করলে দেখবো, যে গানটার হারমনি (শব্দটার ভালো বাংলা পরিভাষা নেই। তবে কাছাকাছি অর্থ- মিশ, একতান, অবিরোধ বলা যেতে পারে ) আমাদের কাছে যতো বেশি সে গানটিই আমরা ততো বেশি পছন্দ করি। কারণ প্রাকৃতিক কারণেই আমাদের মস্তিষ্ক ‘হারমনি’ পছন্দ করে। তাহলে পর্বতমালায় অবিন্যস্ত প্রস্তরখণ্ড, এলোমেলো বয়ে চলা ঝর্নাধারা, জংলি ফুল আমাদের পছন্দ হয় কেন? এদের মধ্যেও কি হারমনি আছে? হ্যাঁ, আছে। সেটা অবিন্যস্ততার ধারাবাহিকতা। এখানে কোনকিছুই যে গোছানো নয় তার ধারাবাহিকতা আছে। যেমন পাহাড়ের চুড়াগুলো এবড়ো থেবড়ো। এগুলোর কয়েকটি যদি নিখুঁত ত্রিকোণ বা চতুষ্কোণ হতো তাহলে এই ধারাবাহিকতা বা হারমনির ব্যত্যয় ঘটতো। সেটা সৌন্দর্যের জন্যও হানিকর হতো। আমাদের এই সৌন্দর্যবোধ আমাদের মস্তিষ্কে রক্ষিত সেন্স অব হারমনি দিয়েই নিয়ন্ত্রিত। ‘আমি’ নামের আধিদৈবিক কোন সত্ত¡া (স্পিরিচুয়াল এনটিটি) এর নিয়ন্তা হলে তা প্রত্যক্ষণের ফলাফলকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখতো এবং আমরা প্রায়-ই অজ্ঞাত- ব্যাখ্যাতীত কার্য-কারণ দিয়ে চালিত হতাম- দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমায় নৌবিহার করতে, বেসুরো গান শুনতে, অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার খেতে, কুত্সিত কোন দৃশ্য দেখতে খারাপ লাগতো না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো বলছে আমাদের আধিদৈবিক সত্ত¡ার মধ্যেই সেই ‘হারমনি’টি (অন্য নামে- যেমন বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাবোধ ইত্যাদি) আছে এবং সেটাই ভালো-মন্দ বুঝিয়ে দেয় এবং পরিপার্শ্বের প্রতি যথার্থ প্রতিক্রিয়া দেখাতে সাহায্য করে। এটা মানতে চাইলে সেই আগের মতোই এক্ষেত্রেও আমাদের নির্ভর করতে হবে অকুন্ঠ- শর্তহীন বিশ্বাসের ওপর।

জীবাত্মাকে যদি আমরা জৈব চেতনার সমার্থক ধরি তাহলে তার অস্তিত্তে¡র একটা ব্যাখ্যা আছে। মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র হলো মস্তিষ্ক, যা গড়ে ৮৫ বিলিয়ন বা ৮৫০০ কোটি নিউরন সেল দিয়ে গঠিত। এরা পরস্পর স্নায়ুতন্তু (প্রবর্ধক) দিয়ে সংযুক্ত, অনেকটা কম্পিউটারের মেমোরির মতো; অথবা গুগলের ওয়েব নেটওয়ার্কের মতো। আমরা যখন কোন তথ্য পেতে সার্চ ফিল্ডে টাইপ করি (বা মুখে বলি) তখন সার্চ এঞ্জিন বিভিন্ন চিপ-এ রক্ষিত তথ্যগুলো থেকে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিকটা খুঁজে বের করে আমাদের জানিয়ে দেয়। মস্তিষ্কের কাজ এর থেকেও বেশি— সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রক্রিয়াজাত করার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে তা শরীরের সংশ্লিষ্ট অংশে প্রেরণ করা। যেমন, আমার পায়ে যদি একটা মশা বসে রক্ত পান করতে শুরু করে তাহলে স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে খবরটা মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। মস্তিষ্ক আগের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে যে এটা মশার দংশন। সে চোখে বার্তা পাঠিয়ে অবলোকনের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে বলে। চোখ সেটা নিশ্চিত করলে মস্তিষ্ক আমার হাতে বার্তা পাঠিয়ে তাকে সক্রিয় করে। এখানেও সিদ্ধান্তের ব্যাপার থাকে। ধরা যাক, আমি ডান হাতে (যেটা সাধারণভাবে বেশি সক্রিয়) চা পান করছি। সেক্ষেত্রে মস্তিষ্ক বার্তাটি পাঠিয়ে দেবে বাম হাতে। এবং আমার বাম হাত মশাটিকে মেরে ফেলবে। আমরা জানি, হাতের কোন চেতনা নেই। কিন্তু এখানে সে শরীরের চেতন অংশের (মস্তিষ্কের) নির্দেশ বুঝতে পারছে এবং নির্দেশটি পালন করা যে জরুরি সেটাও বুঝেছে। মস্তিষ্কের সাথে পুরো শরীরের এই সমন্বিত চেতনাকে যদি আমরা একটা জৈব সংগঠন ভাবি এবং তাকে জীবাত্মা নাম দেই তাহলে বিরোধ থাকে না। সেক্ষেত্রে আমাদের হাতও জীবাত্মার অংশ হয়ে যায়। কিন্তু জীবাত্মাকে যদি আমরা স্পিরিচুয়াল এনটিটি ধরে নেই তাহলে কিছু সমস্যা থেকে যায়; অনেক কিছুর ব্যাখ্যা মেলে না। যেমন শরীরে বড় অস্ত্রোপচারের সময় ওষুধ দিয়ে আমাদের চেতনা লোপ করা হয়। জীবাত্মা স্পিরিচুয়াল কিছু হলে তার চেতনা লোপ পাবার কথা নয়। আর পরমাত্মার বিষয়টা এতোটা নিরঙ্কুশভাবে আধিদৈবিক যে তা জীববিদ্যা স্বীকার বা অধ্যয়ন করতে রাজি থাকে না।

তবে বিজ্ঞান-ই যে শেষ কথা নয় সেটা বোঝা গেছে কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর আবির্ভাবের পর; আরও স্পষ্ট করে বললে ‘অনিশ্চয়তার ধারণা’ সামনে আসার পর। বারট্রান্ড রাসেল বা স্টিফেন হকিং এর বইগুলো পড়লে আমরা খুব বিস্মিত হয়ে দেখি তারা বিজ্ঞানের তত্ত¡কে ব্যাখ্যা করার সময় বারবার দর্শনকে টেনে এনেছেন। প্লেটো লিখেছেন, “তোমার ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করো না; চোখ, কান, নাক, জিহবা তোমাকে ভুল তথ্য দিতে পারে। ইন্দ্রিয়ের মোহজাল থেকে বেরিয়ে আসো, ওদের নিজের জ্ঞানের ওপর নির্ভর করো না, কারণ ওরা আত্ম-জ্ঞানরহিত। নিজের পবিত্র সত্তার ভেতর আসো ও নিজের উপর বিশ্বাস দৃঢ? করো। আপন উপলদ্ধিই বিশুদ্ধ জ্ঞান। তাই অন্য উপায়ে তোমার অর্জিত জ্ঞানকে বিশ্বাস করলে তুমি প্রতারিত হবে। কেননা তারা দৃশ্য ও স্পর্শ। আর তোমার স্বীয় সত্তার উপলদ্ধি তাদের বিপরীত- অদৃশ্য ও স্পর্শাতীত“ (টিমেয়ুস)। সক্রেটিসও আত্মার অস্তিত্ত¡ মানতেন। তিনি আত্মাকে বুদ্ধিমান, ঐশ্বরিক এবং অপরিবর্তনীয় এবং দেহকে মরণশীল, মানবিক ও বিলীয়মান (পরিবর্তনীয় অর্থে) মনে করতেন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এর বাইরে কিছু ভাবার সুযোগও ছিল না। পদার্থ ও শক্তি যে পরস্পর রূপান্তরযোগ্য সে ধারণা তখনও তৈরি হয়নি।

ভারতীয় ঋষি ও দার্শনিক কণাদ ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রথম পরমাণুর ধারণা দেন। তিনি মনে করতেন সকল বস্তু অতি ক্ষুদ্র অবিভাজ্য কণিকা দিয়ে তৈরি। গ্রীক দার্শনিকরাও পদার্থের তত্ত¡ নির্মাণ করেন পুরোপুরি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে আবদেরার ডেমোক্রিটাস এই কল্পিত কণার নাম দেন ‘এটমস’ (গ্রিক: Atomos)। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন পরমাণুও অবিভাজ্য নয়; বরং তা ভাঙলে শক্তি ও তরঙ্গ পাওয়া যায়। আর অতি-পারমাণবিক কণাগুলো নিজেরাই তরঙ্গের আকারে বিরাজ করে, যা অনেকটা চেতনার-ই সমার্থক। কিন্তু এটা বোঝার উপায় নেই যে পদার্থ, কারণের (ঈশ্বরের) অবভাস কিনা অথবা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অসীম সংখ্যক প্রোটন কণার অসীম কোয়ান্টামীয় ক্ষেত্র-ই ‘কারণ’ তৈরি করে কিনা। ‘কারণ’ অভিধাটি আমাদের কাছে কিছুটা অস্পষ্ট মনে হতে পারে। ভাববাদী দার্শনিকরা ‘ঈশ্বর’কে ‘কারণ’ বলে অভিহিত করেন। এর আসলে বিকল্প সমার্থক শব্দ নেই। আমরা এভাবে বুঝতে চেষ্টা করতে পারি- মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তার সবটুকু ঈশ্বরের কারণে ঘটছে। সেকারণে ‘ঈশ্বর’-ই ‘কারণ’। তাহলে শুধু ‘ঈশ্বর’ বললে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো, ভাববাদের ঈশ্বর সরাসরি আমাদের চেনা ঈশ্বর নয়- কখনও তা অসীম ও অনুদ্দেশ চৈতন্য প্রবাহও।

এই আকাশ-পাতাল আলোচনায় আমাদের কি কোন লাভ হলো? হ্যাঁ, হাল ছেড়ে দেওয়াও যে একটা সমাধান সেটা বোঝা গেল। রবীন্দ্রনাথ যেমন তার ভেতরের ‘আমি’র খোঁজ না পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে
আমার বাটে বটের ছায়ায় সারা বেলা গেল খেলে
গাইল কী গান সেই তা জানে, সুর বাজে তার আমার প্রাণে
বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কিছু আভাস পেলে?”
hassangorkii@yahoo.com
মার্চ ২৭, ২০২২। রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।

Exit mobile version