হাসান গোর্কি : পৃথিবীতে একটি মাত্র যুদ্ধের নাম আছে যেটা ঘটেনি। সেটা হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধটা হয়তো কখনই হবে না; শুধু কাগজেই থেকে যাবে। এমন হবার সম্ভাবনা হয়তো ৯৯% বা তার বেশি। এরকম একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা যে ভয় পাই সেটা কেন অমূলক তা পরাশক্তিগুলোর সতর্কতার মাত্রা দেখলে বোঝা যায়। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী চলা যুদ্ধটার নাম ছিল ‘দ্য গ্রেট ওয়ার’ বা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার’। তখন কেউ জানতো না যে এরপর আবার বিশ্বব্যাপী একটা যুদ্ধ হবে। তাই ঐ ‘গ্রেট ওয়ার’কে কেউ ‘ফার্স্ট গ্রেট ওয়ার’ বা ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ’ নাম দেয়নি। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী আবার একটা যুদ্ধ হলো। এটাকে নাম দেওয়া হলো ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’। এবং স্বাভাবিকভাবেই ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার’ বা’গ্রেট ওয়ার’ এর নাম হয়ে গেল ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ’। বড় মেয়ের নাম ছিল আনিকা। ২১ বছর পড় জন্ম নেওয়া ছোট মেয়ের নাম রাখা হলো বুশরা -২। আর বড় মেয়ের নাম বদল করে রাখা হলো বুশরা -১। ব্যাপারটা এরকম আর কি!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার একুশ বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ৭৬ বছর পার হয়েছে। ১৯৬২-র মিসাইল ক্রাইসিস ছাড়া এ দীর্ঘ সময়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি আর একবারও তৈরি হয়নি। লক্ষণীয়ভাবে কমে এসেছে আঞ্চলিক যুদ্ধের সংখ্যা। সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটি ঘটেছে সেটা হলো, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে তাতে তৃতীয় কোন দেশের সরাসরি অংশগ্রহণের সংখ্যাও ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত হয়ে পড়েছে। এর কারণ হলো ঐ দুটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহানোর ফলে মানুষের মনে যে যুদ্ধ ভীতি সৃষ্টি হয়েছিল তা ক্রমেই তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেয়েছে। ফলে পরাশক্তিগুলো, এমনকি পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো পরস্পরকে এতটাই ভয় পায় যে তারা সরাসরি কোন বৈরিতায় যেতে চায় না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার তিন বছরের মাথায় ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব ইসরাইল যুদ্ধ বাধে। জুইস পিপলস কাউন্সিল ঐ বছরের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দিলে ১৫ মে তারিখেই মিশর, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান এবং ইরাক একযোগে ইসরাইল আক্রমণ করে। এরপর ১৯৬৭ এবং ’৭৩ সালে আরও দুটি আরব ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হলেও তা আঞ্চলিক সীমা অতিক্রম করেনি। ১৯১০ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত কোরিয়া উপদ্বীপ জাপানের শাসনাধীন ছিল। যুদ্ধের পর অঞ্চলটি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিভক্ত হয় এবং সংঘাতে জড়িয়ে পরে। ১৯৫০-র জুন থেকে ১৯৫৩-র জুলাই পর্যন্ত চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে স্পষ্ট পক্ষ অবলম্বনকারী পরাশক্তিগুলো সরাসরি যোগ দেয়নি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনামকে সহায়তা করে চীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কম্যুনিস্ট বøকের আরও কিছু দেশ; অন্যদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে সরাসরি অংশগ্রহন করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৫ সালের নভেম্বর থেকে ’৭৫-এর এপ্রিলে সায়গনের পতন পর্যন্ত প্রায় দুই দশক স্থায়ী যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট পরাশক্তিগুলো একবারের জন্যও পরস্পরের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমনের কোন ঝুঁকি নেয়নি। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত সমর্থনে কম্বোডিয়ায় ঢুকে চীন সমর্থিত খেমাররুজ সরকারের পতন ঘটায় ভিয়েতনাম। প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীন ১৯৭৯-র মার্চে ভিয়েতনাম আক্রমণ করে; অভিযানের নাম দেয় ‘পিটুনি অভিযান’। সাকলের ধারণা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েতনামের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাশক্তিগুলো পরস্পরের মুখোমুখি হলেও কৌশলে সন্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে গেছে। ’৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ইরান, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক এবং চীন পাকিস্তানকে অস্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করলেও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন করেনি। ১৯৫৬ সালে জামাল আব্দুল নাসের সুয়েজ খালকে জাতীয়করণের ঘোষণা দিলে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইসরাইল একযোগে মিশর আক্রমণ করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের চাপে শেষমেশ সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত সংঘটিত প্রত্যেকটি যুদ্ধে পরাশক্তিগুলো সংযমের পরিচয় দিয়েছে। এক পরাশক্তি কোনক্রমে জড়িয়ে পরলে অন্য পরাশক্তিগুলো নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে। এর সর্ব-সা¤প্রতিক উদাহরণ হল ক্রিমিয়া সংকট। বিশ্বে একাধিপত্যের বিপক্ষে বড় আঘাত হলেও রাশিয়ার সাথে ক্রিমিয়ার একত্রীকরণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপের কথা চিন্তা করেনি। ইরান এবং সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নমনীয় হতে হয়েছে রাশিয়ার চাপে।

পরিবর্তনের এই ধারা সূচিত হলো কেন? পেছনের রহস্যটা কী? পরাশক্তিগুলো পরস্পরকে সামরিকভাবে মোকাবিলা করতে ভয় পাচ্ছে কেন? উত্তরটা এক শব্দে দেওয়া যায়Ñ “একটা বোমা”। ২৮ জুন ১৯১৪ সারায়েভোতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিনান্ডের হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বিগত সাত দশকের বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে এর চেয়ে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে যার কোনটিই বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়নি। ১৯৬২-র মিসাইল ক্রাইসিস চলাকালে সোভিয়েত রণতরী থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিমান সাগরে ফেলে দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র একটা পাল্টা গুলিও ছোঁড়েনি। কারণ হলো, পাল্টা গুলি ছোঁড়ার অর্থ একটা সত্যিকার যুদ্ধ শুরু করা যা দ্রæতই পরমাণু যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এরকম একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ, আক্রান্ত এবং আক্রমণকারী-উভয়েরই বিলুপ্তি নিশ্চিত করবে। বিলুপ্তি বলতে আমরা কী বুঝব, নিচের হিসেবটি সে সম্পর্কে আমাদের কিছুটা ধারণা দিতে পারে।

২০১৮ সালে ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস-এর হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে পরমাণু বোমার মোট সংখ্যা ১৭,০০০, যার মধ্যে তাৎক্ষনিকভাবে ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় আছে ৪,৩০০। বাকিগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে সক্রিয় করা যাবে। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহৃত বোমার ধ্বংস ক্ষমতা ছিল কুড়ি হাজার টন টিএনটির সমান। বর্তমানে মজুত বোমাগুলোর গড় পড়তা ধ্বংস ক্ষমতা বার লাখ টন টিএনটির সমান। ক্ষমতা ৬০ গুণ হবার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে এগুলো ৬০ গুণ বেশি এলাকা ধ্বংস করবে। সাধারণ হিসেবে ধরা হয় এগুলো হিরোশিমার চেয়ে ২৫ গুন বড় শহরকে পুরোপুরি ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। তবে ধ্বংসযজ্ঞের গড় তীব্রতা হবে হিরোশিমার কমপক্ষে ৭ গুণ। অর্থাৎ লন্ডন বা নিউইয়র্ক শহরের কেন্দ্রস্থলে এ আকারের একটা বোমা নিক্ষেপ করলে সেগুলো কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সাংহাই, পিকিং, করাচি, লাগোস এবং ইস্তানবুলের মত জনবহুল ৫টি শহরের ওপর মাত্র একটা করে বোমা ছুঁড়লে মারা যাবে সর্বমোট ১০ কোটি মানুষ।

আব্দুল রহমান হামিদীর আঁকা কার্টুন…

বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি (৩৭০ কোটি) শহরে বাস করে। এর ৪০% (১৪৮ কোটি) বাস করে বড় শহরগুলোতে। সামরিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় যদি শুধু বড় শহরগুলোতেই বোমা নিক্ষেপ করা হয় তাহলে প্রায় দেড়শ কোটি মানুষ মারা যাবে যুদ্ধ শুরুর প্রথম ২৪ ঘন্টাতেই। গুরুতর আহত হবে শহরগুলোর নিকটবর্তী জনপদে বসবাসকারী আনুমানিক আরও দেড়শ কোটি মানুষ যাদের চিকিৎসা সুবিধা লাভের কোন সুযোগই প্রায় থাকবে না। তাতে আরো ৫০ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। বিমান চলাচল, টেলিফোন, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, পানীয় জল সরবরাহ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়বে। জ্বালানি তেলের মজুত ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে সড়ক, রেল ও নৌ পরিবহণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। মজুত খাদ্যের একটা বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে পৃথিবীব্যাপী প্রাথমিক খাদ্য সংকটে এক বছরের মধ্যে মারা যাবে আনুমানিক ৫০ কোটি মানুষ। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার নেমে আসবে প্রায় শূন্যের কোঠায় এবং খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবার ফলে পৃথিবীব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। ফলে পৃথিবীর জনসংখ্যা পরবর্তী এক দশক সময়ের মধ্যে অর্ধেকে (৩৫০ কোটি) নেমে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার ও শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেলেও প্রযুক্তির কিছু অংশ তখনও টিকে থাকবে যা আবার নতুন সভ্যতার সূচনা করতে পারে।
কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে। ১৭,০০০ পরমাণু বোমা থেকে যে তেজস্ক্রিয়তা পৃথিবীর উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়বে তা পৃথিবীতে প্রাণীকুলের বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য যথেষ্ট হতে পারে। এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার পরমাণু বোমার পরীক্ষামুলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে যার সবগুলোই ভূ-অভ্যন্তরে বা সমুদ্রের তলদেশে। এসব বিস্ফোরণ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা ভূপৃষ্ঠে আসতে পারেনি। হিরোশিমা, নাগাসাকি বা চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয়তা প্রশমিত হবার জন্য যথেষ্ট পরিবেশগত সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু একযোগে এই বিপুল সংখ্যক বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে ভূপৃষ্ঠে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে তা নিষ্ক্রিয় করার সামর্থ্য পৃথিবীর নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের একটা অংশের ধারণা, যে অঞ্চলে বোমা নিক্ষেপ করা হবে তেজস্ক্রিয়তা শুধু সেই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন নয়; বরং তা মেঘের আকারে বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়বে এবং অনাক্রান্ত অঞ্চল এমনকি দূরবর্তী প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ গুলোতেও পৌঁছে যাবে এবং পরবর্ত্ ী২০০ বছরের মধ্যে স্থলভাগের সকল প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শুধু টিকে থাকবে স্থলভাগের কিছু উদ্ভিদ এবং জলভাগের (বিশেষত সমুদ্রের) প্রাণী ও উদ্ভিদ। তবে বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশের ধারণা তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কোন কারণ নাই। আর ছড়িয়ে পড়লেও প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে তার প্রতিক্রিয়া অনুভূত হতে কয়েক হাজার এমনকি মিলিয়ন বছর লাগবে। ফলে সর্বাত্মক পরমাণু যুদ্ধ হয়ে যাবার পরও বেঁচে যাওয়া পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী নতুন করে সভ্যতা গড়ে তুলতে পারবে। খুব বেশি হলে হয়তো যাত্রাটা শুরু হবে এক বা আধা শতাব্দী পেছন থেকে।

তবে এরকম একটা যুদ্ধে যে ক্ষয় ক্ষতি হবে তা নিশ্চিত ভাবেই অকল্পনীয়। সেটা হতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লক্ষ গুণও। এ বিপদের কথাটি রাষ্ট্রনায়করা জানেন। তাই তারা পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি এড়ানোর সকল সম্ভাব্য পথ খুঁজছেন। ১৯৭০ সাল থেকে কার্যকর হওয়া পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি)এ পর্যন্ত স্বাক্ষর করেছে ১৯০টি দেশ। ভারত, ইসরাইল, পাকিস্তান ও দক্ষিণ সুদান এ চুক্তিতে সই করেনি। উত্তর কোরিয়া ১৯৮৫ সালে এ চুক্তির সাথে একমত হয়েও ২০০৩ সালে তা প্রত্যাহার করে নেয়। এই চুক্তির তিনটি ধাপ রয়েছে : (১) পারমানু অস্ত্র ও এই প্রযুক্তির বিস্তার রোধ (২) পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ও (৩) পরমাণু প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার। চুক্তিটি ১৯৭০ সালে যাত্রা শুরু করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দ্রæত ফল পেতে শুরু করে। নিচের সারণিটি লক্ষ করুন।
বিভিন্ন সময় দুই পরাশক্তির হাতে থাকা পরমাণু বোমার সংখ্যা
দেশ ১৯৫০ ১৯৬০ ১৯৭০ ১৯৮০ ১৯৯০ ২০০০ ২০১০ ২০১৩ ২০২২সাল নাগাদ পরিকল্পনা
যুক্তরাষ্ট্র ২৯৯ ১৮,৬৩৮ ২৬,০০৮ ২৪,১০৪ ২১,৩৯২ ১০,৫৭৭ ৮,৩৬০ ৭,৭০০ ৩,৬২০
সোভিয়েত ০৫ ১,৬০৫ ১১,৬৪৩ ৩০,০৬২ ৩৭০০০ ২১,৫০০ ১৭,০০০ ৮,৫০০ ৩,৩৫০
ইউনিয়ন/রাশিয়া

১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে যথাক্রমে ৩৯,১৯৭ ও ২্৩৬৮ টি (মোট ৬২৫৬৫ টি) পরমাণু বোমা জমা হয়, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই সংখ্যা ১৯৯০, ২০০০ এবং ২০১০ সালে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫৮,৩৯২, ৩২,০৭৭ এবং ২৫,৩৬০ টিতে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে ৭,৭০০ টিপরমাণু বোমা যা ২০২২ সাল নাগাদ তারা অর্ধেকে (৩,৬২০ টি) নামিয়ে আনবে। আর একই সময়ে রাশিয়া তার বর্তমান মজুদ অর্ধেকেরও কমে (৩,৩৫০ টি) নামিয়ে আনবে। আমরা লক্ষ করলে অবাক হব যে, যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ মজুদের (২৬,০০৮ টি) মাত্র এক তৃতীয়াংশ বর্তমানে সংরক্ষণ করছে।আর রাশিয়া সংরক্ষণ করছে তার সর্বোচ্চ মজুদের (৩৯,১৯৭ টি) চার ভাগের এক ভাগ। পরিস্থিতি দেখে মনে হয় পরিপূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণকে এক সময় যেভাবে কল্পনা বিলাস বলে উড়িয়ে দেওয়া হতো সে যুগের অবসান হতে চলেছে। ২০১১-র ফেব্রæয়ারিতে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তির নতুন অধ্যায়ে স্বাক্ষর করেছে। লক্ষ্য ২০২২-র ফেব্রæয়ারির মধ্যে পরমাণু বোমা, আন্ত মহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র এবং স্ট্রাটিজিক বোম্বারের সংখ্যা ৪৮% হ্রাস করা যাতে ২০২২ সালের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছা যায়।

তবে কাজটি যে সহজ হবে না সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। এই চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পরমাণু বোমার অকল্পনীয় ধ্বংস ক্ষমতা। কোন রাষ্ট্রের যদি একটা মাত্র পরমাণু বোমা থাকে এবং অন্যদের যদি একটিও না থাকে তাহলে তা-ই বিশাল পার্থক্য তৈরি করবে। এটা একটা নিরাপত্তা ইস্যু। কোন রাষ্ট্র-ই অস্তিত্তে¡র সংকটে পড়তে রাজি থাকবে না। নিজের বোমা ধ্বংস করার আগে সবাই নিশ্চিত হতে চেষ্টা করবে যে অন্যদের হাতও শূন্য। তবে একথাও ঠিক, যতদিন পর্যন্ত পরাশক্তিগুলোর হাতে এই মারণাস্ত্রটি আছে, ধরে নেওয়া যায় ততদিন আমাদের এই গ্রহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি মুক্ত থাকবে। পরমাণু বোমার শক্তি এতো বেশি যে সে নিজেই তার নামে যুদ্ধও ঠেকিয়ে রাখতে পারছে। আব্দুল রহমান হামিদীর আঁকা কার্টুনটিতে দেখানো হচ্ছে ইউএসএ এবং রাশিয়া নিরাপদ দূরত্বে থেকে একটা গ্রেনেডের পিন খুলতে চেষ্টা করছে যাতে তাদের ক্ষতি না হয়। এবং তারা এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করেছে যেখানে সুতা ছিঁড়ে গেলে গ্রেনেডটা গর্তে পড়ে যায়।
একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক — ধরুন আপনি আর আমি পরম শত্রæ (আসলে কিন্তু নই! সেরকম হলে আপনি তো এই লেখাটা পড়তেন না।)। আমরা পরস্পরকে হত্যা করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছি। একটা ১০ তলা ভবনের ছোট কক্ষে আপনি আর আমি ঘটনাক্রমে হাজির হয়েছি। আমার এবং আপনার হাতে একটা করে বোমা আছে যা বিস্ফোরিত হলে পুরো বিল্ডিং নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি কি আপনাকে মারার জন্য বোমাটি ফাটিয়ে দেব? না। তাতে আমিও মরে যাবো। ভেবে দেখুন আপনিও কিন্তু তা-ই করবেন। আমরা বরং হাসিমুখে করমর্দন করতে এগিয়ে যাবো যাতে আমাদের কেউ বোমা ফাটিয়ে না দেই। পরাশক্তিগুলো সেটাই করছে এবং আশা করা ভুল হবে না তারা সেটা করতে থাকবে— ‘ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়’। তবে পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডার কোনদিন খালি হয়ে গেলে বহুল আলোচিত এই যুদ্ধটি আলোর মুখ দেখতে পারে।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।